- বইয়ের নামঃ চিতা বহ্নিমান
- লেখকের নামঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ বুকস্ ফেয়ার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. তপতী বড় হইয়া উঠিল
মেয়েদের বিবাহের বয়স সম্বন্ধে আধুনিক যুগে অবশ্য কোন বাঁধাধরা নিয়ম নাই, তথাপি একমাত্র কন্যার বিবাহটা একটু শীঘ্রই দিবার ইচ্ছা মিঃ শঙ্কর চ্যাটার্জির। সম্বন্ধও পাকা এবং দিনও স্থির হইয়া গিয়াছে। বাকি শুধু বিবাহটার।
তপতী এবার বি-এ পরীক্ষা দিবে, তাহারই জন্য ব্যস্ত সে। বিবাহের নামে বাঙালী মেয়েরা যেরূপ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে তপতীর তাহা কিছুই হয় নাই। কেন হয় নাই, জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিবে—বাপ-মার হাতের দেওয়া অনিবার্য শাক্তি যখন লইতেই হইবে, তখন ভাবিয়া লাভ কি! বিয়েটা হইয়া গেলেই আনন্দ-বা-নিরানন্দ যাহোক একটা করা যাইবে। এখন পরীক্ষার পড়াটা করা যাক।
কিন্তু ইহাতে ভাবিবার কিছুই নাই। তপতীর জন্য ভদ্রবংশের জনৈক শিক্ষিত এবং সুন্দর যুবক প্রস্তুত হইতেছেন। আর তপতী তাহাকে দেখিয়াছেও। বিবাহের পর যুবকটিকে বিলাত পাঠানো হইবে পূর্তবিদ্যা শিখিবার জন্য, ইহাই মিষ্টার এবং মিসেস চ্যাটার্জির ইচ্ছা।
এই তপতী—শিক্ষিতা, আধুনিকা এবং প্রগতিবাদিনী। উহাকে লাভ করিবার জন্য সোসাইটির কোন্ যুবক না সচেষ্ট। দিনের পর দিন তপতীকে ঘিরিয়া তাহারা গুঞ্জন তুলিয়াছে, গান করিয়াছে, গবেষণা করিয়াছে তপতীর ভবিষ্যৎ লইয়া। হ্যাঁ, তপতী অনিন্দ্যা, অনবদ্যাঙ্গী, অসাধারণীয়া। কিন্তু এহেন তপতীকে লাভ করিবে মাত্র একজন, ইহা সহ্য করা অপরের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু উপায় কি, ধনী পিতা তাহার, যাহাকে উপযুক্ত মনে করিবেন, তাহারই হাতে কন্যা দান করিবেন। অপরের হাতে কি বলিবার থাকিতে পারে।
মিঃ চ্যাটার্জির তপতী-নিবাস নামক নবনির্মিত বিশাল প্রাসাদে মহাসমারোহে বিবাহোদ্যোগ চলিতেছে। বর এখনো আসিয়া পৌঁছায় নাই, কিন্তু বরযাত্রীগণ প্রায় অনেকেই আসিয়াছে এবং খাইতেছেন। রাত্রি প্রায় দশটা, অতি মলিন বেশ ছেড়া একটা কামিজ গায়ে মাথার চুল সম্পূর্ণভাবে মুণ্ডিত একটি যুবক আসিয়া মিঃ চ্যাটার্জির সহিত দেখা করিতে চাহিল। বিবাহ সভায় এরূপ অতিথি কেই বা পছন্দ করে। কিন্তু যুবক দেখা করিবেই।
মিঃ চ্যাটার্জি কন্যা সম্প্রদানের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন, তথাপি যুবকের সহিত সাক্ষাৎ করিতে নিজেই খাসকামরায় নামিয়া আসিলেন।
একখানি জীর্ণ দলিল বাহির করিয়া যুবক বলিল,আমার বাবার বাক্সে এই দলিলখানি পেয়েছি, এটা আপনার—আর সম্ভবত দরকারী। দয়া করে গ্রহণ করুন।মিঃ চ্যাটার্জি বিস্মিত হইয়া বলিলেন;—তুমি মহাদেবের ছেলে? এত বড়ো হয়েছ! বসো বাবা, আজ আমার মেয়ের বিয়ে, এখানেই খেয়ে যাবে।
—আমার কিন্তু অন্যত্র কাজ ছিল! যুবক সবিনয়ে জানাইল।
–তা থাক, কাজ অন্যদিন করবে, বসো।
মিঃ চ্যাটার্জি দলিলখানি গ্রহণ করিলেন। সত্যই দরকারী দলিল। যুবককে আর একবার বাসিতে অনুরোধ করিয়া তিনি ভেতরে গেলেন।
বর আসিয়াছে এবং বরের পিতা তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। মিঃ চ্যাটার্জি আসিতেই তিনি বলিলেন,–
-পণ-এর টাকাটা আমায় দিন, তারপর ছেলে আপনার, যা-খুসি করবেন তাকে নিয়ে।
–হ্যাঁ, বেয়াই-মশাই, কাল পরশুই আপনার টাকাটা দিয়ে দেবো।
-কেন? আজই দিয়ে ফেলুন না! ছেলেতো আমি বেচেই দিচ্ছি। নগদ কারবারই ভালো।
—এ রকম কথা কেন বলছেন বেয়াই-মশাই। মিঃ চ্যাটার্জি অত্যন্ত আহত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন।
-বলছি যে আমায় যে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবার কথা সেটা দিয়ে ছেলেকে আপনার নিজস্ব করে নিন, আমি নগদ কারবারই ভালবাসি।
-কিন্তু আজই তো দেবার কথা নয়। আর এই রাত্রে অত টাকা কি করে দেওয়া যাবে বলুন! নগদ টাকাটা কাল নিলে কি ক্ষতি হবে আপনার।
-ওসব চলবে না চাটুজ্যেমশাই, টাকা না পেলে আমি পাত্র উঠিয়ে নিয়ে যাবে।
—উঠিয়ে নিয়ে যাবেন?
বিরাট বিবাহ সভা স্তম্ভিত হইয়া গেল। সভ্য, শিক্ষিত সমাজে এরূপ একটা কাণ্ড ঘটিতে পারে, কেহ কল্পনাও করে নাই। মিঃ চ্যাটার্জি রুদ্ধ-রোষ দমন করিয়া বলিলেন—আচ্ছা, যান উঠিয়ে নিয়ে, টাকা দেবো না।
-হেমেন—চলে এসো–বলিয়া বরকর্তা ডাক দিলেন। বর তৎক্ষণাৎ সুড়সুড় করিয়া উঠিয়া আসিল। বরকর্তা মিঃ চ্যাটার্জিকে উদ্দেশ করিয়া বলিতে লাগিলেন—ফাঁকি দিয়ে বিয়েটি সেরে নিয়ে কাল উনি আমায় কলা দেখাবেন। ওসব চলবেনা,চাটুজ্যেমশাই, আমার পণ-এর টাকাটা ফেলে দিয়ে মেয়ে জামাই নিয়ে যা ইচ্ছে করুন! আপনি তো ধনী, টাকাটা না-দেবার কি কারণ থাকতে পারে?
–টাকা দেবো না! মিঃ চ্যাটার্জি সরোষে বলিয়া উঠিলেন।
–আচ্ছা, তাহলে–হেমেন, চলে এসো!
বর ও বরকর্তা উঠিয়া গেলেন। সভাস্থ সকলে আঃ কি করেন ঘোষাল মশাই, বসুন, বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু মিঃ চ্যাটার্জি দারোয়ানকে ডাকিয়া বলিলেন,–ওঁরা বেরিয়ে গেছে? বেশ, গেট বন্ধ করে দাও আর যেন না ঢোকেন।
সকলে অবাক হইয়া গেল। মিঃ চ্যাটার্জি খাসকামরায় আসিয়া ডাকিলেন—তোমার বিয়ে এখনো হয়নি তো বাবা?
—আজ্ঞে না। কেন?
-এসো তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা ছিল, তোমাকে আমার জামাই করবো। এতদিন ভুলে ছিলুম, তাই ঈশ্বর আজ ঠিক দিনটিতে তোমায় পাঠিয়েছেন। এসো বাবা।
-আমি? আমি কি আপনার মেয়ের যোগ্য?
–নিশ্চয়! তুমিই তার যোগ্য।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অসামান্যা সোসাইটি গার্ল তপতী চ্যাটার্জির সহিত এক নিতান্ত দীনহীন ব্রাহ্মণ যুবকের বিবাহ হইয়া গেল।