শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।
মালতী বলল, আমাকে য্যাখন বলতে চাইছ না, বলো নি। শোনো, আমার রান্না হয়ে গ্যাছে। পরোটা, ছোলার ডাল আর মাংস। খাবার টেবিলে সব গুছিয়ে রাখা আছে। য্যাখন খাবে গরম করে নিও। বাবাকে খই-দুধ খাইয়ে দিয়েছি। এবার বাড়ি ফিরব। আমার সনগে নীচে চলো। বাইরের দোরটা বন্ধ করে দেবে।
অন্যদিনের মতো একটা কানা-উঁচু স্টেনলেস স্টিলের বড় থালায় মালতীর খাবার গুছিয়ে রাখা ছিল। সেটা গামছা দিয়ে বাঁধা। থালাটা নিয়ে চলে গেল সে। আর শিঞ্জিনী রাস্তার দিকের দরজায় খিল দিয়ে ফের ওপরে উঠে সোজা নিজের পড়ার টেবলে গিয়ে বসল।
আগস্টে প্রি-টেস্ট। নভেম্বরের শেষে টেস্ট। পরের বছর মার্চের গোড়ায় ফাইনাল। পর পর এতগুলো পরীক্ষা। পড়ায় মন না দিলে রেজাল্ট ভালো করা যাবে না। একরকম জোর করেই মা আর সেই লোকটার চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল শিঞ্জিনী। তারপর আর কোনওদিকে খেয়াল নেই।
সেই ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় থেকেই নিজের জীবনের একটা লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিল শিঞ্জিনী। আজকাল মেয়েরা চোখ-ধাঁধানো কেরিয়ারের দিকে ঝুঁকছে। কেউ হচ্ছে ডাক্তার। কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কেউ চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। কেউ আর্কিটেক্ট। কেউ আই এ এস। কেউ বা যাচ্ছে ফরেন সারভিসে। কিন্তু শিঞ্জিনীর ইচ্ছা, নামকরা কোনও কলেজে পড়াবে। এই স্বপ্নটা কীভাবে তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, কে জানে। কিন্তু মুখের কথায় তত কলেজের চাকরি হয় না। সে জন্য ইউনিভার্সিটির সবগুলো পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করা চাই। শিঞ্জিনী লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভালো। মেধাবী। কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটলে তার ইচ্ছাপূরণ না হওয়ার কারণ নেই।
কখন যেন একসময় নীচে কলিংবেল বেজে ওঠে। চমকে বই থেকে মুখ তোলে শিঞ্জিনী। মা বোধ হয় ফিরে এল। নিজের অজান্তে, স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে তার চোখ টেবল ক্লকের দিকে চলে যায়। নটা বেজে আটত্রিশ।
চেয়ার থেকে উঠে নীচে নেমে এল শিঞ্জিনী। এ সময় মা ছাড়া আর কারও আসার সম্ভাবনা নেই। তবু নিশ্চিত হবার জন্য আই-হোলে চোখ রেখে নিল সে। হ্যাঁ, মা-ই। দরজা খুলতেই মৃদুলা ভেতরে ঢুকে পড়ে। একটু কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলে, আজও ফিরতে দেরি হয়ে গেল। এত কাজের প্রেশার
শিঞ্জনী উত্তর দিল না।
দরজার ভেতর দিকে এক জোড়া কড়া লাগানো আছে। পাশের কুলুঙ্গিতে তালা চাবি থাকে। মৃদুলা সেগুলো বার করে দরজায় খিল দিয়ে, কড়ায় তালা লাগিয়ে চাবিটা জায়গামতো রেখে দিল। শুধু গ্রিলের ওপর তারা ভরসা করে না। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য তাই ভেতর থেকে তালার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে শিঞ্জিনী লক্ষ্য করল, মায়ের পরনে মেরুন রঙের দামি সিল্ক। পায়ে নতুন ডিজাইনের বাহারি স্ট্র্যাপ লাগানো জুতো। প্লাক করা ভুরু। মুখটা তেলতেলে, মসৃণ। খুব সম্ভব হালকা করে স্নো মেখেছে। মুখ ডিম্বাকৃতি। নখ ম্যানিকিওর করা। কাঁধ পর্যন্ত শ্যাম্পু করা ফাপানো চুল। কপালে মেরুন রঙের টিপ। তার শাড়ি-টাড়ি থেকে মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল।
মৃদুলার বয়স একচল্লিশ। কিন্তু বত্রিশ-তেত্রিশের বেশি মনে হয় না। মেদহীন, ঝকঝকে চেহারা। বাদামি, নিভাজ ত্বক। তার মধ্যে কোথায় যেন একটা লুকনো চুম্বক রয়েছে। যার আকর্ষণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা খুব কম পুরুষেরই আছে। মৃদুলার যে একটি বড় মেয়ে আছে, এবং সে আসছে বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে, ভাবাই যায় না। ইন্দ্রনাথের দুশ্চিন্তা অকারণে নয়।
আগে সাজগোজের দিকে মৃদুলার লক্ষ্য ছিল না। সাধারণ সিনথেটিক শাড়িতে যাতায়াতের সুবিধা। তাই পরত সে। চুলে দ্রুত বারকয়েক চিরুনি চালিয়ে নিত। দুই ভুরুর মাঝখানে ছোট একটি টিপ, সামান্য পাউডার বা স্নো, হাতে একটা চৌকো ঘড়ি। ব্যস, এটুকুই। কিন্তু ইদানীং সাজের মাত্রটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। শিঞ্জিনীর অনভ্যস্ত চোখে কেমন যেন খোঁচা দেয়।
ছেলেবেলা থেকেই শিঞ্জিনী দেখে এসেছে, মা সুন্দরী, বয়সও তেমন কিছু নয়, তবু তার ছিল প্রবল ব্যক্তিত্ব। নিজের চারপাশে সারি সারি অনেকগুলো কাঁচের দেওয়াল তুলে রেখেছিল মৃদুলা। সে সব ভেদ করে তার খুব কাছে ঘেঁষার সাহস কারও হয়নি। তার সেই মা কি বদলে গেছে?
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চোরা চোখে মৃদুলার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল শিঞ্জিনী। সারাদিন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে একটানা কাজ, তারপর ওভারটাইম। এত পরিশ্রমের নিট ফল কী? ক্লান্তি, অবসাদ, দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসা। কিন্তু মায়ের চেহারায় তার চিহ্নমাত্র নেই। চুল পরিপাটি আঁচড়ানো। শাড়ির ভঁজে এতটুকু হেরফের হয়নি। ঘামে নষ্ট হয়ে যায়নি স্নো-পাউডারের প্রলেপ। বরং এত রাতেও তার চোখেমুখে আশ্চর্য তরতাজা ভাব। মনে গোপন আনন্দ থাকলে তার দ্যুতি বাইরে বেরিয়ে আসে। তেমনই কিছু একটা মায়ের সর্বাঙ্গে মাখানো।
মৃদুলা বলল, তুই খেয়ে নিয়েছিস তো?
শিঞ্জিনী বলে, না! তুমি না ফিরলে আমি কখনও খাই?
কতদিন বলেছি, আমার জন্যে ওয়েট করবি না। নটা পর্যন্ত দেখে খেয়ে নিবি।
একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না।
সামান্য বিরক্ত হল মৃদুলা, এর কোনও মানে হয়।
শিঞ্জিনী চুপ করে থাকে।
মৃদুলা বলে, ধর, অফিসের কাজে বা অন্য কোনও কারণে কদিনের জন্যে আমাকে বাইরে যেতে হল। তখন কী করবি? খাবি না?