কারণ একটাই। আমরা তোমাদের দারুণ একটা অফার দিয়েছিলাম। তোমার দাদু রাজি হলেন না। তাই বাধ্য হয়ে লোকটা বলতে লাগল, সে যাক। কাল এই সময় আবার ফোন করব। তোমার দাদুকে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব। তিনি সই করে দিলে এক ঘণ্টার ভেতর মৃদুলা দেবী বাড়ি পৌঁছে যাবেন।
সুরেশ্বরই যে এই লোকটাকে দিয়ে ফোন করাচ্ছে, আগেই টের পাওয়া গেছে। শিঞ্জিনী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই লাইন কেটে দিল লোকটা।
দম বন্ধ করে তাকিয়ে ছিলেন ইন্দ্রনাথ। নাতনির মুখে সব শোনার পর আতঙ্কগ্রস্তের মতো বললেন, ওরা নিয়ে যাক আমার জমি-বাড়ি। যা লেখাতে চায়, লিখিয়ে নিক। শুধু আমার খুকুকে ফিরিয়ে দিক। তাঁর মনোবল, সুরেশ্বর ভৌমিকের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস, সব চুরমার হয়ে গেছে।
কিন্তু লহমায় বদলে গেল শিঞ্জিনী। ভয়, শঙ্কা, উৎকণ্ঠা–সব যেন উধাও হয়ে যায়। একটা লোক মাকে আটকে রেখে, চাপ দিয়ে সর্বস্ব লিখিয়ে নিতে চাইছে, কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছে না সে। ইন্দ্রনাথের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ। চব্বিশ ঘণ্টা সময় পাওয়া গেছে। যা করার এর মধ্যেই তাকে করতে হবে। হঠাৎ দুর্জয় সাহস যেন তার মাথায় ভর করেছে।
শিঞ্জিনী বলল, দাদু, আমি এখন একটু বেরুব। তুমি না বলো না
নির্জীব সুরে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, কোথায় যাবে?
দু-একজনের সঙ্গে দেখা করব। যদি বাড়ি-টাড়ি বাঁচানো যায় আর মাকে উদ্ধার করে আনতে পারি।
চকিত হয়ে উঠলেন ইন্দ্রনাথ, তোমার মতো একটা বাচ্চা মেয়ের পক্ষে ওই রকম বদমাশ ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কতটুকু কী করা সম্ভব? ওরা যদি টের পায়, তুমি কিছু একটা করতে যাচ্ছ, তোমার মায়ের বিপদ তো বাড়বেই, তোমারও ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে?
শিঞ্জিনী বলল, কেউ কিছু জানতে পারবে না।
বাধা দেবার ক্ষমতাও শেষ হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রনাথের। বললেন, দেখো, যদি কিছু করতে পারো। কিন্তু খুব সাবধান
.
কী করবে মোটামুটি তার একটা পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল শিঞ্জিনী। মালতী এলে তার হাতে ইন্দ্রনাথ এবং বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
বড় রাস্তার মোড়ে একটা টেলিফোন বুথ রয়েছে। সেখান থেকে প্রথমে শিবপুরে রজতের হোস্টেলে ফোন করল শিঞ্জিনী। তার গলা শুনে রজতের মনে হল, আকাশের চাঁদ যেন হাতের মুঠোয় নেমে এসেছে।
তুমি যে আমাকে ফোন করবে, ভাবতে পারিনি। উঃ, কী ভালো যে লাগছে!
শতধারায় রজতের উচ্ছ্বাস ফেটে বেরিয়ে আসছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আমি একটা ভীষণ বিপদে পড়েছি। আপনি কি সাহায্য করবেন?
তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে থমকে গেল রজত। একটু চুপ করে থেকে বলল, কী বিপদ? কী ধরনের সাহায্য?
বিপদের বিবরণ শুনিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার মায়ের বহু পুরোনো ছাত্র অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বড় বড় পোস্টে রয়েছেন। তাদের ব্যাপারটা জানালে আমাদের প্রবলেমটা হয়তো
আগেই দমে গিয়েছিল রজত। বলল, পোমোটার, কিডন্যাপিং–এ সব ব্যাপারে নিজেকে জড়ালে মা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। আচ্ছা, রাখছি।
.
রজতের কাছ থেকে সাহায্যের কোনওরকম আশাই নেই। শিঞ্জিনী টেলিফোন বুথ থেকে সোজা চলে এল থানায়। অফিসার-ইন-চার্জকে তার সমস্যার কথা সবিস্তার জানাল।
খুব মনোযোগ দিয়ে অফিসার শিঞ্জিনীর কথা শুনলেন। সহৃদয় সুরে বললেন, ব্যাপারটা সাঙ্ঘাতিক। কাল একটা কিডন্যাপিংয়ের খবর পেয়েছি। তবে কে কিডন্যাপড হয়েছে, কারা এই নোংরা কাজটা করেছে, এখনও কিছুই জানা যায়নি। তোমার টেনশনটা বুঝতে পারছি মা। আমরা খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করব। তোমাদের ঠিকানা রেখে যাও। তোমার মায়ের সন্ধান পেলেই যোগাযোগ করব। একটু থেমে বললেন, সুরেশ্বর ভৌমিক বিরাট প্রোমোটার। সলিড প্রমাণ ছাড়া তার গায়ে তো হাত দেওয়া যায় না।
.
শিঞ্জিনীর মাথায় জেদ চেপে গেছে। পুলিশ অফিসার যে এড়িয়ে গেলেন তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না।
দুজায়গায় ব্যর্থ হবার পর ফার্ন রোডে স্বর্ণালীদের বাড়ি চলে এল শিঞ্জিনী। স্বর্ণালীর বাবা দেবকুমার আঙ্কল বাড়িতেই ছিলেন। তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তাদের বাড়ির সবার প্রতি ওঁর গভীর সহানুভূতি।
সব শুনে দেবকুমার সিঁটিয়ে গেলেন। সুরেশ্বর ভৌমিকের নাম এবং তার কার্যধারা সম্বন্ধে যাবতীয় খবরই রাখেন। বুঝিয়ে দিলেন, এমন লোকের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তোলার ক্ষমতা তার নেই।
.
বিপর্যস্ত, হতাশ শিঞ্জিনী কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না। স্বর্ণালীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনের মতো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিমলেশের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মা বলেছিল, এই লোকটার পুলিশ, প্রশাসন এবং মন্ত্রিমহলে প্রচুর যোগাযোগ এবং প্রভাব।
বিমলেশ সম্পর্কে শিঞ্জিনীর মনে যা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা হল প্রচণ্ড আক্রোশ। সেই সঙ্গে বিদ্বেষ। তার অফিসের ঠিকানাটা মায়ের মুখে শুনেছিল। আশ্চর্য, সেটা মনেও আছে। কখন যে ট্যাক্সি নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল, খেয়াল নেই।
একটা বিশাল হাইরাইজের তিনটে ফ্লোর জুড়ে বিমলেশের পিকক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর বিশাল অফিস। তাঁর সঙ্গে সহজে দেখা করা গেল না। রিসেপশানের স্মার্ট ঝকঝকে সুন্দরী তরুণীটি তাকে রুখে দিল। চেয়ারম্যান অর্থাৎ বিমলেশ আজ ভীষণ ব্যস্ত। শিঞ্জিনী যেন অন্য দিন আসে।