বিমলেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে চলে এসেছে মৃদুলা। এখন একটা বেজে সতেরো। এ তো ভাবাই যায় না। কী হতে পারে মায়ের? মারাত্মক কোনও অ্যাকসিডেন্ট?
মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যেতে থাকে শিঞ্জিনীর। দিশেহারার মতো সে দৌড়ে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে আসে। দাদু ওষুধ খেয়ে অসাড়ে ঘুমোচ্ছে।
কোচিং থেকে ফিরে যখন শিঞ্জিনী এ-ঘরে আসে, বেশি পাওয়ারের বাল্বটা জ্বলছিল। সেটা নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিতে ভুলে গিয়েছিল সে।
অন্যদিন মা থাকে। আজ একটি রুগণ ঘুমন্ত বৃদ্ধ ছাড়া এ-বাড়িতে আর কেউ নেই। শিঞ্জিনীর গা ছম ছম করতে লাগল। একতলায় খাবার টেবলে রুটি বা পরোটা, ডাল, তরকারি, মাংস-টাংস গুছিয়ে রেখে গেছে মালতী। মায়ের জন্য মন যেভাবে তোলপাড় হচ্ছে, খাওয়ার কথা তার মাথাতেই এল না। একা একা নিজের ঘরে সে চলে যাবে, সে সাহসটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। শিঞ্জিনীর গা ছম ছম করতে লাগল।
যতই অথর্ব পঙ্গু হোক, যতই ঘুমিয়ে থাকুক, একটা জীবন্ত মানুষ তো। শিঞ্জিনী এতটুকু শব্দ না করে ঘরের কোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে দাদুর খাটের পাশে বসে রইল।
এ-ঘরে ইন্দ্রনাথের শিয়রের দিকের টেবলে একটা পুরোনো ঘড়ি আছে। মাঝে মাঝেই সেটার দিকে শিঞ্জিনীর চোখ চলে যাচ্ছে। দেড়টা বাজল, দুটো বাজল, তিনটে বাজল। ঘড়ির কাটা যান্ত্রিক নিয়মে ঘুরেই চলেছে।
স্নায়ুগুলো টান টান করে বসেই রয়েছে শিঞ্জিনী। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি মা এল, এই বুঝি নীচে কলিং বেলবেজে উঠল।
.
একসময় সকাল হল।
কখন সূর্য উঠেছে, খেয়াল করেনি শিঞ্জিনী। খোলা-দরজা-জানালা দিয়ে অঢেল বোদ এসে পড়েছে ইন্দ্রনাথের ঘরে।
সারা রাত লহমার জন্যও ঘুমোয়নি শিঞ্জিনী। কপালের দুপাশের শিরাগুলো দপ দপ করছে। যন্ত্রণায় মাথা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আয়নার সামনে গিয়ে এখন যদি সে দাঁড়াত, দেখতে পেত, তার চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটো লাল টকটকে। গালে চোখের জলের শুকনো দাগ।
এদিকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইন্দ্রনাথের। চোখ মেলে নাতনিকে খাটের পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। তারপর ভালো করে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলেন, এ কী, তুমি এখানে বসে আছ! রাত্তিরে ঘুমোওনি?
না। আস্তে মাথা নাড়ল শিঞ্জিনী।
কেন?
ধরা ধরা, ভাঙা গলায় কারণটা জানাল শিঞ্জিনী।
কনুইয়ে ভর দিয়ে ধড়মড় করে নিজের জরাজীর্ণ শরীরটা টেনে তুললেন ইন্দ্রনাথ। লহমায় একটা মানুষের চেহারা এতটা ভেঙেচুরে যেতে পারে, ভাবা যায় না। এমনিতেই রোগে রোগে শরীরে প্রায় কিছুই ছিল না। চামড়া আর হাড়ের কাঠামো মাত্র। সেটা এখন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
রুদ্ধশ্বাসে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, সারা রাত খুকু ফেরেনি। ফোনও করেনি?
না।
আমাকে জানাওনি কেন?
ঘুম ভাঙালে তোমার শরীর খারাপ হত।
উদ্ভ্রান্তের মতো ইন্দ্রনাথ এবার বললেন, কেন এল না মেয়েটা? কেন? কী হল ওর?
তিনটে সম্ভাবনার কথা আগেই মাথায় এসেছিল শিঞ্জিনীর। এক, দুর্ঘটনা। দুই, বিমলেশের সঙ্গে বাইরে কোথাও গিয়ে হয়তো আটকে পড়েছে মৃদুলা। তিন, সুরেশ্বর ভৌমিক এমন কিছু করেছে যাতে তার পক্ষে ফেরা সম্ভব হয়নি।
অস্থির অস্থির ভাবটা খানিক কাটিয়ে উঠে ইন্দ্রনাথ বললেন, মালতী তো এখনও আসেনি?
শিঞ্জিনী বলল, সে কি এত তাড়াতাড়ি আসে?
এক কাজ করো। আমাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাও। মুখ-টুখ ধুয়ে বাসি পোশাক পালটে নেব। আমার হলে তুমিও মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে এসো!
মালতী রোজ সকালে এসে দাদুকে বাথরুমে ঘুরিয়ে এনে ফিটফাট করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সে যতক্ষণ না আসে, ইন্দ্রনাথ অপেক্ষা করেন। আজ তার কেন এত তাড়া, বোঝা যাচ্ছে না।
ইন্দ্রনাথ আবার বললেন, তুমি এসে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করবে। ওরা স্ট্রেচারে করে আমাকে থানায় নিয়ে যাবে। তুমিও সঙ্গে থাকবে।
কয়েক পলক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শিঞ্জিনী। তারপর বলে, থানায় যাবে কেন?
একটা মেয়ে সারারাত বাড়ি ফিরল না। থানায় খবর দিতে হবে না? ওরাই নানা জায়গায় খোঁজ করে–
ইন্দ্রনাথের কথা শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে ওঠে। ইন্দ্রনাথ ব্যগ্র সুরে বলেন, দেখো তো দিদি
টেলিফোন তুলে হ্যালো বলতেই একটা অচেনা ভারীমতো গলা ভেসে এল, আমি মৃদুলাদেবীর মেয়ে শিঞ্জিনীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে শিঞ্জিনীর। ভয়ে ভয়ে সে বলে, আমিই শিঞ্জিনী। আপনি কে বলছেন?
আমাকে তুমি চিনবে না। তোমার মা আমাদের কাছেই আছেন। তার জন্যে চিন্তা কোরো না। নিজেদের দিদির মতো সম্মান দিয়ে তাকে আমাদের কাছে রেখেছি।
মাকে ফোনটা দিন। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি।
খুব স্বাভাবিক। তোমাদের আগেই ফোন করা উচিত ছিল। ভুল হয়ে গেছে।
আমার দাদু ভীষণ অসুস্থ। মায়ের কিছু হলে তিনি বাঁচবেন না। ব্যাকুলভাবে শিঞ্জিনী বলতে লাগল, আমরা আপনাদের কোনও ক্ষতি করিনি। প্লিজ, মাকে ছেড়ে দিন। নইলে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দিন।
এখন কোনওটাই সম্ভব নয়। দাদুকে টেনশন করতে বারণ করো। তোমাকে তো আগেই বলেছি, মৃদুলাদেবীকে খুব যত্ন করে, মর্যাদা দিয়ে আমাদের কাছে রেখেছি।
মাকে আটকে রাখার কারণটা কী? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।