ইন্দ্রনাথ বললেন, সে তুমি বুঝবে না। শরীরের যা হাল, কবে আছি কবে নেই। যেদিন থাকব না সেদিন তোমাদের যে কী হবে, ভাবতেও সাহস হয় না। মানুষ আর মানুষ নেই। শকুন, শেয়াল কি নেকড়ে হয়ে গেছে।
দাদু বাড়ি থেকে বেরুতে পারেন না। কেউ সাহায্য না করলে বিছানা থেকে নামার শক্তিও নেই। প্রায় পঙ্গু, শীর্ণ, রোগকাতর। কিন্তু মাথাটা এখনও পরিষ্কার। ভাবনাচিন্তার মধ্যে এতটুকু জড়তা নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি টের পান, কলকাতার মানুষ অনেক বদলে গেছে। রাস্তাঘাটে মেয়েরা আর ততটা নিরাপদ নয়।
ইন্দ্রনাথের ধারণা সবটাই যে অমূলক তা নয়। বাইরে বেরুলে শিঞ্জিনী টের পায় মানুষ কতটা নোংরা হয়ে গেছে।
হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল হতে অদ্ভুত এক ভয় ঠান্ডা স্রোতের মতো শিঞ্জিনীর শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার।
এই তো আর কিছুক্ষণ বাদে রাতের খাবার তৈরি করে দিয়ে মালতী চলে যাবে। মা কখন ফিরবে ঠিক নেই। ইন্দ্রনাথের আচমকা যদি কিছু হয়ে যায়, মালতী তত আর তাকে বসে বসে পাহারা দেবে না। মা না ফেরা পর্যন্ত শিঞ্জিনীকে এত বড় বাড়িতে একা একা থাকতে হবে। শকুনের পাল কি তা লক্ষ্য করবে না? কৈশোর-পেরুনো একটি মেয়ের পক্ষে তাদের ঠেকানো কি সম্ভব? মা-ও যদি থাকে, হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কতটা যুঝতে পারবে?
যতই রোগাভোগা হোক, শরীর যতই জীর্ণ হয়ে যাক, তবু একজন পুরুষমানুষ তো! দাদু যেন মাথার ওপর মস্ত এক দোয়া, সব ঝড়ঝাঁপটা থেকে আগলে আগলে রাখছেন। তিনি মারা যাবেন, ভাবতেও পারে না শিঞ্জিনী।
ইন্দ্রনাথ বললেন, দেরি করে ফেরা নিয়ে মায়ের সঙ্গে তোমার কোনও কথা হয়েছে?
শিঞ্জিনী বলল, আমি নিজে থেকে কিছু জিগ্যেস করিনি। মা তোমাকে যা বলেছে, আমাকেও ঠিক তাই বলেছে।
মায়ের জবাবদিহিতে ইন্দ্রনাথ যে সন্তুষ্ট নন, তার মনে যে সংশয়ের কুয়াশা জমেছে তা টের পাওয়া যাচ্ছিল।
ইন্দ্রনাথ বললেন, আমি খুকুর অফিসে ফোন করে জেনে নিতে পারতাম কবে কঘণ্টা সে ওভারটাইম খেটেছে। কিন্তু এখনও ফোনটা করিনি। কেন জানো?
নিজের অজান্তেই যেন শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, কেন?
ভয়ে।
কীসের ভয়?
হয় ওর অফিস থেকে এমন খবর দেবে, যাতে আমার আরেকবার স্ট্রোক হয়ে যাবে।
দেখাই যাচ্ছে, ওভারটাইমের ব্যাপারটা ইন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেননি। তার মনে হয়েছে, এটা ছুতো। তবু মেয়ের দেরি করে ফেরার অজুহাতটা যাচাই করে দিতে সাহস হয় না। যদি জানতে পারেন, মৃদুলা মিথ্যে ওজর দিয়ে চলেছে, উৎকণ্ঠা শতগুণ বেড়ে যাবে। জানার উপায় আছে, অথচ জানতে পারছেন না। বুড়ো মানুষটার কী যে চাপা কষ্ট!
শিঞ্জিনী কী উত্তর দেবে, ভেবে পেল না। মায়ের ওভারটাইমের রহস্যটা আজই স্বর্ণালীর কাছে মোটামুটি জেনেছে সে। দাদুর মানসিক যাতনা অনেকদিন ধরেই চলেছিল। আজ থেকে তারও শুরু হয়েছে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, তুমি এ নিয়ে মাকে কিছু বলতে যেও না। আর কিছুদিন দেখি। তারপর যা বলার, আমিই বলব।
স্বর্ণালী যখন খবরটা দেয় শিঞ্জিনী ভেবেছিল, মাকে সোজাসুজি সেই লোকটার কথা জিগ্যেস করবে। পরে ঠিক করেছে, আপাতত চুপচাপ থাকাই ভালো। মৃদুলার গতিবিধি আর কিছুদিন লক্ষ্য করা যাক। তারপর কিছু একটা করা যাবে।
শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। পড়ার ক্ষতি হচ্ছে। এবার যাও।
.
০৩.
নিজের ঘরে ফিরে এসে সামনের জোড়া জানালার মোটা শিক ধরে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী। তাদের বাড়ির পেছনের অংশ, আধভাঙা বাউন্ডারি ওয়ালের পর ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই অনেকটা জমি, জলা-সব এখন ঘন আঁধারে ডুবে আছে। জলার ওধারে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। মনে হয় একেকটা অলীক স্বপ্নপুরী।
নিঝুম ফাঁকা মাঠ আর জলার দিক থেকে একটানা ঝিঁঝির ডাক উঠে আসছে। অদৃশ্য এই পোকাগুলো কোথায় যেন মাইফেল বসিয়ে দিয়েছে। রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজও মাঝে মাঝে ভেসে আসে।
কবছর আগেও ওই জলার দিকটায় সন্ধের পর থেকে শিয়ালেরা কোরাসে ডেকে উঠত। ওধারের হাইরাইজগুলো আকাশে মাথা তোলার পর প্রাণীগুলো তল্লাট ছেড়ে উধাও হয়েছে।
সেই অজানা লোকটা আর মাকে ঘিরে দুশ্চিন্তাটা এক লহমাও পিছু ছাড়ছে না। মাথার ভেতর অবিরল পাক দিয়ে চলেছে।
কতক্ষণ দূরে তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই। মালতী ডাকল, রূপাদিদি।
একটু চমকে ঘুরে দাঁড়ায় শিঞ্জিনী। দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মালতী। সে বলল, কী গো, এখনও পড়তে বসোনি!
মালতী বেশ অবাকই হয়েছে। অন্যদিন স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেয়েই পড়তে বসে যায় শিঞ্জিনী। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না। তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল মালতী।
শিঞ্জিনী জানালার পাশ থেকে সরে এল, এইবার বসব।
মালতী একদৃষ্টে তাকিয়েই ছিল। বলল, তোমার কী হয়েছে, বলো দিকিন?
কী হবে?
ইস্কুল থিকে আসা অব্দি দেখছি, সব্বেক্ষণ কী ভেবেই চলেছ।
তার মুখেচোখে ভেতরকার উদ্বেগ বা মানসিক চাপ যে ফুটে বেরিয়েছে, তা মালতীর নজর এড়িয়ে যায়নি। একটু হেসে শিঞ্জিনী বলল, ধুৎ, কী আবার ভাবব।
দেখো রূপাদিদি, তোমার য্যাখন চার বছর বয়স সেই ত্যাশন থিকে এ বাড়িতে কাজে লেগিচি। কোলে পিঠে করে তোমায় মানুষ করিচি। তোমার ধাত আমার জানা আছে। মুখ দেখল পেটের কথা টের পাই।