এই তো সেদিন কৈশোর পেরুল। কিন্তু এই বয়সেই তার সবটুকু কমনীয়তা কেউ যেন নিঙড়ে বার করে নিয়েছে। ভেতরটা তার রীতিমতো রুক্ষ। কঠিন। সহজে সে কাতর হয় না।
কিন্তু স্বর্ণালী আজ যে খবরটা দিল তাতে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে। মা-ই তার সব। মাকে ঘিরেই তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড! পরস্পরকে জড়িয়ে বেশ তো ছিল তারা। হঠাৎ কোত্থেকে অচেনা ওই লোকটা তার আর মৃদুলার মাঝখানে এসে যে জুড়ে বসল।
নিজের অজান্তে শিঞ্জিনীর দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে।
.
০২.
কনডাক্টরের হাঁকডাকে হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে শিঞ্জিনীর। মিনিবাস তাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে থেমেছে।
টের পায়নি, কখন যেন চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গালে গড়িয়ে এসেছিল। মিনিবাসে এত মানুষের ভেতর সে কেঁদেছে। একটু লজ্জা পেল শিঞ্জিনী। দ্রুত রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চারদিকে তাকাল। না, কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি।
বাসে উঠে স্কুলব্যাগটা কোলে নামিয়ে রেখেছিল। সেটা ফের পিঠে ঝুলিয়ে নানা বয়সের পাঁচ-ছটি পুরুষ এবং মহিলার সঙ্গে নেমে এল শিঞ্জিনী।
বাসরাস্তার উলটো দিকে, কোনাকুনি যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, ওটার প্রায় শেষ মাথায় তাদের বাড়ি। কবছরে জায়গাটা পুরোপুরি বদলে গেছে। ছেলেবেলায় এখানে কটাই বা বাড়ি-টাড়ি দেখেছে! কিছু কিছু একতলা কি দোতলা। সেগুলো পুরোনো, দেওয়ালে শ্যাওলার পুরু ছোপ, কার্নিস ভাঙা। টিন বা টালির চাপ-বাঁধা বস্তিই বেশি। প্রচুর ফাঁকা জায়গা। সেখানে খাড়া খাড়া তাল গাছ, বেঁটে বেঁটে খেজুর। বেশ কটা আঁশফলের বাগান। ঝোঁপঝাড়। প্রায় সারাদিনই ঝিঁঝির ডাক। তক্ষকের ডাক। রাতের দিকে গম্ভীর, কর্কশ গলায় পেঁচারা ডেকে যেত।
আচমকা প্রোমোটারদের নজর এসে পড়ল জায়গাটার ওপর। লহমায় বস্তি উধাও। বেশিরভাগ পুরোনো পাকা বাড়ি উধাও। ফাঁকা মাঠ উধাও। আঁশফলের বাগান উধাও। পানাপুকুরগুলো ঝটিতি বুজিয়ে ফেলা হল। একের পর এক উঠতে লাগল হাইরাইজ। সেগুলো ডানা মেলে আকাশ ছুঁতে চায়। কী সব আর্কিটেকচার! যেদিকেই তাকানো যাক, চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
কয়েকটা সেকেলে বাড়ি এখনও কোনওরকমে টিকে আছে। তবে আয়ু আর কদিন? এক বছর, দুবছর, তিন বছর। তারপরেই ওগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে মাথা তুলবে আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং।
তাদের রাস্তাটার ভোলও পালটে গেছে। কবছর আগেও ছিল খানাখন্দে বোঝাই। এখন দশ ইঞ্চি অ্যাসফাল্টে মোড়া। মসৃণ পথের ওপর দিয়ে ঝকঝকে নতুন মডেলের গাড়িগুলো যেন উড়তে থাকে।
সমস্ত তল্লাট জুড়ে তখন সারাদিন কেমন একটা ঝিমুনিভাব। নির্জীব আলস্য গায়ে জড়িয়ে নিঝুম পড়ে থাকত জায়গাটা। এখন সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চারদিক সরগরম।
বড় রাস্তা পেরিয়ে ওপারে চলে এল শিঞ্জিনী। কোনাকুনি রাস্তাটার মোড়ে সাইকেল রিকশার জটলা। সেটার গায়ে পাড়ার একটা ক্লাব। তরুণ সমিতি। আগে ছিল টিনের চালা। এখন প্রোমোটারদের কাছ থেকে জবরদস্তি টাকা আদায় করে বেশ বড় একতলা বাড়ি তোলা হয়েছে।
সমিতির কটা ছেলে, চোয়াড়ে চেহারা, পঁচিশ-ছব্বিশের মতো বয়স, ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে হই হই করে গজল্লা করছিল। ক্লাবটা ওদের স্থায়ী গুলতানির আখড়া। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস, যখনই এ পথে আসা যাক, ক্লাবের সামনে ওদের পাওয়া যাবেই।
শিঞ্জিনী ক্লাবের পাশ দিয়ে এগিয়ে যায়। ওকে দেখে ছোকরাগুলোর হল্লা থেমে গিয়েছিল। ওদের দিকে কখনও তাকায় না সে, আজও তাকাল না। তবু হাঁটতে হাঁটতে টের পেল, পাঁচ-ছজোড়া চোখ তার পিঠে ফলার মতো বিধছে। আগে অস্বস্তি হত, ভীষণ ভয় লাগত। এখন আর সে গ্রাহ্য করে না।
শুধু ওরাই কি, রাস্তায় বেরুলেই অসংখ্য চোখ তাকে গিলতে থাকে। এমনকী, বন্ধুদের বাড়ি গেলেও নিস্তার নেই। ওদের দাদাদের, কাকাদের কিংবা অন্য আত্মীয়দের তার সম্পর্কে একটু বেশি রকমের উৎসাহ। গেলে সারাক্ষণ তার সঙ্গে লেপটে থাকতে চায়। কারও কারও বাবা পর্যন্ত আদরের ছলে গায়ে-মাথায় এমনভাবে হাত বুলোয় যে শরীর কুঁকড়ে যায়। কোনটা আদর, কোনটা স্নেহ, আর কোনটা এসবের বাইরে অন্য কিছু, তা না-বোঝার মতো নাবালিকা শিঞ্জিনী নয়। তার চোখে এই লোকগুলোর মুখ আর মানুষের মুখ থাকে না, জন্তুর মুখ হয়ে যায়। আর এই জন্তুদের লকলকে জিভ থেকে সর্বক্ষণ লালা ঝরতে থাকে।
স্বর্ণালীদের বাড়িটাই একমাত্র জায়গা যেখানে সে নির্ভয়ে যেতে পারে। ওখানে কেউ তাকে উত্যক্ত করবে না। দেবকুমার আঙ্কল চমৎকার মানুষ। সহৃদয়। স্নেহপ্রবণ। স্বর্ণালীর মা অনুপমা আন্টি, ওর দিদি সুদীপ্তাও তা-ই। নিজের বাবাকে নিয়ে শিঞ্জিনীর বিরাট একটা দুঃখ আছে। সে জন্য তার প্রতি স্বর্ণালীদের অপার সহানুভূতি। ওদের বাড়িতে গেলে তার গোপন যন্ত্রণা অনেকখানি জুড়িয়ে যায়। তাই সময় পেলেই সে ওদের কাছে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসে।
লম্বা রাস্তাটা ফুরিয়ে এসেছিল। শিঞ্জিনী বাড়িতে পৌঁছে গেল।
অনেকখানি জায়গার মাঝখানে ওদের বুড়োটে, সেকেলে বাড়িটা নেহাতই সাদামাটা। ছিরিছাঁদহীন। কবছর আগে গোলাপি রং করা হয়েছিল। বর্ষার জলে ধুয়ে ধুয়ে রংটা ফিকে হয়ে গেছে। চারদিকের সীমানা ভাঙাচোরা বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা।
রাস্তার দিকে কাঠের গেট। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকলে ফুলের বাগান। পরিচর্যার অভাবে ফুলগাছগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। বাড়ির পেছন দিকে দু-চারটে ফলের গাছ। পেয়ারা, নারকেল, বাতাবি আর গন্ধরাজ লেবু। বাকি সবই আগাছা।