তারপর আইন-আদালত। ডিভোর্সের মামলা। একমাত্র মেয়ের বিবাহিত জীবনের এমন শোকাবহ পরিণামের ধাক্কাটা সামলাতে পারেননি অন্নপূর্ণা। আগেই নানা রোগে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। মৃদুলা পাকাপাকি তাদের কাছে চলে আসার চার মাসের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
ইন্দ্রনাথের শরীর-স্বাস্থ্যের হাল ভালো ছিল না। অসুখে-বিসুখে তিনিও যথেষ্ট কাহিল। কিন্তু মনের জোর ছিল প্রচণ্ড। মামলার সময় সর্বক্ষণ মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহস যুগিয়েছেন। নিজের সঞ্চয় ভেঙে জলের মতো টাকা খরচ করেছেন।
ডিভোর্সের কেসটা প্রায় একতরফাই হয়েছিল। পাছে জেরার মুখে পারিবারিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির পচা দুর্গন্ধ বেরিয়ে পড়ে তাই অনিবার্ণরা কোর্টে কদাচিৎ এসেছে। তবে শিঞ্জিনীকে ওরা সহজে ছাড়তে চায়নি। তাকে পাওয়ার জন্য তিন বছর মামলা চালিয়ে গেছে। বেলগাছিয়ার পরিবেশটা কেমন সবিস্তারে কোর্টকে জানিয়ে মৃদুলার আর্জি ছিল, ওখানে থাকলে মেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে। শিঞ্জিনীর জীবন যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য মৃদুলার কাছেই তার থাকা দরকার। আদালত তার পক্ষই রায় দিয়েছিল। তবে ইচ্ছা করলে অনির্বাণ সপ্তাহে একদিন মেয়েকে তার দাদামশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতে পারে।
অনির্বাণ কিন্তু কোনওদিনই প্রাক্তন শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে দেখতে আসেনি। প্রথম দিকে বছরখানেক মাঝে মাঝে ফোন করত। তারপর কবেই তা বন্ধ হয়ে গেছে।
বিয়ের আগেই এম.এটা পাশ করেছিল মৃদুলা। মামলা-টামলা চুকে যাবার পর কম্পিউটারের কী একটা ট্রেনিং নিয়ে বিরাট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে সে। ইচ্ছা করলে অনেক আগেই ফের বিয়ে করতে পারত কিন্তু অনির্বাণের সঙ্গে কটা বছর কাটিয়ে পুরুষ সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা সে ভাবতেও পারত না। শিঞ্জিনীই ছিল তার সর্বস্ব।
যে মৃদুলা মেয়েকে পাওয়ার জন্য কটা বছর দাঁতে দাঁত চেপে অবিরল যুদ্ধ করে গেছে, পুরুষ জাতিকে যে চরম ঘৃণা করে, আজ তার মুখে বিমলেশ বসুমল্লিকের নাম শোনা গেল। বিদ্বেষ নয়, অশ্রদ্ধা নয়, অচেনা শিল্পপতিটি সম্পর্কে তার প্রতিটি কথা থেকে বেরিয়ে আসছিল চাপা উচ্ছ্বাস। নাকি স্তুতি?…
….জানালার বাইরে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। আজ রাতে থামবে বলে মনে হয় না। মেঘ ডাকার বিরাম নেই। কাছে-দূরে সমানে বাজ পড়ছে।
শিঞ্জিনীর খেয়াল হল, তার দুচোখ জলে ভরে গেছে।
২. কোচিং ক্লাসে
০৬.
স্কুল ছুটির পর সপ্তাহে তিন দিন কোচিং ক্লাসে যায় শিঞ্জিনী। একদিন দেবারতি মিসের বাড়ি, বাকি দুদিন অন্য দুজায়গায়। হায়ার সেকেন্ডারির যে বিশাল কোর্স তাতে ভালো রেজাল্ট করতে হলে প্রাইভেট টিউশন ছাড়া গতি নেই। এই তিন দিন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায় তার। কোচিং ক্লাসের ব্যাপারটা ইন্দ্রনাথের জানা। তাই এই কটা দিন নাতনী দেরিতে ফিরলে তার দুশ্চিন্তা হয় না।
শিঞ্জিনীর সঙ্গে স্বর্ণালীও ওই তিনটে কোচিং ক্লাসে পড়তে যায়। ইচ্ছা করলে ওর বাবা বাড়িতে পড়িয়ে যাবার জন্য কয়েক গণ্ডা টিউটর রাখতে পারেন। কিন্তু তিনি চান তার মেয়েরা অন্য দশটা সাধারণ ফ্যামিলির মেয়েদের মতো একটু কষ্ট করে মানুষ তোক।
আজ দেবারতি মিসের ক্লাস। স্কুল ছুটির পর শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী ছুটতে ছুটতে বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। এখন চারটে বেজে পঁচিশ। পাঁচটায় দেবারতি মিসের ক্লাসে তাদের পৌঁছুতেই হবে। তিনি ইংরেজি পড়ান। কঁটায় কাঁটায় পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটা। তারপর অন্য ব্যাচ পড়তে আসবে।
দেবারতি মিস একটা বিখ্যাত মিশনারি স্কুলে সিনিয়র টিচার ছিলেন। কিন্তু সারাদিন বাড়িতে ব্যাচের পর ব্যাচ হায়ার সেকেন্ডারির ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে স্কুলে যাবার সময় পেতেন না। তাই বছর দুই হল চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নটা বাজতে না বাজতে এখন নাকেমুখে গুঁজে বাস কি ট্যাক্সি ধরতে হয় না। দশটায় স্কুলে হাজিরা দেবার হাঙ্গামা নেই। নিজের ফ্ল্যাটে বসে পড়িয়ে গেলেই হল। ফাঁকে ফাঁকে স্নান, খাওয়া, রেস্ট। তাছাড়া, স্কুল থেকে যা মাইনে পেতেন, প্রাইভেট টিউশন করে এখন তার পাঁচগুণ রোজগার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সময়কে তিনি নিজের ইচ্ছামতো কাজে লাগাতে পারেন।
খুব ছোট্ট পরিবার ওঁদের। দেবারতি মিস আর একমাত্র ছেলে রজত। রজত শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। খুব সম্ভব, থার্ড ইয়ারে। ওখানেই হোস্টেলে থাকে। ছুটিতে মায়ের কাছে আসে।
দেবারতি মিস দারুণ পড়ান। এমন তৈরি করে দেন যে হায়ার সেকেন্ডারির ছেলেমেয়েরা চোখ বুজে এইটি-এইটি ফাইভ পারসেন্ট মার্কস পেয়ে যায়। যে দেড় ঘণ্টা তিনি ক্লাস নেন তার মধ্যে এতটুকু ফাঁকি নেই। বাজে গল্প করে সময় নষ্ট করা নেই। পৌঁছুতে পাঁচ-দশ মিনিট দেরি হলে নিজেদেরই ক্ষতি। তাই শিঞ্জিনীদের এমন তাড়াহুড়ো, এমন ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়।
দেবারতি মিসেস ফ্ল্যাট শিঞ্জিনীদের স্কুল থেকে অনেকটা দূরে। বাসে কি অটোয় যেতে হয়। বাস থেমে থেমে, লোক তুলতে তুলতে যায়। তাই সময় বেশি লাগে। তাই ওরা অটোই ধরে।
ছুটির পর ভীষণ খিদে পায়। কিন্তু ফাস্ট ফুড মিষ্টির দোকানে খেতে গেলে কম করে পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগবে। সময় বাঁচাবার জন্য শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী প্যাটিস কি কেক-টেক কিনে অটোয় বসে খেতে খেতে যায়।