কণ্ঠস্বরটা অচেনা। আগে আর কখনও শুনেছে কি? শিঞ্জিনী মনে করতে পারল না। আসলে খুব কম লোকজনই এ বাড়িতে ফোন করে। যারা করে তাদের গলা ভালো করেই সে চেনে। বেশ অবাক হয়েই বলল, হ্যাঁ।
লোকটা বলল, গলা শুনে মনে হচ্ছে তোমার বয়স কম। তুমি কি মৃদুলাদেবীর মেয়ে?
বিস্ময়টা সহস্র গুণ বেড়ে যায় শিঞ্জিনীর। অপরিচিত লোকটা তার মাকে তো চেনেই, গলা শুনেই আন্দাজ করে নিয়েছে সে অল্পবয়সি মেয়ে এবং মৃদুলা তার মা। এ বাড়িতে মৃদুলা আর সে ছাড়া অন্য কোনও মহিলা বা কম বয়সের মেয়ে যে নেই, সেটা তার জানা।
শিঞ্জিনী বলল, হ্যাঁ কিন্তু আপনি কে বলছেন?
উত্তর না দিয়ে লোকটা বলল, তোমার দাদু এখন কেমন আছেন? মাঝখানে তো ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন
দেখা যাচ্ছে, লোকটা এ বাড়ির নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখে। শিঞ্জিনী বলল, আগের থেকে অনেকটা ভালো। কিন্তু আপনার পরিচয় এখনও জানতে পারিনি।
পারবে, পারবে। তাড়া কীসের?
ইন্দ্রনাথ তিন-চারটে বালিশের ওপর মাথা রেখে আধশোওয়া মতো হয়ে ছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। চাপা, নীচু গলায় বললেন, কার সঙ্গে এত কথা বলছ?
হাতের ইশারায় ইন্দ্রনাথকে থামিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী লোকটাকে বলল, আপনি কি দাদুর সঙ্গে কথা বলতে চান?
লোকটা বলল, না। শুনেছি, তিনি বেড রিডন। তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আমি মৃদুলা দেবীর সঙ্গে কথা বলব।
কিন্তু মা তো এখন অফিসে।
আমার ধারণা ছিল উইকে পাঁচ দিন ওঁর অফিস। শনি-রবি ছুটি।
একটু চুপচাপ।
তারপর লোকটা বলল, ঠিক আছে, মাকে বোলো কাল সকাল নটায় তোমাদের বাড়ি আসব। মৃদুলাদেবীর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
শিঞ্জিনী বলল, মা ওই সময় বাড়িতে থাকবে কিনা, আমার জানা নেই। বাইরে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকতে পারে।
যে অ্যাপয়েন্টমেন্টই থাক, ক্যানসেল করতে বলবে। এবার পরিচয়টা দেওয়া যাক। আমার নাম সুরেশ্বর ভৌমিক। আবার বলছি, কাল ঠিক নটায় আসব। এতক্ষণ ভারী গলায় কথা বললেও সুরটা ছিল নরম। এবার তার স্বরে হুকুমের মতো কিছু একটা ফুটে বেরুল।
শিঞ্জিনী কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই খুট করে শব্দ হল। সুরেশ্বর ওধার থেকে লাইন কেটে দিয়েছে।
নাতনির দিকে তাকিয়ে ছিলেন ইন্দ্রনাথ। পলকহীন। শিঞ্জিনী টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই তিনি বললেন, কে ফোন করেছে দিদিভাই?
শিঞ্জিনী বলল, সুরেশ্বর ভৌমিক নামে একটা লোক
নামটা চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না। কী চায় সে?
তা কিছু বলেনি। কাল নটায় আসবে। মাকে বাড়িতে থাকতে বলল।
খুকুর সঙ্গে তার কী দরকার?
আমি কী করে বলব?
ইন্দ্রনাথ বিরক্ত হলেন, জিগ্যেস করবে তো?
শিঞ্জিনী বলল, করতে যাচ্ছিলাম। লোকটা সময় দিলে না। ফোন নামিয়ে রাখল। কিছুক্ষণ চুপচাপ।
কপাল কুঁচকে, চোখ আধবোজা করে কী ভাবতে লাগলেন ইন্দ্রনাথ। তারপর স্বগতোক্তির টংয়ে বললেন, কে হতে পারে লোকটা? কে?
ইন্দ্রনাথ যে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন, বোঝা যাচ্ছে। অচেনা একটা লোক আচমকা ফোন করে অসুস্থ, শয্যাশায়ী মানুষটার শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে। শিঞ্জিনী কী করবে, ভেবে পেল না।
অনেকক্ষণ পর ইন্দ্রনাথ নাতনিকে বললেন, কাল আসুক, তখন লোকটার মতলব বোঝা যাবে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। যাও চান-টান করে খেয়ে নাও
শিঞ্জিনী উঠে পড়ল।
.
অন্যদিনের মতো আজও রাত করে বাড়ি ফিরল মৃদুলা। অফিস ছুটির পর কার সঙ্গে এতটা সময় কাটিয়ে এসেছে, শিঞ্জিনীর এখন আর অজানা নেই।
সন্ধের পর মালতী রুটি আলুর দম, বেগুনভাজা, অড়হর ডাল করে টেবলে গুছিয়ে রেখে গেছে। একটা বড় কাঁচের প্লেটে কটা বড় রাজভোগ ঢাকা দিয়ে রেখেছে। রাতে সন্দেশ, রাজভোগ বা পান্তুয়া, যা-ই হোক না, কোনও একটা মিষ্টি শিঞ্জিনীদের চাই-ই। শেষ পাতে মিষ্টি না থাকলে রাতের খাওয়াটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
রাতে বাড়ি ফিরে দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে বাইরের পোশাক পালটিয়ে মেয়েকে নিয়ে খেতে বসে যায় মৃদুলা। আজও তার হেরফের হল না।
সেদিন পার্ক স্ট্রিটে বিমলেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার পর থেকে প্রায় রোজ রাতেই খাওয়ার টেবলে বসে সতর্কভাবে শিঞ্জিনীকে লক্ষ্য করতে করতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা প্রশ্ন করে সে, বিমলেশ আমাদের বাড়ি আসতে চাইছে। তুই কি এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?
কোনওদিন জবাবটা এড়িয়ে গেছে শিঞ্জিনী। কোনওদিন বলেছে, আমাকে আরেকটু ভাবতে দাও। আসলে এর মধ্যেই সে মাকে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। তার ভয়, বাকিটুকুও তার হাতে থাকবে না। বিমলেশ বসুমল্লিককে তার খারাপ লাগেনি। সুন্দর কথা বলেন। চমৎকার ব্যবহার। ঘণ্টা দেড়েকের মতো একসঙ্গে কাটিয়েছিল। এই অল্প সময়ের ভেতর তাকে বেশ স্নেহপ্রবণ মনে হয়েছে। তার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীলও। সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে, তার মতামত ছাড়া মায়ের ব্যাপারে তিনি এগুতে চান না। সবই ঠিক, কিন্তু মৃদুলার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবার পর ওপরকার মায়াবী খোলসের ভেতর থেকে বিমলেশের অন্য কোনও ভয়ঙ্কর স্বরূপ বেরিয়ে পড়বে কিনা, সে সম্বন্ধে শিঞ্জিনীর মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মাকে পুরোপুরি হারালে সে বাঁচবে না।
খেতে খেতে টুকরো টুকরো কথা হচ্ছিল। ছুটির পর বিমলেশের সঙ্গে যে খানিকটা সময় কাটায়, আজকাল আর তা গোপন করে না মৃদুলা। বিমলেশের সঙ্গে শিঞ্জিনীর আলাপ হবার পর লুকোচুরির আর দরকার নেই।