মৃদুলা পরিষ্কার টের পাচ্ছিল, ওরা দুজনে বজ্জাতিটা চালিয়ে যাচ্ছে সঙ্গোপনে। সুকৌশলে। কিন্তু কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না।
মৃদুলার মাথায় দুরন্ত এক জেদ চেপে গিয়েছিল। যেভাবে হোক, অনির্বাণকে তরুলতার মুঠি থেকে বার করে আনবে।
এসব শিঞ্জিনীর জানার কথা নয়। সে তখন মায়ের গর্ভে জ্বণের আকারে। জন্মের বহুকাল পরে সে যখন বেশ বড় হয়েছে, মৃদুলা ধারাবাহিক তাকে সমস্ত জানিয়েছিল।
সেই যে সেদিন মাঝরাতে অনির্বাণের খোঁজে মৃদুলা তরুলতার ঘরে হানা দেয়, তার মাস তিনেক বাদে সে মা-বাবার কাছে চলে এসেছিল। মেয়ের প্রথম সন্তান জন্ম নিতে চলেছে, তার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন ইন্দ্রনাথ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা ভালো নার্সিংহোম ঠিক করা হয়েছিল।
বাপের বাড়ি এসেছিল ঠিকই, কিন্তু তার মনটা পড়ে থাকত বেলগাছিয়ায়। সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠা। তার সামনে প্রকাশ্যে অনির্বাণ আর তরুলতা নষ্টামি করত না। হয়তো চক্ষুলজ্জায়, হয়তো সাহসের অভাবে। এখন তো ওবাড়ি ওদের কাছে মুক্তাঞ্চল। যা ইচ্ছা করে বেড়াতে পারে। বাধা দেবার কেউ নেই। শাশুড়ি দেখেও দেখবেন না। শুনেও শুনবেন না। অন্ধ ও বধির হয়ে থাকবেন।
একেকবার মৃদুলার মনে হয়েছে, মা-বাবাকে সব খুলে বলে। পরক্ষণে তার অহংবোধে ধাক্কা লেগেছে। কী নেই তার? সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যৌবন।একটি পুরুষকে মুগ্ধ করার মতো সমস্ত কিছু। এ যুদ্ধটা তারই। যা করার সে নিজেই করবে। এর ভেতর অন্য কাউকে টেনে আনবে না। কোনও ভাবেই নয়।
নার্সিংহোমে ভর্তির আগে এবং পরে অনির্বাণ আর তরুলতা মাঝে মাঝেই মৃদুলাকে দেখতে আসত। বেশিরভাগ সময় আলাদা আলাদা, কখনও কখনও একসঙ্গে। রত্নময়ীর যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। তিনি বেশি আসতে পারতেন না।
অনির্বাণ আর তরুলতাকে একসঙ্গে দেখলে মাথায় আগুন ধরে যেত মৃদুলার, মুখ শক্ত হয়ে উঠত। ওদের সঙ্গে কথা বলত ঠিকই, তবে খুবই নীরস গলায়।
তার মনোভাব হয়তো বুঝতে পারত তরুলতা। কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করত, বোকা মেয়ে, অত ভাবিস কেন? তোর স্বামী তোরই আছে।
দাঁতে দাঁত চেপে মৃদুলা বলত, না, নেই।
হেসে হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাইত তরুলতা, কী যে বলিস!
ঠিকই বলি। আর সেটা আপনি নিজেও ভালো করে জানেন।
তোর পাগলামিটা আর কাটল না। অকারণে কী যে সন্দেহ?
অহেতুক কি সে সন্দেহ?
অহেতুক?
চোখের তারায় নিষ্ঠুরতা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেছে তরুলতার। খুব নরম গলায় বলেছে, নয়তো কী? আমার লঘুগুরু জ্ঞান নেই?
বিদ্রুপের সুরে মৃদুলা বলেছে, আছে বুঝি!
তরুলতা উত্তর দেয়নি।
মৃদুলা ভেবেছে, সে অনির্বাণের বৈধ স্ত্রী, তার সন্তানের জননী হতে চলেছে। তার জোর অনেক বেশি। শেষ দেখে তবে ছাড়বে। অন্য একটা চিন্তাও পাশাপাশি তার মাথায় ভর করত। একটা পোকায়-খাওয়া, দুশ্চরিত্র মানুষের জন্য শক্তিক্ষয় করার মানে হয় না। সঙ্গে সঙ্গে সেই গোঁ-টা তাকে পেয়ে বসত। একটা পুরুষকে সে জয় করে নিতে পারবে না?
.
শিঞ্জিনী শুনেছে তার জন্মটা মসৃণ নিয়মে হয়নি। মৃদুলার কী একটা শারীরিক সমস্যার কারণে দু-তিনটে বড় অপারেশন করতে হয়েছিল। স্বাভাবিক ডেলিভারি হলে যে সময় প্রসূতি আর বাচ্চাকে ছেড়ে দেবার কথা, তারও পর পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন নার্সিং হোমে থাকতে হয়েছিল মৃদুলাকে।
ইন্দ্রনাথ তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও অনেকদিন লেগেছে। এর মধ্যে যথারীতি তরুলতা আর অনির্বাণ তাকে এবং শিঞ্জিনীকে দেখতে এসেছে। রত্নময়ীও তিন-চার দিন নাতনিকে দেখে গেছেন।
হ্রদের ওপর দিকটা প্রশান্ত হলেও জলতলে প্রবল চোরা ঘূর্ণি থাকে। অনির্বাণদের দেখামাত্র নিজের মধ্যে তেমন কিছু তীব্রভাব অনুভব করত মৃদুলা।
শিঞ্জিনীর যখন সাত মাস বয়স, শ্বশুরবাড়ি ফিরে গিয়েছিল মৃদুলা। তার দিন সাতেকের মধ্যে সংসারে বড় রকমের একটা বিস্ফোরণ ঘটাল সে।
মৃদুলা আগেই লক্ষ্য করেছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে অনির্বাণদের কোনওরকম মাখামাখি ছিল না। মাখামাখি দূরের কথা, কেউ তাদের বাড়ি আসত না, তারাও কারও বাড়ি যেত না। তবে ঝগড়াঝাটি ছিল না। উদাসীনভাবে পরস্পরকে তারা এড়িয়ে চলত।
আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন যেন আলগা আলগা। কারও বাড়িতে কোনও কাজ থাকলে–বিয়ে, শ্রাদ্ধ, মুখেভাত-~~কেউ এসে নেমন্তন্ন করে যেত। ব্যস, এই পর্যন্ত। বেশির ভাগ জায়গায় অনির্বাণরা যেত না। কাউকে দিয়ে উপহার পাঠিয়ে দিত।
সেদিন মধ্যমগ্রামে অনির্বাণের এক মামাতো ভাইয়ের বিয়ে। সম্পর্কটা খুব কাছের। না গিয়ে উপায় নেই। অনির্বাণ রত্নময়ী আর মৃদুলাকে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে বিয়েবাড়ি গিয়েছিল। তরুলতাকে বারবার বলা সত্ত্বেও যায়নি। শিঞ্জিনীকে নিয়ে বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে রত্নময়ী আর অনির্বাণ কদাচিৎ গেলেও তরুলতা কখনও যেত না।
বিয়েবাড়িতে গিয়ে একটা ব্যাপার নজরে পড়েছে মৃদুলার। আত্মীয়দের অনেকেই, বিশেষ করে মহিলারা তাকে লক্ষ্য করছিল। তাদের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যাতে সে আদৌ স্বস্তি বোধ করছিল না।
এদিকে রত্নময়ী মৃদুলার কাছছাড়া হচ্ছিলেন না। প্রায় তার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে ছিলেন। এবং সারাক্ষণ তাকে আগলে আগলে রাখছিলেন। কেউ তাকে কিছু জিগ্যেস করলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। মৃদুলাকে মুখ খুলতেই দিচ্ছিলেন না। নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। শাশুড়ির এই আচরণ খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে মৃদুলার। অত্যন্ত অস্বাভাবিকও।