বিমলেশ আস্তে মাথা নাড়লেন, খুব সঙ্গত প্রশ্ন। উত্তরটা হল, হিসেব কষে তো সব কিছু হয় না। হৃদয় একটা ভীষণ জটিল ব্যাপার রূপা। কার যে কাকে ভালো লেগে যায় সেটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল।
আমার সেকেন্ড প্রশ্ন হল, আমার মাকে না হয় আপনার ভালো লেগেছে। তার সঙ্গে আমায় জড়াচ্ছেন কেন?
তুমি কি জানো, তোমার মায়ের জীবনে তুমি কতখানি অংশ জুড়ে আছ?
কথাটা ঠিক বুঝলাম না।
মৃদুলার সঙ্গে আলাপের পর থেকে একটা কথাই সে বারবার জানিয়েছে, তোমাকে ছাড়া তার জীবন ইনকমপ্লিট। তোমাকে বাদ দিয়ে সে কিছুই ভাবতে পারে না।
মায়ের জন্যেই তা হলে আপনার কাছে আমার এত ইমপর্টান্স?
তোমার জন্যেই তোমার ইমপর্টান্স। আমি একটা মেয়ে পেয়ে যাব। সেটা কি মস্ত প্রাপ্তি নয়?
যেভাবে বিমলেশ তাকে ভজাতে চাইছেন তাতে মনে হয়, লোকটা যথেষ্ট আন্তরিক কিংবা অত্যন্ত চতুর। কোনটা যে ঠিক, নিশ্চিতভাবে ধরা যাচ্ছে না। শিঞ্জিনী নিজের স্নায়ুমণ্ডলীকে সজাগ রেখে বলে, আমার থার্ড প্রশ্নটা হল, আপনি তো জানেন আমাদের মাথার ওপর দাদু আছেন?
বিমলেশ বললেন, নিশ্চয়ই জানি।
আমাকে এখানে ডাকিয়ে না এনে তার সঙ্গেই ত আপনার কথা বলা উচিত ছিল। কেননা, আমার মা তারই মেয়ে।
নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু সবার আগে যা চাই সেটা হল তোমার অনুমতি। যেদিন পারমিশন দেবে সেদিনই তোমার দাদুর সঙ্গে দেখা করব।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর শিঞ্জিনী বলল, আমার সম্বন্ধে আপনি কতটা জানেন?
বিমলেশ বললেন, তোমার মায়ের মুখে যা শুনেছি, ততটুকুই। হঠাৎ এ প্রশ্ন?
মা কি বলেছে দু-একটা একসেপশন বাদে আমি পুরুষমানুষদের বিশ্বাস করি না, ভীষণ ঘৃণা করি?
বলেছে। অবিশ্বাস আর ঘৃণা করাটাই তোমার পক্ষে স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক কেন?
বিমলেশের ব্যাখ্যাটা এইরকম। জন্মের পর থেকে শিঞ্জিনী তার বাবার যে কুৎসিত চেহারাটা দেখেছে সেটা তার মনে চিরস্থায়ী, ভীতিকর ছাপ রেখে গেছে। তার ধারণা, সব পুরুষই এক ধাঁচের। লম্পট। নোংরা। বদমাশ।
বিমলেশ বললেন, কি, আমি ঠিক বললাম?
অর্থাৎ অনির্বাণ সম্পর্কে মৃদুলার কাছে সব শুনেছেন বিমলেশ। উত্তর না দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আমার দাদু আর দেবকুমার আঙ্কল ছাড়া অন্য কারও সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধা নেই।
দেবকুমার আঙ্কল কে?
আমার বন্ধুর বাবা।
বিমলেশ হাসতে হাসতে বললেন, যে দুজন একসেপশনের কথা বললে, মানে তোমার দাদু আর আঙ্কল, তাদের জায়গায় পৌঁছুতে আমার কতদিন লাগবে?
আজই তো সবে আপনাকে দেখলাম। একদিনেই আপনার এই প্রশ্নের উত্তর চান? বিমলেশের চোখের দিকে চোখ রেখে পালটা প্রশ্ন করে শিঞ্জিনী।
বিমলেশ বিব্রত বা অপ্রতিভ হননি। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে লাগলেন, ঠিক। বেশ কিছুদিন না দেখলে, না মিশলে তুমি বুঝবে কী করে, আমি মানুষটা কেমন? বেশ, আমি অপেক্ষা করতে রাজি।
লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং হলের একটা টেবলও এখন আর ফাঁকা নেই। স্টুয়ার্ড এবং বেয়ারারা ব্যস্তভাবে এ-টেবল সে-টেবলে ছোটাছুটি করছে। এই ধরনের দামি, অভিজাত রেস্তোরাঁয় কেউ চিৎকার করে কথা বলে না। যত নীচু গলায় বলুক, চারপাশ থেকে গুঞ্জন উঠে আসছিল।
এই সময় মৃদুলা ফিরে এল। শিঞ্জিনীর ডান পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে লহমায় দুজনকে একবার দেখে নিয়ে হাসিমুখে জিগ্যেস করল, কাজটা সেরে আসতে আসতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তা তোমাদের আলাপ-টালাপ কীরকম হল?
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।
বিমলেশ বললেন, ফাইন। শি ইজ আ নাইস ইয়াং লেডি। ভেরি স্ট্রেটফরোয়ার্ড। তুমি যা বলেছ, তার চেয়ে ওর পার্সোনালিটি অনেক বেশি।
শিঞ্জিনী সম্পর্কে একটি অপ্রিয় শব্দও উচ্চারণ করেননি বিমলেশ। বরং যা বলেছেন তার সবটাই প্রশংসা। তবু কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে মৃদুলার। নিজের মেয়েকে তার চেয়ে কে আর বেশি চেনে!
স্টুয়ার্ড টেবলের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ছোট নোট বই।
টেবলে সুদৃশ্য মেনু-কার্ড পড়ে ছিল। সেটা শিঞ্জিনীকে দিয়ে বিমলেশ জিগ্যেস করলেন, দেখে বলো, কী কী অর্ডার দেব?
কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার যা ভালো মনে হয় বলে দিন। তবে চিকেন ছাড়া আমি অন্য মাংস খাই না—
ও কে মৃদুলার সঙ্গে পরামর্শ করে অর্ডার দিলেন বিমলেশ। পোলাও ক্রিম-ভেটকি, প্রন কাটলেট, স্যালাড এবং আইসক্রিম। নোটবুকে টুকে নিয়ে চলে গেল স্টুয়ার্ড।
যান্ত্রিক নিয়মে কিছুক্ষণের ভেতর টেবলে লোভনীয় খাদ্যগুলো পৌঁছে গেল। খেতে খেতে নানারকম গল্প হতে লাগল। এলোমেলো, পারম্পর্যহীন। যে কারণে এই রেস্তোরাঁয় আসা, সে সম্বন্ধে কিন্তু একটি কথাও নয়।
মৃদুলা খাচ্ছে ঠিকই, তবে ভেতরে ভেতরে বেশ উতলা হয়ে আছে।
তার অনুপস্থিতিতে ওদের দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছে, জানার জন্য ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে। বাইরে অবশ্য তার কোনও প্রকাশ নেই।
শিঞ্জিনী এমন বালিকা নয় যে মায়ের মনোভাব বুঝতে পারছে না। সে কিন্তু ওদিক দিয়েই গেল না। প্রায় নিঃশব্দে খেতে লাগল।
উলটো দিকের টেবলে বসে প্লেট থেকে মাঝে মাঝে মুখ তুলে মৃদুলাকে লক্ষ্য করছেন বিমলেশ। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। দুই চোখ কৌতুকে চিক চিক করছে। মৃদুলার মনের গতিক তিনিও আঁচ করে নিয়েছেন। বললেন, ডোন্ট বি রেস্টলেস। পৃথিবীতে সব কিছুই সুলভ নয়। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।