সকালে দুধ খায় শিঞ্জিনী, বিকেলে এক কাপ চা। খিদে পেয়েছিল, প্লেটটা তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল সে। সেই চিন্তাটা কিন্তু চলছেই। নাছোড়বান্দা বিষাক্ত পোকার মতো মাথা ভেতর কামড় দিয়ে বসে আছে।
মিনিট দশেক বাদে মালতী চা নিয়ে এল। বলল, চা খেয়ে দাদুর ঘরে যেও। উনি যেতি বুলেছেন। অনেক বছর কলকাতায় আছে মালতী। কিন্তু তার কথায় এখনও গেঁয়ো টান। দাদুর খবরটা দিয়ে সে চলে গেল।
শিঞ্জিনীর মনে পড়ল, ইন্দ্রনাথ তখন বলছিলেন কী একটা জরুরি কথা বলবেন। কী বলবেন? দেরি করে ফেরার জন্য বকুনি তো দিয়েছেনই। তারপর আর কী বলার থাকতে পারে?
চা খেয়ে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল শিঞ্জিনী। দাদু আগের মতোই বিছানায় শুয়ে আছেন। জোরালো আলোয় ঘর ভরে রয়েছে। নিশ্চয়ই মালতী জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে।
পয়সার জন্য খাটতে এসেছে বলে তার কাছে কিন্তু দায়সারা ভাবটা নেই। এ বাড়ির মানুষগুলোকে সত্যিই সে ভালোবাসে। সবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। কখন কী করতে হবে, তাকে বলে দিতে হয় না। নিঃশব্দে নিজের কাজটি সে করে যায়। বেশিরভাগ সময় চোখ বুজে শুয়ে থাকেন ইন্দ্রনাথ। এখন কিন্তু তাকিয়েই আছেন। নাতনির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনকার মতো বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে শিঞ্জিনীকে কাছে বসালেন। কোমল গলায় বললেন, জলখাবার খেয়েছ?
আস্তে মাথা কাত করল শিঞ্জিনী, হ্যাঁ।
দেওয়ালে টাঙানো একটা ওয়াল ক্লকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছটা চল্লিশ। এবার তো পড়তে বসবে।
হ্যাঁ।
তার আগে এক কাজ করো, মাথার কাছের সেই টেবলটা দেখিয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন, আমার ওই ডায়েরিটা দাও তো
ওষুধপত্র, রামায়ণ-মহাভারত এবং টেলিফোনের পাশে ইন্দ্রনাথের একটা নীল মলাটওলা ডায়েরি আর কলমও থাকে। সেটা তুলে এনে তাঁকে দিল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ সরু সরু, রোগা আঙুলে পাতা ওলটাতে লাগলেন।
শিঞ্জিনী জানে, রোজই দু-চার লাইন কী যেন লেখেন ইন্দ্রনাথ। ডায়েরি লেখাটা তার বহুকালের অভ্যাস। অবশ্য তিনি কী লেখেন সে সম্পর্কে শিঞ্জিনীর বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।
পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় এসে থামলেন ইন্দ্রনাথ। নাতনির হাতে ডায়েরিটা দিয়ে বললেন, এখান থেকে পর পর পাতাগুলো দেখে যাও
শিঞ্জিনী সামান্য উত্তেজনা বোধ করল। নিজের গোপন দিনলিপি যে দাদু পড়তে দেবেন, সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু ডায়েরির পাতার দিকে তাকাতেই তার চক্ষুস্থির। তারিখটা আট এপ্রিল। দাদু লিখেছেন, আজ খুকু অফিস ছুটির পর সাড়ে ছটার মধ্যে বাড়ি আসে নাই। সে ফিরিল আটটা বাজিয়া বত্রিশ মিনিটে। জিজ্ঞাসা করায় বলিল, অফিসে ওভারটাইম চলিতেছে। তাই ফিরিতে দেরি হইয়াছে।
খুকু মৃদুলার ডাকনাম। শিঞ্জিনী পাতার পর পাতা উলটে যেতে লাগল। কোনওদিন মা ফিরেছে পৌনে নটায়, কোনওদিন নটা পাঁচে, কোনওদিন দশটা বেয়াল্লিশে। কবে, কখন ফিরেছে, ইন্দ্রনাথ সমস্ত লক্ষ্য করেছেন এবং তাঁর দিনলিপিতে লিখে রেখেছেন।
শিঞ্জিনীর সারা শরীরে তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেল। কোনও কিছুই অসুস্থ, রোগজৰ্জর মানুষটার নজর এড়িয়ে যায় না।
কালকের তারিখ পর্যন্ত দেখার পর ডায়েরিটা বন্ধ করে ধন্ধ-ধরা মানুষের মতো ইন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী। আজকের পাতাটা ফাঁকা। খুব সম্ভব মা ফিরে এলে ঘড়ি দেখে সময়টা লিখে রাখবেন।
শিঞ্জিনীর মনে হয়েছিল, তার সম্বন্ধে হয়তো আরও অভিযোগ আছে দাদুর। কিন্তু দুম করে তিনি যে মায়ের প্রসঙ্গ তুলে বসবেন, ভাবতে পারেনি।
নাতনির হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে পাশে রাখলেন ইন্দ্রনাথ। বললেন, কী বুঝলে রূপাদিদি?
ইন্দ্রনাথ সঠিক কী জানতে চান, বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে শিঞ্জিনী।
ইন্দ্রনাথ বললেন, লক্ষ্য করেছ, এপ্রিল মাসের সেকেন্ড উইক থেকে খুকু সাড়ে আটটার আগে কোনওদিন বাড়ি ফেরেনি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী করেছে।
স্বর্ণালী একদিনই মায়ের নাটক দেখার কথা বলেছিল। হঠাৎই একাডেমিতে ওদের দেখে ফেলেছে। তাছাড়া একদিন দেখেছে হোটেলে আর একদিন মার্কেটে। মা আরও কতদিন ছুটির পর সেই লোকটার সঙ্গে নাটক বা সিনেমা দেখতে গেছে, কিংবা ডিনার খেতে গেছে কোনও হোটেলে, বা বেড়াতে গেছে অন্য কোথাও, স্বর্ণালীর জানার কথা নয়। সে তো সর্বক্ষণ ওদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে নেই। ইভনিং শোয়ে গেলে বা বাইরে রাতের খাওয়া সারলে দশটা সাড়ে-দশটার আগে বাড়ি ফেরা আদৌ সম্ভব নয়।
শিঞ্জিনী নীরবে বসে থাকে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, জিগ্যেস করলে খুকু বলে, অফিসে নাকি ওভারটাইম চলছে
দেরি করে আসার কৈফিয়ৎ হিসেবে একই কথা শিঞ্জিনীকেও বলেছে মৃদুলা। সে উত্তর দেয় না।
ইন্দ্রনাথ এবার বলেন, কাজের বেশি প্রেশার থাকলে অফিসে দু-চার দিন ওভারটাইম হয়। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন? তোমার কী মনে হয়?
শিঞ্জিনী বলে, কী মনে হবে। আমি কি চাকরি করি যে অফিসে কী হয় না-হয় আমি জানব!
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর ইন্দ্রনাথ বলেন, কী এমন বয়স তোমার মায়ের। মাত্র একচল্লিশ। এখনও যথেষ্ট সুশ্রী। যতক্ষণ না ফেরে, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। মনে হয়, দম আটকে আসছে। তোমাদের দুজনকে নিয়ে আমার যে কী দুশিন্তা!
শিঞ্জিনী একটু ভয়ে ভয়ে বলল, এত টেনশন করো কেন? আজকাল কোনও মেয়ে বাড়িতে বসে থাকে! কত কাজে তাদের বেরুতে হয়। অত চিন্তা করলে চলে! বলল বটে, কিন্তু টের পাচ্ছে, মাকে নিয়ে নিজের দুর্ভাবনা একেবারেই কাটছে না। মাথার ভেতর সেই অদৃশ্য পোকাটা অবিরাম দাঁত বসিয়ে যাচ্ছে।