গলার কাছে লোহার বলের মতো কী যেন আটকে আটকে যাচ্ছে। কোনওরকমে শিঞ্জিনী বলল, কীরকম দেখতে বল তো?
স্বর্ণালী প্রায় নিখুঁত একটা বর্ণনা দিল। মৃদুলার সঙ্গীটি রীতিমতো সুপুরুষ। বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। টান টান শরীর। রং বাদামি। হাইট বেশ ভালো। ছফিটের আশেপাশে। চওড়া বুক, মজবুত কবজি। জুলপিতে সামান্য পাক ধরেছে। চুল ব্যাক ব্রাশ করা। সরু শৌখিন গোঁফ। পরনে দামি সাফারি স্যুট। চোখে রিমলেস চশমা।
শিঞ্জিনী ভেবে পেল না, লোকটা কে হতে পারে। তাদের কোনও আত্মীয়স্বজন? নাকি পারিবারিক কোনও বন্ধু? কিন্তু কবছর ধরেই আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধনগুলো ভীষণ আলগা হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধবরা কবেই তাদের বাড়ি যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে কি মায়ের কোনও কলিগ? মৃদুলার সহকর্মীদের অনেককেই চেনে শিঞ্জিনী। ফি বছর অফিসের অ্যানুয়াল ফাংশানে মা তাকে নিয়ে যায়। সেখানেই তার এই কলিগদের সঙ্গে শিঞ্জিনীর আলাপ হয়েছে। ওদেরই কি কেউ? আকাশ-পাতাল হাতড়েও স্বর্ণালীর বর্ণনার সঙ্গে তাদের কারও চেহারার মিল খুঁজে পেল না সে।
অবশ্য মায়ের সব সহকর্মীকেই যে শিঞ্জিনী চেনে, তা নয়। লোকটা কি ওই অপরিচিতদের মধ্যে পড়ে?
স্বর্ণালীর চোখ শিঞ্জিনীর মুখের ওপর স্থির হয়ে ছিল। সে বলে, কী রে, চিনতে পারলি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী, না। একটু থেমে জিগ্যেস করে, আর কিছু বলবি?
না।
চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সাড়ে পাঁচটার ভেতর বাড়ি না ফিরলে দাদু অস্থির হয়ে উঠবে।
গল্ফ গ্রিনের একটা মিনিবাস পেয়ে দুজনে উঠে পড়ল। মোটামুটি ফঁকা। বসার জায়গাও পাওয়া গেল। জানালার ধারে বসেছে শিঞ্জিনী। পাশে স্বর্ণালী।
শিঞ্জিনীর মুখ জানালার বাইরে ফেরানো। উলটোদিক থেকে সাঁ, সাঁ, ছুটে আসছে বাস, ট্যাক্সি, জিপ, ভ্যান, নানা ধরনের ঝকঝকে প্রাইভেট কার। ওধারের উঁচু উঁচু বাড়িগুলো ছিটকে ছিটকে পিছিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। চারদিক থেকে গাড়ির শব্দ, মানুষের কোলাহল উঠে আসছে।
শিঞ্জিনী কিছুই দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিল না। সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা। যেন এক আধ-চেনা অবাস্তব শহরের মাঝখান দিয়ে সে চলেছে। যার সঙ্গে তার আদৌ যোগ নেই। আসলে সেই চিন্তাটা অদৃশ্য পোকার মতো মাথায় হুল ফুটিয়ে চলেছে। বিরতিহীন।
শিঞ্জিনী নিজেকে প্রাণপণে বোঝাতে চাইল, মা যদি কারও সঙ্গে হঠাৎ একদিন থিয়েটার দেখতে গিয়েই থাকে, মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খান খান হয়ে মাথার ওপর ভেঙেও পড়বে না। পরক্ষণে মনে হয়, যুক্তিগুলো বড় পলকা, ভঙ্গুর। একদিন না হয় একাডেমিতে গেছে, কিন্তু তার পরও একই লোকের সঙ্গে তাকে আরও নানা জায়গায় দেখা যাবে কেন?
এটা তো পরিষ্কার, দুজনের মধ্যে চোখে পড়ার মতো যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তা স্বর্ণালীর চোখ এড়ায়নি। একজন অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে একজন মহিলার পরিচয় হতেই পারে। তাদের মধ্যে সাধারণ ভদ্রতার সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারে। তেমন শোভন ব্যাপার মা আর ওই লোকটার ভেতর যদি থাকত, স্বর্ণালী নিশ্চয়ই তাকে এত কথা বলত না।
এই লোকটা সম্পর্কে মায়ের কেন এমন গোপনীয়তা? বুকের ভেতরটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠতে থাকে শিঞ্জিনীর।
স্বর্ণালী বন্ধুর দিক থেকে লহমার জন্যও চোখ ফেরায়নি। অস্বস্তি বোধ করছিল সে। যথেষ্ট অপ্রস্তুতও। নীচু গলার ডাকল, এই রূপা–
শিঞ্জিনীর ডাকনাম রূপা। স্বর্ণালীর ডোনা। দুজনে ছেলেবেলার বন্ধু। পরস্পরকে তারা ডাকনামেই ডেকে থাকে।
শিঞ্জিনী দুরমনস্কর মতো সাড়া দেয়, কী বলছিস?
আমার দিকে তাকা–
শিঞ্জিনীর মুখ ফেরায়। স্বর্ণালী বলে, আমার হয়তো দেখার ভুল হয়েছে। কী বলতে কী বলে ফেলেছি। তুই এই নিয়ে আন্টিকে কিন্তু কিছু বলিস না। ফরগেট ইট।
স্বর্ণালী খুব সিরিয়াস মেয়ে। আলগা কোনও মন্তব্য করে না। ঠিকমতো না জেনে, না বুঝে আলটপকা কিছু বলে বসে না। শিঞ্জিনী বুঝতে পারছে, তার মন খারাপ দেখে ব্যাপারটা লঘু করে দিতে চাইছে স্বর্ণালী। সে উত্তর দিল না।
স্বর্ণালী উতলা হল, কী রে কিছু বললি না যে?
কী বলব?
ওই যে আন্টিকে জানাতে বারণ করলাম।
ওটা এমনই এক প্রসঙ্গ, অপ্রিয় এবং অস্বস্তিকর, মায়ের সামনে কোনও মেয়ের পক্ষে উত্থাপন করা অসম্ভব। বরং কিছু দিন অপেক্ষা করে মায়ের মতিগতির দিকে লক্ষ্য রাখা যাক। তারপর কী করবে বা করা উচিত, এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ নীরব থেকে শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে, জানাব না।
প্রমিস?
শিঞ্জিনী যান্ত্রিক সুরে বলল, প্রমিস।
গোলপার্কে স্বর্ণালী নেমে গেল। আবার মিনিবাসের দৌড় শুরু হয়েছে। দুধারের দৃশ্যাবলি কিছুক্ষণ আগের মতোই ফের ঝাপসা। চতুর্দিকের শব্দপুঞ্জ কান ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, ভেতরে প্রবেশ করছে না।
শিঞ্জিনী একতাল তলতলে মোম নয় যে একটুতেই গলে যাবে। কিংবা শো-কেসে সাজানো ঠুনকো বাহারি পুতুল নয় যে টোকা দিলেই ভেঙে শতখান হবে। তার বন্ধুদের, বা তার বয়সি অন্য দশটা মেয়ের থেকে সে আলাদা। অল্প বয়সের কথা তেমন মনে নেই। জ্ঞান হবার পর থেকে এলোপাতাড়ি ঘা খেতে খেতে সে বড় হয়ে উঠেছে। একের পর এক আঘাত। সবই মনের ওপর। সে যে কী নিদারুণ যাতনা।