হলঘরের শেষ মাথায় চৌকো পিলারের পাশে একটা টেবলে যিনি একা বসে ছিলেন, সোজা তার কাছে শিঞ্জিনীকে সঙ্গে করে চলে এল মৃদুলা।
আগে এঁকে না দেখলেও স্বর্ণালীর নিখুঁত বর্ণনাটা মস্তিষ্কের কোনও অদৃশ্য কম্পিউটারে ধরা ছিল। হুবহু সেই চেহারা। পরনে দামি ট্রাউজার্স আর শার্ট। চওড়া কবজিতে নামকরা কোম্পানির চৌকো ঘড়ি। শিঞ্জিনী শুনেছে, সফল মানুষদের চোখে-মুখে আলাদা দ্যুতি থাকে। এই মানুষটিকে ঘিরে তেমনই উজ্জ্বলতা।
বিমলেশ শিঞ্জিনীদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মৃদুলা বলল, আগে পরিচয় করিয়ে দিই।
বিমলেশ হাত তুলে মৃদুলাকে থামিয়ে দিতে দিতে বললেন, কিচ্ছু করাতে হবে না। ওটা আমরা নিজেরাই করে নিচ্ছি। হাসিমুখে শিঞ্জিনীকে বললেন, ইউ মাস্ট বি শিঞ্জিনী-মানে রূপা। আমি বিমলেশ। আশা করি, আমার নামটা মায়ের মুখে শুনেছ।
নিজের মধ্যে কাঠিন্য অনুভব করল শিঞ্জিনী! একদৃষ্টে বিমলেশকে লক্ষ্য করতে লাগল সে। কোনও উত্তর দিল না।
বিমলেশের হঠাৎ যেন খেয়াল হল, শিঞ্জিনীরা দাঁড়িয়ে আছে। শশব্যস্ত বললেন, বসো-বসো-প্লিজ শিঞ্জিনীর হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে নিজে তার মুখোমুখি বসলেন।
একেকটা টেবল ঘিরে চারটে করে চেয়ার। মৃদুলা কিন্তু বসল না। বলল, পরিচয় তো হয়েই গেছে। আমি কাছেই একটা কাজ সেরে আসি। ম্যাক্সিমাম হাফ অ্যান আওয়ার।
শিঞ্জিনী বুঝতে পারল, বিমলেশ যখন তার সঙ্গে কথা বলবে, মৃদুলা তখন কাছে থাকতে চায় না। মায়ের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে সে। মৃদুলা তার কাঁধে হালকা একটু চাপ দিয়ে মৃদু হাসে। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়, কোনও ভয় নেই। ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একতলার সিঁড়ির দিকে চলে যায় সে।
যতক্ষণ মাকে দেখা যায়, তাকিয়ে থাকে শিঞ্জিনী। মৃদুলা একতলায় নেমে গেলে বিমলেশের দিকে সে চোখ ফেরায়। সদ্যপরিচিত একটি লোকের সামনে সে এখন একেবারে একা। শিরদাঁড়ায় অদ্ভুত এক শিহরন খেতে গেল তার। সেটা কি ভয়ে? তীব্র অস্বস্তিতে? অনুভূতিটা যে ঠিক কী, শিঞ্জিনী বুঝিয়ে বলতে পারবে না। কয়েক লহমা মাত্র। তারপরেই নিজেকে দৃঢ় করে নিল। নিজের অজান্তেই বুঝিবা এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সে।
বিমলেশ বললেন, লাঞ্চের এখনও দেরি আছে। কী খাবে বলো। কফি? সফট ড্রিংক?
শিঞ্জিনী বলল, কিছু দরকার নেই।
তাই কখনও হয়? বিমলেশ একটা বেয়ারাকে ডেকে সফট ড্রিংক নিয়ে আসতে বললেন।
মুহূর্তে নকশা-করা কাঁচের গেলাসে ঠান্ডা পানীয় এসে গেল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা গেলাস তুলে নিল শিঞ্জিনী।
বিমলেশ গল্প শুরু করে দিলেন। প্রায় একতরফা। শিঞ্জিনীর পড়াশোনা কেমন চলছে, স্কুলের মিসরা কেমন পড়ান, হায়ার সেকেন্ডারিতে কত পারসেন্ট মার্ক সে আশা করছে, গ্র্যাজুয়েশনটা কোন কলেজ থেকে করতে চায়, কোন সাবজেক্টে অনার্স নেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
শিঞ্জিনী বুঝতে পারছিল, এসব ধানাইপানাই বকে জমি তৈরি করে নিচ্ছে বিমলেশ। আসল বক্তব্যটা কখন ঝুলি থেকে বেরুবে, সে জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে সে। নীরস গলায়, খুব সংক্ষেপে উত্তর দিতে লাগল সে।
লেখাপড়া ছেড়ে এবার শিঞ্জিনীর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে পড়লেন বিমলেশ। এখন ভীষণ পড়ার চাপ চলছে। শরীরের বিশেষ ভাবে যত্ন নেওয়া উচিত। তিনি মৃদুলাকে বলবেন, বড় ডাক্তারকে দিয়ে শিঞ্জিনীর জন্য একটা ডায়েট চার্ট যেন করিয়ে নেয়। এনার্জি বাড়ে এমন ট্যাবলেট বা টনিকেরও খুবই প্রয়োজন।
শিঞ্জিনীর পর ইন্দ্রনাথের অসুখ-বিসুখের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন বিমলেশ। তিনি কেমন আছেন, ঠিকমতো ওষুধ-টোষুধ খান কিনা, ফিজিওথেরাপিতে কতটা কাজ হচ্ছে, পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো এসব জানতে চাইলেন।
তাদের বাড়ির যাবতীয় খবরই যে বিমলেশ রাখেন, শিঞ্জিনী বুঝতে পারছিল। মৃদুলা ছাড়া আর কেই-বা এই সব খবরের সোর্স হতে পারে?
বিমলেশের আবোল-তাবোল বকা অসহ্য লাগছিল শিঞ্জিনীর। এক পলক ঘড়ি দেখে সে বলল, মা আধঘণ্টা সময় দিয়েছিল। চোদ্দ মিনিট কেটে গেছে। আমার সঙ্গে কেন আলাপ করতে চেয়েছেন, তা কিন্তু এখনও জানা হয়নি।
বিমলেশের মতো বয়স্ক, অভিজ্ঞ, সফল মানুষও সামান্য থতিয়ে গেলেন। একটু নার্ভাসও কি? তিনি যে শিঞ্জিনীদের কত বড় শুভার্থী, সাতকাহন ফেঁদে তা বোঝাবার পর আসল প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটার অন্য কোনও ব্যাপারেই আগ্রহ নেই। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বিমলেশ বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা তো বলতেই হবে।
সুস্বাদু, শীতল পানীয়ের গেলাসে দু-তিনটে হালকা চুমুক দিয়েছিল শিঞ্জিনী। এখন গেলাসটা হাতের ভেতর আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে চলেছে। বিমলেশের দিকে তাকিয়ে সে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল।
বিমলেশ বললেন, আমার সম্বন্ধে তোমার মায়ের কাছে নিশ্চয়ই সব শুনেছ?
শিঞ্জিনী বলল, সব নয়। খানিকটা। আপনি একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। বনেদি ফ্যামিলিতে জন্ম। প্রচুর টাকা আপনার। সল্টলেকে বিরাট বাড়ি। উইডোয়ার। ব্যস, এই পর্যন্ত।
মেয়েটার মধ্যে নরম ভাব কম। কথাবার্তা চঁছাছোলা। চোখেমুখে, আচরণে, কথা বলার ভঙ্গিতে ছুরির ফলার মতো কী যেন আছে। এর সামনে সারাক্ষণ সতর্ক না থাকলে মারাত্মক অস্বস্তিতে পড়তে হবে।