সুশীলা বালিকার মতো মৃদুলা যে বাড়ি ফিরছে তার কারণ হয়তো এইরকম। সুরেশ্বর ভৌমিক তার মাথায় আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। পাঁচদিন যদিও সময় দিয়েছে, তবু কেন যেন লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যদি হুট করে এর ভেতর ফোন করে বসে? ইন্দ্রনাথ হয়তো এমন কিছু বলে বসবেন যাতে সমস্যা আরও ঘোরালো হয়ে উঠবে। তাই বাবাকে আগলে আগলে রাখতে চাইছে সে।
অবশ্য মৃদুলার পক্ষে সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাকে অফিসে বেরুতে হয়। সেই ফাঁকেও তো সুরেশ্বরের ফোন আসতে পারে। তা হলে অবশ্য কিছু করার থাকবে না। তবু বাবার কাছে যতক্ষণ থাকা যায়।
এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ইন্দ্রনাথ বলেছেন, একটা অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে তাকে যেন মৃদুলারা থানায় নিয়ে যায়। সুরেশ্বর ভৌমিকের নামে তিনি একটা ডায়েরি করবেন।
মৃদুলা বুঝিয়েছে, সুরেশ্বর এখনও তাদের কোনও ক্ষতি করেনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে থানা গ্রাহ্যই করবে না।
ইন্দ্রনাথ মেয়ের ওপর বিরক্ত হয়েছেন তার মানে যতদিন না ক্ষতি করছে, মুখ বুজে বসে থাকব? আগে থেকে কোনও প্রিকশান নেব না?
এখনই থানায় ছুটলে তার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক হতে পারে, ইন্দ্রনাথকে তা বোঝানো মুশকিল। মৃদুলা এবং শিঞ্জিনী দুজনেই চুপ করে থাকে।
সুরেশ্বর ভৌমিকের কথার যে নড়চড় হয় না সেটা টের পাওয়া গেল। পাঁচদিন সময় দিয়েছিল সে। এর মধ্যে একবারও যোগাযোগ করেনি।
রবিবার সশরীরে এসে মৃদুলার সঙ্গে কথা বলে গেছে সুরেশ্বর। আজ শনিবার। গতকাল তার দেওয়া সময়সীমা পার হয়েছে।
একটা দিন এ-বাড়ির লোকজনের, বিশেষ করে মৃদুলা আর শিঞ্জিনীর প্রতিটি লহমা তীব্র উৎকণ্ঠায় কেটেছে। আজ ঘুম ভাঙার পর থেকে উদ্বেগটা শতগুণ বেড়ে গেছে। তাদের ধারণা, যে-কোনও মুহূর্তে সুরেশ্বরের ফোন আসবে।
শনিবার শিঞ্জিনীর স্কুলে পুরো ছুটি। এই দিনটা তার কোচিং ক্লাসও থাকে না। কাজেই বাড়ি থেকে বেরুবার প্রশ্ন নেই। শনিবার মৃদুলার হাফ-ডে অফিস। কিন্তু সেও আজ ছুটি নিয়েছে, এবং সকাল থেকে ইন্দ্রনাথের ঘরে বসে আছে। শিঞ্জিনী তার ঘরে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। মাঝে মাঝেই অস্থির পায়ে উঠে এসে ইন্দ্রনাথের ঘরে ঘুরে যাচ্ছে।
সারাদিন কেটে যাবার পর যখন সন্ধে কমতে শুরু করেছে সেই সময় সুরেশ্বরের ফোন এল। ইন্দ্রনাথ হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই ফোনটা তুলে নিল মৃদুলা।
আমি সুরেশ্বর বলছি।
বুঝতে পারছি। বলুন
কবে ডিলের কাগজপত্র নিয়ে আসব?
আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, আমার বাবা রাজি হয়ে গেছেন?
এমন একটা চমৎকার অফার দিয়েছি। রাজি হওয়াই তো উচিত।
শিঞ্জিনীর কান এদিকেই ছিল। টেলিফোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে ইন্দ্রনাথ খাটের বাজুতে ঠেসান দিয়ে বসেছেন। সুরেশ্বর অন্য প্রান্ত থেকে কী বলছে শোনা না গেলেও মৃদুলার উত্তর শুনে বোঝা যাচ্ছে সে কী চায়।
উত্তেজিত ইন্দ্রনাথ ক্ষীণ, দুর্বল কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে চিৎকার করছেন, ফোনটা আমাকে দে খুকু। রাসকেলটাকে মজা দেখিয়ে ছাড়ছি।
টেলিফোনটা ইন্দ্রনাথকে দিল না মৃদুলা। নিজেই কথা বলতে লাগল, বাবা রাজি হননি। পোমোটারের হাতে তিনি নিজের বাড়ি-জমি কিছুতেই তুলে দেবেন না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সুরেশ্বর। তারপর বলে, কিন্তু ওই বাড়ি আর ল্যান্ড যে আমার চাই ম্যাডাম
মৃদুলা যেন নিজের অজান্তেই বলে ওঠে, না দিলে আপনি কি জোর করে কেড়ে নেবেন?
প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে সুরেশ্বর বলল, আমি আপনাকে আরও দুদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে যেভাবে হোক, বাবাকে রাজি করাবেন। তাকে বলবেন, সুরেশ্বর ভৌমিক যখন ঠিক করেছে এখানে একটা হাই রাইজ উঠবে তখন সেটা উঠবেই। দুদিন পর আবার কথা হবে। সেটাই হবে আমার লাস্ট ফোন।
বাবা যদি তখনও রাজি না হন?
সে ব্যাপারও ভেবে রেখেছি। তবে আজই তা বলছি না। দুটো দিন ধৈর্য ধরে থাকব। আচ্ছা নমস্কার।
মৃদুলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল সুরেশ্বর। এতক্ষণ ফোনে সে কী বলেছে, তা জানাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ইন্দ্রনাথ। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করলেন, তারপর ভীষণ কাহিল হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল তার।
.
১১.
আরও যে দুদিন সময় পাওয়া গেছে, তার মধ্যেও ইন্দ্রনাথের মনোভাবের তিলমাত্র পরিবর্তন হয়নি। তার শীর্ণ শরীরের কাঠামোটার ভেতর একটি অনমনীয় জেদি মানুষ আছে। তাকে টলানো প্রায় অসম্ভব। একটা বদ লোক বড় বড় দুটো ফ্ল্যাট এবং প্রচুর নগদ টাকার লোভ দেখাচ্ছে, আর তিনি নাচতে নাচতে তার ফাঁদে পা দেবেন, তেমনি বান্দাই নন ইন্দ্রনাথ। ঠাকুরদার তৈরি বাড়ি ভেঙে সেই জায়গায় হাই-রাইজ তুলে চড়া দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করবে। বিহারি পাঞ্জাবি মারাঠি মারোয়াড়ি গুজরাটি এমনি নানা জাতের কুড়ি-বাইশটা ফ্ল্যাট-মালিকের সঙ্গে বাস করতে হবে–এই চিন্তাটা তাকে খেপিয়ে তুলেছে। প্রশ্নটা অধিকারবোধের। আমার বাড়ি যেমনই হোক–সেকেলে, সাদামাঠা, রঙচটা কার্নিসভাঙা-সেটা আমারই। তার কোনও ভাগীদার অবাঞ্ছনীয়।
এ হল একটা দিক। অন্য দিকটা আরও অসহ্য। সুরেশ্বর বুঝিয়ে দিয়েছে, জমি-বাড়ি না পেলে কী একটা ব্যবস্থা করবে। মতলবটা পরিষ্কার। যেনতেন প্রকারে বাড়ি-টাড়ি দখল করবে। এটাই ইন্দ্রনাথের মাথায় একটা বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।