রুগ্ণ, অশক্ত, তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাওয়া এই মানুষটির মধ্যে কোথায় যেন ব্যক্তিত্বের সামান্য একটু তলানি এখনও পড়ে আছে। তার অনুরোধ বা হুকুম কিছুই অমান্য করা যায় না। পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে জড়সড় হয়ে বসল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ এবার কী বলবেন, সেটা তার জানা। কঁচুমাচু মুখে বলল, ছুটির পর বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। অনেকক্ষণ বাদে মিনিবাস এল। সবগুলো ক্রসিংয়ে ভীষণ জ্যাম। তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। স্বর্ণালীর কথা শুনতে শুনতে খানিকটা সময় নষ্ট হয়েছে তা তো আর দাদুকে বলা যায় না।
নিস্তেজ চোখে কয়েক লহমা নাতনির দিকে তাকিয়ে রইলেন ইন্দ্রনাথ। বললেন, তুমি যতক্ষণ না ফিরে আসো, আমার কী উৎকণ্ঠা যে হয়। সেটা কি তুমি বোঝ?
রোজই তো ঠিক সময়ে ফিরে আসি। যেদিন যেদিন কোচিং ক্লাসে যাই, ফিরতে দেরি হয়। রাস্তায় জ্যাম হলে আমি কী করতে পারি?
জ্যামের দোহাই দিতে হবে না। খবরের কাগজে পড়ি, পরিবেশ ভীষণ নোংরা হয়ে গেছে। তোমাদের বয়সি মেয়েদের পদে পদে বিপদ।
ইন্দ্রনাথ কি তার কথা বিশ্বাস করেননি? একটু জোর দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, তুমি তো বাড়ি থেকে বেরোও না। কলকাতার ট্রাফিকের কী অবস্থা হয়েছে, তোমার ধারণা নেই।
ইন্দ্রনাথ বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। এখন গিয়ে হাতমুখ ধোও। কিছু খেয়ে রেস্ট নাও। পরে তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শিঞ্জিনী বলল, কী কথা?
তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মালতাঁকে দিয়ে তোমাকে ডাকিয়ে আনব। তখন শুনো।
দোতলায় পাশাপাশি তিনটে ঘর। সামনে দিয়ে রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দা চলে গেছে।
শিঞ্জিনীর ঘরটা বারান্দার শেষ মাথায়। ইন্দ্রনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে জুতোজোড়া ফের পায়ে গলিয়ে সেখানে চলে এল সে।
একধারে সিঙ্গল-বেড় খাটে ধবধবে, নিভাজ বিছানা! আরেক পাশে লেখাপড়ার জন্য টেবল-চেয়ার। জামাকাপড়ের একটা আলমারি। বইরের র্যাক। মাথার ওপর মান্ধাতা আমলের সেই চার ব্লেডওলা ফ্যান।
স্কুলের জুতোমোজা খুলে দেওয়ালের গা ঘেঁষে রেখে দিল শিঞ্জিনী। বইয়ের ব্যাগটা রাখল পড়ার টেবলে। আলমারি থেকে লম্বাঝল স্কার্ট আর ঢোল্লা জামা বার করে চানঘরে ঢুকে গেল। সেকেলে বাড়ি হলেও দোতলার প্রতিটি বেডরুমেই অ্যাটাচড বাথ।
মিনিট পনেরো বাদে স্নান সেরে পোশাক পালটে চানঘর থেকে শিঞ্জিনী যখন বেরিয়ে এল, নিজেকে অনেকখানি তাজা লাগছে। বছরের এই সময়টা দিনের বেলা ভ্যাপসা গরমে গায়ের চামড়া যেন সেদ্ধ হয়ে যায়। স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার স্নান না করতে পারলে ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে।
তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মাথা মুছে, চুলে বারকয়েক চিরুনি টেনে, ফ্যান চালিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল শিঞ্জিনী। তার মাথায় দিকে মস্ত জোড়া জানালা। ডান ধারের দেওয়ালেও অবিকল তেমনই আরেক জোড়া।
কিছুক্ষণ চোখের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি রেখে চুপচাপ পড়ে রইল শিঞ্জিনী। তারপর বুকে বালিশ চেপে মাথার দিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তাদের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের পর খানিকটা পোতো জমি। নানা ধরনের ঝোঁপঝাড় আগাছায় বোঝাই। এই জমিটার গা ঘেঁষে কচুরিপানায় ঠাসা বেশ বড় একটা জলা। ওগুলো এই অঞ্চলের এক সময়ের জমিদার সরকার-বাবুদের। সরকারদের কাউকে কোনওদিন চোখে দেখেনি শিঞ্জিনী। সে শুনেছে ওই ফাঁকা জমি আর জলা নিয়ে বহুদিন ধরে মামলা চলছে।
জলার ওধারে চার-পাঁচটা উঁচু উঁচু নতুন বাড়ি উঠেছে। আরও কয়েকটার কাজ চলেছে। কবছরে ডানধারেও ছ-সাতটা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে।
যেভাবে একের পর এক স্কাইস্ক্রেপার হচ্ছে তাতে কঁকা জমি বলতে এই এলাকায় কিছু থাকবে না।
নেহাত মামলা চলছে, তাই শিয়রের দিকের মাঠ আর জলাটা টিকে আছে। নইলে কবেই হাইরাইজে হাইরাইজে ছেয়ে যেত। আকাশ দেখা যেত না। ওদিক থেকে হুহু করে যে হাওয়া আসে তাও বন্ধ হয়ে যেত। শিঞ্জিনী আগে অনেকবার ভেবেছে, সরকারদের মামলাটা চিরকাল চলুক। তাদের বাড়ির ওধারটা বরাবর ফাঁকা থাকুক।
স্কুল ছুটির পর শিঞ্জিনীর চোখে পড়েছিল, পশ্চিম আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সেই মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
মেঘ, অদূরে ফাঁকা জমি, জলা, বা বড় বড় আকাশছোঁয়া বাড়ি-কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না শিঞ্জিনী। সেই চিন্তাটা তার মাথায় আবার ফিরে এসেছে। মায়ের সঙ্গী ওই লোকটি কে? তার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক কতখানি গভীর? নতুন করে পরিচিত লোকজনদের মুখ ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু না, স্বর্ণালীর বর্ণনার সঙ্গে এবার কাউকে মেলানো যাচ্ছে না।
সূর্য ডুবে গেছে। যে বিষণ্ণ আলোটুকু চারপাশে গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, একটানে কেউ যেন সেটা টেনে নিয়েছে। বাইরে আবছা আঁধার নেমে এসেছে। অবশ্য চারপাশের বাড়িগুলোতে হাজার আলো জ্বলে উঠেছে।
খুট করে সুইচ টেপার শব্দ কানে এল। সেই সঙ্গে মালতীর গলা, সন্ধে হয়ে গেল। অমন চুপ করে শুয়ে আছ যে! শরীর খারাপ লাগতেছে?
আলোয় ঘর ভরে গেছে। ধড়মড় করে উঠে বসল শিঞ্জিনী। বলল, এমনি শুয়ে ছিলাম। শরীর ঠিক আছে।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করল না মালতী। তার হাতে সাদা প্লেটে দুখানা পরোটা, আলুর তরকারি আর একটা বড় সন্দেশ এবং জলের গেলাস। একটা ছোট নীচু সাইড টেবল শিঞ্জিনীর খাটের কাছে টেনে এনে তার ওপর প্লেট এবং গেলাসটা রেখে বলল, খাও। আমি চা নিয়ে আসছি।