জাস্টিশ মুখার্জি অত্যন্ত নিরীহ এবং গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাহার গাম্ভীর্য টুটাইয়া তিনি কহিলেন,—শঙ্কর বলছিল যে জামাই তাঁর খুব ভালো হয়েছে, তা এতো ভালো হয়েছে
কে জানতো! খুব ভালো ছেলে!
-তোমার খুব ভালো লেগেছে,–নয় বাবা? এত কথা বলে ফেল্লে যে!শিখা কৌতুক হাস্যে চাহিল তার বাবার পানে।
শিখার মা দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলেন, বলিলেন,–তোমার আর একটা জোড় নেই বাবা? দুটোকেই বাঁধতুম!
শিখা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল,—ওকি গরু নাকি মা, বাঁধতে চাইছো?
–তোর বন্ধু সেদিন স্যার রমেনের বাড়ীর পার্টিতে বলছিল, তার বর নাকি হয়েছে একটা গরু। তাই তোর জন্যেও একটা এমনি গরু আমরা খুঁজছি।
-না মা, গরুটরু বলো না, আমার দাদা যে ও। শিখা মৃদু হাসিয়া বলিল।
–নিশ্চয় আপনি বলবেন কাকীমা। আমার মা আমার শেষ দিন পর্যন্ত গরু আর গাধা বলতেন। তারপর থেকে আর কেউ বলেনি। আপনি বলুন তো, আপনার কণ্ঠে আমার মার কণ্ঠস্বর শুনে নিই আর একবার!–তপনের দুটি চক্ষু ছল ছল করিয়া উঠিল। শিখার মাতা বিহ্বল হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, তুমি যদি গরু হও বাবা, তাহলে মানুষ কে, তাই ভাবছি। কিন্তু বাবা, অফিস থেকে আসছো তো? এসো, হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে গল্প করবেখন।
খাইতে বসিয়া তপন বলিল,–শিখার বিয়ে দিতে চান কাকীমা! আপনার কিছু ঠিক করা নেই তো?
–না বাবা, ঠিক কিছু নেই। মেয়েকে আর বড় করতে ভরসা করিনে বাবা; চারিদিকে দেখছো তো, ধিঙ্গি মেয়েরা সব মোটরে চড়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে। বয়স বাড়ছে বিয়ে হচ্ছে না। সমাজে কত মেয়ে যে আইবুড়ো রয়েছে তার ঠিক নেই।
—আপনাদের সমাজের তো এই রকমই গতি কাকীমা। কিন্তু সমাজের উপর আপনি চটলেন কেন?
–না বাবা, আমাদের সেকানের সমাজই ভালো ছিল। বিয়ে করবে না, ধিঙ্গিপনা কবে বেড়াবে, তারপর বয়েস বাড়লে আর বিয়েই হবে না। এই তো হচ্ছে আকছার।
–আশায় আশায় থাকে কাকীমা, মনে করে, আরো ভালো বর জুটবে, তারপর আরো ভালো, এমনি করেই বয়েস বেড়ে যায়। আর আমাদের সমাজের মতো আপনারা তো কচি মেয়ের জোর করে বিয়ে দেন না; জোর করে বিয়ে দেবার অবশ্য আমিও পক্ষপাতী নই, তবে যোল থেকে কুড়ি একুশের মধ্যেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত।
শিখা এতক্ষণ নতমুখে তপনের চা তৈরী করিতেছিল, বাগ পাইয়া বলিয়া উঠিল,–ওপির বয়স এখনো কুড়িও পেরোনি, অতএব মাভৈঃ দাদা!
–তুই থাম—গুরুজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাগড়া দিস নে!
শিখা অনাবিল আনন্দে তপনের মুখের দিকে চাইল। শিখার দাদার অধিকারটি তপন অতি সহজে গ্রহণ করিয়াছে। এমন করিয়া কেহ কোনদিন তাহাকে ধমক দেয় নাই, এমন মিষ্ট, এমন আন্তরিকতাপূর্ণ। হাসি মুখে সে চা আগাইয়া দিয়া বলিল,–আচ্ছা, গুরুজনদের সঙ্গে কথা শেষ হলে ডেকো আমায়।
শিখা চলিয়া যাইতেছে, মা বলিলেন,—যাচ্ছিস কেন?
শিখা দুই পা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ভাবছো কৈন মা? ও তোমার আধুনিক যুগের চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি, মুখার্জি, ঘোষ, বোস, মিত্তির নয়। শিখা না থাকলেও ওর চলবে, বরং ভালোই চলবে। আমি কিছু বেল ফুল তুলে নিয়ে আসি।
শিখা চলিয়া গেল। তপন মধুর হাসিয়া বলিল,কাকীমা, এই আধাবিলেতি সহরের বুকের ওপর মেয়েকে আপনারা কি করে এমন শুদ্ধাচারিণী রেখেছেন?
-আমি ওকে খুব কড়া নজরে রাখি বাবা। চারিদিকে তো দেখছি। আমি ছিলুম ভটচাজ্যি বামুনের মেয়ে, একেবারে সনাতনপন্থী; এখানকার সব দেখে মনে হয় ভালো আমাদের সমাজে অনেকেই ছিল, মন্দ যে না ছিল তা নয়, কিন্তু মন্দটা বেছে না ফেলে আমরা ভালোমন্দ সবই বিসর্জন দিয়েছি অথচ যাদের অনুকরণ করতে চাইছি, তাদের ভালোগুলো ছেড়ে মন্দগুলোই নিচ্ছি।
তপন হাসিমুখে শুনছিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল,–আমি দেখেই বুঝেছিলাম কাকীমা, আপনার সতী-শশাণিত ওর প্রতি শিরায় বইছে। আচ্ছা কাকীমা আপনি আমার উপর নির্ভর যদি করেন তো ওর যোগ্য এবং আপনার মনের মতো ছেলে আমি ওর জন্যে এনে দেবো। কিন্তু আমি যে আপনার বাড়ী এসেছি বা মাঝে মাঝে আসবো একথা যেন কোনরূপে আমার শ্বশুরবাড়ীতে প্রকাশ না পায়। কারণ শিখার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক হওয়া উচিত বলে ওঁরা মনে করেছেন, শিখা তার থেকে আমার ঢের বেশী আপনার।
-তুমি ওঁদের বলে আসনি বুঝি।
-না,–এবং কোনদিন বলে আসবোনা। কারণ ওদের জামাই সম্পর্কে তো আর আমি আপনার বাড়ীতে আসছি না, আসছি আপন বোনটিকে দেখতে। আমি কায়-মন এক করে কথা বলি কাকীমা, শিখার সঙ্গে আমার সহোদর বোনের আর কিছু তফাৎ নাই। আমি তো আজকালকার দা জাতীয় জীবনই—যাকে তাকে আমি দাদা বলতে অনুমতি দিই না।
-বেশ বাবা, তুমি শিখার দাদা, এ তার গৌরব। তোমার কটি ভাই-বোন?
—আমার কেউ নেই কাকীমা, একটা খুড়তুতো বোন আছে। এই সারা বিশ্ব-সংসারে আজ সকাল পর্যন্ত সেই একমাত্র মেয়ে ছিল যার সঙ্গে আমি যখন তখন কথা বলি, দুষ্টুমি করি। আজ থেকে হলো আমার দুটি বোন শিখা আর সে!
শিখা আসিয়া পড়িল একটা রূপার রেকাবিতে কতকগুলি ফুটন্ত বেল ফুল লইয়া। বলিল,–পা দুটি বাড়াও তো! তোমার পায়ে শ্বেতপুষ্প ছাড়া আর কিছুই দেওয়া যায় না।
মা বলিলেন,–তোমরা গল্প করে বাবা, আমি ঘরের কাজ দেখি। তিনি চলিয়া গেলেন। তপন বলিল,লক্ষ্মী বোনটি একটা কথা তোকে জিজ্ঞাসা করবো, সত্যি উত্তর দিস।
–তোমার কাছে মিথ্যে বলব না দাদা, যদিও মিথ্যে অনেক সময়ই বলি আমি। তপন তাহার বিবাহ হওয়ার পর হইতে এই দুই মাসের ঘটনা শিখাকে বলিয়া গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করিল,—ওর মতবল কি শিখা, ও কি কাউকে ভালোবাসে?