না, না, মাঝে মাঝে করলেই খুশি হব। শিঞ্জিনীর কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে বিপুল উৎসাহে হোস্টেলের ফোন নাম্বারটা লিখে দিল রজত।
কলম-টলম ব্যাগে পুরতে পুরতে ব্যস্তভাবে শিঞ্জিনী বলল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার কিন্তু আমাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। রজতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলন্ত একটা অটো থামিয়ে স্বর্ণালীকে ডেকে চোখের পলকে উঠে পড়ল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইল রজত।
অটো ফের ছুটতে শুরু করেছিল। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে, ঠোঁট টিপে মজাদার একটা ভঙ্গি করল স্বর্ণালী। তারপর শিঞ্জিনীর কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, দুজনে দারুণ জমে গিয়েছিলি।
তেরছা চোখে স্বর্ণালীকে দেখতে দেখতে রুক্ষ গলায় শিঞ্জিনী বলল, জমে গিয়েছিলাম। তোর তা-ই মনে হল।
বন্ধুকে নিয়ে একটু মজা করতে ইচ্ছা হয়েছিল স্বর্ণালীর। কিন্তু তার মেজাজ দেখে দমে গেল। জিগ্যেস করল, কী কথা হল তোদের?
সিটের ধার ঘেঁষে বসেছিল শিঞ্জিনী। কিছুক্ষণ চুপচাপ বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে সমস্ত বলে গেল।
স্বর্ণালী বলল, কিছু লুকোচ্ছিস না তো?
শিঞ্জিনী বলল, তোর কাছে আমি কিছু লুকোই?
স্বর্ণালী জবাব দিল না।
শিঞ্জিনী ফের বলে, আমাদের ফ্যামিলির সব কথা তোকে জানিয়েছি। পুরুষদের আমি ঘৃণা করি। আই হেট দেম।
স্বর্ণালী চমকে ওঠে, রজতকে এসব বলেছিস!
পাগল! আরও কটা মাস দেবারতি মিসের কাছে পড়তে হবে না? ছেলেকে খেপিয়ে দিলে মা কি আমাকে কোলে বসিয়ে আদর করে পোলাও-মাংস খাওয়াবে? এই খাবার দুটো শিঞ্জিনীর খুবই প্রিয়।
স্বর্ণালী বলল, ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করতে চাইছিস?
কখনও কখনও ট্যাক্টফুল তো হতেই হয়। হায়ার সেকেন্ডারিটা হয়ে যাক। আই শ্যাল টোটালি ফরগেট ইট।
.
০৭.
যেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর শিঞ্জিনীর ঘরে এসে মৃদুলা বিমলেশ বসুমল্লিকের কথা বলেছিল, তারপর দিন দশেক কেটে গেছে।
আজ রবিবার। ছুটির দিন।
কালই মৃদুলা জানিয়ে দিয়েছিল, আজ বিমলেশের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবে। এগারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে শিঞ্জিনীকে নিয়ে বেরুবে। সে যেন তার মধ্যেই তৈরি হয়ে নেয়। লাঞ্চের ব্যবস্থা বাইরে করা হয়েছে।
ইন্দ্রনাথকে বিমলেশের কথা ঘুণাক্ষরেও জানায়নি মৃদুলা। তাকে শুধু বলেছে, দুপুরে এক কলিগের বাড়িতে তার আর শিঞ্জিনীর নেমন্তন্ন। উপলক্ষ, সহকর্মীটির ছেলের পৈতে।
কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মৃদুলা। বাড়ির সামনে একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে যাওয়ায় সুবিধাই হল। নইলে মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে হত। কেননা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডটা ওখানেই।
গাড়িতে উঠে মৃদুলা ড্রাইভারকে বলল পার্ক স্ট্রিট চলুন—
রবিবার। তাই রাস্তা আজ প্রায় কঁকাই। ট্যাক্সি প্রায় ডানা মেলে উড়তে লাগল।
ব্যাক সিটের এক জানালার পাশে বসেছে মৃদুলা অন্য জানালার ধারে শিঞ্জিনী। মায়ের মুখে পার্ক স্ট্রিট শুনেই সে বুঝে গেছে ওখানেই কোথাও বিমলেশ তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ভদ্রলোক কেন তার সঙ্গে আলাপ করতে চান, কী বলবেন তিনি, কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বিতৃষ্ণা, বিরক্তি, সেই সঙ্গে অনেকখানি কৌতূহল। সব মিলেমিশে মনের ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে। অন্যমনস্কর মতো জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী।
তিন ফুট দুরত্বে বসে মৃদুলা মেয়েকে লক্ষ্য করছিল। লহমার জন্যও চোখ অন্য কোনও দিকে সরায়নি।
ট্যাক্সি দু-তিনটে রাস্তা ঘুরে এখন টালিগঞ্জ রেলব্রিজের কাছে চলে এসেছে। মৃদুলা শিঞ্জিনীর দিকে এগিয়ে এসে ঘন হয়ে বসল। কোমল স্বরে ডাকল, রূপা
সামান্য চমকে উঠে মুখ ফেরায় শিঞ্জিনী, কী বলছ?
খুব টেনশন হচ্ছে?
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।
মৃদুলা এবার বলল, বিমলেশ বসুমল্লিকের সঙ্গে আলাপ হলে বুঝবি, পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব বেশি হয় না।
এমন স্তুতিবাক্য আগেও মায়ের মুখে শুনেছে। শিঞ্জিনী চুপ করে থাকে।
মৃদুলা থামেনি, আমার কথা বিশ্বাস কর, ওঁকে দেখলে তোর খুব ভালো লাগবে। দেখবি তোকে কত স্নেহ করবেন। রিল্যাক্স
শিঞ্জিনীর এবারও জবাব নেই।
মৃদুলাও আর কিছু বলল না।
একসময় ট্যাক্সি পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা এয়ার-কন্ডিশড রেস্তোরাঁর সামনে আসতে মৃদুলা ড্রাইভারকে থামতে বলে। তারপর ভাড়া মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে চলে আসে।
এয়ার-কন্ডিশনড হওয়ায় ভেতরটা বেশ আরামদায়ক। নরম আলোয় চারদিক ভরে আছে।
রেস্তোরাঁটা দোতলা। এখানে বার নেই। শুধুই খাওয়ার ব্যবস্থা। একতলার বিশাল হলঘরে অসংখ্য টেবল পাতা। তার একপাশে ক্যাশ কাউন্টার।
এখনও লাঞ্চ টাইম শুরু হয়নি। অল্প কিছু লোকজন এধারে-ওধারে, নানা টেবলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে।
হলঘরটার মাঝখানে থেকে টাইলস-বসানো ঘোরানো সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে।
এ ধরনের দামি রেস্তোরাঁয় আগে কখনও আসেনি শিঞ্জিনী। তার অবাক এবং মুগ্ধ হবার কথা। কিন্তু কিছুই ভালো করে লক্ষ্য করছিল না সে। ভেতরে ভেতরে সেই টেনশনটা দ্রুত বেড়েই চলেছে। এই হলঘরে কোন লোকটা বিমলেশ বসুমল্লিক, কে জানে। মৃদুলা যথেষ্ট গুণকীর্তন করলেও আসলে তিনি ঠিক কেমন মানুষ?
মৃদুলা কিন্তু একতলার কোনও টেবলের সামনেই গেল না। সিঁড়ি দিয়ে মেয়েকে নিয়ে দোতলায় উঠে এল। এখানেও নীচের তলার মতোই মস্ত হল। তেমনই সারি সারি টেবল এবং চেয়ার পাতা। চারপাশ চমৎকার সাজানো। এখানেও ভিড়-টিড় নেই। নানা বয়সের কয়েক জোড়া পুরুষ এবং মহিলা কটা টেবলে বসে নীচু গলায় গল্প করছে। চার-পাঁচটা স্মার্ট চেহারার উর্দি-পরা বেয়ারা একধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। এই মুহূর্তে তাদের বিশেষ তাড়া নেই। এখন সমস্ত কিছুই ঢিলেঢালা, আলস্য-জড়ানো।