ইন্দ্রনাথ মেয়েকে দিয়েছিলেনও প্রচুর। দুসেট গয়না, খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল, রঙিন টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ডিভান, এমনি কত কী। মৃদুলার জন্মের পর থেকেই তার বিয়ের জন্য মাসে মাসে ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ে গেছেন ইন্দ্রনাথ। বিয়ের সময় সুদে আসলে সেটা কয়েক লাখে দাঁড়িয়ে ছিল। সবটাই তিনি খরচ করেছেন।
শ্বশুরবাড়িতে যাবার পর কিছুদিন কোনও গোলমাল নেই। সব মসৃণ নিয়মেই চলছিল। যেমন অন্য দশটা মেয়ের জীবনে ঘটে, অবিকল তা-ই।
প্রথমটা লক্ষ্য করেনি মৃদুলা। বিয়ের পর পর যে-কোনও তরুণীর শরীরে এবং মনে ঘোর লেগে থাকে। সেই ঘোরটা কেটে গেলে এমন কিছু কিছু ব্যাপার চোখে পড়তে লাগল যা ভীষণ চোখে পড়ে। তার ভুরু কুঁচকে যেতে লাগল।
তরুলতা মাঝে মাঝে অনির্বাণের দিকে কেমন করে যেন তাকায়। ঠোঁট টিপে নিঃশব্দে অদ্ভুত হাসে। তার চাউনি আর হাসির মধ্যে কীসের যেন সংকেত থাকে। তাছাড়া, একটু আড়াল হলেই অনির্বাণকে জড়িয়ে ধরে নাকটা তার গালে কি গলায় ঘষতে থাকে। চাপা, ফিসফিস গলায় কী যেন বলে।
ততদিনে শিঞ্জিনী পেটে এসে গেছে। দেখেশুনে অদ্ভুত শঙ্কায় মন ভরে যেত মৃদুলার। সারাক্ষণ বুকের ভেতর থির থির কাঁপুনি। এক ঝাক বিষাক্ত পোকা যেন মাথায় অবিরাম হুল ফুটিয়ে চলেছে। কী যে কষ্ট! কী যে নিদারুণ যাতনা!
মৃদুলা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কী করবে, কী করা উচিত, প্রথম দিকে ভেবে পাচ্ছিল না। একবার ভেবেছিল, মা-বাবাকে সব জানায়। পরক্ষণে মনে হয়েছে, তাঁরা ভেঙে পড়বেন। সে মনস্থির করে ফেলেছিল, অনির্বাণের সঙ্গে বোঝাঁপড়াটা নিজেই করে নেবে। এর মধ্যে আপাতত অন্য কাউকে জড়াবে না।
একদিন রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া চুকে যাবার পর শোওয়ার হতাড়জোড় চলছে, মৃদুলা বলেছিল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। বসো খাটের এক কোনায় নিজে বসে অন্য প্রান্তটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে।
মৃদুলার স্বরে চাপা কাঠিন্য মেশানো। একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতে তাকাতে খাটের অন্য কোনায় বাজুতে আলগা করে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিল অনির্বাণ। জিগ্যেস করেছে, কী কথা?
আমি যা বলব, তোমার কিন্তু ভালো লাগবে না।
ঠিক আছে। বলো–
একটু চুপচাপ।
তারপর পরিবেশটা লঘু করার জন্যই হয়তো অনির্বাণ বলেছে, আমি গর্দান দেবার জন্যে প্রস্তুত।
থমথমে মুখে মৃদুলা বলেছে, হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। যা বলব তার সঙ্গে তোমার আমার ভবিষ্যৎ অনেকখানি জড়িয়ে আছে।
দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিল অনির্বাণের। সে কোনও প্রশ্ন করেনি।
তরুলতার সঙ্গে অনির্বাণকে কবে কখন, কোন অবস্থায় দেখেছে, তাদের টুকরো টুকরো কী কথা কানে এসেছে, এবার তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গেছে মৃদুলা। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেয়নি। তারপর জিগ্যেস করেছে, অস্বীকার করতে পারো?
হতচকিত অনির্বাণ কী উত্তর দেবে, ভেবে পায়নি।
মৃদুলা গলায় স্বর উঁচুতে তুলে বলেছে, এ সবের মানে কী?
সরাসরি আক্রমণ এবং অতর্কিত। বর্ম পরে সেটা ঠেকাবার মতো যথেষ্ট সময় পায়নি অনির্বাণ। তবু খানিকটা সামলে নিয়ে বলেছে, তুমি ভুল বুঝেছ
মৃদুলার কপাল কুঁচকে গেছে, মানে?
তুমি যা ভাবছ তা নয়। বৌদি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো মনে করে। দিদি কি তার ভাইকে আদর করতে পারে না?
আমি যথেষ্ট সাবালিকা। দিদির আদর কী, সেটা আমাকে বোঝাতে হবে না। একটা কথা তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। এ ধরনের ব্যাপার আমি পছন্দ করি না।
অনির্বাণ বলেছিল, তুমি একটা ভুল ধারণা তৈরি করে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছ। এর কোনও মানে হয় না।
মৃদুলা উত্তর দেয়নি।
পরদিন তরুলতা মৃদুলার একটা হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে কাছে বসিয়েছিল। মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে গলার স্বরে অপার স্নেহ ঢেলে দিয়ে বলেছে, কী পাগল মেয়ে রে তুই! অনির্বাণ খুব দুঃখ পেয়েছে। মাথা থেকে ওই সব চিন্তা বার করে দে।
মৃদুলা চুপ। সে বুঝতে পারছিল, আগের রাতে সে যা যা বলেছে, অনির্বাণ সবই তরুলতাকে জানিয়ে দিয়েছে।
তরুলতা ফের বলেছে, তোকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল কে? আমি তো? আমার মত না থাকলে তুই কি এ বাড়ির বউ হয়ে আসতে পারতিস?
তরুলতা কী ইঙ্গিত দিতে চাইছে, মোটামুটি আঁচ করতে পারছিল মৃদুলা। কী চাইছিল সুন্দরী বিধবা তরুণীটি? যেহেতু তার পছন্দের জোরে বিয়েটা হয়েছে তাই মৃদুলাকে মুখ বুজে তার সব কিছু মেনে নিতে হবে?
মৃদুলা ফুঁসে উঠতে যাচ্ছিল তার আগেই হেসে হেসে ফের তরুলতা বলেছে, তুই দুঃখ পাস, এমন কিছু কি আমি করতে পারি? সন্দেহ আর দুশ্চিন্তাকে যদি প্রশ্রয় দিস, নিজের তো বটেই, পেটে যে বড় ইচ্ছে তারও ক্ষতি। এসময়টা মেয়েদের আনন্দে থাকতে হয়।
তরুলতা মিষ্টি মিষ্টি কথায় তাকে বোঝাতে চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতর সন্দেহের সে কাটাবন মাথা তুলতে শুরু করেছিল তা নির্মূল হয়নি।
রত্নময়ীর সঙ্গেও এই নিয়ে কথা হয়েছে মৃদুলার, তিনিও অন্যরকম কিছু বলেননি, তরুলতা যখন বউ হয়ে এ বাড়িতে এল, অনির্বাণ তখন সদ্য যুবক। মাত্র সতেরো কি আঠারো বছর বয়স। নিজের ভাইবোন নেই, স্বামীর ভাইটিকে বড় মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিল তরুলতা। দুজনের সম্পর্কটা বড় মধুর। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র নোংরামি বা আবিলতা নেই। ইত্যাদি।