দেবারতি মিসদের বাড়িটা এগারোতলা বিশাল এক হাইরাইজ। নাম আকাশ দীপ। বাড়িটার তিনতলায় ওঁদের তিন কামরার মস্ত ফ্ল্যাট।
আকাশ দীপ-এর সামনে অটো থেকে শিঞ্জিনীরা যখন নামল, পাঁচটা বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িটার দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছে, স্বর্ণালী চাপা গলায় বলল, ওপর দিকে তাকিয়ে দ্যাখ
আগেই লক্ষ্য করেছিল শিঞ্জিনী। দেবারতি মিসদের রাস্তায় দিকের চওড়া ব্যালকনিতে রজত দাঁড়িয়ে আছে। কিছুদিন ধরেই তার চোখে পড়ছে, যেদিন এখানে সে পড়তে আসে, রজতকে ওই ব্যালকনিটায় দেখা যায়। প্রতি সপ্তাহে না হলেও, প্রায়ই। এখন ওদের কলেজ পুরোদমে চলছে। কোনওরকম ছুটি-ছাটা নেই। নিশ্চয়ই কিছু একটা ছুতো তৈরি করে শিবপুর থেকে চলে আসে। দেবারতি মিসকে হুটহাট চলে আসার কী কারণ দেখায়, শিঞ্জিনী জানে না। হয়তো মায়ের ধারণা, তাঁকে বেশিদিন না দেখলে ছেলের মন খারাপ হয়ে যায়, তাই না এসে পারে না। কিন্তু তার বাড়ি আসার কেন এত গরজ, আকর্ষণটা কোথায়, শিঞ্জিনী তা খুব ভালো করেই জানে। আর জানে স্বর্ণালী।
দেড় বছর দেবারতি মিসের কাছে পড়ছে শিঞ্জিনী। প্রথম যেদিন রজত তাকে দেখে তখন থেকেই মুগ্ধ হয়ে আছে। ঘোরটা কিছুতেই আর কাটছে না। আগে আগে দূর থেকেই তাকিয়ে থাকত। পরে সাহস বাড়ছিল। দেবারতি মিসের ক্লাস শেষ হলে রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা করত। এমনিতে খুব ভদ্র, মার্জিত। স্বর্ণালীর সামনেই সাধারণ দু-একটা কথা হত। পড়াশোনা কীরকম চলছে, হায়ার সেকেন্ডারির পর কোন সাবজেক্টে অনার্স নেবে, বাড়িতে কে কে আছে, ইত্যাদি। আপত্তিকর একটি শব্দও রজতের মুখ থেকে বেরুত না। কথাবার্তা এবং আচরণ কখনও শালীনতার সীমা ছাড়া না।
সপ্তাহ তিনেক আগে স্বর্ণালীর সামনেই একটা মুখ-আঁটা সাদা খাম তাকে দিয়ে রজত বলেছিল, এটা বাড়িতে গিয়ে পড়ো। যা লিখেছি তোমার বন্ধু স্বর্ণালীকেও জানাতে পারো।
সতেরো-পেরুনো এক তরুণীর কাছে এক ঝকঝকে অনাত্মীয় যুবকের প্রথম চিঠি। হৃৎস্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল শিঞ্জিনীর। তারপর চিঠিটা বইয়ের ব্যাগে পুরে খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, আপনি কী লিখেছেন, বুঝতে পারছি। তবু পড়ব, বন্ধুকেও পড়াব।
এই সময় অটো এসে গিয়েছিল। শিঞ্জিনীরা আর দাঁড়ায়নি, চটপট উঠে পড়েছিল।
যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই। রজতের চিঠিটা নিছকই প্রেমপত্র। উচ্ছ্বাস আবেগ প্রতিটি লাইন থেকে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।
চিঠিটা স্বর্ণালীকেও পড়িয়েছে শিঞ্জিনী। সে খুশিই হয়েছিল, দেবারতি মিসের ছেলে। দারুণ স্টুডেন্ট। তোকে তো চিনি। যা মাথা গরম! না বলে দিস না।
শিঞ্জিনী উত্তর দেয়নি। জীবনে প্রথম যে পুরুষটিকে সে দেখে সে অনির্বাণ। এই নোংরা, জঘন্য লোকটা মৃদুলার মতো তার মনেও পুরুষদের সম্পর্কে চিরস্থায়ী ঘৃণা আর সন্দেহ সৃষ্টি করে রেখেছে। এর বাইরে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।
স্বর্ণালী সেই চিঠির ব্যাপারে আরও অনেকবার জানতে চেয়েছে, কী রে, কী করবি?
শিঞ্জিনীর জবাব খুবই সংক্ষিপ্ত, দেখি–
সেই যে রজত চিঠি দিয়েছিল, তারপর মাঝখানে দুসপ্তাহ শিবপুর থেকে আসেনি। আজ আবার তাকে দেখা গেল।
বন্ধুর হাতে আঙুলের আলতো খোঁচা দিয়ে স্বর্ণালী বলল, ওপরে তাকা একবার।
তাকাবার কিছু নেই। শিঞ্জিনী বলল, রজত দাঁড়িয়ে আছে তো?
ও বাবা, এর মধ্যে দেখা হয়ে গেছে!
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।
স্বর্ণালী বলল, কীরকম চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে দ্যাখ—
শিঞ্জিনী বলল, থাক তাকিয়ে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে না থেকে এখন চল তো–
আকাশ দীপ-এর বিশাল গেটের দিকে দুজনে পা বাড়িয়ে দেয়। এ-বাড়ির সিকিউরিটির ভীষণ কড়াকড়ি। মস্ত গোবদা একখানা খাতায় খোপ-কাটা ঘরে ভিজিটরদের নাম, ঠিকানা, কার সঙ্গে দেখা করবে, ইত্যাদি লিখতে হয়। কিন্তু শিঞ্জিনীরা দেড় বছর এখানে আসছে। সিকিউরিটি গার্ডরা সবাই তাদের চেনে। ওদের বেলা নিয়মটা শিথিল। ভিজিটরস বুকে কিছুই লিখতে হয় না।
যে মাঝবয়সি ইউনিফর্ম-পরা লোকটা খাতা-কলম নিয়ে গেটের কাছাকাছি বসে আছে, শিঞ্জিনীদের দেখে সে একটু হাসল। শিঞ্জিনীরাও হেসে তার পাশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। একজোড়া লিফট আছে। কিন্তু সে দুটো সদাব্যস্ত। সারাক্ষণ ওঠা-নামা করছে। হয়তো গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামছিল, হঠাৎ ওপরে উঠে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা না করলে চড়া যায় না।
শিঞ্জিনীরা কোনওদিনই লিফটে করে ওপরে যায় না। তিনটে তো মোটে ফ্লোর। টকাটক সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়।
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে স্বর্ণালী বলল, আজ তোকে নিশ্চয়ই ধরবে।
শিঞ্জিনী আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। শুধু শুধু কি আর শিবপুর থেকে চলে এসেছে?
চিঠিতে যা লিখেছে তার কী উত্তর দিবি?
কিছু তো একটা দিতেই হবে। দেখা যাক—
একসময় ওরা তেতলায় পৌঁছে গেল।
.
শিঞ্জিনীরা ছাড়াও লোরেটো, গোখেল আর সাউথ পয়েন্টের আরও তিনটি মেয়ে এই ব্যাচটায় রয়েছে। সাড়ে ছটায় ছুটির পর পাঁচজন বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে আসে। শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী রাস্তার ওপারে চলে যায়। ওদিক থেকেই তাদের অটো বা মিনিবাস ধরতে হবে। অন্য তিনজন যাবে উলটো দিকে। তারা এধারের ফুটপাতে বাস-টাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।