বাগান পেরিয়ে কলিংবেল টিপতেই মালতী দরজা খুলে দিল।
মালতী শিঞ্জিনীদের কাজের মেয়ে। বয়স চল্লিশের আশে-পাশে। পেটানো, মজবুত স্বাস্থ্য। চেহারায় শক্ত, পুরুষালী ভাব। চৌকো মুখ। খর চোখ। কপালের মাঝখানে মস্ত সিঁদুরের টিপ। সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর।
অনেক আগেই পাঁড় মাতাল, রগচটা স্বামীর সঙ্গে মালতীর কাটান ছাড়ান হয়ে গেছে। তবু বিলুপ্ত দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কেন যে সে সিঁদুরটা ধারণ করে, সেই জানে।
মালতী সকালে শিঞ্জিনীদের বাড়িতে আসে। রান্নাবান্না, কাপড়-কাঁচা, ঘর ধোয়া-মোছা থেকে সারাদিন যাবতীয় কাজকর্ম দশভুজা হয়ে সামলায়। সন্ধের পর রাতের রুটি-তরকারি, মাংস-টাংস বেঁধে নিজের খাবার বেঁধে নিয়ে চলে যায়। ওরা থাকে বেশ খানিকটা দূরে, একটা বড় গোরস্থানের পাশের বস্তিতে। সেখানে তার সঙ্গে থাকে তার একমাত্র ছেলে আর ছেলের বউ। ছেলে রিকশা চালায়।
মালতী বলল, কী গো রূপাদিদি, তোমার আজ এত দেরি যে? দাদু কতবার যে তোমার কথা বলেছে?
এটাই ভেবেছিল শিঞ্জিনী। মালতীর পাশ দিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলল, আমি আগে দাদুর কাছে যাচ্ছি। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও।
এ-বাড়িতে সবসুদ্ধ ছখানা ঘর। একতলায় তিনটে। দোতলাতেও তা-ই। নীচের তলার দুটো ঘরে রান্না এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। বাকিটায় রাজ্যের অকেজো বাতিল জিনিসের পাহাড়।
দোতলায় একটা ঘর মৃদুলার, একটা শিঞ্জিনীর, একটা তার দাদু ইন্দ্রনাথের। ইন্দ্রনাথ তার দাদামশায়। মা তার একমাত্র সন্তান।
ত্বরিত পায়ে সিঁড়ি টপকে টপকে ওপরে উঠে এল শিঞ্জিনী। বাইরের প্যাসেজে জুতো খুলে ইন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকল।
দাদুর ঘরটা বেশ বড়। পনেরো ফিট বাই কুড়ি ফিট। মাঝখানে পেল্লায় ভারী খাট। নকশাদার ছত্রির মাথায় আধময়লা মশারি গুটিয়ে রাখা হয়েছে।
দেওয়াল ঘেঁষে তিনটে ঢাউস আলমারি। একটা মস্ত ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল। কটা বেতের মোড়া। সব সেকেলে ডিজাইনের আসবাব। পালিশ উঠে উঠে কবেই ভেতরকার কাঠ বেরিয়ে পড়েছে। সিলিং থেকে চার ব্লেডের আদ্যিকালের একটা ফ্যান ঝুলছে। ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে ওটা আস্তে আস্তে ঘুরে চলেছে। ভালো মালমশলা দিয়ে তৈরি, তাই এখনও নিষ্ঠাভরে সারভিস দিয়ে যাচ্ছে। দুই দেওয়ালে মোটা মোটা শিক বসানো জোড়া জানালা। সেগুলোর পাল্লা খোলা রয়েছে।
খাটের মধ্যিখানে ফ্যানের তলায় উঁচু উঁচু দুটো বালিশে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে আছেন ইন্দ্রনাথ। তাঁর দুপাশে দুটো কোলবালিশ। মাথার দিকে একটা মাঝারি টেবলে ডাঁই-করা ওষুধ। হার্টের সুগারের। রক্তচাপের। এবং আরও নানা রোগের। আর আছে রামায়ণ এবং মহাভারত। মূল সংস্কৃত থেকে রাজশেখর বসুর চমৎকার অনুবাদ। একটা টেলিফোনও রয়েছে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এই যন্ত্রটা দিয়েই তার যেটুকু যোগাযোগ।
ইন্দ্রনাথের চোখ দুটো বোজা। পরনে হাফহাতা পাতলা পাঞ্জাবি এবং পাজামা। শিঞ্জিনীর পায়ের শব্দ তার কানে যায়নি।
ঘুমোচ্ছন কি? তাকে জাগানো ঠিক হবে? একটু ইতস্তত করল শিঞ্জিনী। তারপর নীচু গলায় ডাকল, দাদু
এক ডাকেই চোখ মেললেন ইন্দ্রনাথ। নাতনিকে দেখে দুই কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইলেন।
শিঞ্জিনী ব্যস্তভাবে বলে উঠল, উঠো না, উঠো না। শুয়ে থাকো
নাতনির আপত্তি কানে তুললেন না ইন্দ্রনাথ। রীতিমতো কষ্ট করেই পিঠে বালিশ রেখে খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বসলেন। এই সামান্য পরিশ্রমেই হাঁফ ধরে গিয়েছিল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে খানিকটা ধাতস্থ হলেন।
রং মাটি খসে গেলে প্রতিমার যে কাঠামোটা পড়ে থাকে, ইন্দ্রনাথ অবিকল তা-ই। শীর্ণ, নিজীব। হাড়ের ওপর খোলসের মতো ঢিলে চামড়া জড়ানো। মুখটা শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। সারা শরীর জুড়ে অজস্র ভাঙচুর। চোখের তলায় কালি। মাংস ঝরে যাওয়ায় চোখ থুতনি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।
বছর দুয়েক আগে একটা বড় রকমের স্ট্রোক হয়েছিল। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। তারপরই সেরিব্রালের ছোবলে বাঁ দিকটা অসাড় হয়ে যায়। তারপর শয়ে শয়ে ট্যাবলেট, ইঞ্জেকশন। নিয়মিত ই সি জি। টি এম টি। করোনারি এনজিওগ্রাফি। ডাক্তার। আয়া। অবিরাম শুশ্রূষা। ইন্দ্রনাথের শিয়রে বসে মৃদুলা আর শিঞ্জিনীর রাত জাগা। এমনি কত কী। আশা ছিল না, নেহাত আয়ুর জোরে টিকে গেলেন ইন্দ্রনাথ। পক্ষাঘাতে অবশ দিকটাকে সচল, সক্রিয় করার জন্য কী করা হয়েছে।
অ্যাটাকের ধাক্কা খানিকটা সামলানোর পর ফিজিওথেরাপিস্ট ডাকা হয়েছিল। প্রথমদিকে রোজ এসে সে ম্যাসাজ এবং এক্সারসাইজ করাত ইন্দ্রনাথকে। এখন সপ্তাহে তিন দিন করাচ্ছে। মাস দুয়েক হল সাড় অনেকটাই ফিরে এসেছে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত ভালোই নাড়াতে পারেন ইন্দ্রনাথ। ধরে ধরে দুবেলা কয়েক মিনিট করে তাঁকে হাঁটানোও হয়। আর কিছুদিন পর অন্যের সাহায্য ছাড়াই খুব সম্ভব হাঁটতে পারবেন। অবশ্যই ঘরের মধ্যে। বাড়ির বাইরে ডাক্তাররা কবে বেরুতে দেবেন, কে জানে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, স্কুল ড্রেস এখনও ছাড়োনি দেখছি। সোজা আমার ঘরে চলে এসেছ বুঝি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী।
ইন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক আছে, দুমিনিট বসে যাও। পরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিও। আঙুল বাড়িয়ে খাটের একটা কোনা দেখিয়ে দিলেন।