.
ঠিক দুদিন পর আবার সুরেশ্বরের ফোন এল, কী ডিসিশন নিলেন?
মৃদুলা বলল, আপনাকে আগে যা বলেছিলাম, এখনও তাই বলছি। বাবা রাজি নন। তিনি চাইছেন, বাড়িটা যেমন আছে তেমনি থাক।
আপনি নিজে কী চাইছেন?
বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাব না।
এটাই আপনাদের শেষ কথা?
হ্যাঁ।
ধন্যবাদ।
ওধারে ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ হল।
.
১২.
আট-দশদিন কেটে গেল।
এর ভেতর আর কোনওরকম যোগাযোগ করেনি সুরেশ্বর। এ-বাড়িতে আসেওনি, ফোনও করেনি। স্পষ্টাস্পষ্টি না বলে দেবার পর সে কি তা হলে হাত গুটিয়ে নিয়েছে? লোকটা যে ধরনের সাঙ্ঘাতিক তাতে আদৌ বিশ্বাস হয় না। গোপনে কী ফন্দি আঁটছে, বোঝারও উপায় নেই।
তবে এটা ঠিক, লোকটা চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় ইন্দ্রনাথদের টেনশন কমতে শুরু করেছে।
.
আজ বুধবার। স্কুল ছুটির পর কোচিং ক্লাসে গিয়েছিল শিঞ্জিনী। সপ্তাহের এই দিনটা জয়ব্রত স্যারের বাড়ি স্বর্ণালী আর সে ইকনমিকস পড়তে যায়। দেবারতি মিসের মতো জয়ব্রত স্যারও পাঁচ-ছজনের একেকটা ব্যাচ করে পড়ান। শিঞ্জিনীদের ব্যাচে সে আর স্বর্ণালী ছাড়া অন্য স্কুলের আরও চারজন ছেলেমেয়ে আছে।
যেদিন কোচিং ক্লাস থাকে, বাড়ি ফিরতে দেরি হয় শিঞ্জিনীর। প্রায় আটটা বেজে যায়।
আজ যখন ফিরল, আটটা বাজতে বারো মিনিট বাকি। সে বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মালতী জানাল মৃদুলা এখনও ফেরেনি। ইন্দ্রনাথ মেয়ের জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। খবরটা দিয়ে আর সে দাঁড়াল না। তার রাতের খাবার গোছগাছ করাই ছিল। সেটা নিয়ে তাদের বস্তিতে চলে গেল।
সুরেশ্বর যেদিন প্রথম এ-বাড়িতে এল, তারপর থেকে অফিস ছুটির পর বাইরে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না মৃদুলা। চার্টার্ড বাস ধরে ছটা-সোয়া ছটার ভেতর ফিরে আসে। মাকে আরও বেশি করে নিজের কাছে পাচ্ছিল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ পাচ্ছিলেন তাঁর মেয়েকে।
কিন্তু আজ মৃদুলার দেরি করার কারণ কী? মা কি ফের তার সেই পুরোনো অভ্যাসে ফিরে গেছে? যেমনটা চার মাস ধরে করে আসছিল? অর্থাৎ বিমলেশ বসুমল্লিকের সঙ্গে নাটক বা সিনেমা দেখা বা দামি হোটেলে খাওয়া বা মোটরে করে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়া–এই সব?
একদিন বিমলেশ বসুমল্লিকের কথা স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। মস্তিষ্কের অদৃশ্য কুঠুরি থেকে সে যেন আবার বেরিয়ে আসে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথার মতো একটা কষ্ট হতে থাকে তার।
দোতলায় এসে বাইরের বারান্দায় জুতো খুলে প্রথমে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল শিঞ্জিনী। যেদিন যেদিন কোচিং ক্লাস থাকে, নাতনি দেরি করে ফেরে। সেটা তার জানা আছে। আজ শিঞ্জিনীর জন্য নয়, আজ তিনি মেয়ের জন্য ভীষণ উতলা। বললেন, কদিন ধরে তোমার মা ঠিক সময়ে ফিরছিল। আটটা বাজতে চলল। আজ এত দেরি করছে কেন বলো তো? একটু থেমে জিগ্যেস করলেন, তোমাকে কি কিছু বলে গেছে?
শিঞ্জিনী আস্তে মাথা নাড়ে, কই, না! বিমলেশ বসুমল্লিকের নামটা তার মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল। দ্রুত সামলে নিল। বিমলেশের কথা এখনও তাকে জানানো হয়নি। জানালে উৎকণ্ঠা শতগুণ বেড়ে যাবে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, সেই প্রোমোটারটা কোনও শয়তানি করল কি?
বিমলেশের চিন্তাটাই মাথায় পাক খাচ্ছিল শিঞ্জিনীর। সুরেশ্বর ভৌমিকের কথা এই মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও সে ভাবেনি। মায়ের সঙ্গে কী ধরনের শয়তানি করতে পারে লোকটা? মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, প্রচণ্ড সাহসী। তবু সংশয় থেকেই যাচ্ছে। সুরেশ্বর সাধারণ মাপের ক্রিমিনাল নয়। অত্যন্ত ধুরন্ধর এবং নিষ্ঠুর। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সে না পারে এমন কোনও কাজ নেই। খুনখারাপি, ঘরে আগুন থেকে যাবতীয় দুষ্কর্ম। একটি মহিলার পক্ষে তাকে ঠেকানো কতটা সম্ভব?
অন্যমনস্কর মতো ইন্দ্রনাথ বললেন, সেই নটায় বেরিয়েছ। স্কুল, কোচিং ক্লাস করে, নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। যাও, আগে হাতমুখ ধুয়ে রেস্ট নিয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর পড়তে বসো।
ইন্দ্রনাথের খাট থেকে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে মেঝেতে নামাতে নামাতে শিঞ্জিনী বলল, কদিন মা ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরছে। তার আগে তো বেশ দেরি করত। হয়তো কোনও
কারণে আটকে গেছে। তুমি এত ভেবো না।
ইন্দ্রনাথের চোখ বুজে আসছিল। নিশ্চয়ই বস্তিতে যাবার আগে মালতী তাকে রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গেছে।
শিঞ্জিনী নিজের ঘরে গিয়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে পোশাক পালটে ফেলল। মালতী তার ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিল। ভীষণ খিদে পেয়েছে। খাওয়া চুকিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে জিরিয়ে নিল। তারপর পড়ার টেবলে গিয়ে টেবলল্যাম্প জ্বেলে পড়তে বসে গেল।
.
কতক্ষণ বইয়ের ভেতর ডুবে ছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ রাতচরা কোনও পাখির কর্কশ ডাকে চমকে উঠল শিঞ্জিনী। সমস্ত এলাকা এখন নিঝুম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাই ঘুমের আরকে ডুবে আছে। দক্ষিণ দিকের আগাছায় ভরা মাঠ, পানাপুকুরে ঠাসা জলাটার ওধারে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর প্রায় সব বাতি নিভে গেছে। দু-একটা জানালায় ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়ে।
আকাশে ছাড়া ছাড়া কিছু মেঘ আছে। তবে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। মহাশূন্যে লক্ষ কোটি তারার মেলা। ক্ষীণ একটি চাঁদও দেখা যাচ্ছে।
স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে শিঞ্জিনীর চোখ সামনের দেওয়াল ঘড়িতে আটকে যায়। একটা বেজে সতেরো। চমকে উঠল সে। মা তো এখনও ফিরে আসেনি! এলে নীচে কলিংবেল বাজাত।