এরপর তরুলতা আর অনির্বাণ অনেকটা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। এমন কিছু চোখে পড়েনি যা আপত্তিকর। কিন্তু কোনও কোনও দিন রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলে মৃদুলা দেখতে পেত, পাশের জায়গাটা খালি, অনির্বাণ নেই। কখন যে উঠে গেছে, টের পাওয়া যায়নি।
চকিতে অ্যাটাচড বাথরুমের দিকে তাকিয়েছে মৃদুলা। সেটার দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। তড়িৎপ্রবাহের মতো কিছু একটা খেলে গেছে তার। বিছানা থেকে নামতে যাবে, তখনই ফিরে এসেছে অনিবার্ণ। জিগ্যেস করলে সে বলেছে, ঘুম আসছিল না, তাই বাইরের বারান্দায় গিয়ে পায়চারি করতে করতে সিগারেট খাচ্ছিল।
অনির্বাণের অজুহাতে খুঁত নেই। তবু বুকের সেই কাটাবনটা ক্রমশ ডালপালা ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
আর একদিন অনির্বাণকে বিছানায় না দেখে, দোতলায় শেষ মাথায় তরুলতার ঘরের সামনে গিয়েছিল মৃদুলা। বারান্দার দিকের জোড়া জানালার একটা পাল্লা ছিল ভোলা। ভেতরে অল্প পাওয়ারের নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না।
মৃদুলা জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে দরজার পাল্লায় কান রেখে দাঁড়িয়েছিল। ঘরটা নিঝুম। সেখানে কোনও সাড়াশব্দ নেই।
সে যখন নিজেদের বেডরুমে ফিরে আসবে, হঠাৎ তরুলতার ঘরে বেশি পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠেছে এবং দড়াম করে দরজাটা খুলে গেছে। ফিরে আসা হয়নি মৃদুলার। পা দুটো কেউ পেরেক ঠুকে বারান্দায় গেঁথে দিয়েছে!
বিচিত্র হেসে তরুলতা বলেছিল কী রে, এখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস!
মৃদুলা এতটাই হকচকিয়ে গেছে যে উত্তর দিতে পারেনি।
আয়, ভেতরে আয় মৃদুলার হাত ধরে নিজের খাটে বসিয়ে তরুলতা জিগ্যেস করেছে, তারও কি অনির্বাণের মতো ইনসমনিয়ার ধাত নাকি?
অনির্বাণ বরাবরই অনিদ্রার ভোগে কিনা, মৃদুলার জানা ছিল না। তরুলতার কথাগুলোর মধ্যে কোনও ইঙ্গিত আছে কি? মৃদুলা বলেছিল, না। হঠাৎ আপনার এটা মনে হল কেন?
রহস্যময় হাসি লেগেই ছিল তরুলতার মুখে। সে বলেছে, ইনসমনিয়া বোধ হয় ছোঁয়াচে রোগ। এক ঘরে থাকা, এক বিছানায় শোওয়া। স্বামীর হলে স্ত্রীরও হতে পারে, তাই না রে?
মৃদুলা এক পলক তরুলতার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল।
হঠাৎ তরুলতার মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। হাসছিল ঠিকই, কিন্তু সে হাসি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিষ ঝরতে শুরু করেছিল। মৃদুলা কিছু বোঝার আগেই এক টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তরুলতা। খাটের চাদর বালিশ ওলটপালট করে, ড্রেসিং টেবলের দেরাজ আর আলমারির পাল্লা খুলে, এমনকী মৃদুলাকে জোর করে মেঝেতে বসিয়ে খাটের তলাটা দেখিয়ে জিগ্যেস করেছিল, পাওয়া গেল? তার গলায় সাপের শিসের মতো চাপা আওয়াজ। দুই চোখ জ্বলছিল।
মৃদুলা ভয় পেয়ে গেছে। তরুলতার মধ্যে এমন একটা হিংস্র চেহারা লুকনো ছিল, সে ভাবতে পারেনি। আড়ষ্ট হতে হতে বলেছে, কী পাওয়া যাবে?
যাকে খোঁজার জন্যে মাঝরাতে আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলি।
কারা যেন খড়ি পেতে ভূ-ভারতের সব খবর আগাম জেনে যায়, তরুলতা কি তাদের কেউ? রাতদুপুরে মৃদুলা যে এখানে হানা দেবে, তা কি সে টের পেয়ে গিয়েছিল? অনির্বাণকে হাতেনাতে ধরতে এসে চূড়ান্ত নাকাল হতে হয়েছে। না, তরুলতা ছাড়া এ-ঘরে আর কেউ নেই। মৃদুলার জবাব দেবার কিছু ছিল না। নতচোখে সে দাঁড়িয়ে থেকেছে।
যে হিংস্রতা আগুনের হলকার মতো বেরিয়ে এসেছিল, লহমায় অদৃশ্য খাপের ভেতর সেটা পুরে ফেলেছে তরুলতা। ফের তাকে আগের মতোই দেখাচ্ছিল। মুখে স্নিগ্ধ হাসি, দুচোখে অপার মায়া। মৃদুলার কপালে চুমু খেয়ে, স্নেহতরল গলায় বলেছিল, এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে নেই। বাচ্চাটার কথা একটু ভাববি তো? চল মৃদুলার কাঁধটা হাতে জড়িয়ে নিয়ে বারান্দার আধাআধি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তরুলতা।
কোনও মানুষ যে চকিতে এতটা বদলে যেতে পারে, কে জানত। এই ফণা-তোলা সাপিনী, পরক্ষণে মমতাময়ী নারী। পৃথিবীর সেরা নাট্যসম্রাজ্ঞীও বোধ হয় এতটা পেরে উঠত না।
ঘরে আসতেই চোখে পড়েছিল, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ শুয়ে আছে। চোখের তারা জ্বলে উঠেছিল মৃদুলার। জিগ্যেস করছিল, কোথায় গিয়েছিল?
মধ্যরাতে মৃদুলা কেন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তা জানাতে চায়নি অনির্বাণ। শুধু বলেছে, ছাদে গিয়েছিলাম
চাঁদ দেখতে?
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। মহাশূন্য থেকে হলুদ বর্ণের গোলাকার চাঁদ নীচের পৃথিবীতে জ্যোৎস্না চেলে যাচ্ছিল অবিরাম। অপার্থিব আলোয় ভরে যাচ্ছিল কলকাতা নামে খানাখন্দে আবর্জনায় বোঝাই, ভাঙাচোরা, কুৎসিত এই মহানগর।
অনির্বাণ যে ডাহা মিথ্যে বলেছে, সেটা তার মুখচোখের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। মৃদুলা শ্লেষের সুরে বলেছিল, এক বছরের ওপর আমাদের বিয়ে হয়েছে। এর ভেতর কতবার পূর্ণিমা এসেছে। আগে কখনও চঁদ দেখতে ছাদে উঠেছ বলে তো মনে পড়ে না।
আগে উঠিনি বলে, কোনওদিন উঠব না, তার কি কোনও মানে আছে? আজ ইচ্ছে হয়েছিল তাই ছাদে গিয়েছিলাম।
হঠাৎ এই প্রকৃতিপ্রেম চাড়া দিয়ে উঠল যে? কারণটা কী?
কোনও কারণ নেই।
তীব্র, কটু গলায় মৃদুলা বলেছে, আছে, আছে। লায়ার–মিথ্যেবাদী।
আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ভ্যাজর ভ্যাজর থামাও- বলে পাশ ফিরে শুয়েছিল অনির্বাণ।
অসহ্য ক্রোধে কপালের দুপাশের রগগুলো যেন ছিঁড়ে পড়বে। জ্বলন্ত চোখে অনির্বাণের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেছে মৃদুলা। এই পুরুষটির বেশিরভাগটাই দখল করে নিয়েছে এক কুহকময়ী নারী। তার ভাগে পড়েছে ছিটেফোঁটা। যার ষোল আনা প্রাপ্য সে কণিকা পরিমাণ নিয়ে খুশি থাকবে কেন?