–তাতো জানিনে দাদা, সেরকম কিছুতো দেখিনি! দাদা, তোমায় ও ভুল বুঝেছে। আমি কালই ওকে বুঝিয়ে দেবো।
-না! তপনের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দৃঢ়-না শিখা, তাহলে তোকে আর ভগ্নীস্নেহ দিতে পারবো না। সে আমায় ভালো যদি বাসে, এমনিই বাসবে, কারো প্ররোচনায় নয়। আমি যেমন, যেমনটি সে আমায় দেখেছে, তেমনি ভাবেই আমি তার হৃদয় জয় করতে চাই। যদি না পারি, জানবো সে আমার নয়।
কয়েক মিনিট নীরবে কাটিয়া গেল। তপন পুনরায় আরম্ভ করিল—আমি তো আধুনিক কোনককেট মেয়েকে বিয়ে করতে আসিনি শিখা, আমি ভেবেছিলুম বিয়েকরছিস্বর্গীয় মহাত্মা শ্যামসুন্দর চ্যাটুজ্যের নানীকে।যুক্তকর ললাটে ঠেকাইয়াতপন সেই স্বর্গীয় মহাত্মারউদ্দেশে নতি জানাইল। তারপর বলিল,–আর শুনলাম, আমার বাবা নাকি মিঃ চ্যাটার্জিকে কথা দিয়েছিলেন, তাই পিতৃসত্য পালন আর বিপন্ন মিঃচ্যাটার্জিকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম আর ভেবেছিলাম, আমার অনন্ত জীবনের সাথীকে হয়ত ঐ বাড়ীতেই খুঁজে পাবো।
ব্যথায় বেদনায় তপনের কণ্ঠ মলিন শুনাইতেছে। শিখা অভিভূতের মতো তপনের দিকে চাহিয়া রহিল, চোখ তাহার জলে ঝাপসা হইয়া আসিতেছে। এই অপরূপ সুন্দর হৃদয়বান মানুষটিকে তপতী গ্রহণ করে নাই—আশ্চর্য!
-তুমি আমায় অনুমতি করো দাদা, আমি কালই তোমার সাথীকে এনে দেবব—সে তোমায় চেনেনি!
-না, শিখা তা হয় না। আমার স্বরূপ উদঘাটিত করে তার ভালোবাসা পাওয়া এখন আর আমার আকাঙক্ষার বস্তু নয়। আমি জানি প্রত্যেক মেয়েই চায়, তার স্বামী রূপবান, জ্ঞানবান, ধনবান হোক, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যদি তা কারো না হয়, তবে সে কি এমন করে স্বামীর অন্তর চূর্ণ করে দেবে? হিন্দু নারী সে, পবিত্র বৈদিক-মন্ত্রে তার বিয়ে হয়েছে যে বিয়ের জের জন্ম হতে জন্মান্তরে চলে বলেইনা শাস্ত্রের বিশ্বাস—সেই ধর্মের মেয়ে হয়ে সে স্বামীকে একটা সুযোগ পর্যন্ত দিল না নিজেকে প্রকাশ করবার! আমি বুঝেছি শিখা, এই অহঙ্কারের মূলে দুটো জিনিস থাকতে পারে। এক, সে অন্য কাউকে ভালোবেসে, যাকে পেল না বলে গভীর ক্ষুব্ধ হয়েছে; নয় ত, সে আজো অন্যাসক্তা, পবিত্র আছে, কাউকেই ভালোবাসে না। যদি শেষের কারণ সত্যি হয়, তবে আমি তাকে এমনি থেকেই ফিরে পাব, আর যদি প্রথম কারণটা সত্যি হয়, তাহলে সে আমায় হাজার ভালোবাসলেও আমি তাকে গ্রহণ করবো না। আমার জীবনে অন্যাক্তা নারীর ঠাঁই নেই।
শিখা শিহরিয়া উঠিল। তপতী এ কি করিয়া বসিয়াছে। যে অদ্ভুত চরিত্রবান স্বামী সে লাভ করিয়াছে, তাহাতে তপতীকে অন্যাক্তা ভাবিয়া ত্যাগ করা তপনের পক্ষে কিছুই বিচিত্র নহে।…গভীর স্তব্ধতার মধ্যে শিখা ভাবিতে লাগিল।
-বোনটি, আমার মায়ের পেটের বোনের সঙ্গে তোের আজ কিছু তফাৎ নেই। আমার কথা রাখবি তো?
–নিশ্চয় দাদা, তোমার কথার অবাধ্য হবো যেদিন সেদিন তোমায় দাদা বলবার মোগ্যতা হারাবো যে।
তপতীর পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে। আজ সে আসিয়া বসিবে বন্ধুদের আসরে। উপরে প্রসাধনে সে ব্যস্ত। বন্ধুগণ আসরটা জমাইয়া তুলিতেছেন।
রেবা দেবী বলিলেন,–এবার কিন্তু তপতী বরের সঙ্গে মিশবার বিস্তর সময় পাবে বুঝেছে, এতকাল তো বৃথাই কাটালে সব। এখনো সে দেখেনি, কিন্তু একবার দেখলে আর রক্ষে নাই।
সমস্বরে ব্যানার্জি-চ্যাটার্জি-ঘোষ প্রশ্ন করিলেন কেন?
—কারণ ছেলেটা যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি সুন্দর কথা; তপতী আবার কাব্যপ্রিয়, ওর একটা কথাতেই মুগ্ধ হয়ে যাবে।
–বলো কী! সে তো একটা বোকারাম, মূর্খ।
—মোটই না! আমি মাত্র একদিন গিয়েছিলাম তার কাছে। আমায় দেখে কি বল্পে জানোত।
—কি বল্লে!
-বল্লে, আসুন। আপনি কোন্ দেশীয়া? নমস্কার না করমর্দন করবো! আমি বল্লাম একদম স্বদেশী,নাম শ্রীমতী রেবা দেবী! তা বম্নে কি জাননা? বম্নে রেবা তো উপল-বিষমে বিশীর্ণা। কিন্তু আপনি তো দেখছি শীর্ণা নন!
—উত্তরে তুমি কি বল্লে?–মিঃ ব্যানার্জি প্রশ্ন করিলেন।
–বল্লাম, আমি মোটা হলে তো কিছু যায় আসে না, তপতী খুব স্লিম্।
—ও কথা তুমি বলতে গেলে কেন? তপতীর রূপ ওর না দেখাই তো দরকার।
—শোনই-না কথাটা। তপতী স্লিম শুনে বলে, বড্ড খুসী হলাম শুনে; ওর তন্বী দেহ তরবারী দিয়ে অনেককে জবাই করতে পারবে, কি বলেন? আমি তো অবাক! বম, হাঁ আমাদেরগুলো একদম ভোঁতা।
—তাতে কি বল্পেঃ মিঃ ব্যানার্জি শুধাইলেন।
-বল্লে, শান দিয়ে নিন। এত রুপাউডার লিপষ্টিক রয়েছে কি জন্যে। শুনে আমি চুপ করে গেলুম। ও মুখ ফিরিয়ে হরু-ঠাকুরের পাঁচালী পড়তে লাগলো। পরদিন তপতীর মা বারণ করলেন ওখানে যেতে। নইলে ওর জবাব আমি দিতাম।
–বারণ করলেন কেন?
—তা জানি না, বোধহয়, ও বিরক্ত হয়।
–বিরক্ত নয়, ভয় করে, ওর বিদ্যে প্রকাশ হয়ে পড়বে।
–ওর বিদ্যে প্রকাশ হলে তোমাদের বিশেষ সুবিধে হবে না। কারণ ও সত্যি বিদ্বান—তোমাদের মতো শ্যালো নয়।
ইতিমধ্যে মিঃ অধিকারী আসিয়া পৌঁছিলেন। এই মিঃ অধিকারীকে এখন আর ইহারা সুনজরে দেখিতেছেন না। কারণ তপতী তাহার কাছ হইতে আংটি লইয়াছে। অধিকারীই তাহা হইলে তপতীর মন আকর্ষণ করিয়াছে সর্বাপেক্ষা অধিক।
রেবা তাহাকে দেখিয়া বলিল,–আসুন—মিঃ অধিকারী এবার আমাদের মেঘদূতের আপনিই তো যক্ষ!
মিঃ অধিকারী আত্মপ্রসাদের হাস্য করিলেন। ওদিকে তিন-চারটি যুবক তাহার দিকে জনান্তিকে ক্রুদ্ধ ত্রুর কটাক্ষপাত করিতেছে। বিনয়ের সহিত অধিকারী কহিলেন,–বেশ, আমি সম্মত।