যতই উদাসীন থাকতে চেষ্টা করুক, ভেতরে ভেতরে স্নায়ুগুলো কিন্তু টান টান হয়েই আছে। নিজের অজান্তেই চোরা দৃষ্টিতে এধারে-ওধারে তাকাল শিঞ্জিনী। যা ভাবা গিয়েছিল, তা-ই। ডান পাশে, খানিক দূরে একটা প্রাইভেট টেলিফোন বুথ। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রজত আর হাত নেড়ে নেড়ে ইশারায় ওখানে যেতে বলছে।
স্বর্ণালীও রজতকে লক্ষ্য করেছিল। বলল, চল, ডাকছে
শিঞ্জিনী আপত্তি করল না। নীরবে স্বর্ণালীকে নিয়ে রজতের কাছে চলে এল।
রজত বলল, কোথাও বসে কথা বলতে পারলে ভালো হয়। ওখানে একটা রেস্তোরাঁ আছে। চলো– রাস্তাটা যেখানে মোড় ঘুরে বাঁয়ে বেঁকে গেছে, সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সে।
শিঞ্জিনী বলে, না। সম্ভব নয় বলেই মনে হল, কথাটা বেশ রূঢ়ই হয়ে গেছে। পরক্ষণে সুর নরম করে বলল, এখন রেস্তোরাঁয় গেলে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। আমার দাদু ভীষণ চিন্তা করবেন।
.
প্রথমটা খতিয়ে গিয়েছিল রজত। শিঞ্জিনীদের রেস্তোরাঁয় না যাবার কারণটা এবার যুক্তিসঙ্গত মনে হল। সে বলল, তা হলে
যা বলার এখানেই বলুন।
এই রাস্তায়!
শিঞ্জিনী জবাব দিল না।
রজত বলে, ঠিক আছে। অনেকে আমাদের লক্ষ্য করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। চলো, হাঁটতে হাঁটতে বলা যাক। স্বর্ণালীকে বলল, আমরা একটু আগে আগে হাঁটছি। তুমি পেছন পেছন এসো স্বর্ণালীর সামনে সে কথাটা বলতে চায় না।
ফুটপাত ধরে শিঞ্জিনী আর রজত পাশাপাশি ওধারের মোড়ের দিকে চলেছে ধীর গতিতে। তাদের দশ-বারো ফিট পেছনে স্বর্ণালী।
প্রচুর বাংলা-ইংরাজি লাভ স্টোরি পড়েছে স্বর্ণালী। কিন্তু কোনও প্রেমকাহিনিতেই এমন দৃশ্য আছে কিনা, তার মনে পড়ল না। ভীষণ মজা লাগছিল। কুল কুল করে পেটের ভেতর থেকে হাসি উঠে আসছে। ঠোঁট টিপে হাসিটাকে রুখে দিল সে।
রজত নীচু গলায় বলছিল, কিছু ভাবলে?
শিঞ্জিনী চকিতে ঠিক করে নিল, রজত অসন্তুষ্ট হয়, এমন কিছু করা বা বলা ঠিক হবে না। রজত খুব ভদ্র, কিন্তু চটে গেলে মানুষের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। দেবারতি মিসের কাছে তার নামে সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে লাগাতেও পারে। তখন দেবারতি মিস যদি পড়াতে না চান? এমন একজন ভালো টিচার কোথায় পাওয়া যাবে?
শিঞ্জিনী চোখের কোণ দিয়ে একবার রজতকে দেখে নিল। তারপর বলল, দেখুন, ফাইনাল পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। এখন অন্যদিকে মন গেলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আমি ভালো রেজাল্ট করতে চাই।
রজত একটু বিব্রত হল, মায়ের কাছে শুনেছি, তুমি ভালো স্টুডেন্ট রেজাল্ট তোমার ভালো হবেই।
পড়ায় কনসেনট্রেট করতে পারলে, তবেই না? তা ছাড়া
কী?
আমার লাইফের একটা এইম আছে। আমি ভালো কেরিয়ার করতে চাই।
নিশ্চয়ই করবে।
এম.এ. পাশ না করতে পারলে সেটা সম্ভব নয়।
নিজের পায়ে দাঁড়াতে আমারও তিন-চার বছর লেগে যাবে। তোমার এম.এ. পর্যন্ত আমি ওয়েট করতে রাজি। তুমি কী বলো?
একটু নীরবতা।
তারপর শিঞ্জিনী বলল, আমার মা আছেন, দাদু আছেন। আমার সম্বন্ধে যা ভাবার তারাই ভাবেন। ওঁদের লুকিয়ে আমি কিছু করি না।
রজত হকচকিয়ে গেল, না, না, লুকোবার প্রশ্নই নেই। তুমি যদি বলো, আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করব।
শিঞ্জিনী চমকে ওঠে, না, না, একেবারেই না।
কেন বলো তো?
আমার দাদু এখন এসব পছন্দ করবেন না।
তা হলে?
শিঞ্জিনী বলল, আমার পরীক্ষা-টরীক্ষা হয়ে যাক। তারপর কী করা যায়, ভাবা যাবে। তার ইচ্ছা, ব্যাপারটাকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত টেনে দিয়ে যাওয়া। পরীক্ষা হয়ে গেলে রজতকে পাত্তাই দেবে না। পরিষ্কার জানিয়ে দেবে, তার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
রজতকে হতাশ দেখায়। সে বলে, ঠিক আছে। পরীক্ষাটা হয়েই যাক। দু-তিন মাস পর আমারও একটা পরীক্ষা রয়েছে। এর মধ্যে বাড়ি আসা সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। খুব খারাপ লাগছে।
শিঞ্জিনী মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কোনও উত্তর দেয় না।
রজত বলল, তোমাদের ফোন নাম্বারটা লিখে দাও।
সচকিত শিঞ্জিনী বলল, কেন বলুন তো?
দেখা না হোক, মাঝে মাঝে আমরা কথা বলতে পারব।
ত্রস্ত সুরে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে শিঞ্জিনী, না না—
রজত অবাক। জিগ্যেস করে, না কেন? ফোনে কথা বললে, দোষের কী আছে?
শিঞ্জিনী জানায়, তাদের টেলিফোনটা আছে দাদুর ঘরে, তার মাথার কাছে একটা টেবলের ওপর। বাইরে থেকে যার ফোনই আসুক, তিনিই প্রথমে সেটা ধরেন।
দাদু কড়া ধাতের সেকেলে মানুষ, ভীষণ রক্ষণশীল। অনাত্মীয় যুবক নাতনির সঙ্গে ফোনে গল্প করতে চাইছে, কিছুতেই তা বরদাস্ত করবেন না। এতে শিঞ্জিনী ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। রজত সম্পর্কে জেরা করে করে দাদু তাকে নাজেহাল তো করবেনই। এমনকী স্কুলে এবং কোচিং ক্লাসে যাবার সময় পাহারাদারও সঙ্গে দেবেন। বানিয়ে বানিয়ে ইন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রজতের মাথায় একটা ভীতিকর ধারণা তৈরি করে দিল।
রজত বেশ মুষড়ে পড়ে। খানিকক্ষণ কী ভেবে বলে, আমার একটা কথা রাখবে?
কী?
আমাকে তো ফোন করতে বারণ করলে। তুমিই বরং রাস্তায় কোনও বুথ থেকে আমার হোস্টেলে ফোন করো। সকালের দিকে এগারোটা পর্যন্ত আর বিকেলে পাঁচটার পর আমাকে হোস্টেলে পাবে।
রজত একেবারে নাছোড়বান্দা। মনে মনে শিঞ্জিনী ঠিক করে ফেলল, কোনওদিনই রজতকে ফোন করবে না। মুখে অবশ্য বলল, ঠিক আছে। তবে রোজ আমার ফোন এক্সপেক্ট করবেন না।