এ বাড়িতে সুরেশ্বরের আবির্ভাবের হেতুটা আগেই আঁচ করেছিল মৃদুলা। এবার উদ্দেশ্যটা তার মুখ থেকেই সরাসরি জানা গেল।
মৃদুলা শুনেছে, সুরেশ্বর যদি কোনও জমি-টমির দিকে হাত বাড়ায়, কারও ক্ষমতা নেই তাকে রোখে। তার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শিহরণ খেলে গেল।
সুরেশ্বর থামেনি, আপনাদের সঙ্গে আমি খুব তাড়াতাড়ি ডিল করতে চাই। দুটো সাড়ে বারোশ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আপনারা পাবেন। বেস্ট কোয়ালিটির মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি করে দেব। তিনটে বেডরুম, বিরাট ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল, কিচেন, স্টোর। প্রত্যেকটা বেডরুমের গায়ে অ্যাটচড বাথ, ব্যালকনি। বাথরুমে আর কিচেনে টাইলস বসিয়ে দেব। তাছাড়া- বলে থেমে গেল সে।
মৃদুলা জিগ্যেস করে, তাছাড়া কী?
সুরেশ্বর হাসল, একটু ভাবুন না?
অত চিন্তাশক্তি আমার নেই।
ব্ল্যাক আর হোয়াইট মিলিয়ে নগদ দশ লাখ টাকাও পাবেন। যদি বলেন কালো টাকা স্পর্শ করবেন না, নো প্রবলেম। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকেই পে করব।
মৃদুলা উত্তর দিল না।
সুরেশ্বর বলল, আরও একটা কথা আছে
কী?
যতদিন না এখানে নতুন বাড়ি কমপ্লিট হচ্ছে, আপনাদের থাকার জন্য কাছাকাছি একটা বড় ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করব। তার ভাড়া আমি দেব। বিল্ডিং তৈরি হতে ম্যাক্সিমাম দেড় বছর। তারপর আপনারা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে আসবেন।
মৃদুলা চুপ করে রইল।
সুরেশ্বর বলল, তা হলে পেপার-টেপারগুলো আমাদের লইয়ারকে দিয়ে তৈরি করে ফেলি। ধরুন ব্যাপারটা আট-দশ দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, আপনাদের বাড়ির দলিলের ফোটোকপি লাগবে
এবারও জবাব নেই মৃদুলার।
সুরেশ্বর কী বলতে গিয়ে থমকে গেল। কয়েক মুহূর্ত মৃদুলাকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করে বলল, কী, আপনি তো কিছুই বলছেন না?
কী বলব?
এই যে এতক্ষণ আমি বকে গেলাম, সে সম্বন্ধে আপনার তো কিছু বক্তব্য থাকতে পারে
মৃদুলা বলল, আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, আমাদের বাড়িটা আপনার হাতে তুলে দেব?
সুরেশ্বরের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়েই মিলিয়ে যায়। অন্য কোনও প্রোমোটার কি আপনাদের সঙ্গে ডিল করতে চাইছে?
মৃদুলা বলল, এই এরিয়ায় এসে ল্যান্ড যোগাড় করে হাই রাইজ তুলবে, এমন কোনও প্রোমোটার এখনও জন্মায়নি। ঠিক বলছি?
সুরেশ্বরের মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি। সে বলল, আপনি কী ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ধরতে পারছি। ব্যাপারটা হল, এই অঞ্চলের লোকজন আমাকে ভালোবাসে। পুরোনো বাড়ি জমি আমাকে দেয়। আমিও তাদের ঠকাই না। কথা যা দিই তা রাখি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর সুরেশ্বর ফের শুরু করে, আমার অফারটা কি আপনার পছন্দ হয়নি? যদি বলেন ক্যাশ টাকাটা আরও একটু বাড়িয়ে দেব। দশের জায়গায় পনেরো। আশা করি, এবার আর অসুবিধা নেই। বলতে বলতে উঠে পড়ে সে, বলুন দলিলের ফোটো কপিটা নিতে কবে আসব?
মৃদুলার মাথায় অপার্থিব কোনও শক্তি যেন ভর করে। সুরেশ্বরের চেয়ারটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে, আর মিনিট পাঁচেক বসে যান।
একটু অবাকই হয়েছিল সুরেশ্বর, কিন্তু মৃদুলার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু রয়েছে, হয়তো তার ব্যক্তিত্ব কিংবা সাহস, যা ঠিক অমান্য করা যায় না। আস্তে আস্তে সে বসে পড়ে।
মৃদুলা বলে, আমার বক্তব্যের কথা বলছিলেন না, সেটা কিন্তু জানাবার সুযোগ পাইনি।
ভেতরে ভেতরে সামান্য হলেও অস্বস্তি বোধ করে সুরেশ্বর। বাইরে অবশ্য তার প্রকাশ নেই। হেসে বলল, ঠিক আছে, বলুন
আপনি আমাদের অনেক খবরই রাখেন। নিশ্চয়ই জানেন, বাড়িটা আমার বাবার। দলিল-টলিল তার নামেই।
জানি।
বুঝতেই পারছেন, এই বাড়ির ব্যাপারে কারও সঙ্গে ডিল করার ক্ষমতা আমার নেই।
সুরেশ্বর বলল, আমি আরও কিছু জানি মৃদুলা দেবী
মৃদুলা সতর্ক ভঙ্গিতে বলে, কী?
আপনি যা বলবেন, এ-বড়িতে সেটাই শেষ কথা। আমার সঙ্গে যখন ডিল করবেন, ইন্দ্রনাথবাবু চোখ বুজে সই করে দেবেন।
এখানেই আপনার ভুল হচ্ছে।
মানে?
বাবা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেও তার মতামত ছাড়া এ-বাড়িতে কিছুই হয় না। তিনি যখন থাকবেন না, তখন অবশ্য আলাদা কথা। তাছাড়া
কী?
এই বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন আমার বাবার ঠাকুরদা। বাড়িটার সঙ্গে বাবার ইমোশান, সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে। আমি জানি, উনি চান, বাড়িটা যেমন আছে তেমনই থাক।
এর কোনও মানে হয় না।
কীসের কথা বলছেন?
সুরেশ্বর বলল, ওই সব ইমোশান, সেন্টিমেন্ট। হার্ড রিয়ালিটির দিকটা ভাবুন। কার্পোরেশনের ট্যাক্স দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আপনাদের এতটা জমি। তার মাঝখানে ছোট পুরোনো একটা বাড়ি। নিজেরা বাস করা ছাড়া জমিটা ফালতু পড়েই আছে। কোনও কাজেই লাগছে না। আজকাল কেউ এভাবে ল্যান্ড ফেলে রাখে না। আমি যা বলছি করুন। যে দুটো ফ্ল্যাট পাবেন তার একটায় আরামে থাকবেন। ইচ্ছা করলে অন্যটা ভাড়া দিতে পারবেন। মিনিমাম সাত-আট হাজার টাকা ভাড়া পাবেন। ক্যাশ যা পাবেন সেটা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করলে মান্থলি দশ-বারো হাজার পেয়ে যাবেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকবে না। কত দিক থেকে লাভ, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো একটানা কথাগুলো বলে সে থামল।
খুব শান্ত মুখে মৃদুলা জিগ্যেস করল, আমাদের লাভের কথা ভেবেই তা হলে অফারটা দিতে এসেছেন?
একদৃষ্টে কিছুক্ষণ মৃদুলাকে লক্ষ্য করল সুরেশ্বর। তার মুখে অদ্ভুত ঠান্ডা হাসি ফুটে ওঠে, আমি প্রোমোটারি করি। ফিলানথ্রপিস্ট নই। আমারও কিছু লাভ থাকবে বইকি। নইলে পেট্রোল খরচা করে আপনাদের কাছে আসব কেন? মৃদুলার মুখ থেকে চোখ না সরিয়ে বলে যেতে লাগল, আমাদের মতো সাধারণ পার্থিব মানুষ দুটো পয়সার আশা থাকে বলেই না চারদিকে ছুটে বেড়ায়?