একসময় কে যেন রত্নময়ীকে অন্য একটা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। মৃদুলাকে একা রেখে যাবার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না তার। কিন্তু বিষয়টা এমন জরুরি যে না গিয়েও উপায় ছিল না।
যে ঘরে মৃদুলা আর রত্নময়ীকে বসানো হয়েছিল সেটা প্রমীলা রাজ্য। শুধু মহিলা আর মহিলা। হাসি-ঠাট্টা-গল্পে তারা আসর জমিয়ে রেখেছিল। বিয়েবাড়িতে যেমন হয় আর কী। এরা সবাই অনির্বাণদের আত্মীয়। এখানে এসেই তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মৃদুলার। হয়তো তার বৌভাতে এরা গিয়েও ছিল। সেই কবে অল্পক্ষণের জন্য এদের দেখেছে। যাতায়াত না থাকায় তাদের মুখ ভুলেও গিয়েছিল।
রত্নময়ী চলে যাবার পর হঠাৎ একটি মহিলা–বেশ সুন্দরী, চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, মেদহীন ছিপছিপে চেহারা, হাতে গোছ গোছ সোনার চুড়ি, গলায় হীরের নেকলেস, কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ, নাম লতিকা উঠে এসে মৃদুলার পাশে ঘন হয়ে বসেছিল। খানিক আগেই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সম্পর্কে অনির্বাণের কীরকম বৌদি। কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে সে বলেছে, রত্নময়ী মাসি তোমাকে পাহারা দিচ্ছিলেন, তাই ভালো করে কথা বলতে পারিনি। তুমি দেখতে এত সুন্দর। শুনেছি, খুবই শিক্ষিত। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। কলকাতায় বাড়ি আছে। বাবার টাকা-পয়সার অভাব নেই। দেশে তোমার মতো মেয়ের জন্য কোনও সৎ পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না? তোমার বাবা ভালো করে খোঁজখবর না নিয়েই বিয়েটা দিয়ে দিলেন।
লতিকা কী ইঙ্গিত দিয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবু চকিত হয়ে উঠেছে মৃদুলা মানে!
লতিকা বলেছিল, অনির্বাণের কথা বলছি। তরুলতার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা কী, টের পাওনি? জঘন্য, নোংরা মেয়েমানুষ। ওর জন্যে অনির্বাণের দাদা সুকুমার বাসের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। রত্নময়ী মাসিরা অবশ্য অ্যাকসিডেন্টও বলে চালায়। একটু চুপ করে থেকে তীব্র, চাপা গলায় বলেছে, অ্যাকসিডেন্টও নয়, আত্মহত্যাও নয়। ওটা খুন। সুকুমার ছিল সরল, ভালোমানুষ। তরুলতা আর অনির্বাণ ওর ওপর এমন মানসিক নির্যাতন শুরু করেছিল যে শেষ পর্যন্ত চরম পথটাই বেছে নিয়েছে। সুকুমারের জন্যে এত কষ্ট হয় যে বলে বোঝাতে পারব না।
সুকুমারের মৃত্যুরহস্য এতদিনে পরিষ্কার হয়েছিল। মৃদুলা জিগ্যেস করেছে, সুকুমারদা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত তো একদিনে নেননি। দিনের পর দিন নিজের স্ত্রী আর ভাইয়ের আচরণে কষ্ট পেতে পেতে তবেই না ভেবেছিলেন বেঁচে থাকার অর্থ নেই।
নিশ্চয়ই।
আত্মহত্যা, বা অ্যাকসিডেন্ট বা খুন, যাই হোক না, আমার শাশুড়ি কি তার কারণটা বুঝতে পারেননি? তা হলে মুখ বুজে ছোট ছেলে আর বড় বউর কুকীর্তি সহ্য করে গেছেন কেন?
আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর নেই। মনে হয়, রত্নময়ী মাসি তরুলতাকে ভীষণ ভয় পায়।
একটু নীরবতা।
তারপর লতিকা বলেছে, নিশ্চয়ই অনির্বাণ আর তরুলতার নানা ব্যাপার তোমার চোখে পড়েছে। ব্যাপার বলতে কী বোঝাতে চাইছি, আশা করি বুঝতে পারছ।
অবশ্যই বুঝতে পেরেছে মৃদুলা। লতিকা ঠিক কী বলতে চায়, শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল সে।
লতিকা এবার বলেছে, এমন একটা জঘন্য মেয়েমানুষের সঙ্গে এক বাড়িতে আছ কী করে? ও যে ধরনের নোংরা চরিত্রের মহিলা তাতে একদিন তোমার অবস্থা ঠিক সুকুমারের মতো করে ছাড়বে। যে করে থোক, ওকে তোমাদের বাড়ি থেকে তাড়াও। পারলে
এই সময় রত্নময়ী ফিরে এসেছিলেন। লতিকা আর এক মুহূর্তও বসে থাকেনি। ঝটিতি উঠে গিয়ে খানিক দূরে অন্য মহিলাদের জটলায় মিশে গিয়েছিল।
কপাল কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে কয়েক পলক লতিকার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন রত্নময়ী। তবে লতিকা সম্পর্কে সেই মুহূর্তে মৃদুলাকে কোনও প্রশ্ন করেননি।
লতিকা উঠে যাবার আগে মৃদুলার মাথায় কোনও বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই সে জেনেছে, সুকুমারের জীবনটা অনির্বাণ আর তরুলতা নষ্ট করে দিয়েছে। তাকেও তিল তিল করে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মৃদুলা তখনই মনস্থির করে ফেলেছিল, কোনওভাবেই আর বরদাস্ত করবে না।
বিয়েবাড়ি থেকে বেড়া আগুনের ভেতর দিয়ে পুড়তে পুড়তে যখন রত্নময়ীদের সঙ্গে ফিরে এসেছিল, তখন মাঝরাত পার হয়ে গেছে। ফিরেই তরুলতার দিকে তোপ দাগতে শুরু করেছিল, এ-বাড়িতে আপনার আর জায়গা হবে না। কাল সকালে উঠেই চলে যাবেন।
মৃদুলা তখন অগ্নিমুর্তি। তাকে এমন চেহারায় আগে কখনও দেখেনি তরুলতারা। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
তরুলতা তোতলাতে তোতলাতে বলেছে, কী-কী বলছ তুমি! এর–এর মানে কী?
প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে অনির্বাণ আর রত্নময়ী পালটা আক্রমণের জন্য ততক্ষণে নিজেদের প্রস্তুত করে নিয়েছেন।
রত্নময়ীর মাথায় খুন চলে গিয়েছিল, এত সাহস তোমার! বড় বৌমাকে তাড়াতে চাইছ! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! মাথা নীচু করে যদি থাকতে হয় তো এ বাড়িতে থাকবে। নইলে দরজা খোলা আছে। চিৎকার করতে করতে তাঁর গলার স্বর চিরে বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল, ওর সম্বন্ধে তোমার কানে বিষ ঢালল কে? নিশ্চয়ই লতিকা?
বিয়েবাড়িতে লতিকাকে তার পাশে দেখে কিছু একটা সন্দেহ যে রত্নময়ী করেছেন, তখনই আন্দাজ করা গিয়েছিল। একবার কামানের গোলা ছোঁড়া হয়ে গেছে। আর পিছু হটার উপায় নেই। গলার স্বর আরও চড়িয়ে মৃদুলা বলেছে, অন্যের বিষ ঢালতে হবে কেন? জানেন না, আপনার বড় বৌমাটি কত বড় বদমাশ, দুশ্চরিত্র। নিজের স্বামীকে তো শেষ করেছেই—