বিমলেশ বললেন, এটা কি তোমার মা বলেছে, আমি একজন দুঃখী, নিঃসঙ্গ মানুষ।
কী চায় লোকটা? তার সহানুভূতি? কিন্তু কেন? শিঞ্জিনী বলল, বলে থাকতে পারে। মনে পড়ছে না।
বিমলেশ বললেন, তোমাদের কথাও শুনেছি। দুজনে অনেক দুঃখ পেয়েছ।
পৃথিবীতে বদ, লম্পট স্বামীর জন্যে অনেক ম্যারেড লাইফ ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও হবে। এই টাইপের পুরুষদের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা দুঃখই পেয়ে থাকে। আমরাও পেয়েছি। তার মধ্যেই বেঁচে থাকতে চেষ্টা করছি।
গুড। দ্যাট শুড বি দা স্পিরিট।
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।
বিমলেশ বললেন, আমার একটা কথা বিশ্বাস করবে রূপা?
শিঞ্জিনী একটু অবাক হল। বিমলেশের দিকে সতর্ক চোখ রেখে বলল, কী কথা?
হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন বিমলেশ, আমি তোমাদের সুখী করতে চাই রেস্তোরাঁর মৃদু আলোয় তার গলার স্বর কাঁপতে লাগল।
শিঞ্জিনী ইঙ্গিতটা মোটামুটি ধরতে পারছিল। তবু ঈষৎ রূঢ় গলায় জিগ্যেস করল, ওয়ার্ল্ডে দুঃখী মানুষের অভাব নেই। কিন্তু বেছে বেছে আমাদের সুখী করার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেন?
এমন মেয়ে আগে কখনও দেখেননি বিমলেশ। কত আর বয়স! মৃদুলার কাছে শুনেছেন, মাস তিনেক আগে সতেরো পেরিয়েছে। এই ধরনের সদ্যতরুণীরা বয়স্ক লোকেদের কাছে নিজেদের অনেকখানি গুটিয়ে রাখে। সঙ্কোচে। লজ্জায়। বিশেষ করে সবেমাত্র পরিচয় হয়েছে, এমন কারও সামনে। কিন্তু শিঞ্জিনী অন্য ধাতুতে তৈরি। সে যেন অস্ত্র উঁচিয়েই রেখেছে।
শিঞ্জিনীর প্রশ্নটা নিছক প্রশ্ন নয়। এর মধ্যে লুকনো রয়েছে তীব্র আক্রমণ। প্রস্তুত ছিলেন না বিমলেশ। মনে মনে তিন পা পিছিয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে দ্রুত রণ-কৌশলটা ভেবে নিলেন। তরল আবেগের ঢল নামিয়ে এই মেয়েকে ভাসিয়ে নেওয়া যাবে না। যা বলার সোজাসুজিই বলতে হবে।
বিমলেশ বললেন, তুমি বড় হয়েছ। তোমাকে কথাটা বলা যেতে পারে। হয়তো শুনেছ, আমাদের তৈরি বহু প্রোডাক্ট তোমার মায়ের ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ইন্ডিয়ার নানা সিটিতে পাঠায়। এই সূত্রেই তার সঙ্গে আলাপ। তারপর কখন যে আমাদের ভেতর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, বুঝতে পারিনি। বুঝতেই পারছ, সম্পর্কটা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি।
শিঞ্জিনী কিছু বলে না। পলকহীন তাকিয়ে থাকে।
বিমলেশ থামেননি, আমার ইচ্ছা এই সম্পর্কটা পার্মানেন্ট হোক।
শিঞ্জিনী এবারও জবাব দেয় না।
বিমলেশ ব্যগ্রভাবে বললেন, চুপ করে আছ কেন?
শিঞ্জিনীর চারপাশের সৌরলোক দুলতে শুরু করেছিল। বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ি পেটার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল সে। মনে হচ্ছিল, সব আলো নিভে গেছে, বাতাস আর বইছে না।
নিজেকে ধাতস্থ করতে খানিকটা সময় লাগল শিঞ্জিনীর। বিমলেশের সঙ্গে আজকের এই সাক্ষাৎকার নিতান্ত আলাপ-পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সেটা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। কিন্তু ওঁরা যে এতদূর এগিয়েছেন, এবং সেটা তাকে জানানোর জন্য এই রেস্তোরাঁয় টেনে আনা হয়েছে তা ভাবতে পারেনি শিঞ্জিনী।
ব্যাপারটা এমনই অতর্কিত যে প্রথমটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সে। এবার খুব ঠান্ডা গলায় বলল, আপনার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছিলাম।
বিমলেশ বললেন, আমি যা চাই, তোমাকে বোঝাতে পেরেছি?
নিশ্চয়ই পেরেছেন। কিন্তু
বলো—
আমার মা-ও কি তা-ই চায়?
নিশ্চয়ই।
শিঞ্জিনী বলতে লাগল, আমার মা পুরুষদের ঘৃণা করত। তার কাছে পুরুষমানুষ মাত্রেই স্কাউন্ডেল। আপনি যে তার ধারণা পালটে দিতে পেরেছেন, সেটা বিরাট অ্যাচিভমেন্ট।
মেয়েটার কথায় কি শ্লেষ মেশানো রয়েছে? ঠিক বোঝা গেল না। ব্যাপারটা গায়ে মাখলেন না বিমলেশ। হেসে হেসে বললেন, তা বলতে পারো।
একটু নীরবতা।
তারপর বিমলেশ বললেন, কী, তুমি তো কিছুই বললে না?
শিঞ্জিনী বলল, আপনারা ডিসিশন নিয়েছেন। ফর্মালি আমাকে শুধু জানালেন। এ নিয়ে আমার কী বলার থাকতে পারে?
বিমলেশ সচকিত। বললেন, কে বললে, আমরা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি? আমরা কী চাই, সেটা শুধু বলেছি। এখন সব কিছুই তোমার ওপর নির্ভর করছে।
মানে?
তোমার পারমিশান পেলে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা এগুতে পারি।
তীক্ষ্ম গলায় শিঞ্জিনী বলে, যে স্টেজে আপনারা পৌঁছেছেন, সেখানে আমার পারমিশানের কি কোনও দরকার আছে?
বিমলেশ বললেন, সেটাই সবচেয়ে বেশি আর্জেন্ট। তা না হলে অনেক আগেই তো আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে চলে যেতে পারতাম। আসলে
আসলে কী?
তুমি কি বুঝতে পারছ না, মৃদুলাকেই শুধু নয়, আমি তোমাকে চাই মা–
ভদ্রলোক কথা বলেন চমৎকার। এবার কণ্ঠস্বরে আরও বেশি করে আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। তবে তিনি কতটা আন্তরিক বোঝা যাচ্ছে না। শিঞ্জিনী চুপ করে রইল।
বিমলেশ বলতে লাগলেন, তুমি যতদিন না রাজি হচ্ছ, আমরা কোনও সিদ্ধান্ত নেব না। ব্যাপারটা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেইখানেই আটকে থাকবে।
বিমলেশের চোখের দিকে তাকিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার কাছে কটা প্রশ্ন আছে।
সোজা হয়ে বসলেন বিমলেশ, কী প্রশ্ন?
শিঞ্জিনী বলল, আপনি এত বড় একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। প্রচুর টাকা আপনার ইচ্ছা করলে আপনাদের লেভেলের বিরাট কোনও ফ্যামিলির ভার্জিন মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। তা না করে আমার মায়ের মতো একজন ডিভোর্সিকে পছন্দ করলেন কেন? যার আবার আঠারো বছরের একটি মেয়ে আছে–