একটু চুপচাপ।
তারপর মৃদুলা বলল, আপনার অফারটা শুনতে ভালো লাগছে, কিন্তু বাবা রাজি হবেন বলে মনে হচ্ছে না।
সুরেশ্বর বলল, বৃদ্ধ মানুষদের নিয়ে এই এক সমস্যা। পুরোনো সমস্ত কিছুই তারা আঁকড়ে থাকতে চান। টোটালি মিনিংলেস।
মৃদুলা উত্তর দিল না।
সুরেশ্বর বলল, ম্যাডাম, আপনাকে আমার বিশেষ অনুরোধ, বাবাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করান।
যদি রাজি না হন?
হবেন, হবেন। একমাত্র সন্তান আপনি। আপনার কথায় রাজি না হয়ে পারেন?
মৃদুলা বলল, কিন্তু
তাকে থামিয়ে দিয়ে সুরেশ্বর বলল, এর মধ্যে কিন্তু টিন্তু কিছু নেই। আপনাদের অনেকটা সময় নষ্ট করেছি। এবার চলি–
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিগ্যেস করল, ডিলের কাগজপত্র নিয়ে কবে আপনার সঙ্গে দেখা করব?
মৃদুলা আর শিঞ্জিনীও উঠে দাঁড়ায়। মৃদুলা বলে, আপনি ধরেই নিয়েছেন, বাবা আপনার অফারটা মেনে নেবেন?
আমার তো সেই রকমই ধারণা। এখন পর্যন্ত যাকে যাকে অফার দিয়েছি, সবাই তা মেনে নিয়েছে। কবে দেখা করছি?
বাবার সঙ্গে কথা না বলে কী করে বলব?
সে তো বটেই। আপনাকে দিন পাঁচেক সময় দিচ্ছি। আশা করি, এর ভেতর সব ঠিক হয়ে যাবে। আসার আগে আপনাকে ফোন করব।
সুরেশ্বর চলে যাবার পর দোতলায় উঠতে উঠতে শিঞ্জিনী বলল, দাদু যদি রাজি না হয়, কী হবে মা? তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ।
সুরেশ্বর খুব ভদ্রভাবেই কথা বলেছে কিন্তু তার মধ্যে ছিল একটা চাপা হুমকির সুর। মৃদুলাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। সে বলল, দেখি বাবা কী বলে। তবে
কী?
শনির দৃষ্টি যখন এসে পড়েছে, কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না।
ওপরে আসতেই চোখে পড়ল, বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ইন্দ্রনাথ খোলা দরজা দিয়ে বাইরের রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন। সুরেশ্বর ভৌমিকের সঙ্গে মৃদুলাদের কী কথা হয়েছে শোনার জন্য তিনি খুবই ব্যগ্র। হয়তো উল্কণ্ঠিতও।
শিঞ্জিনীকে তার ঘরে পাঠাতে চাইল মৃদুলা। সে কিছুতেই যেতে রাজি হল না। মায়ের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল। এক কোনা থেকে দুটো চেয়ার টেনে এনে ইন্দ্রনাথের খাটের কাছাকাছি বসল।
শ্বাস-টানা গলায় ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, লোকটা বিদেয় হয়েছে?
হ্যাঁ আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল মৃদুলা।
কী চায় সে?
সুরেশ্বরের সঙ্গে যা যা আলোচনা হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিল মৃদুলা, খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দিল না।
রুগণ, শয্যাশায়ী ইন্দ্রনাথের জীর্ণ শরীরে তীব্র উত্তেজনা চারিয়ে যায়। অসহ্য ক্রোধে তিনি ফেটে পড়েন, এটা মগের মুল্লুক? কী ভেবেছে লোকটা?
মৃদুলা বলল, কিন্তু বাবা, তুমি তো জানো, সুরেশ্বর ভৌমিক কী ডেঞ্জারাস টাইপের লোক।
জানি, জানি ইন্দ্রনাথের দুচোখ থেকে আগুনের ফুলকি বেরুতে থাকে, আমার জমি, আমার বাড়ি। সেটা দেব কি দেব না, তা কি ও ঠিক করবে?
মৃদুলা বলল, বাবা, তুমি এত রাগারাগি করো না। শান্ত হও। শরীরের তো এই হাল। এক্সাইটমেন্ট তোমার পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর।
মেয়ের কোনও কথাই কানে গেল না ইন্দ্রনাথের। তীব্র গলায় তিনি বলতে লাগলেন, এই বাড়ি আমার ঠাকুরদা বানিয়েছিল। রূপাকে ধরলে পাঁচ জেনারেশন আমরা এখানে আছি। বংশের কত স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সুরেশ্বর ভৌমিক এসে শাসাল, আর অমনি ভয়ে ভয়ে আমি সব তার হাতে তুলে দিলাম। দেশে আইন-কানুন নেই, পুলিশ নেই?
ইন্দ্ৰনাথ শুনেছেন, সুরেশ্বর ভৌমিক লোকটা ভীষণ খারাপ। কিন্তু কতটা বিপজ্জনক, তার স্পষ্ট ধারণা নেই। মৃদুলা জানে, সুরেশ্বর আইন-কানুন এবং পুলিশ-টুলিশের ঊর্ধ্বে। বাবাকে কী বলবে, সে ভেবে পেল না।
শিঞ্জিনীও সুরেশ্বর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। এজাতীয় লোকেরা নাকি বন্দুকবাজ পোষে। জমি-টমি দখল করার জন্য দরকার হলে তাদের লেলিয়ে দেয়।
সুরেশ্বর ভৌমিককে দেখার পর থেকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল শিঞ্জিনীর। এই প্রথম সে কথা বলল, দাদু, লোকটা মাকে পাঁচদিন সময় দিয়েছে। তারপর ফোন করবে। তুমি যদি আমাদের বাড়ি তাকে দিতে রাজি না হও, কী যে করবে, বুঝতে পারছি না।
রোগা, শীর্ণ একখানা হাত নাতনির কাঁধে রেখে ইন্দ্রনাথ বললেন, ফোন তো আমার ঘরেই আসবে। যা উত্তর দেবার আমিই দেব। চিন্তা কোরো না। এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমার পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনার দিকে ভালো করে নজর দাও।
মৃদুলা আর শিঞ্জিনী, দুজনেই জানে, ইন্দ্রনাথ ভীষণ একগুঁয়ে ধরনের মানুষ। শরীর ভেঙেচুরে গেছে, প্রায় পঙ্গু। তবু জেদটা প্রবল। যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেন, সেখান থেকে তাকে সহজে টলানো যায় না। সুরেশ্বরকে তিনি কী বলবেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, কে জানে।
.
১০.
বিমলেশ বসুমল্লিককে নিয়ে টেনশন তো ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন এক সমস্যা। সুরেশ্বর ভৌমিক।
মারাত্মক উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছে শিঞ্জিনীর। স্কুলে যাচ্ছে ঠিকই, ক্লাস করছে, টিউটোরিয়ালেও যাচ্ছে, বাড়ি ফিরে পড়ার টেবলেও বসছে। কিন্তু মন দারুণ বিক্ষিপ্ত। বইয়ের পাতার কালো কালো হরফগুলো কেমন যেন ঝাপসা, দুবোধ্য হয়ে যায়। এই উদ্বেগ আরও কিছুদিন চললে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের আশা নেই।
তবে একটা ব্যাপার শিঞ্জিনী আজকাল লক্ষ্য করছে, অফিস ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে আসছে মা। মাঝখানে যে ফিরতে ফিরতে আটটা নটা দশটা হচ্ছিল সেটা বন্ধ হয়েছে।