আজ কোথায় গিয়েছিল, শিঞ্জিনীকে বিমলেশ কতটা ভালোবাসেন-এমনি নানা গল্প ফঁদতে যাচ্ছিল মৃদুলা, কিন্তু বাধা পড়ল।
শিঞ্জিনী হঠাৎ জিগ্যেস করল, সুরেশ্বর ভৌমিক বলে তুমি কাউকে চেনো?
যা বলতে যাচ্ছিল তা আর বলা হল না। কপাল কুঁচকে মৃদুলা জিগ্যেস করল, কে সুরেশ্বর ভৌমিক? কী করে?
নামটাই শুধু জেনেছি। কী করে বলতে পারব না। আজ এগারোটা-সাড়ে এগারোটায় ফোন করে তোমার খোঁজ করছিল।
কেন?
তা জানায়নি। কাল নটায় সে আসবে। তোমাকে বাড়িতে থাকতে বলেছে।
কে একটা উটকো লোক বলেছে বলে আমাকে থাকতে হবে? কাল আমার অন্য কাজ আছে। সকালে বেরুতে হবে। আমি লোকটার আর্দালি নাকি যে কঁঝিয়ে উঠতে গিয়ে থমকে গেল মৃদুলা। লহমায় চেহারাই পালটে গেল তার। মুখটা ফ্যাকাসে। কেমন যেন ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত।
মায়ের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল শিঞ্জিনী। ব্ৰস্তভাবে জিগ্যেস করে, কী হল মা?
ভয়ার্ত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না মৃদুলা। কাঁপা গলায় বলল, এই সুরেশ্বর ভৌমিক নিশ্চয়ই প্রোমোটার। ভীষণ নোটোরিয়াস
কী জন্যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, বুঝতে পারছ?
না-আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে মৃদুলা।
.
০৯.
পরদিন সকালে বেরুতে সাহস হয়নি মৃদুলার। বাড়িতেই থেকে গেল।
রোজ ভোরে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে পড়তে বসে শিঞ্জিনী। আজ বইয়ে মন বসাতে পারছিল না। বারবার পড়ার টেবল থেকে উঠে মায়ের কাছে চলে আসছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলার টেনশন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আর সেটা শিঞ্জিনীর মধ্যেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।
কাঁটায় কাটায় নটায় এয়ারকন্ডিশনড় মারুতি সুজুকিতে চেপে সুরেশ্বর ভৌমিক এসে গেল। মালতাঁকে বলা ছিল। সে সুরেশ্বরকে একতলার ড্রইংরুমে বসিয়ে ওপরে খবর দিয়ে গেল।
মৃদুলা একা ওইরকম একটা লোকের কাছে যাবে, এটা ভাবতে পারছিল না শিঞ্জিনী। সে তার সঙ্গে সঙ্গে চলল।
মৃদুলা বলল, তুই আসছিস কেন? পড়তে যা—
জেদের সুরে শিঞ্জিনী বলল, না, আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
মৃদুলা আর আপত্তি করল না। মেয়ে পাশে থাকায় খুব সম্ভব সে খানিকটা সাহস পাচ্ছে।
একতলায় বসার ঘরে চলে এল দুজনে। সুরেশ্বর একাই সেখানে বসে ছিল। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। ভারী, মজবুত চেহারা। চওড়া কাঁধ। চৌকো ধরনের মুখ। ভারী চোয়াল। থুতনিতে গভীর খাঁজ। গালের মাঝামাঝি পর্যন্ত জুলপি। কোকড়া চুলে পাক ধরেছে। চোখে নীলচে চশমা। পরনে দামি সাফারি স্যুট। বাঁ হাতের কবজিতে সোনার ব্যান্ডে নামকরা কোম্পানির ঘড়ি।
মৃদুলাদের দেখে উঠে দাঁড়াল সুরেশ্বর। বিগলিত সুরে বলল, আসুন আসুন– ভাবখানা এমন, যেন এ বাড়িটা তারই। সম্মানিত অতিথিদের সে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
মৃদুলা বলল, বসুন—
বশংবদ ভঙ্গিতে সুরেশ্বর বলল, না, না, আগে আপনারা।
নিঃশব্দে বসে পড়ল মৃদুলা। তার পাশে শিঞ্জিনী। মুখোমুখি সুরেশ্বরও বসল।
ঘরে ঢোকার পর সুরেশ্বরের দিক থেকে লহমার জন্য চোখ সরায়নি মৃদুলা। বাইরের দিকটা কঠিন আবরণে মুড়ে রাখলেও ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তার। সে কি ভয়ে? স্নায়বিক চাপে? মৃদুলা টের পাচ্ছিল, হৃৎস্পন্দন শতগুণ বেড়ে গেছে।
সুরেশ্বর হেসে হেসে জিগ্যেস করল, আমার নামটা কি আপনার মনে আছে?
নিশ্চয়ই আছে। আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।
সুরেশ্বর লঘু সুরে বলল, কুখ্যাত বলুন।
তার কথা যেন শুনতে পায়নি মৃদুলা। বলল, কাল রাতে বাড়ি ফিরে শুনলাম, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আজ আসবেন। কোনও দরকার আছে?
আছে বইকি। না হলে ফর নাথিং আপনাকে বিরক্ত করতে আসব কেন?
মৃদুলা এবার আর কিছু বলে না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
সুরেশ্বর বলল, আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে। শিঞ্জিনীকে দেখিয়ে বলে, মামণি ছেলেমানুষ, ওর সামনে
ইঙ্গিতটা ধরতে পারে মৃদুলা। বলে, আলোচনাটা ওর সামনেই হোক।
একটু ভেবে সুরেশ্বর বলল, বেশ। আপনি যখন তাই চাইছেন—
মৃদুলা উত্তর দিল না।
মনে মনে বক্তব্যটা গুছিয়ে নিয়ে সুরেশ্বর শুরু করল, দু-আড়াই বছর আগেই আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ আপনার বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাই আর করিনি।
মৃদুলা বলল, আমার বাবা এখনও বেড-রিডন। অতি কষ্টে উঠে বসতে পারেন মাত্র। না ধরলে বিছানা থেকে নামতে পারেন না।
জানি। আশা করি, উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সুরেশ্বর বলতে লাগল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। নিশ্চয়ই শুনেছেন আমি একজন প্রোমোটার। আপনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাতে তো বটেই, চারপাশের নানা এরিয়ায় আমি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটা হাই রাইজ তুলেছি। বেশ কয়েকটার কাজ চলছে। অনেকগুলো প্রাইমারি স্টেজে রয়েছে। যেমন ধরুন, যে সব জায়গায় বাড়ি উঠবে সেই জমিগুলোর মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি, কারও কারও সঙ্গে ডিডস হয়ে গেছে, বেশ কটার প্ল্যান কর্পোরেশনে জমা দিয়েছি।
ও।
একটু চুপচাপ।
তারপর সুরেশ্বর আচমকা জিগ্যেস করে, আপনাদের এই বাড়িটা তো সাড়ে সাত কাঠা জায়গার ওপর।
সঠিক মাপই বলেছে সুরেশ্বর। রীতিমতো চমকে ওঠে মৃদুলা। এমন নির্ভুল তথ্য কোত্থেকে যোগাড় করল সুরেশ্বর?
মৃদুলা পুরোপুরি স্বীকার করল না, হয়তো হবে। কেন বলুন তো?
এখানে রাস্তা বেশ চওড়া। কর্পোরেশন চোখ বুজে এই ল্যান্ডে সাততলা বিল্ডিংয়ের প্ল্যান পাস করে দেবে।