ইঙ্গিতটা হয়তো বুঝতে পেরেছে মৃদুলা। সে হকচকিয়ে গেল, আমাকে দেখে কি রেস্টলেস মনে হচ্ছে?
উত্তর না দিয়ে ছুরি দিয়ে প্রন কাটলেট কেটে টুকরো করতে লাগলেন বিমলেশ।
.
লাঞ্চ শেষ হলে বিমলেশ তার গাড়িতে সল্টলেকে চলে গেছেন। আগে দু-একবার মৃদুলাকে বাড়ি পর্যন্ত লিফট দিতে চেয়েছেন তিনি। মৃদুলা রাজি হয়নি। তাদের এলাকায় কখন কার চোখে পড়ে যাবে, ইন্দ্রনাথের কানে খবরটা পৌঁছুবে। সব মিলিয়ে অশান্তি। স্ক্যান্ডল। এসব আদৌ পছন্দ নয় মৃদুলার। ফিরতে দেরি হলে সে ট্যাক্সি নেয়। তাছাড়া মিনিবাস-টাস তো আছেন।
শিঞ্জিনীকে নিয়ে ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরছিল মৃদুলা। পার্ক স্ট্রিটে যাবার সময় যেমন, এখনও ঠিক তেমনি দুই জানালার পাশে দু-জনে বসে আছে।
ভবানীপুর পর্যন্ত কেউ একটি কথাও বলেনি। তারপর হঠাৎ মৃদুলা ডাকল, রূপা—
শিঞ্জিনী মায়ের দিকে তাকাল।
মৃদুলা বলল, বিমলেশকে কেমন লাগল?
শিঞ্জিনী বলল, শিক্ষিত কালচার্ড মানুষ। সুন্দর কথা বলেন–
মৃদুলা যে প্রশ্নটা করেছে তার দুটো জবাব হতে পারে। ভালো বা মন্দ। কিন্তু শিঞ্জিনী তার ধার দিয়ে যায়নি।
উতলা ভাবটা কিছুতেই কাটছে না মৃদুলার। বিমলেশের সঙ্গে কী কথা হল, সবিস্তারে না জানা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। এ এমন এক বিষয়, মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে সঙ্কোচ হয়। শিঞ্জিনী যে বিমলেশের সঙ্গে বেয়াড়াপনা করেছে কিংবা তার ওপর খেপে উঠেছে, বিমলেশের কথায় তার এতটুকু আভাস পাওয়া যায়নি। শিঞ্জিনী প্রায় চুপচাপ ছিল ঠিকই, তবে খাবার টেবলে তাকে বিমর্ষ, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিত, কিছুই মনে হয়নি। বরং মহার্ঘ খাদ্যবস্তুগুলো সে বেশ তৃপ্তি করেই খেয়েছে।
মৃদুলা মনে মনে কৌশল ঠিক করে নেয়। সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে অন্যভাবে তাকে সব জেনে নিতে হবে। কাল অফিসে গিয়ে কিংবা আজই শিঞ্জিনীকে বাড়িতে রেখে কোনও একটা ছুতো করে বাইরে বেরিয়ে প্রাইভেট টেলিফোন বুথ থেকে বিমলেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। লহমায় সে সব জেনে যাবে। কিন্তু তার তর সইছিল না।
মদুলা জিগ্যেস করল, বিমলেশ তোকে কী বলল?
এক পলক মাকে দেখে নিল শিঞ্জিনী। ভারি সরল মুখ। তার প্রশ্নটার মধ্যে যেন কোনওরকম অভিসন্ধি বা উদ্দেশ্য নেই। নেহাতই শিশুসুলভ অপার কৌতূহল।
মায়ের চাতুরি ধরে ফেলেছে শিঞ্জিনী। কিন্তু নিজে সে ধরা দিল না। বলল, কী আর বলবেন? আমার পড়াশোনা কেমন চলেছে, পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হল, দাদুর শরীর কেমন যাচ্ছে–এই সব।
এতক্ষণে সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে উঠল মৃদুলা, আর কিছু বলেনি?
হ্যাঁ। খুব শান্ত গলায় জবাব দেয় শিঞ্জিনী।
শ্বাস-আটকানো, চাপা স্বরে মৃদুলা জিগ্যেস করে, কী বলেছে?
কী বলতে পারেন, সেটা কি তুমি জানো না? সোজা মায়ের চোখের দিকে তাকায় শিঞ্জিনী।
মৃদুলা চমকে ওঠে। কিছু একটা উত্তর দিতে চায়, কিন্তু গলায় স্বর ফোটে না।
একটু চুপচাপ।
শিঞ্জিনী মায়ের চোখ থেকে চোখ সরায়নি। এবার বলল, মিস্টার বসুমল্লিক দাদুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমার পারমিশান চাইছিলেন–
তুই কী বললি?
মায়ের প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি শিঞ্জিনী। সে বলল, মিস্টার বসুমল্লিক তোমাকে তখন কী বলেছেন, মনে আছে?
মৃদুলা বলল, কী বলেছে?
ধৈর্য ধরতে।
মেয়ের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, মোটামুটি আন্দাজ করে নিল মৃদুলা। সে আর কিছু জিগ্যেস করল না।
.
০৮.
মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের পর ইন্দ্রনাথের কাছে এসে দিনগুলো মোটামুটি একই নিয়মে কেটে যাচ্ছিল। জীবনের আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতির মধ্যে বিশেষ হেরফের ঘটেনি। বড় হবার পর রাস্তায় বেরুলে লোকজনের নোংরা চোখের দৃষ্টি তীরের মতো গায়ে এসে বিধত। প্রথম প্রথম ভীষণ অস্বস্তি হত। পরে সয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণালীদের বাড়ি ছাড়া অন্য বন্ধুদের বাড়ি গেলে তাদের কাকা-দাদারা আদর করার ছলে যা করত তাতে শরীর কুঁকড়ে যেত। ফলে তাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিল।
হঠাৎ কদিন হল দুদিক থেকে দুটো সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক দিকে রজত, অন্যদিকে বিমলেশ। রজত কথা দিয়েছে, আপাতত হোস্টেল থেকে আসছে না, শিঞ্জিনীর পড়া শোনায় যাতে বিঘ্ন না হয় সেটা মনে রাখবে। বিমলেশ জানিয়েছেন, তার অনুমতি ছাড়া মায়ের ব্যাপারে এগুবে না। কিন্তু মৌখিক এই প্রতিশ্রুতি কতটা বিশ্বাস করা যায়?
পরীক্ষার বেশিদিন দেরি নেই। প্রাণপণে ওই সব উটকো দুশ্চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিয়ে পড়ায় মন বসাতে চাইছে শিঞ্জিনী। রেজাল্ট তাকে ভালো করতেই হবে।
.
আজ অন্যদিক থেকে নতুন এক সংকট দেখা দিল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।
শনি ও রবি সপ্তাহের এই দুদিন শিঞ্জিনীদের স্কুল ছুটি থাকে।
আজ শনিবার। পড়া শেষ করে ইন্দ্রনাথের ঘরে এসে তার সঙ্গে গল্প করছিল শিঞ্জিনী। সারাদিন একা একা শুয়ে থাকেন। সঙ্গ দেবার লোক নেই। লেখাপড়ার ফাঁকে সময় পেলেই দাদুর কাছে এসে বসে সে।
শনিবার মৃদুলার হাফ-ডে অফিস। সে বাড়ি নেই। এখন এগারোটার মতো বাজে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল।
ইন্দ্রনাথ বললেন, দেখ তো দিদি-
ফোনটা তুলে শিঞ্জিনী বলল, কাকে চাইছেন? শিঞ্জিনীদের টেলিফোন নাম্বারটা বলে ওধার থেকে কেউ ভারী গলায় জানতে চায়, নাম্বারটা সঠিক কিনা।