বাধা দিয়ে অনির্বাণ গর্জে উঠেছে, বৌদি সম্পর্কে আর একটা বাজে কথা বললে তোমাকে এক্ষুনি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।
মৃদুলা খুব ঠান্ডা গলায় বলেছে, তোমার এত ক্ষমতা!
হ্যাঁ, হ্যাঁ। এটা আমাদের বাড়ি। যখন–।
তোমাদের বাড়ি! মানে তোমার আর ওই বজ্জাত মেয়েমানুষটার।
বিদ্রুপে মুখ কুঁচকে গেছে মৃদুলার। গলার স্বর শাণিত করে, টেনে টেনে এবার সে বলেছে, তোমাদের কীর্তির কথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারও জানতে বাকি নেই। ধরো, কাল পাড়ার লোজন আর তোমার আত্মীয়দের ডাকিয়ে আনলাম। বিয়ের পর যা আমার চোখে পড়েছে, দিনের পর দিন যেভাবে মানসিক টরচার সহ্য করেছি- সব তাদের বললাম। তারপর জিগ্যেস করলাম, এই নোংরা ব্যাপারগুলোর প্রতিবাদ করেছি বলে তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে চাইছ। তাদের জিগ্যেস করব, আপনারা কী বলেন?
রত্নময়ীদের মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মৃদুলাকে থামিয়ে দিয়ে ত্রস্ত সুরে অনির্বাণ বলেছে, সত্যিই তুমি ওদের ডাকবে নাকি?
তার কথা কানেই তোলেনি মৃদুলা। একটানা সে বলে যাচ্ছিল, তারপর ধরো, একদিন তোমার অফিসে গিয়ে তোমাদের জেনারেল ম্যানেজার, ডাইরেক্টরস বোর্ডের মেম্বার আর কলিগদের সঙ্গে দেখা করে তোমাদের গুণকীর্তন করলাম
বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল অনির্বাণকে। কাঁপা গলায় সে জিগ্যেস করেছে, আমাদের অফিসেও যাবে?
মৃদুলা বলেছে, কী মনে হয় তোমার? বাড়ি থেকে যখন বার করে দিতে চাইছ, আর মুখ বুজে আমি যদি তোমার এই হুকুমটা তামিলই করি, লোকে কী বলবে? ভাববে দোষটা আমার। যাবার আগে সবার সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া দরকার কিনা, তুমিই বলো
বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থেকেছে অনির্বাণ। কী উত্তর দেবে, ভেবে পায়নি।
মৃদুলা এবার তরুলতা আর রত্নময়ীর দিকে তাকিয়েছে, আমি এতক্ষণ যা বললাম সেটা ঠিক না? আপনারা কী করতে বলেন?
দুই রমণী একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিল।
মাথাটা আস্তে আস্তে ডাইনে-বাঁয়ে নাড়তে নাড়তে মৃদুলা এবার বলেছে, আমি কারও কাছেই যাচ্ছি না। একটা কথা পরিষ্কার করে আপনাদের বুঝিয়ে দিতে চাই। আমি কিন্তু সুকুমার দত্তের মতো দুর্বল নই। কোনওদিন গাড়ির তলায় লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে পারব না। লোকজন জুটিয়ে সিন ক্রিয়েটও করব না। কারও সাহায্যেরও আমার দরকার নেই। যা করার আমি নিজেই করব।
বড় হবার পর এই ব্যাপারটা নিয়ে শিঞ্জিনীর সঙ্গে মৃদুলার অনেকবার কথা হয়েছে। উত্তেজিত শিঞ্জিনীর একটাই প্রশ্ন বা অভিযোগ। কেন মা তার বাপের বাড়ি ফিরে আসেনি? ওই রকম একটা কদর্য পরিবেশে একটা বদ, নোংরা লোকের সঙ্গে কেন অনেক আগেই সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেনি?
মৃদুলা মেয়েকে প্রতিবারই এক উত্তর দিয়ে গেছে। অনিবার্ণকে ভালোবেসে সে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকেনি। এটা হল অহংবোধ এবং অধিকারের প্রশ্ন। একটা নষ্ট মেয়েমানুষ তার নিজস্ব পুরুষটিকে ছিনিয়ে নেবে, সেটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই বেলগাছিয়াতেই থেকে নিদারুণ শক্তি পরীক্ষায় নেমেছিল সে।
বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে সেদিন মৃদুলা যে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিল তার ফল কিন্তু হাতেনাতেই ফলেছিল। পরদিন পাতিপুকুরে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল তরুলতা। মৃদুলা শুনেছে, সেখানে তার শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মা আর তাকে দেখাশোনার জন্য দু-তিনটে কাজের লোক ছাড়াও দূরসম্পর্কের এক পিসি ছিল। পিসি বিধবা। জগৎ-সংসারে তার কেউ নেই। তরুলতাদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যাবার জায়গা ছিল না তার। টাকা-পয়সার অভাব অবশ্য ছিল না। মৃত্যুর আগে তরুলতার বাবা ব্যাঙ্কে প্রচুর রেখে গেছেন। সেখান থেকে যথেষ্ট ইন্টারেস্ট পওয়া যেত।
যাবার আগে তরুলতা বলেছিল, আমি চললাম। এবার শান্তিতে থাকতে পারবি তো?
তরুলতা কী ইঙ্গিত দিয়েছিল, তখন বুঝতে পারেনি মৃদুলা। আশ্চর্য, অত কাণ্ডের পরেও দিন কুড়ি-বাইশ বাদে পাতিপুকুর থেকে ফিরে এল সে। মৃদুলার একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলেছিল, রূপাটার জন্যে মন ভীষণ খারাপ লাগছিল। তাই চলে এলাম। রাগ করিস না– শিঞ্জিনীর ডাকনাম রূপা তারই দেওয়া।
কয়েকটা দিন মোটামুটি ভালোই কাটল। তারপর সেই আগের মতোই লুকিয়ে-চুরিয়ে নষ্টামি শুরু হল। মেয়েমানুষ একবার খারাপ হয়ে গেলে তার স্বভাব কি সহজে শোধরায়? শিঞ্জিনীর টানে তরুলতা বেলগাছিয়ায় এসেছে, পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি মৃদুলা। ওদের নজরে নজরে রেখেছিল। একদিন ধরেও ফেলেছে দুজনকে। তারপর ফের অশান্তি। আবার তরুলতাকে পাতিপুকুরে পাঠিয়ে দিয়েছে মৃদুলা। কিন্তু দু-চার মাস পর আবার সে ফিরে এসেছে।
পাতিপুকুর আর বেলগাছিয়া, এই করেই কবছর কাটিয়ে দিয়েছে তরুলতা। অনিবার্ণকে অনেক বুঝিয়েছে মৃদুলা, একটা নষ্ট মেয়েমানুষের দখল থেকে তাকে বার করে আনতে শতভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হয়নি।
হঠাৎ মৃদুলা জানতে পারল, তরুলতা যখন পাতিপুকুরে থাকে সেই সময় মাঝে মাঝেই অফিসে যাবার ছুতো করে সেখানে চলে যায় অনির্বাণ। ওর যা কাজ তাতে কয়েক মাস পর পর দু-চার দিনের জন্য দিল্লি, চেন্নাই কি হায়দ্রাবাদে টুরে যেতে হয়। অফিস থেকেই পাঠায়। অনেক সময় এই সব ট্যুরে তরুলতাকে গোপনে সঙ্গে নিয়ে যায় সে। তরুলতার অথর্ব পঙ্গু মায়ের সাধ্য নেই তাদের ঠেকান। এই খবরগুলো পাওয়ার পরই মৃদুলা মনস্থির করে ফেলে। মেয়েকে নিয়ে সোজা চলে আসে মা-বাবার কাছে।