ফিরে যাবার জন্য শিঞ্জিনী আসেনি। একটা শ্লিপ লিখে রিসেপশনিস্ট মেয়েটাকে দিয়ে কঠোর সুরে বলল, এটা আপনাদের চেয়ারম্যানকে পাঠিয়ে দিন। নইলে আপনি অসুবিধায় পড়বেন।
কয়েক লহমা শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটি। তারপর নিজেই স্লিপটা নিয়ে চলে গেল।
কয়েক মিনিটের ভেতর প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে এলেন বিমলেশ। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়, তুমি!
শিঞ্জিনী বলল, বিশেষ দরকারে আপনার কাছে আসতে হল। আমরা খুব বিপদে পড়েছি।
রিসেপশানে আরও লোজন রয়েছে। তাদের সামনে কোনও প্রশ্ন করলেন না বিমলেশ। শিঞ্জিনীকে চমৎকার-সাজানো বিশাল এক চেম্বারে এনে বসালেন। নিজে তার সামনে বসলে বসতে বললেন, কী হয়েছে, বলো
শিঞ্জিনী যা যা ঘটেছে, কাল রাতটা কী নিদারুণ উল্কণ্ঠায় তাদের কেটেছে, সব জানাল। সেই সঙ্গে সুরেশ্বর ভৌমিকের ক্রমাগত চাপ এবং হুমকির ব্যাপারটাও।
সমস্ত শোনার পর মুখটা থমথমে হয়ে যায় বিমলেশের। বললেন, ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন বলো, কী খাবে?
কিচ্ছু না। দাদু বাড়িতে খুব ভাবছে। এখনই আমাকে ফিরে যেতে হবে।
বিমলেশ অনুমান করে নিলেন, এখন খাওয়ার মতো মনের অবস্থা নয় শিঞ্জিনীর। তিনি জোর করলেন না। বললেন, ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। সে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
বিমলেশের গাড়িতে ওঠার ইচ্ছা ছিল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হল শিঞ্জিনী।
.
১৩.
সকালে শিঞ্জিনী যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, ঘড়িতে তখন সোয়া আটটা। বিমলেশের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরেছিল সাড়ে বারোটায়। এতক্ষণ কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কার কার সঙ্গে দেখা করেছে, সব ইন্দ্রনাথকে বলেছে সে। শুধু বিমলেশের সঙ্গে মৃদুলার সম্পর্কটাই জানায়নি।
সেই বারোটা থেকে ইন্দ্রনাথ আর শিঞ্জিনী উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে। এমনকী মালতী। সে-ও সব জেনে গেছে।
সন্ধের খানিক আগে, তখনও মরা মরা একটু রোদ চারদিকে আলগাভাবে জড়িয়ে আছে, সেই সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। সেই সঙ্গে মৃদুলার ডাক ভেসে আসে, রূপা রূপা-মালতী।
রূপা ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নীচে এসে দরজা খোলে। মালতীও দৌড়ে এসেছে।
মাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শিঞ্জনী। তারপর দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। ভাঙা ভাঙা, জড়ানো গলায় বলে, কাল কী হয়েছিল তোমার মা? সুরেশ্বর ভৌমিকরা তোমাকে কীভাবে ধরে নিয়ে গেল?
মৃদুলাও কাঁদছিল। বলল, সুরেশ্বরের গানম্যানরা বন্দুক দেখিয়ে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে সব শুনিস। রাস্তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, উনি না বাঁচালে কী যে হত!
ফুটপাতের ধার ঘেঁষে একটা এয়ার-কন্ডিশনড টোয়েটা। সেটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিমলেশ। শিঞ্জিনীর সঙ্গে চোখাচোখি হতে নরম গলায় বললেন, তোমার মাকে দিয়ে গেলাম। সুরেশ্বর আর কোনও গোলমাল করবে না। আচ্ছা, চলি–
হঠাৎ অদ্ভুত এক আবেগ শতধারায় বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে যেতে লাগল শিঞ্জিনীর। বিমলেশ গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন, মাকে ছেড়ে দৌড়ে তার কাছে চলে আসে সে, প্লিজ, যাবেন না
দাদু পঙ্গু মানুষ। নির্জীব, শয্যাশায়ী। কবে আছেন, কবে নেই। এদিকে শকুনের পাল, হাঙরের দঙ্গল তাদের ছিঁড়ে খাবার জন্য দাঁত-নখ শানিয়ে রেখেছে। মাথার ওপর বিমলেশের মতো একজন শক্তিমান মানুষ না থাকলে তারা বাঁচবে না।
বিমলেশ বললেন, যেতে বারণ করছ?
হ্যাঁ। ধরা গলায় শিঞ্জিনী বলল, আসুন
এই ডাকটার জন্য কতদিন অপেক্ষা করে আছেন বিমলেশ। তাঁর মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে ওঠে। আশ্চর্য সুন্দর। মায়াময়। বললেন, তুমি যখন যেতে বলেছ, নিশ্চয়ই তোমাদের বাড়ি যাব–
দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে শিঞ্জিনীর।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই উপন্যাস রচিত। স্থান এবং চরিত্রগুলির নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে কল্পনার আশ্রয়।)