গলিতে ঢুকে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বারবার শিঞ্জিনীর দিকে তাকাচ্ছিল স্বর্ণালী। চোখাচোখি হলেই মুখ অন্য দিকে সরিয়ে নিচ্ছে সে।
শিঞ্জিনীর কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। এতক্ষণ সমানে কলকল করছিল স্বর্ণালী। গরমের ছুটিতে কী কী করেছে, কোথায় কোথায় গেছে, কোন কোন আত্মীয়স্বজন তাদের বাড়িতে এসেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর হঠাৎ চুপ করে গিয়ে তাকে দেখছে। দেখেই যাচ্ছে। এভাবে তার তাকানোর কারণ কী?
কী ভেবে শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, তুই কি আমাকে কিছু বলবি?
একটু দ্বিধান্বিত দেখাল স্বর্ণালীকে। তারপর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
আর কোনও প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করতে লাগল শিঞ্জিনী।
ওরা বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। বাসস্ট্যান্ডের গা ঘেঁষে যে শেডটা, তার তলায় মোটামুটি ভিড় রয়েছে। শেডের দিকে না গিয়ে স্বর্ণালী শিঞ্জিনীকে নিয়ে খানিক দূরে একটা বড় বাড়ির ঝুল বারান্দার নীচে এসে দাঁড়াল। এখানে অন্য লোকজন নেই।
শিঞ্জিনী বেশ অবাক হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে কিছুটা উদ্বিগ্নও ক্লাস ফাইভ থেকে একই স্কুলে, একই ক্লাসে তারা পড়ছে। স্বর্ণালী তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আগে কখনও তো এমনটা করেনি।
স্বর্ণালী বলল, তুই যদি কিছু মনে না করিস, কথাটা বলব।
মনে করার মতো কি কিছু?
ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে তোর কিন্তু জানা দরকার।
তা হলে তো শুনতেই হয়।
গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে স্বর্ণালী বলল, তুই তো জানিস, আমার বাবা নাটক দেখতে ভীষণ ভালোবাসে।
স্বর্ণালী ছাড়া অন্য কোনও বন্ধুর বাড়িতে একেবারেই যায় না শিঞ্জিনী। ওর বাবা দেবকুমার আঙ্কল তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। নাটকপাগল মানুষ। গ্রুপ থিয়েটারের ভালো নাটক থাকলে, যত ব্যস্ততাই থাক, সময় বার করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে দেখতে ছুটবেনই। একাডেমি কি শিশির মঞ্চে।
শিঞ্জিনী বলল, জানি– সে ভেবে পেল না, দেবকুমার আঙ্কলের নাটক দেখার মধ্যে এমন কী আছে যা তার মন খারাপ করে দিতে পারে!
স্বর্ণালী বলল, এবার গরমের ছুটি পড়ার দিন সাতেক পর বাবা আমাকে, দিদিকে আর মাকে নিয়ে একাডেমিতে একটা নাটক দেখতে গিয়েছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল, আমরা যে রোটায় বসেছি তার উলটো দিকের রোয়ের একেবারে শেষে মৃদুলা আন্টি আর এক ভদ্রলোক পাশাপাশি বসে আছেন। তখনও নাটক শুরু হয়নি। হল-এ আলো জ্বলছিল। ভাবলাম আন্টির সঙ্গে কথা বলে আসি। কিন্তু শেষ না করে সে চুপ করে গেল।
মৃদুলা শিঞ্জিনীর মায়ের নাম। সে জিগ্যেস করল, কিন্তু কী?
স্বর্ণালী বলে, আন্টি পাশের ভদ্রলোকটির সঙ্গে হেসে হেসে খুব গল্প করছিল। আমি গেলে ওদের ডিসটার্ব করা হত। তাই যাইনি।
মৃদুলা নাটক দেখতে গেছে, এটাই চমকে দেবার মতো খবর। শিঞ্জিনী আঠাবোয় পা দিয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছরে কোনওদিন মনে হয়নি, নাটক সম্পর্কে মায়ের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে। কখনও তার মুখে কোনও নাটকের নামও শোনেনি শিঞ্জিনী। তবে সিনেমা খুব দেখে মৃদুলা। হল-এ গিয়ে নয়, বাড়িতে বসে; রাত্তিরে টিভি চালিয়ে। বাংলা হিন্দি বা ইংরেজি, সব রকমের ছবি। সেই মা রাতারাতি নাটকের এমন সমঝদার হয়ে উঠল যে একাডেমিতে ছুটেছে। সেন্টিমেন্টে বোঝাই, সস্তা, প্যানপেনে বাংলা ড্রামা নয়। গ্রুপ থিয়েটারের খটমট, জটিল নাটকের অনুরাগিণী! আশ্চর্য!
মা কখনও তার কাছে কিছু লুকোয় না। সারাদিন অফিসে কী করেছে, সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কোন বিষয়ে তার মতে মেলেনি, সহকর্মীদের মধ্যে যারা একটু ফাজিল তারা কী ধরনের মজা করেছে–সব শিঞ্জিনীকে বলা চাই। কিন্তু এই নাটক দেখার ব্যাপারটা একদম গোপন করে গেছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার মায়ের ওই সঙ্গীটি। মনের প্রান্তসীমায় মেঘ জমতে থাকে শিঞ্জিনীর।
তিন-চার মাস ধরে মায়ের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে। আগে অফিস ছুটি হলে এক মুহূর্তও বাইরে সময় নষ্ট করত না মৃদুলা। চার্টার্ড বাসে পার্ক স্ট্রিট থেকে বাড়ি আসতে ঘন্টাখানেক। ছটার ভেতর পৌঁছে যেত। ট্র্যাফিক জ্যাম থাকলে আরও তিরিশ-চল্লিশ মিনিট বেশি লাগত। সাতটার পর বাড়ি ফিরেছে, এমনটা কখনও হয়নি। কিন্তু গত তিন-চার মাস ফিরতে ফিরতে নটা, সাড়ে নটাও হয়ে যাচ্ছে। জিগ্যেস করলে বলে, অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। ওভারটাইম খাটতে হচ্ছে।
মায়ের দেরি করে ফেরার সঙ্গে ওই ভদ্রলোকটির কি কোনও সম্পর্ক আছে? শিঞ্জিনীর বুকের ভেতর ধারালো শালার মতো কী যেন বিধে যায়।
স্বর্ণালী বলল, আন্টি আর ওই ভদ্রলোককে এই ছুটিতে আমি আরও দুজায়গায় দেখেছি।
শিঞ্জিনী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। চমকে উঠে বলল, কোথায় কোথায়?
স্বর্ণালী জানায়, বাবার সঙ্গে তারা সবাই একদিন সন্ধেবেলায় নামকরা একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিল। সেখানে মৃদুলাদের দেখেছে। অন্য একদিন এয়ার-কন্ডিশনড মার্কেটে।
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না। দমবন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
স্বর্ণালী এবার বলে, তিনবারই একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়েছে। যেভাবে আন্টিরা হাসছিল, কথা বলছিল, মনে হয়েছে দুজনে খুব ইন্টিমেট।
সেই শলাটা বুকের গভীরে আরও অনেকটা ঢুকে যায়। অদ্ভুত এক কষ্ট বুক থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
স্বর্ণালী বন্ধুর দিকে সামান্য ঝুঁকে জিগ্যেস করে, তুই চিনিস ভদ্রলোককে?