Site icon BnBoi.Com

দেরি হয়ে গেছে – প্রচেত গুপ্ত

দেরি হয়ে গেছে - প্রচেত গুপ্ত

০১. বাইরে চোখ পড়তে

 

০১.

বাইরে চোখ পড়তে থমকে গেল যামিনী। সামান্য চমকেও উঠল। দেবনাথ রিকশা থেকে নামছে। রিকশা কেন! দেবনাথ তো চট করে রিকশায় ওঠে না। চিন্তিত যামিনী গ্রিলের ওপর ঝুঁকে স্বামীর মুখ দেখতে গেল। পারল না। দেবনাথের মুখ উলটো দিকে ফেরানো।

যামিনীর চিন্তার কারণ আছে। কিছুদিন হল দেবনাথের বাঁ-হাতে একটা ব্যথা শুরু হয়েছে। কনুইয়ের ওপর থেকে মাঝেমধ্যে টানের মতো ধরে। বাজারের ভারী ব্যাগ ধরলে ব্যথা বাড়তে পারে এই ভেবে যামিনী রিকশার কথা বলেছিল। দেবনাথ হেসে উড়িয়ে দেয়।

যামিনী বলল, হাসার কী হয়েছে! ভারী ব্যাগ নিয়ে এতটা পথ হেঁটে আসো তাই রিকশার কথা বললাম। হাতের ব্যথাটা বাড়তে পারে। রিকশা নিলে সময়ও কম লাগবে।

দেবনাথ গম্ভীর গলায় বলল, সময় লাগার জন্যই তো হাঁটি যামিনী। আগে ঘোষবাগানের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করতাম, এখন সেটাও বন্ধ করে দিয়েছি।

সকালবেলা হেঁটে শরীর ভালো করতে চাও তো ঝাড়া হাত পায়ে হাঁটো। কে বারণ করেছে? বাজার-ভরতি ব্যাগ নিয়ে হাঁটার দরকার কী? ব্যথা বাড়লে তো আমাকেই সেবা করতে হবে। রাগ দেখায় যামিনী।

বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটারই দরকার আছে। ওই সময়টায় আমি বেগুন, আলু, ঝিঙে পটলের সঙ্গে গল্প করতে করতে আসি। ব্যাগের ভেতর থেকে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে।

যামিনী দেবনাথের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

তাই নাকি! কী বলে ওরা?

দেবনাথ সহজ ভঙ্গিতে বলল, এমন কিছু নয়, হালকা- পলকা কথা সব। দেশের খবর, রাজনীতির খবর জানতে চায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বলে সেদিন খুব দুশ্চিন্তা করছিল। বলল, স্যার, আপনাদের চারজনের সংসার, কীভাবে যে ম্যানেজ করেন! নেহাত ম্যাডাম স্কুলে পড়ান তাই চলছে। না হলে হালুয়া টাইট হয়ে যেত। সবার অবস্থাই তো দেখছি। আপনার মাইনেটাইনের অবস্থা তো মোটে ভালো নয়। সামনে কোনও প্রোমোশন আছে বলেও মনে হচ্ছে না। শুনেছি ইউনিয়নকে তেল মারতে পারেন না, প্রোমোশন হবে কী করে! যাক, ম্যাডামকে সাবধানে চলতে বলবেন। ওঁর আবার খরচাপাতির হাত বেশি। এরকম করলে চলবে না, টেনে চলতে হবে। ছেলেমেয়ে দুটো এখন ছোট বলে চলে যাচ্ছে, বড় হলে চাপ বাড়বে। দিনকাল ভালো নয়।

যামিনী চোখ বড় করে, গলায় মেকি বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, তোমার ঝিঙে-পটলরা তোমাকে জ্ঞানও দেয়? বাপরে! এ তো শিক্ষিত ঝিঙে পটল দেখছি!

দেবনাথ গলায় আবেগ এনে বলল, জ্ঞান বলছ কেন যামিনী? অ্যাডভাইস বলো। বন্ধুকে বন্ধুর অ্যাডভাইস।

যামিনী আর পারে না, হেসে ফেলে। বলল, থাক, তোমাকে রিকশা চাপতে হবে না, তুমি হেঁটেই এসো। আমার বলাটাই অন্যায় হয়েছে। তোমার ঝিঙে-পটল রাগ করবে।

দেবনাথের রসিকতার স্বভাব যামিনী গোড়া থেকেই চিনেছে। বিয়ের সময় থেকেই। ফুলশয্যার রাতে এই লোক তাকে ফিসফিস করে বলেছিল, একটা গোপন কথা আছে। যদি কখনও ফাস না করে বলতে পারি। এই কথা আমি কাউকে বলিনি।

সম্বন্ধ করে বিয়ে। মানুষটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় মাত্র কয়েকদিনের। কথা হয়েছে মেরেকেটে পাঁচদিন। তা-ও তিনদিন টেলিফোনে, দুদিন মুখোমুখি। সেই মুখোমুখির আবার ভাগ ছিল। প্রথমদিন সঙ্গে বাড়ির লোক ছিল। ছেলের বউদি। দ্বিতীয়দিন দুজনে একা একা। ফলে চেনা হয়নি প্রায় কিছুই। তার ওপর ফুলশয্যা-রাতের আড়ষ্টতা। যামিনী কথা না বলে শুধু চোখ তুলেছিল। একটু ভয়ও পেয়েছিল। গোপন কথা আবার কী রে বাপু! অসুখবিসুখ আছে নাকি? মালবিকার এরকম হয়েছিল। ফুলশয্যার রাতে ছেলে দরজা বন্ধ করেই কান্নাকাটি শুরু করল– আমি পারি না, আমার অসুখ আছে। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও। এ-ও সেরকম নয় তো! পুরোনো প্রেম? গল্প-উপন্যাসে এরকম পড়েছে। এইসব সময় নতুন স্বামী দুম করে অন্য মেয়ের গল্প বলে বসে। প্রথম প্রেমে ব্যথা পাওয়ার গল্প। হাত চেপে ধরে যাত্রামার্কা থরথর গলায় বলে, তুমি কিন্তু একাজ করো না, তা হলে আমি মরে যাব সোনা।

দেবনাথ সে সব কিছুই বলল না। স্মার্ট ভঙ্গিতে সরাসরি প্রশ্ন করল, আমি তোমাকে কেন বিয়ে করলাম জানো যামিনী?

যামিনী চুপ করে রইল। একথার সে কী উত্তর দেবে? ফুলশয্যার পরীক্ষায় যাতে মোটামুটি পাস করতে পারে তার জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর শিখে এসেছে। থিওরিটিক্যাল, প্র্যাকটিকাল দুটোই। তাতে এই প্রশ্ন ছিল না। তবু লাজুক গলায় বলল, পছন্দ হয়েছে তাই।

দেবনাথ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। হাতটা মাথার পিছনে রেখে বালিশে শুয়ে পড়ল ধপাস করে। তারপর সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে উদাসীন গলায় বলল, অনেকে ভাববে সুন্দরী এবং ভালো মেয়ে বলে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কথাটা ঠিক নয়। আমি একবারই মেয়ে। দেখতে গেছি, আর সেটা তোমাকেই। ফাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল। তুমি যদি এটা শুনে খুশি হও, তা হলে বিরাট বোকামি করবে। কিছু মনে কোরো না, তোমার বদলে সেদিন যদি অন্য কাউকে দেখতে যেতাম, তা হলেও রাজি হয়ে যেতাম। আমার পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। কারণ আমি বিয়ে করেছি বউয়ের জন্য নয়, ভূতের জন্য!

এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না যামিনী। বলল, ভূতের জন্য! মানে?

দেবনাথ শোয়া অবস্থাতে বাঁ-পায়ের হাঁটুর ওপর ডান পা তুলে নাড়তে লাগল। বলল, আমার খুব ভূতের ভয় যামিনী। রাতে ঘুম ভাঙলেই খুটখাট আওয়াজ পাই। ছোটবেলায় ছিল না, বয়েস হওয়ার পর শুরু হয়েছে। মনে হয়, কে যেন পাশে এসে বসল! মাথার বালিশটা ঠিক করে গায়ের চাদরটা টেনে দিল! ঠান্ডা লাগলে ফ্যানের রেগুলেটর কমিয়ে দেয়। ওরে বাবা! প্রায়ই আমার ঘুমের দফারফা হয়ে যায়।

যামিনী মজা পায়। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি এনে বলল, কেন?

দেবনাথ ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে। কোলের ওপর বালিশ টেনে স্ত্রীর দিকে বড় চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে, কেন কী গো! ঘরে ভূত নিয়ে ঘুমোব? তুমি কি খেপেছ? বাকি রাত জেগে, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। কথাটা কাউকে বলতেও পারি না। ধেড়ে লোক ভূতের ভয় পায় শুনলে সকলে হাসবে। ভাবতাম, ইস রাতে কেউ যদি আমার সঙ্গে শুত! এই জন্যই বিয়ে। আবার শুয়ে পড়ল দেবনাথ। হাসিমুখে বলল, তুমি এসে গেছ আর চিন্তা রইল না। এবার নিশ্চিন্তে, নাক ডেকে ঘুমোব। আমার কী মনে হয় জানো যামিনী? মনে হয়, আমার মতো অনেকেই আছে যারা স্রেফ ভূতের হাত থেকে বাঁচতে বিয়ে করে। লজ্জায় মুখ ফুটে বলে না।

যামিনী মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে ফেলল। তার খুব ভালো লাগে। বিয়ের আগে অল্পস্বল্প কথা বলে বুঝেছিল, মানুষটা ভালো, কেয়ারিং। সম্ভবত এইরকম একজন পুরুষের জন্যই সে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু মানুষটার মধ্যে যে উইট আছে সেটা বুঝতে পারেনি। এটা বাড়তি পাওনা হল। ছ্যাবলা হওয়া খারাপ, তা বলে গোটা জীবন একটা গোমড়ামুখো মানুষের সঙ্গে কাটানো আরও ভয়ঙ্কর।

সেদিন রাতে আলো নেভানোর পর যামিনী যখন স্বামীর গা-ঘেঁষে আসে, দেবনাথ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেছিল, কে? ভূত নাকি?

যামিনী দেবনাথের কানের পাশে মুখ এনে বলল, না, পেত্নি!

দেবনাথ স্ত্রীর দিকে ঘন হয়। বলে, পেত্নি এত জামাকাপড় পরে নাকি? খসখসে বেনারসি?

যামিনী লজ্জা পায়। বলল, আমি জানি না।

দেবনাথ হাত বাড়িয়ে যামিনীর ব্লাউজের বোতাম খুঁজতে খুঁজতে বলে, আমি জানি।

পরদিন সকালে সবাই যখন যামিনীকে চেপে ধরেছিল, যামিনী মুচকি হেসে বলল, পরে বলব, সে একটা ভূতের গল্প।

এই লোক যে বাজারের আলু-পটল নিয়ে রসিকতা করবে সে আর আশ্চর্য কী?

যামিনী চায়ের জল বসিয়ে দিল। স্বামী হিসেবে যামিনীর কাছে দেবনাথের যে ছোটখাটো অল্প কয়েকটা চাহিদা আছে, তার মধ্যে একটা বাজার থেকে ফিরলেই চা দিতে হবে। গরম চা। তবে সেই চা সঙ্গে সঙ্গে খাবে না দেবনাথ। গরম চা সে খেতে পারে না। হাতে কাপটা ধরে খবরের কাগজ খুলে বসবে। সময় নিয়ে কাগজ পড়বে। চা ঠান্ডা হলে চুমুক দেবে। বিয়ের পর এই অদ্ভুত স্বভাব দেখে যামিনী অবাক হয়েছিল।

এ আবার কী! খাবে না তো এত হুটোপুটি করো কেন? আমি অন্য সব ফেলে চা নিয়ে পড়ি।

দেবনাথ বলছিল, খবরের কাগজ পড়ার সময় গরম কিছু হাতে না ধরলে মজা পাই না। তাই গরম কাপ নিয়ে বসি। তবে আজকাল কাগজগুলোতে গরম যেভাবে বাড়ছে তাতে আর চায়ের কাপে হবে বলে মনে হচ্ছে না। ডাইরেক্ট আগুন হাতে বসতে হবে। তুমি একটা কাঠকয়লা পুড়িয়ে রাখবে, আমি বাঁ-হাতের চেটোতে রেখে নেতা-মন্ত্রীর ভাষণ পড়ব আর উঃ আঃ করব। হা হা। প্রাণ খুলে হাসে দেবনাথ।

যামিনী ঠোঁট বেঁকায়। মজা পেলেও বুঝতে দেয় না। গলায় বিরক্তি এনে বলে, থামো তো, সবসময় তোমার এই হ্যাঁ-হ্যাঁ হি-হি ভালো লাগে না।

এখন দেবনাথ বাজার থেকে ফেরার আগেই মোটামুটি একটা হিসেব করে চায়ের জল বসিয়ে রাখে যামিনী। হিসেব কাছাকাছি ঠিকই হয়। এতদিনে আরও অভ্যেস হয়ে গেছে। আসলে গুছিয়ে বাজার করলেও, দেবনাথ কখনও রাস্তায় সময় নষ্ট করে না। কারও সঙ্গে দেখা হলে আড্ডায় দাঁড়িয়ে যাওয়ার স্বভাব তার নেই। দু-একটা কথা বলেই সরে পড়ে। শুধু বাজার নয়, কোথাও গেলেও বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে। নেমন্তন্ন বাড়িতে পৌঁছেই খেয়ে নিতে চায়। ট্রেন-বাসের বাহানা তোলে।

ভাই, শুনছি মেনু যেরকম লম্বা করেছ তাতে খেতে অনেকটা সময় লাগবে। লাস্ট ট্রেনটাও মিস হয়ে যাবে। তোমাদের মতো কলকাতাতে তো থাকি না। হয় মেনু কাটছাঁট করো, না হয় এখনই বসিয়ে দাও।

বিয়ের পর পর পুরুষমানুষ বাড়ির ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করলে বন্ধুরা ঠাট্টা করে। সেই ঠাট্টার মধ্যে আদিরস থাকে। দেবনাথের বেলায় সেরকম কিছু হয়নি। পরিচিতরা সকলেই জানে মানুষটা এরকমই। হোমসিক, ঘরকুনো। খানিকটা যেন অলস টাইপের। যামিনী বুঝেছে, অলস বা ঘরকুনো নয়, তার স্বামীর কাছে বাড়িটাই সবথেকে স্বস্তির জায়গা। রোজ কলকাতা পর্যন্ত চাকরি করতে গিয়ে অনেকটা সময় যাতায়াতেই চলে যায়। এরপর আর বাইরেটা ভালো লাগে না। আর যদি ঘরকুনো হয় তাতেই বা ক্ষতি কী? উড়নচণ্ডী স্বামীর থেকে ঘরকুনো স্বামী ভালো। স্ত্রীর সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা বেশি হয়। তা ছাড়া যখন খুশি সংসারের পাঁচটা পরামর্শও করা যায়। এটা খুব দরকার। যারা স্বামীকে পায় না, তারা বোঝে কত দরকার। তার ওপর দেবনাথের মস্ত গুণ হল, এমনি যতই হাসিঠাট্টা করুক, কাজের সময় সিরিয়াস। কোনও একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভেবেচিন্তে নেয়, কিন্তু নেওয়ার পর কখনও দোনামোনা করে না। কনফিডেন্সের সঙ্গে কাজটা করে। বলে, একবার যখন ঠিক করে ফেলেছি, দ্যাট ইজ ফাইনাল। যদি ভুল হয় হবে। বাড়ির পুরুষমানুষ এরকম হলে সুবিধে। যামিনী ভরসা পায়।

.

স্কুলের স্টাফরুমে ঘর সংসার, ছেলেমেয়ে নিয়ে সবসময়েই আলোচনা চলছে। এতবছর পরেও দেবনাথের স্বভাব নিয়ে কথা ওঠে। হিস্ট্রির বিশাখা ভারি সুন্দর মেয়ে। নরম মন। যামিনীকে পছন্দ করে খুব। যামিনীদি, যামিনীদি করে। সে-ও দেবনাথকে নিয়ে মজা করে। বিশাখার চার বছর হল বিয়ে হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে। হিন্দোল চমৎকার ছেলে। পছন্দ করার মতোই ছেলে। চাকরিটা ভালো, তবে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। প্রথম প্রথম বিশাখার কোনও সমস্যা হয়নি। সব ঠিকঠাক ছিল। শ্বশুরবাড়িতে নানারকম জটিলতা দেখা দিল। এদিকে ছেলে বড় হচ্ছে। তার হাজারটা ঝামেলা। বিশাখাকে একা হাতে ঘর-বাইরে সব সামলাতে হয়। কাজের লোক দিয়ে পুরোটা হয় না, শ্বশুরশাশুড়ির সেবাযত্নের ওপর নিজে নজর না রাখলে তাদের মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। এমন অনেক সমস্যা আসে যেগুলোর ডিসিশন চট করে একা নেওয়া কঠিন। হিন্দোলের সঙ্গে পরামর্শের দরকার হয়। কিন্তু তাকে পাবে কোথায়? হিন্দোলকে বললে সে অবাক হয়।

কেন! মোবাইলে পাবে। মোবাইল তো সবসময় খোলা।

রেগে যায় বিশাখা। বলে, ঠিকই বলেছ। সুন্দর দেখতে একটা মোবাইল ফোনকে বিয়ে করলেই পারতে। দরকারে অদরকারে তোমার সঙ্গে কথা বলত, গানও শোনাত। আজকাল চমৎকার সব রিং টোন পাওয়া যায়।

সেদিনই স্টাফরুমে বিশাখা বলল, যামিনীদি, আই ফিল জেলাস ফর ইউ। তোমার জন্য হিংসে হয়; একটা বর পেয়েছে বটে! বোতল-দৈত্যের মতো সারাক্ষণ গিন্নির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কী করতে হবে প্রিয়তমা? একবার শুধু হুকুম করো।

কথাটা বলতে বলতে হাতজোড় করে দেখায় বিশাখা। সবাই হেসে ওঠে। যামিনী চোখ পাকিয়ে হেসে বলল, অ্যাই, নজর দিচ্ছিস কেন? আমি সুখে আছি সহ্য হচ্ছে না বুঝি?

বিশাখা জিভ কেটে, হেসে বলল, ছি ছি নজর দেব কেন? চিরকাল তোমরা এরকম ভাবে থাক। যখন পৃথিবীর দাম্পত্য- ইতিহাস লেখা হবে তোমাদের নাম থাকবে সবার ওপরে।

যামিনী হাসতে হাসতে বলল, তুই তো হিস্ট্রির ছাত্রী, তুই লেখ না!

অঙ্কের আরতিদি বিষয়টা কোনওদিনই ভালো চোখে দেখে না। মহিলা টিপিক্যাল পুরোনো-দিনের দিদিমণি টাইপ। খিটখিটে স্বভাব থেকে যতটা না বেরোতে পারে, তার থেকে বেশি বেরোতে চায় না। ব্যক্তিগত জীবনও গোলমেলে। দুটো বিয়ে। প্রথমজন ডিভোর্স করে সরে গেছে। দ্বিতীয়জন বিয়ের সময় খুব আহা উঁহু করেছিল। এখন সে-ও নাকি পালাতে পারলে বাঁচে। সকাল হতে না হতে বেরিয়ে পড়ে, বাড়িতে ঢোকে গভীর রাতে। উপায় কী? কয়েকবছর হল, আরতিদির সন্দেহবাতিক অসুখ দেখা দিয়েছে। সবসময় সন্দেহ। বাড়িতে স্বামী থাকলে কাজের লোককে পর্যন্ত একা ছেড়ে বেরোতে চায় না। স্কুলে এসে তাকে নীচু গলায় মাঝেমধ্যে এসব বলেও। যামিনী শুনতে চায় না, তা-ও জোর করে।

তুই জানিস না যামিনী, লোকটা খুব পাজি। মেয়েমানুষ দেখলেই উসখুস করে।

যামিনী চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, উফ আরতিদি, আবার শুরু করলে? পশুপতিদার নামে তুমি মিছিমিছি এ সব বল।

মিছিমিছি! একদিন আমার সঙ্গে থাকলে বুঝতে পারতিস তোদের পশুপতিদা কত বড় দুশ্চরিত্র।

যামিনী হাত তুলে বাধা দেয়। বলে, ঠিক আছে, তোমার কথাই মেনে নিলাম। এবার চুপ কর দেখি।

আরতিদি চুপ করে না। বলে, সেদিন উমা ঘর মুছছিল। গায়ে কাপড়চোপড় ঠিক ছিল না। তোর পশুপতিদা দেখি মেয়েটার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিশ্চিত, আড়ালে ওই লোক উমার গায়ে হাত দেয়।

কাজের লোক ছাড়িয়ে দিলেই হয়!

আরতিদি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। বলে, লোক কম ছাড়িয়েছি? কোনও লাভ হয়নি। আমার বিশ্বাস পাশের বাড়ির বউটার সঙ্গেও ওর লটঘট আছে। বউটা কাপড় শুকোতে দেওয়ার সময় ওকে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে দেখেছি। বউটা বদ। হাত তুলে বগল দেখায়!

যামিনী চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, উফ থামবে? এবার কিন্তু আমি উঠে যাব। আরতিদি থামে না। বলতেই থাকে। আমার বোনের সঙ্গেও চেষ্টা করে। হেসে হেসে কথা বলে। ঢলানি করে। যামিনী এবার হেসে ফেলল। বলল, শালির সঙ্গে হেসে কথা বলবে না তো কী করবে? কেঁদে কথা বলবে? এর সঙ্গে চরিত্রের কী সম্পর্ক আরতিদি!

আরতিদি হাসে না, গম্ভীর গলায় বলল, সম্পর্ক আছে। বোনকে বলেছি, আমি না থাকলে বাড়িতে আসবি না।

ক্লাসের ঘণ্টা বেজে যায়। যামিনী চক-ডাস্টার নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নামিয়ে বলে, তুমি এবার মাথার ডাক্তার দেখাও। নইলে প্রবলেম বাড়বে।

সেই আরতিদি বিশাখার কথায় ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, অত আদিখ্যেতা ভালো নয়। এ আবার কী! পুরুষমানুষ সারাক্ষণ বউয়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকবে? ইস মাগো! অসহ্য।

যামিনী বলল, সারাক্ষণ কোথায়? কাজকর্ম করে না বুঝি? অফিস যায় না? সকাল আটটা বাজতে না বাজতে সেই কলকাতায় ছোটে।

আরতিদি বলে, ওই একই হল। বেটাছেলে সন্ধের পর একটু-আধটু বাইরে না থাকলে মানায় না। একটু তাস-পাশা, একটু মেয়েমানুষ, একটু নেশাভাঙ করবে তবেই না পুরুষ!

বিশাখা মুখ টিপে হাসে। কিছু একটা বলতে চায়। যামিনী চোখের ইশারায় বারণ করে। পাগলকে সাঁকো নাড়ানোর মানে হয় না।

তবে যে যা-ই বলুক, যামিনী খুশি। দেবনাথের সংসারের দায়দায়িত্ব যে খুব কিছু ভাগ করে নিয়েছে এমন নয়, সত্যি সে কিছুটা অলস প্রকৃতির। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে ঘরদোর সামলানোর প্রায় পুরোটাই যামিনীর ম্যানেজমেন্ট। বাসন মাজা, কাপড় কাঁচার লোক আছে। গনাইয়ের মা করিতকর্মা মহিলা। আটটা বাজতে না বাজতে কাজ গুছিয়ে চলে যায়। তারপর রান্নার জন্য বিজলি আসে। বাড়িতে থাকলে দেবনাথের কাজ হল, চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিভিতে খবর দেখা, ম্যাগাজিন উলটানো। সিডি চালিয়ে কখনও গান শোনে। চাপাচাপি করলে মেয়েকে অঙ্ক দেখিয়ে দেয়। মেয়েটা অঙ্কে কাঁচা। তবে বাবার নেওটা। বাবা বাবা করে। হাতের কাছে পাওয়ার কারণে মানুষটাকে দিয়ে যে সবসময় বিরাট কোনও কাজের কাজ হয় এমন নয়। কিন্তু তার উপস্থিতিটাই এই বাড়ির পক্ষে স্বস্তিদায়ক। অভ্যেস হয়ে গেছে।

.

জানলার দিকে এক পা এগিয়ে গেল যামিনী। দেবনাথ রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিচ্ছে। মুখটা এবার দেখা যাচ্ছে। শরীর খারাপের কিছু নেই, বরং মুখ হাসি-হাসি। যামিনী নিশ্চিন্ত হল, আবার অবাকও হল। সাতসকালে রিকশাওলার সঙ্গে হাসাহাসি কীসের! এই লোক কি না হেসে পারে না! জানলা থেকে ফিরে রাগ-রাগ মুখে চায়ের কাপে মন দিল যামিনী।

ভাড়া বাড়িতে রান্নাঘর মাপে ছোট হয়। অনেক সময় একেবারে এক চিলতে। বাতাস চলাচলের ব্যাপার থাকে না। দিনেরবেলাতেও অন্ধকার। সবসময় মনে হয়, বাইরে মেঘ করেছে, এখনই শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে হবে। সেই তুলনায় এই জানলা যথেষ্ট বড়। যামিনীর পছন্দের। পছন্দ জানলার মাপের জন্য নয়, পছন্দ জানলা থেকে বাড়ির গেট পর্যন্ত দেখা যায় সেই কারণে। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে বাড়িতে কে আসছে যাচ্ছে জানা যায়। এটা একটা অ্যাডভান্টেজ। ছেলেমেয়ে দুজনেই স্কুলে পড়ে। স্কুলে পড়ে মানে অবশ্য একেবারে ছোটও নয়। নীলাদ্রি এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। কিঙ্কিনির ক্লাস সেভেন শেষ হতে চলল। দুজনের কারওরই আতুপুতুর বয়স নেই। তবু তারা বাড়ি থেকে বেরোলে চিন্তা হয়। আগে এতটা ছিল না। তখন ছেলেমেয়েরা সত্যি-সত্যি বেশ ছোট ছিল। গুট-গুট করে বাড়ির কাছে স্কুলে যেত। রিকশাতে ষোলো-সতেরো মিনিটের পথ। রেলগেটে আটকে পড়লে আরও খানিকটা বাড়তি সময় লাগত। তবে সে তো আর রোজ নয়, যেদিন লেট হত সেদিন। আসলে শহরটাই ছোট। একপাশে রেলস্টেশন, অন্যপাশে হাইওয়ে। তার ওপর এখানে দেখতে দেখতে অনেকটা দিন থাকা হয়ে গেল। কিঙ্কিনির যখন দু-বছর বয়েস তখন এসেছিল। এতদিনে কম বেশি প্রায় সকলেই মুখ চেনা হয়ে গেছে। আর পাঁচটা ছোট মফসল শহরের চেহারা যেমন হয়। শহর বাড়ছে। দোকান বাজার, ফ্ল্যাটবাড়ি, সাইবার কাফে হয়েছে। যামিনীর ছেলেমেয়ে দুজনেই এখন দূরের স্কুলে যায়। ছেলে যায় ট্রেনে। চারটে স্টেশন পেরোতে হয়। মেয়েও তিন বছর হয়ে গেল হাইওয়ের ধারে নতুন স্কুলে গেছে। স্কুলের বাস আছে। বাস অবশ্য বাড়ির সামনে পর্যন্ত আসে না। গলি থেকে বেরিয়ে মিনিট দশ হাঁটতে হয়। ব্যবস্থা সব ঠিকঠাক হলেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে যামিনীর উদ্‌বেগ কমে না। চাকরি করতে গিয়েও চিন্তা করে। রাতে শোয়ার সময় দেবনাথকে বলে, বাচ্চাদের নিয়ে আমার টেনশন হয়। অতটা সময় স্কুলে থাকি। ওরাও বাইরে। তোমার তো কোনও খেয়াল নেই। আজ কী শুনলাম জান?

কী শুনলে?

বাসবীদির মেয়ের একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছে।

বাসবীদিটা কে? দেবনাথ অবাক হয়ে বলল।

আমার কলিগ, সায়েন্সের টিচার।

কাণ্ডটা কী হয়েছে?

ট্রেনে একটা ছেলে চিঠি দিয়েছে। হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়েছে। আতঙ্কিত গলায় বলল যামিনী।

দেবনাথ আওয়াজ করে হেসে উঠল। যামিনী রেগে গিয়ে বলল, হাসছ! হাসছ কেন?

দেবনাথ হাসতে হাসতে বলল, হাসব না! একটা মেয়েকে একটা ছেলে চিঠি দেবে না তো কাকে দেবে? আমরাও দিয়েছি। মনে আছে নুপুর বলে একটা মেয়েকে চিঠি দিয়েছিলাম।

চুপ কর। একটা ক্লাস এইটে পড়া মেয়েকে প্রেমপত্র দেবে! ছি ছি।

দেবনাথ স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, শুনে বেশ ভালোই লাগছে যামিনী। আজকাল এসব হাতে লেখা চিঠি এখনও আছে তা হলে, আমি তো জানতাম উঠেই গেছে! মফস্সল বলে। চলছে। কলকাতা হলে এস এম এস আর চ্যাট হত। এখানেও কদিন পরে আর থাকবে না।

যামিনী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, থামো তো। আমার নীল আর কিঙ্কিকে নিয়ে ভয় করছে আর উনি চিঠির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করছেন!

দেবনাথ স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, আরে বাবা, ওরা তো বড় হচ্ছে, সব সময় চোখ। পেতে রাখলে হবে? এবার একটু নিজের মতো থাকতে দাও, ওদের শিখতে হবে না?

যামিনী বিরক্ত গলায় বলে, কী বলছ যা-তা? নিজের মতো থাকবে কথাটার মানে কী? এই বয়সটাই গোলমেলে। ছেলেমেয়ে দুজনের জন্য আলাদা-আলাদা করে গোলমেলে। বাইরে হাজারটা হাতছানি। এখনই তো বাবা-মায়ের বেশি করে নজর রাখার সময়। আজ বাদে কাল ছেলের ফাইনাল পরীক্ষা, একবার মন অন্যদিকে চলে গেলে কী হয় জান না? ফুলদির ননদের ছেলেটার কী হল? রাত করে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে, পরে জানা গেল নেশা করে।

দেবনাথ বিদ্রুপের গলায় বলল, তুমি দেখছি চিড়ে-মুড়ি সব এক করে ফেললে যামিনী। মনে রাখবে চিড়ে ইজ চিঁড়ে, মুড়ি ইজ মুড়ি। তোমার দিদির হাজব্যান্ডটি কেমন সেটা তো দেখবে। সারাদিন ব্যবসা আর সন্ধের পর পার্টি। মধ্যরাতে মদ্যপান করে বাড়ি ফেরা। বাবাকে দেখে ছেলেও বখে যাচ্ছে। আমাদের নীলকে নিয়ে ওসব চিন্তা কোরো না। তার বাবার লাইফ স্টাইলে কোনও ইনিডিসিপ্লিন নেই। অফিসের পর হাওড়ায় গিয়ে ছটা দশের গাড়ি ধরে কাটায় কাটায় আটটা চল্লিশে ইন। নটার মধ্যে বাড়ির ডোরবেলে আওয়াজ। টিং টং, টিং টং। আওয়াজ পাও কিনা?

কথাটা সত্যি। স্বামীকে নিয়ে চিন্তা নেই যামিনীর। বিয়ের পর থেকেই নেই। ঝড়বৃষ্টি, ট্রেনের সমস্যা বা কলকাতায় ঝামেলা কিছু না হলে দেবনাথের বাড়ি ফেরা ঘড়ি ধরে। সেরকম কিছু হলে খবর দেয়।

দেবনাথ এবার গাঢ় গলায় বলল, ছেলেমেয়ে নিয়ে অকারণে চিন্তা করলে মুখে ছাপ পড়বে, দেখতে বিচ্ছিরি হয়ে যাবে।

যামিনী রাগী গলায় বলল, বুড়ো বয়েসে আদিখ্যেতা কোরো না তো।

দেবনাথ ভুরু কুঁচকে বলল, কী আদিখ্যেতা করলাম?

যামিনী সরে গিয়ে বলল, জানি না।

দেবনাথ দু-হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে টানতে যায়। ফিসফিস করে বলল, জানি না বললে ছাড়ব কেন?

যামিনী বলল, অ্যাই ছাড়ো, ছেলেমেয়ে জেগে আছে। আওয়াজ পাবে।

ঠিক আছে, আওয়াজ হবে না। সাইলেন্ট মুভি।

যামিনী স্বামীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে করতে বলল, বুড়ো বয়েসে শখ গেল না। অসভ্য! তাড়াতাড়ি করো।

দেবনাথ দ্রুত হাতে যামিনীর নাইটি খুলতে খুলতে বলল, শখ যাবে কী করে? বউ এরকম সুন্দরী থাকলে মরার সময়েও শখ যাবে না।

কথাটা মিথ্যে নয়। দুই সন্তানের মা হলেও যামিনীর শরীর এখনও নষ্ট হয়নি। হিসেব মতো এতদিনে একটা ছাড়া-ছাড়া ভাব এসে যাওয়ার কথা। যামিনীর বেলায় এখনও আঁটোসাঁটো রয়েছে। পেটে মেদ জমেনি। বুকদুটো আজও অল্পবয়সিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এই বয়েসে গায়ের চামড়া ঠিক রাখাটা বিরাট সমস্যা। ঘরে-বাইরে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। যামিনীর হাতে-পায়ে বা নাকের পাশে কোথাও চামড়া এতটুকু কোঁচকায়নি। রাতে মেয়ের কাছে শোয় যামিনী। ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সপ্তাহে দু-তিনদিন দেবনাথের কাছে আসে। মুখে বিরক্তি দেখালেও আসতে ভালো লাগে। এই দিনগুলোর জন্য মনে মনে অপেক্ষা করে। মাঝেমাঝে। যামিনী অবাকও হয়। এই বয়েসে স্বামীর আদর এত কেন ভালো লাগবে! শরীরের কারণে? নাকি ভালোবাসা?

বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে নামিয়ে দেবনাথ বলল, ঝটপট চা দাও। তখনও তার মুখে হাসি হাসি ভাব। যামিনী আড়চোখে তাকিয়ে বলল, রিকশা করে এলে যে? ব্যথা বেড়েছে?

আরে না না, আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে।

যামিনী চুপ করে রইল। দেবনাথের মজার গল্প শোনার মতো সময় তার নেই। মেয়ে। স্কুলে চলে গেছে। ছেলে এখনই বেরোবে। আজ তার কেমিস্ট্রি না ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল। নীল বলে ল্যাব আছে। তাকেও কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময় স্কুলে ছুটতে হবে। আজ থেকে স্কুলে হাফইয়ারলি শুরু। টানা সাতদিনের ঝামেলা। কামাই চলবে না। এদিকে কিঙ্কিনির পরীক্ষা শুরু হবে পরের সপ্তাহ থেকে। পরীক্ষার আগের কটাদিন মেয়েটার পাশে না বসলে হয় না। ঘ্যানঘ্যান করে।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দেবনাথ বলল, মজার কথাটা শুনবে?

না, শুনব না, তোমার মজা শোনার সময় নেই। তুমি এই উইকটা ছুটি নাও। কিঙ্কির পরীক্ষা। আমি কামাই করতে পারব না।

দেবনাথ বলল, আচ্ছা সে দেখা যাবে। ঘটনাটা শোনো তো আগে।

যামিনী না শুনতে চাইলেও দেবনাথ রসিয়ে ঘটনা বলতে শুরু করল–

আমি বাজারে যাচ্ছি, দেখি মলয়বাবু হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলাম। ভাবলাম, এই রে, মলয়বাবু মানেই সময় নষ্ট। বুড়োমানুষ একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একশোবার বলবে। পালাতেও পারব না। পুরোনো বাড়িওলা বলে কথা। প্রথম যখন এখানে আসি, কিছু চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না, কেউ চট করে ভাড়া দিতে চায় না, তখন ঘর দিয়ে মানুষটা উপকার করেছিল। সেই মানুষকে পাশ কাটিয়ে যাই কী করে? বুঝলাম, আজ বিপদ কেউ ঠেকাতে পারবে না। মলয়বাবু টানতে টানতে চায়ের দোকানে ঢোকাবেন। আগেও উনি এই কাজ করেছেন। গাদাখানেক সময় নিয়ে তবে ছেড়েছেন। আশ্চর্যের কথা কী জানো যামিনী, ভদ্রলোক আজ সেরকম কিছুই করলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। বেচারা ধরনের হাসি। বললেন, আজ চলি কেমন? দেরি হয়ে গেছে। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে বললাম, বেশ হয়েছে। তোমার দেরি না হলে আজ আমার ঝামেলা হত। তারপর মন দিয়ে বাজার করলাম। ভালো ইলিশ এসেছে। মাঝারি দেখে একটা নিয়েছি। মিলিয়ে বেগুন নিয়েছি, কুমড়ো নিয়েছি। বহুদিন কুমড়ো, বেগুন দিয়ে ইলিশমাছের হালকা ঝোল খাওয়া হয় না।

.

দেবনাথ বেশি খেতে পারে না, কিন্তু খাদ্যরসিক। তার থেকে বলা ভালো বাজার এক্সপার্ট। মিলিয়ে মিলিয়ে বাজার করতে ওস্তাদ। মোচা কিনলে নারকেল, ছোলা কেনে। লাউ নিলে সঙ্গে ধনেপাতা আনতে ভোলে না। ছুটির দিন খেতে বসে ছেলেমেয়েকেও বলে, আচ্ছা, নীল বল তো, কই মাছের সঙ্গে কোন আনাজ ভালো যায়?

নীলাদ্রি মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। সেই তাকানোয় একইসঙ্গে বিরক্তি এবং বিস্ময়। তারপর মাথা নামিয়ে আবার খাওয়ায় মন দেয়।

যামিনী বলে, আহা, ও এসব জানবে কী করে?

দেবনাথ ভাত মাখতে মাখতে বলে, শিখবে। শুধু লেখাপড়া শিখলেই তো হবে না খাওয়া দাওয়াও শিখতে হবে। আমি বুড়ো হলে কী হবে? বাজার করবে কে? সেইজন্যই তো ইজি দিয়ে শুরু করেছি। আচ্ছা কিঙ্কি, এবার তুমি বল, লাউয়ের ঘন্টে কোন মাছ দিলে মুখে জল আসে? এটা কিন্তু তোমার পারা উচিত। ভেরি ইজি।

কিঙ্কিনি মুখ না তুলে বলে, বাবা, তুমি ঠাকুমার কাছে রান্না শিখেছ না?

দেবনাথ হো হো আওয়াজে হেসে ওঠে। বলে, দুর, রান্নার আমি কী জানি? আমাকে। কখনও রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেছিস? এসব নিজে নিজেই শিখতে হয়। তোরাও শিখবি। এই ধর না তোর মা, রান্নার কিস্যু জানত না। এখন কত কী পারে। কেন পারে জানিস? আমরা কী খেতে ভালোবাসি সেটা বুঝে গেছে। রান্নাটা বড় কথা নয়, নিজের লোক কী ভালোবাসে এটা জানাই বড় কথা। জানলে রান্নাও আসে ভালো হবে।

যামিনী বলে, উফ তুমি লেকচার থামাবে? খেতে বসে বকবক!

ছেলেমেয়ে বাবার এই স্বভাব পছন্দ করে না। মায়ের কাছে বিরক্তি দেখায়। নীলাদ্রি বলে, যতসব ব্যাকডেটেড ব্যাপার। খাওয়া নিয়ে বাবার এসব বাড়াবাড়ির কোনও মানে হয় না। পেট ভরাতে একটা কিছু খেয়ে নিলেই হল।

কিঙ্কিনি বলে, আমি পেট ভরাতেও চাই না। ভাত খেতেই আমার জঘন্য লাগে। মাছ তো হরিবল। ইস মাছ খাওয়া কে যে আবিষ্কার করল। আমি দুপুরে শুধু স্যান্ডুইচ খেতে চাই। যামিনী শাসন করে। বলে, ছিঃ, বাবার সামনে এসব বোলো না। দুঃখ পাবে। আমাদের সকলের জন্য মানুষটা কত যত্নে বাজার করে, সেটা তো দেখবে।

নীলাদ্রি মুখ ঘুরিয়ে বলল, মায়ের সবসময় বাবাকে সাপোর্ট।

কিঙ্কিনি মাথার চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক বলেছিস। আমাদের ফ্যামিলিতে দুটো দল। বাবা-মা একদিকে, আমরা দুজন অন্যদিকে।

যামিনী হেসে ফেলে। বলে, থাক, অনেক পাকা পাকা কথা হয়েছে। এবার কাজে যাও।

.

ইলিশ, বেগুনের ফিরিস্তি শোনার পর যামিনী রাগী গলায় বলল, এই তোমার মজার কথা!

দেবনাথ চায়ের কাপে চুমুক দিল। বলল না, এটা মজার কথা নয়। মজার কথা অন্য। বাজার সেরে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই হঠাৎ খেয়াল হল, আরে, মলয়বাবুর কথাটা মাথায় ঢুকে গেছে! ঢুকে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেরি হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে…। বোঝে কাণ্ড! একটা অতি সাধারণ কথা, দিনের মধ্যে চোদ্দোবার বলি, আজ হঠাৎ খচ করে মাথায় ঢুকে যাবে কেন! আমি অন্য কথা ভাবতে শুরু করলাম। বাজারে কেমন ঠকলাম, মেয়েটার অঙ্কের জন্য একজন ভালো টিউটর দিলে কেমন হয়, ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে কত টাকা লাগবে? ব্যাঙ্ক লোন পাব? এখন থেকেই খোঁজখবর নেওয়া দরকার। ঠিক করলাম, কোন্নগরে দাদার কাছে দু-একদিনের মধ্যেই যাব, এক মাসেই বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা ফাইনাল করব। টাকা পেলেই ফ্ল্যাট কিনব। ভাড়া বাড়ি থেকে বিদায় নেব। কিন্তু তাতেও দেখলাম লাভ হল না। মলয়বাবুর দেরি হয়ে গেছের ভূত ঘাড় থেকে নামছে না। শুধু তা-ই নয় যামিনী, একটু পরে দেখি, আমার নিজেরও একইরকম মনে হতে শুরু করেছে! দেরি হয়ে গেছে। কীসের দেরি, কেন দেরি কিছু বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে দেরি হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলাম। তারপর থেকেই হাসছি। ঘটনা মজার না?

কথার উত্তর না দিয়ে যামিনী রান্নাঘরে ছুটল। এখন প্রতিটা মুহূর্তই জরুরি। ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়োতে হবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই কেলেঙ্কারি। সংসার নিখুঁত ভাবে চালানো সোজা কথা নয়।

সারাদিন সবকিছু নিখুঁত ভাবেই চলল। নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি স্কুল শেষ করে, কোচিং থেকে পড়ে বাড়ি ফিরল সন্ধের মুখে। যামিনী জলখাবার বানিয়ে দিল। মেয়েকে জিওগ্রাফির ম্যাপ দেখিয়ে দিল। সাউথ আফ্রিকার নদ-নদী। টিভিতে সিরিয়াল দেখল। কোন্ননগরে জা-কে ফোন করল। ভাশুরের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। প্রেশারের সমস্যা। বিজলি সকালেই সব বেঁধে গেছে। তবু যামিনী রান্নাঘরে গেল। সামান্য রান্না করল। একেবারেই সামান্য। বেসন মাখিয়ে কটা আলু ভাজল। দেবনাথ পছন্দ করে। মেয়েটাও চায়। কিঙ্কিনি বাবার মতো হয়েছে।

সবই ঠিকঠাক চলল, শুধু দেবনাথ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল না। যামিনী, নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি অপেক্ষা করে রইল। একদিন, দুদিন, তিনদিন…। দেবনাথ বাড়ি ফিরল না।

০২. নীলাদ্রির ঘুম ভাঙল

০২.

নীলাদ্রির ঘুম ভাঙল কান্নার আওয়াজে। হইচই করে কান্না নয়, চাপা ফোঁপানি। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে। নীলাদ্রি মাথার বালিশটা টেনে কানে চাপা দিল। পাঁচ বছর ধরে এই একই জিনিস চলছে। এ বাড়িতে সকাল হয় কান্নার আওয়াজ দিয়ে। রান্নাঘরে মা চা করে আর কাঁদে। কাপ, ডিশ, চামচের টুং-টাং শব্দের সঙ্গে সেই কান্নার আওয়াজ ভেসে-ভেসে বেড়ায়।

দরজা ঠেলে কিঙ্কিনি ঘরে ঢুকল। এত সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে না। আজকাল তার বিছানা ছাড়তে অনেক বেলা হয়। মাত্র উনিশদিন হল তার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার শেষদিন কিঙ্কিনি তার বন্ধুদের কাছে ঘোষণা করেছিল–

রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত আমি বিছানা থেকে নামব না। বিছানায় বসে খাব, গল্পের বই পড়ব, টিভি দেখব, কম্পিউটারে চ্যাট করব, আর মাঝেমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ব। আমার খাটের পাশে চেয়ার থাকবে। তোরা এলে সেই চেয়ারে বসবি। আড্ডা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলবি, চল কিঙ্কি, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিবি। আমি বলব, সরি, আমি যেতে পারছি না। রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত আমার খাট থেকে নামা বারণ। পলিটিক্যাল নেতারা যেমন গৃহবন্দি হয়, আমি তেমন খাটবন্দি হয়েছি।

শুধুমাত্র পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলেই যে কিঙ্কিনি বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে এমন নয়। অনেক সময় ভোরে তার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে। যামিনী কখন স্কুলে বেরিয়ে যাবে তার জন্য অপেক্ষা। যতটা মায়ের মুখোমুখি না হওয়া যায়। যামিনীর ছুটিছাটার দিনগুলোয় সে পারতপক্ষে বাড়ি থাকতে চায় না। বন্ধুর বাড়ি, সিনেমা হলে চলে যায়। কিছু না থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। সবদিন অবশ্য দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। কদিন হল নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে। কম্পিউটার ক্লাস। সপ্তাহে দুদিন করে। সকালে উঠে যেতে হয়। দাদার জোরাজুরিতে ভরতি হতে বাধ্য হয়েছে কিঙ্কিনি। আড়াল থেকে মায়ের চাপ থাকতে পারে। পারে কেন? নিশ্চয় ছিল। কিঙ্কিনির একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। তার কম্পিউটারে চ্যাট করতে, গান শুনতে ভালো লাগে। কোর্স শিখতে ইচ্ছে করে না। অঙ্কের কিছু থাকলে তো একেবারেই নয়। ছোটবেলায় তার অঙ্ক নিয়ে যে সমস্যা ছিল। তা কাটেনি, বরং বেড়েছে। সেই কারণেই আর্টস নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়া। কিঙ্কিনি জানে তাতেও খুব কিছু লাভ হবে না। তার রেজাল্ট বেশ খারাপই হবে। মাঝারি ধরনের সেকেন্ড ডিভিশন পেতে পারে। পড়াশোনা তার মাথায় ঢোকে না এমন নয়, কিন্তু পরীক্ষার জন্য যতটা পড়ার দরকার তা সে পড়েনি। যত দিন যাচ্ছে বুঝতে পারছে, লেখাপড়া তার বিষয় নয়। পড়তে তার ভালো লাগে না। তার বিষয় অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুটা কী?

কিঙ্কিনি নীলাদ্রির খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। ঝুঁকে পড়ে ডাকল, দাদা, অ্যাই দাদা।

নীলাদ্রি কোনও উত্তর দিল না। নড়েচড়ে শুল মাত্র। কিঙ্কিনি মশারির ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে নীলাদ্রির মাথার বালিশ ধরে টান দিল। নীচু গলায় আবার ডাকল, কীরে উঠবি তো!

চোখ বোজা অবস্থাতে নীলাদ্রি বিরক্ত গলায় বলল, কী হয়েছে?

আগে ওঠ, তারপর বলছি।

উঠতে পারব না। কী হয়েছে বল।

কিঙ্কিনি খাটের একপাশে বসল। এক ঝলক দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসে গলায় বলল, আড়াইশো টাকা দিতে পারবি? ঠিক আছে আড়াইশো দিতে হবে না, দুশো কুড়ি পঁচিশ হলেই হবে। আছে?

নীলাদ্রি এবার বালিশ সরিয়ে চিত হয়ে শুল। চোখ খুলল। আড়াইশো টাকা! কিঙ্কিনি তার কাছে মাঝেমধ্যে টাকা চায় বটে, কিন্তু সে তো পাঁচ দশ। খুব বেশি হলে পঞ্চাশ। কোনও কোনও সময় মোবাইল রিচার্জ করিয়ে দিতে হবে। একসঙ্গে এত টাকা তো কখনও চায়নি!

কিঙ্কিনি হেসে বলল, কেন চাইছি জানতে চাইবি না কিন্তু।

কিঙ্কিনি দেখতে সুন্দর হয়েছে। তবে যামিনীর মতো নরমসরম সুন্দর নয়। কিঙ্কিনির চেহারার মধ্যে একটা ঝকঝকে ছাপ রয়েছে। দেবনাথের মতো। চোখমুখ শার্প। হাঁটাচলা, হাবভাবের মধ্যেও দেবনাথের মতো চাপা কনফিডেন্স। ভাবটা এমন যেন আমি যা করি ভেবেচিন্তে করি, ঠিক করি। দেখলে মনে হয়, এই মেয়ের বুদ্ধি বেশি। শুধু দেখতে নয়, কথাবার্তাতেও সে তার বাবার মতো রসিকতা তৈরি করতে শিখেছে।

কিঙ্কিনি এই সাতসকালেই বাইরে বেরোনোর জন্য তৈরি। স্নান সেরে জিনস আর কালো টপ পরেছে। মেয়েদের পছন্দের রং কালো নয়। তবু কিঙ্কিনি মাঝেমধ্যেই কালো রঙের পোশাক পরে। কারণ সে জানে তার গায়ের ফরসা রঙে কালো ঝলমল করে। নিজের সৌন্দর্যের বিষয়ে। বেশি মাত্রায় সচেতন কিঙ্কিনি। সে বুঝতে পারছে, শুধু নিছক সৌন্দর্য নয়, তার চেহারা ইতিমধ্যেই একধরনের আকর্ষণ তৈরি করতে শুরু করেছে। সম্ভবত একেই বলে শরীরী আকর্ষণ। খুব জোরালো নয়, কিন্তু তৈরি হয়েছে। অতি সাধারণ সাজগোজ করলেও রাস্তাঘাটে ছেলেরা তার দিকে না তাকিয়ে পারে না। বন্ধুরাও বিষয়টা জানে। ঠাট্টা করে বলে, তোর সঙ্গে বেরোতে ইচ্ছে করে না। আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। বৈদভটিা অসভ্য। একটু গোলমেলেও আছে। একদিন আড়ালে ফট করে বুকে হাত দিয়ে বসল। বলল, হাউ নাইস কিঙ্কি! আউচ! কত বড় হয়ে গেছে!

নীলাদ্রি ভুরু কুঁচকে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বোনকে সে ভালোবাসে। দেবনাথের নিরুদ্দেশ হওয়ায় সেই ভালোবাসা খানিকটা আশকারার চেহারা নিয়েছে। শুধু দেবনাথের নিরুদ্দেশ হওয়া নয়, আশকারার অন্য কারণও আছে। স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মেয়ের প্রতি যামিনী ক্রমশ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে। যত দিন। গেছে সেই ভাব বেড়েছে। মেয়েদের কোনও কিছু যেন তার পছন্দ হয় না। আচার-আচরণ, কথাবার্তা সবেতেই বিরক্ত হয়! ছোটখাটো বিষয়ে বকাঝকা করে, খোঁচা দিয়ে কথা বলে। একটা সময় মারধোরও করেছে। কঠিন মার। কিঙ্কিনি প্রথম প্রথম মায়ের এই ব্যবহারে অবাক হত। অভিমান করত। মা তার সঙ্গে কেন এমন করে! কই দাদার সঙ্গে তো করে না! সে কী দোষ। করল? তাকে বলার জন্য মা কেন খুঁজে খুঁজে কারণ বের করে? কারণ না পেলে, বানিয়ে বানিয়ে কারণ তৈরি করে। স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে চুলের মুঠি চেপে ধরেছে। কিঙ্কিনি বলার চেষ্টা করেছে, দেরি সে করেনি, তার স্কুলবাস খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মা শোনেনি। টিভি দেখলে রেগে যেত। টিভিতে সিনেমা বা সিরিয়াল নয়, ছোটবেলা থেকেই কিঙ্কিনির চ্যানেল ঘুরিয়ে খবর দেখার নেশা। দেবনাথের মতো। খবর কিছু বুঝত না। তবু দেখত। যামিনী রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে চড় মারত। পাড়ার কোন বখাটে ছেলে দুদিন বাড়ির সামনে সাইকেলের বেল বাজিয়ে চলে গেছে, কিঙ্কিনি জানেও না। বেধড়ক মার খেয়েছে কিঙ্কিনি। অপমানের মার। পায়ের চটি খুলে মেরেছে যামিনী। তখন মাকে ভয় পেত কিঙ্কিনি, লুকিয়ে কাঁদত। একটা বয়সের পর যামিনী মেয়েকে মারধোর বন্ধ করল, কিন্তু বকাঝকা চলতে লাগল। কিঙ্কিনি খানিকটা বড় হয়ে কান্নাকাটি, মান অভিমান সব বন্ধ করে দিয়েছে। মায়ের বকাঝকা, বেঁকা কথা এখন আর তার গায়ে লাগে না, সে ভয়ও পায় না। হয় অবজ্ঞা করে, নয় মুখে মুখে কথা বলে। কিছুদিন আগেও মেয়ের তর্ক শুনলে যামিনী চিৎকার করে উঠত। কিঙ্কিনি শান্ত গলায় বলত, মা, তুমি যদি চিৎকার কর আমি তোমার ডবল চিৎকার করব। তুমি চিৎকার করতে করতে হাঁপিয়ে যাবে। আমি হাঁপাব না, কারণ আমার বয়স তোমার থেকে কম। আমার দম বেশি।

তারপর থেকে যামিনী চিৎকার করা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছে। যেটুকু না বললে নয়। গত সোমবারের কথা কাটাকাটির পর থেকে তা-ও বন্ধ। এখন পরোক্ষ ভাবে খাবার দেওয়া হয়েছে, ড্রেসিং টেবিলের ওপর টাকা রইল, ছাদ থেকে জামাটা তুলতে হবে গোছের কথা চলে। বাকিটুকু ভায়া নীলাদ্রি।

মা-মেয়ে একসঙ্গে খেতে বসে না আজকাল। হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকেই কিঙ্কিনি এই নিয়ম চালু করেছে। পড়ার চাপ। সময় ধরে খাওয়াদাওয়া সম্ভব নয়। কোনওদিন ভাত খেতে বেলা গড়িয়ে যায়, কখনও ডিনারে বসতে রাত হয়। সুতরাং যে যার মতো খেয়ে নিতে হবে। তবু গত সোমবার দুজনে একসঙ্গে টেবিলে বসেছিল। মা-মেয়ে দুজনেরই তাড়া। কিঙ্কিনি শালিনীর সঙ্গে কলকাতায় যাবে। শালিনীর বড়মামা হাসপাতালে, ভাগনিকে দেখতে চেয়েছেন। সে একা যাবে না, বন্ধুকে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে হাসপাতালে যাওয়ার আগে সিনেমা দেখবে দুজনে। ফেরা নিয়ে চিন্তা নেই। শালিনীর বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে ওদের নিয়ে আসবে। চুপচাপই খাচ্ছিল দুজনে। টেবিলের দুদিকে বসে। মেনু নিয়ে আপত্তি তুলল কিঙ্কিনি। নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল। ছাপোষা ডাল-ভাত আর মাছের ঝোল তার আর সহ্য হচ্ছে না। অরুচি ধরে গেছে। তারওপর রান্নাও খারাপ। স্বাদ নেই। নীচু গলায় কিঙ্কিনি একটানা বলতে থাকে

এগুলো মানুষ খায়? নিজেকে গরুর মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘাস খাচ্ছি। রোজ রোজ এই অখাদ্যগুলো খাওয়ার থেকে না খাওয়া ভালো।

যামিনী জানে, নীচু গলায় বললেও মেয়ে তাকে শুনিয়ে কথাগুলো বলছে। এতদিন পরে হঠাৎ এসব কথা কেন! যামিনী কথার উত্তর দেয় না। মাথা নামিয়ে দ্রুত খেতে থাকে। আর উত্তর দেবারই বা কী আছে? মেয়ে তো ভুল বলছে না। সত্যি তো খাবার স্বাদহীন। বিজলীকে অনেকদিন ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। না দিয়ে উপায় ছিল না। এই সংসারে আলাদা করে রান্নার লোক রাখার সামর্থ্যও কোথায়? যামিনী নিজেই রান্না করে। সেই রান্নায় যত্ন, মন কিছুই থাকে না। করতে হয় তাই করা। দু-একদিন মন দেওয়ার চেষ্টা করেছে, পারেনি। মনে হয়েছে, ঠিকমতো রান্না করা সে ভুলেই গেছে। আর কোনওদিনও পারবে না। মাঝেমধ্যে ভয় করে। যদি দেবনাথ ফিরে আসে? তখনও কি রাঁধতে পারবে না?

যামিনী চুপ করে থাকলেও কিঙ্কিনি বলে চলে–

একেই তো মেনু জঘন্য, রোজই এক খাবার, তারওপর কোনওদিন নুন থাকে না, কোনওদিন গাদাখানেক চিনি। আজ মাছের ঝোলে নুন চিনি কিছুই নেই। বমি আসছে।

যামিনী আর পারল না। মুখ না তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, কাল থেকে নিজে রান্না করে নিও।

কিঙ্কিনি নাক মুখ কুঁচকে বলল, জানলে তাই করতাম।

শিখে নাও। ঘর সংসারের কাজ শেখার বয়স তোমার হয়ে গেছে। সারাদিন তো হয় ঘুমোচ্ছ, নয় টইটই করে বেড়াচ্ছ।

কিঙ্কিনি মুখ দিয়ে বিদ্রুপের আওয়াজ করল। বলল, হ্যাঁ, এখন সব ছেড়েছুঁড়ে রান্নাঘরে। ঢুকে হাঁড়ি ঠেলি আর কী। বয়ে গেছে। আমার কোনও বন্ধু রান্না করে না।

যামিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, বন্ধুদের সঙ্গে নিজেকে মেলাবে না।

কিঙ্কিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কেন মেলাব না কেন? তারা কি আলাদা?

যামিনী চোয়াল শক্ত করে বলল, হ্যাঁ, তারা আলাদা। তাদের বাবারা কেউ বউ-ছেলেমেয়ে ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়নি। তোমার বাবা গেছে।

কিঙ্কিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মা, তুমি এমন বলছ যেন বাবা আমাদের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। পানিশমেন্ট হিসেবে আমাকে রান্না করতে হবে, দাদাকে বাসন মাজতে হবে।

যামিনী মুখ তুলে বলল, আমি সেকথা বলিনি। তুমি এমন ভাবে কথা বলছ কেন?

আমি বলিনি, তুমি বলছ। আমি ডালের কথা বললাম, তুমি বাবার কথা বলছ। বাবার চলে যাওয়ার কথা। রান্না খারাপের সঙ্গে বাবার কথা আসে কীভাবে?

গলায় ঝাঁঝ এনে যামিনী বলল, তোমার বাবা গেছে বলেই বলছি। সব কথাতেই আসবে।

কিঙ্কিনি ঠোঁটের কোনায় বেঁকা হেসে বলল, বাবা আমার জন্য তো বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি। আমি কোন দুঃখে ঘাস পাতা খাব? কথাটার মধ্যে চাপা ইঙ্গিত ছিল।

যামিনী স্থির চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কার জন্য গেছে?

কিঙ্কিনি মায়ের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। গলা নামিয়ে বলল, আমরা কী জানি? আমি দাদা দুজনেই তখন যথেষ্ট ছোট ছিলাম। যদি জানার হয় তুমি জানবে। যদি কেন? বাবার বিষয়টা তোমারই জানা উচিত।

যামিনী থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুই কী বলতে চাইছিস?

কিঙ্কিনি গ্লাস তুলে জল খেল। তারপর টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে হালকা ভঙ্গিতে বলল, কী বলতে চাইছি তুমি ভালো করেই জানো মা। আমি কেন সবাই তোমাকে এই কথাটাই বলে। বলে না?

যামিনী কিছু বলতে গিয়ে থেমে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর হিসহিসিয়ে বলে উঠল, চুপ কর কিঙ্কি, চুপ কর। খুব সাহস হয়েছে তোর, খুব সাহস, মুখে যা আসছে বলে ফেলছিস।

যামিনীর ধমক কিঙ্কিনি পাত্তা দিল না। হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সহজ গলায় বলল, সাহস হওয়া তো খারাপ নয় মা। যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক কিছু বলতে পারিনি, অনেক কিছু অজানাও থেকে গেছে। এখন তো আর ছোট নেই। তারওপর অনেকে অনেকরকম বলে। সেটাই বলছি।

যামিনী উঠে দাঁড়ায়। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, কী বলে?

বাথরুম থেকে কিঙ্কিনি চিৎকার করে বলে, কী বলে তুমি ভালো করেই জানো। জানো না?

এরপর থেকে যামিনী মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। নীলাদ্রি শান্তপ্রকৃতির ছেলে। সে ঝগড়াঝাটি সহ্য করতে পারে না। পরদিন সকালে বোনকে বোঝানোর চেষ্টা করে।

মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করিস না।

দাদার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কিঙ্কিনি বলল, মা তোকে লাগিয়েছে?

নীলাদ্রি বলল, এর মধ্যে লাগানোর কী আছে? মায়ের মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। কাল রাতে খায়নি। উফ তোরা কি একটুও চুপ করে থাকতে পারিস না?

কিঙ্কিনি মুখ নামিয়ে বলল, আমি কিছু করিনি।

যে-ই করুক, দয়া করে ঝামেলা বন্ধ কর।

কিঙ্কিনি বলল, থামা বললেই কি থামবে দাদা? ঝামেলা তো শুধু আজ হচ্ছে না, বহুদিন ধরেই হচ্ছে। মা আমাকে সহ্য করতে পারে না। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই এই কাণ্ড চলছে। আমাকে দেখলেই তার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। মনে আছে দাদা, একবার সকালে বাবার মতো গরম চায়ের কাপ হাতে পেপার পড়ছিলাম বলে মা টেনে তুলে দেওয়ালে মাথা। ঠুকে দিয়েছিল? মনে আছে? এই দেখ এখনও দাগ রয়েছে। কপালের চুল সরায় কিঙ্কিনি। সত্যি বাঁদিকে ভুরুর পাশে দাগ রয়ে গেছে।

নীলাদ্রি জানে কিঙ্কিনি যা বলছে ভুল বলছে না। মায়ের ওপর তার রাগ আর শুধু রাগে আটকে নেই। খানিকটা যেন ঘৃণার চেহারা নিয়েছে। মা যে কেন কিঙ্কির ওপর এত বিরক্ত, এতদিনেও বুঝতে পারে না নীলাদ্রি। তবু সে বলল, জানিসই তো মায়ের মনমেজাজ সবসময় খারাপ হয়ে থাকে।

কিঙ্কিনি চুল বাঁধছিল। তার চুলের ব্যান্ড হারিয়ে গেছে। সামনে ছড়িয়ে থাকা বইখাতা, কাগজপত্র সরিয়ে ব্যান্ডটা খুঁজতে লাগল। আলগোছে বলল, কেন? মনমেজাজ খারাপ কেন?

নীলাদ্রি বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, জানিস না কেন? ঠাট্টা করছিস? বাবার ঘটনাটার পর থেকেই তো এরকম হয়ে গেছে। সেটাই নরমাল।

কিঙ্কিনি ব্যান্ড খুঁজে পায়। চুলে লাগাতে লাগাতে বলল, জানবো না কেন? আমি তো আর ছোট খুকি নই, কিন্তু মা এমন ছোট খুকির মতো ব্যবহার করে কেন বলতে পারিস? মা কি মনে করে দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় নামের মানুষটা শুধু তার স্বামী ছিল? আমাদের বাবা ছিল না? মানুষটা হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের মনমেজাজ খারাপ হতে নেই? দুঃখ অপমান হতে পারে না? বাবা শুধু তার সম্পত্তি? তার মানুষ?

নীলাদ্রি চুপ করে এই অভিমানের কথা শোনে। এগিয়ে এসে বোনের পিঠে হাত রেখে বলল, এইটুকু বয়েসে খুব পাকাঁপাকা কথা শিখেছিস।

কিঙ্কিনি চুপ থেকে শান্ত গলায় বলল, শিখতে বাধ্য হয়েছি। যেসব ছেলেমেয়ের বাবা কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তারা সবাই কম বয়েসে পাকা কথা শিখে যায়। তুইও শিখেছিস। তুই ভালো ছেলে তাই বলিস না। আমি বলে বিপদে পড়ি।

না বললেই পারিস। ওসব বলে মাকে রাগিয়ে দিস কেন?

কিঙ্কিনি দাদার কথার উত্তর না দিয়ে বলে, আমি জানি মা কেন আমার ওপর এত খাপ্পা। নীলাদ্রি ভুরু কোঁচকালো। কিঙ্কিনি বলল, আগে বুঝতে পারতাম না, এখন বুঝি।

নীলাদ্রি বলল, কেন?

কিঙ্কিনি দাদার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল। বলল, থাক, শুনলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।

নীলাদ্রি সেদিন অবাক হয়েছিল। মেয়েটা এই কম বয়সেও কত ম্যাচিওরড হয়ে গেছে। রাগ অভিমানের মধ্যেও গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। বাবাও এরকম গুছিয়ে কথা বলত।

আজও অবাক হল নীলাদ্রি। এই সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে টাকা চাইছেও কেমন সুন্দর করে!

কিঙ্কিনি মাথা কাত করে বলল, কীরে দাদা টাকা হবে?

কত হবে জানি না। পার্সটা দেখ, যা থাকে নিয়ে নে।

কিঙ্কিনি খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, সব নিয়ে নিলে তোর চলবে কী করে।

নীলাদ্রি এবার উঠে বসল। আড়মোড়া ভেঙে বলল, সে আমি বুঝব।

নীলাদ্রিকে তার বাবা-মা কারও মতোই দেখতে হয়নি। তাকে চট করে সুন্দর বলা যাবে না। একজন সাধারণ চেহারার যুবক। ভিড়ে মিশে যাওয়া ধরনের। একসময় আত্মীয়রা বলত, নীলাদ্রি নাকি তার মামার মতো চেহারা পেয়েছে। রোগা আর লম্বাটে গড়ন। শুধু চেহারায় সাধারণ নয়, শান্তস্বভাবের এই ছেলে লেখাপড়াতেও সাধারণ হয়ে গেছে। যে ছেলে চারটে লেটার নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেছিল, সে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় তেমন কিছু করতে পারল না। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার, হল না। হওয়ার কথাও নয়। তখন সবে কদিন হল দেবনাথ নিরুদ্দেশ হয়েছে। গোটা পরিবার বিপর্যস্ত, দিশেহারা। সাজানো গোছানো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। যেন নাটক শেষ হওয়ার আগে মঞ্চের সামনে কেউ কালো, ভারী পরদা টেনে দিল। কদিন পরেই যে নীলাদ্রি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষায় বসবে সেকথা কারও মাথায় রইল না। এমনকী নীলাদ্রিরও নয়। তখন বেঁচে থাকাটাই একটা পরীক্ষা। যেন প্রতিটা মুহূর্তে কঠিন প্রশ্নপত্রের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

হায়ার সেকেন্ডারির মতো গ্র্যাজুয়েশনেও সাধারণ, মাঝারি রেজাল্ট। তাও যামিনী চেয়েছিল, ছেলেটা আরও পড়ুক। আজকাল রেজাল্ট খারাপ হলেও টাকা খরচ করে কেরিয়ার করবার অনেক ব্যবস্থা হয়েছে। ম্যানেজমেন্টে পড়া যায়। নীলাদ্রি সে পথে যায়নি। সে বুঝেছিল, এ-বাড়ির পক্ষে আর টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। উলটে টাকা রোজগার করতে হবে। ছোটখাটো একটা ট্রেনিং করে আই টি সেক্টরে কাজ করছে। প্রজেক্ট অ্যাসিটেন্ট গোছের কাজ। আরও পাঁচজনের সঙ্গে বসে ডাটাবেস তৈরি করতে হয়। সবসময় কাজ থাকে না। এজেন্সির কাছে নাম লেখানো রয়েছে। তারা দরকার মতো খবর দেয়। তখন ছুটতে হয় সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে। তবে কাজ থাকলে পেমেন্ট খারাপ নয়। টানা কাজ থাকাটাই সমস্যা। আই টি সেক্টর বাইরে থেকে শুনতেই গালভারী। নীচের দিকে ভিড় বাড়ছে। অনেকটা সময় হাত গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে হয়। এখন যেমন বেশ কিছুদিন হল নীলাদ্রির বেকারদশা চলছে। নীলাদ্রি বুঝতে পারছে এভাবে চলবে না, একটা অন্য কিছু দেখতে হবে। পাকাপাকি কিছু। চেষ্টাও করছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো কয়েকটা দিয়েছে। এখনও লাগেনি।

নীলাদ্রির ব্যাগে দুশো তিরিশ টাকা মতো পড়ে আছে। একশো টাকার নোটদুটো নিয়ে কিঙ্কিনি বলল, আজ আমাদের বন্ধুদের পিকনিক। আড়াইশো করে চাঁদা।

নীলাদ্রি বলল, পিকনিক! এখন তো শীত নয়, পিকনিক কীসের?

কিঙ্কিনি হেসে বলল, শুধু শীতেই পিকনিক করা যায় এমন কোনও কথা আছে নাকি? আর থাকলেও সে আমরা ভাঙছি। কোথায় যাচ্ছি জানিস দাদা?

কোথায়?

কিঙ্কিনি ঘাড় কাত করে নীলাদ্রির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মিটিমিটি হেসে বলল, উঁহু, বলব না। বললে তুই চিন্তা করবি। সবাই পিকনিক করতে সুন্দর জায়গায় যায়, আমরা একটা ভয়ংকর জায়গায় যাচ্ছি। সেখানে আমাদের ভয়ঙ্কর পিকনিক হবে।

কিঙ্কিনি হাসি ঠাট্টা করলেও নীলাদ্রির বিষয়টা পছন্দ হচ্ছে না। যতই গুছিয়ে সুন্দর করে হাসি মুখে কথা বলুক আজকাল এই মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হয়। কিঙ্কিনির মধ্যে কেমন একটা বেপরোয়া ভাব এসে যাচ্ছে। ধুম ধাড়াক্কা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মা বলেছে, দু-একদিন রাত করেও নাকি বাড়ি ফিরেছে। কখনও আবার টানা তিনদিন নিজের ঘরেই দরজা আটকে বসে থাকে। শুধু খেতে আর স্নান করতে বেরোয়। কারও সঙ্গে কথা বলে না। কিছু বলতে গেলে রেগে যায়। মায়ের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়াও করে। খারাপ কথা বলে। বাইরে থেকে কেউ দেখলে মনে করবে, শাসন নেই। মেয়েটা বিগড়ে যাচ্ছে। মাও তাই বলে। নীলাদ্রির সেরকম মনে হয় না। তার মনে হয়, ছোটবেলায় মায়ের অতিরিক্তি বকাঝকা গোলমাল করে দিয়েছে। এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। মায়ের প্রতি একটা প্রতিশোধ। কই তার সঙ্গে তো কিঙ্কি খারাপ ব্যবহার করে না। পরীক্ষার পর কম্পিউটার ক্লাসে ভরতি হতে বলেছিল, হয়েছেও। মনে হচ্ছে, এবার একদিন মা-কিঙ্কি দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে বসতে হবে। ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে। মায়ের ওপর রাগ করে এই বয়েসে বড় কিছু গোলমাল করে ফেললে সর্বনাশ হবে। তবে কাজটা করতে হবে খুব সতর্ক হয়ে। এই মেয়ে যদি মনে করে দাদাও তাকে শাসন করতে চাইছে, তখন তার হাত থেকেও বেরিয়ে যাবে।

নীলাদ্রি আড়মোড়া ভেঙে বলল, ভয়ঙ্কর না সুন্দর আমার জানার দরকার নেই, যেখানেই যাবে সাবধানে থাকবে। সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরবে আর ফোন করলে ধরবে।

কিঙ্কিনি হাত জোড় করে বলল, প্লিজ দাদা, তুই অন্তত আর গার্জেনগিরি করিস না। গার্জেনগিরি অনেক হয়েছে। কপালে স্টিচ, পিঠে জুতোর দাগ নিয়ে আই অ্যাম টায়ার্ড। আমাদের পিকনিকের আজ নিয়ম কেউ মোবাইল অন করতে পারবে না। যে করবে তার ফাইন হবে। অতএব নো কল।

কিঙ্কিনি ঘর থেকে বেরোতে গেল। নীলাদ্রি ডাকল, অ্যাই কিঙ্কি শোন একবার। কিঙ্কিনি ঘুরে দাঁড়াল।

ইস পিছনে ডাকলি তো, কী হল?

নীলাদ্রি ফিসফিস করে বলল, মা, কাঁদছে না?

কিঙ্কিনি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, কাঁদছে! কই না তো, দেখলাম টেবিলে বসে আরাম করে চা খাচ্ছে। মনে হয় সেকেন্ড কাপ। তোর আবার বেশি বেশি।

কিঙ্কিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরও নীলাদ্রি বেশ খানিকটা সময় চুপ করে শুয়ে রইল। মা কাঁদছে না! তা হলে কোন কান্নার আওয়াজে আজ তার ঘুম ভাঙল? স্বপ্নে কিছু শুনছে? অথবা কে জানে হয়তো অভ্যেস হয়ে গেছে। কেউ না কাঁদলেও মনে হয়, এ বাড়ির সকাল হয় কান্না দিয়ে। মনটা খারাপ হয়ে গেল নীলাদ্রির।

 ০৩. স্কুলগেটের একপাশে বিশাখা

০৩.

যামিনী দূর থেকেই দেখতে পেল স্কুলগেটের একপাশে বিশাখা দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, কারও জন্য অপেক্ষা করছে।

এই সময়টা স্কুলে সবথেকে হই-হট্টগোলের সময়। গেটের কাছে ঠাসাঠাসি অবস্থা। মেয়েরা হুড়োহুড়ি করে ঢুকছে। ছোট ছোট দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মায়েরা। চোখেমুখে গভীর উদবেগ। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অকারণ উদবেগ। কেউ কেউ টিচার দেখলে পড়িমড়ি করে ছুটে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে জানে না। কিছু বলার নেই। তবু যাচ্ছে, হাবিজাবি প্রশ্ন করছে। যেন টিচারের সঙ্গে কথা বলতে পারলেই মেয়ের জীবন এগিয়ে যাবে তরতর করে! রোজকার ঘটনা।

ভিড় দেখে প্রতিদিনকার মতো আজও যামিনীর গা জ্বলে গেল। উফ, আবার ওখান দিয়ে ঢুকতে হবে। তাকে যে সবাইকে ঠেলে ঢুকতে হবে এমন নয়। টিচারদের দেখলে সকলেই পথ ছেড়ে দেয়। তাকেও দেবে। যামিনীর রাগ হওয়ার কারণ অন্য। সে এলেই ছাত্রীর মায়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বন্ধ করে দেয়, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যতক্ষণ না বাগান পেরিয়ে, সিঁড়ি টপকে স্কুল বিল্ডিংয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ছে ততক্ষণ এই দেখা চলতে থাকে। এতদিনে সকলেই ঘটনাটা জেনে গেছে। এমনকী যেসব মেয়েরা স্কুলে নতুন অ্যাডমিশন নেয় তাদের মায়েরাও কীভাবে যেন খবরটা সবার আগে পেয়ে যায়।

যামিনী মিসের বর নিখোঁজ।

বেশিরভাগেরই বিশ্বাস পালিয়ে গেছে। অন্তত সেরকম ভাবতে ভালোবাসে। পালিয়ে গেছের মধ্যে একটা রসালো ব্যাপার আছে। তাই যামিনীকে দেখার সময় দৃষ্টিতে একইসঙ্গে থাকে করুণা আর আঁশটে ভাব। প্রথম প্রথম লজ্জা, অপমানে মরে যেত যামিনী। ইচ্ছে করত মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। ধীরে ধীরে সেটা রাগে পরিণত হল। পরে অভ্যেস করে নিল। তবে সবদিন অভ্যেস কাজে দেয় না। কোনও কোনওদিন ভিড় থেকে ফিসফিস শুনতে পায়–ওই যে আসছে দেখ। মাথায় আগুন জ্বলে যায় তখন। স্কুলের পিছনে একটা ছোট গেট আছে। যামিনী হেডমিস্ট্রেসকে গেটটা খুলে দেওয়ার জন্য বলেছিল।

মায়াদি, ওই গেটটা, আপনি খুলে দিন। শুধু টিচাররা ইউজ করবে।

কেন মেইন গেটে সমস্যা কী হয়েছে?

হেডমিস্ট্রেসের টেবিলের ওপর খানিকটা গলা মোম জমে আছে। খাম-টাম সিল করতে গলা মোম লাগে। যামিনী মাথা নামিয়ে নখ দিয়ে সেই মোম খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, না, সেরকম কিছু নয়। আসলে স্কুলে ঢোকার সময় খুব ভিড় হয়। স্টুডেন্ট, গার্জেন সবাই দাঁড়িয়ে থাকে।

মায়াদি অবাক হয়ে বললেন, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না যামিনী। এতদিন তো ওখান দিয়েই সবাই আসা যাওয়া করেছে। আমি করেছি, তুমি করেছে। হঠাৎ কী এমন ঘটল, যার জন্য আমাকে পিছনের গেটটা খুলে দিতে হবে!

যামিনী মুখ তুলল। বেশিরভাগ স্কুলের হেডমিস্ট্রেসরাই এরকম হয়। টিচারদের অসুবিধের কথা কিছু শুনতে চায় না। অথচ নিজেরা সাধারণ টিচার থাকার সময় অসুবিধে নিয়ে বিপ্লব দেখাত। দ্বিচারিতার চরম। নিজেরা চেয়ারে বসলে পুরোনো কথা সব ভুলে যায়। এই মহিলা মনে হয় সবার থেকে বেশি। মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে। কোনও সমস্যা শুনলে এমন অবাক হয়ে পড়ে যেন আগে কখনও শোনেনি।

যামিনী বিরক্ত গলায় বলল, কিছু হয়নি। গেটের ওপর থেকে ভিড়ের চাপটা একটু কমে আর কী।

হেডমিস্ট্রেসের বিস্ময় আরও বাড়ল। তিনি চোখ বড় করে বললেন, ভিড়ের চাপ! দশ পনেরো মিনিটের তো মামলা। তুমি এমনভাবে বলছ যামিনী যেন এটা স্কুল নয়, ফুটবল খেলার স্টেডিয়াম বা শপিং মল। কাতারে কাতারে লোক ঢুকছে।

যামিনী বুঝল, এই মহিলাকে বোঝানো যাবে না। ইনি বুঝতে চান না। সে গলায় কঠিন ভাব এনে বলল, খুললে অসুবিধে তো কিছু নেই। গেটটা তো রয়েছেই, নতুন করে বানাতে হবে না। খরচ কিছু হচ্ছে না। আপনি এত চিন্তা করছেন কেন?

মায়াদি চেয়ারে হেলান দিলেন। একটু হাসলেন। বললেন, প্রশ্নটা সুবিধে অসুবিধের নয় যামিনী, প্রশ্নটা কারণ। একটা কাজ করতে গেলে তার পিছনে কারণ লাগে। এটা মেয়েদের স্কুল। তাদের ঢোকা বেরোনোর ওপর সবসময় নজর রাখতে হয়। দুম করে আরও একটা গেট খুলে দিলেই হল না। সেখানেও একজন দারোয়ান রাখতে হবে। তার মানে নতুন পোস্ট, নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট। গভর্নিংবডির ডিসিশন লাগবে।

যামিনী উঠে পড়ে। মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে বাদ দিন। বিষয়টা এত জটিল বুঝতে পারিনি। আমারই বলা ভুল হয়েছে।

হেডমিস্ট্রেস সামান্য হাসলেন। বললেন, যামিনী, তুমি কোনও কারণে উত্তেজিত হয়ে আছো। ঠিক আছে আমি অন্যদের সঙ্গে কথা বলব। সবাই যদি বলে তখন তো একটা কিছু করতেই হবে।

যামিনী হাতজোড় করে বলল, দোহাই আপনাকে, এটা নিয়ে আর পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলতে যাবেন না। সামান্য একটা গেট খোলা নিয়ে যে এত কথা শুনতে হবে আমি বুঝতে পারিনি। সরি মায়াদি।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসে যামিনী, বেরোনোর সময় ঘরের দরজাটা অতিরিক্ত আওয়াজ করে বন্ধ করে। ইচ্ছে করেই করে। মানুষটাকে রাগ দেখানো প্রয়োজন। রাগ দেখানোর প্রতিশোধ নিলেন মায়াদি। পাঁচজনকে বললেন না, কিন্তু দুএকজনকে ডেকে ঘটনাটা বলে দিলেন। তিনি জানেন, টিচারদের মধ্যে কীভাবে দল বানাতে হয়। দল না থাকলে কন্ট্রোল থাকে না। সবাই ঘাড়ে ওঠে। গেটের খবর স্টাফরুমে আসতে সময় লাগল না। স্কুলের স্টাফরুম যে কত ভয়ঙ্কর জায়গা যার অভিজ্ঞতা নেই সে জানে না। যামিনী বলে, মেয়েদের স্কুল এককাঠি ওপরে। যে যার ইচ্ছেমতো ঘটনায় রং লাগাতে পারে। রং কতটা হবে তা নির্ভর করছে হিংসে আর কেচ্ছার ওপর। দুদিনের কানাঘুষোয় যামিনী শুনতে পেল, সে নাকি গোপনে স্কুলে যাতায়াত করতে চাইছে। সবার চোখের আড়ালে। এমনকী বসার জন্য ম্যানেজমেন্টের কাছে আলাদা ঘর পর্যন্ত চেয়ে চিঠি লিখেছে। কথাটা কানে যেতে যামিনী একবার ভেবেছিল, হেডমিস্ট্রেসের ঘরে গিয়ে চেঁচামেচি করে আসবে। তারপর বুঝল, এতে লাভ হবে একটাই, কেউ কেউ আলোচনার জন্য মুখরোচক বিষয় পাবে। তার থেকে পাত্তা না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দেবনাথ চলে যাওয়ার পর থেকে কতজনই তো নানান ভাবে অপমান করছে। কলিগরাই বা বাদ যাবে কেন?

তবে সবাই যে এরকম তা নয়। কেউ কেউ অন্যরকমও আছে। সবথেকে অন্যরকম বিশাখা। দেবনাথের ঘটনাটার পর সে ভীষণভাবে যামিনীদির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যে-কোনও আত্মীয়ের থেকে অনেক বেশি। শুধু বিশাখা নয়, সঙ্গে আছে তার স্বামীও। যে হিন্দোল চাকরির জন্য বাড়িতে আসার সময় পেত না, সে অফিস কামাই করে যামিনীর সঙ্গে ছোটাছুটি করেছে। কতদিন। প্রথম কটা দিনের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। তখন দু-বেলা হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হত, নাম না জানা, ঠিকানা না জানা কেউ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভরতি হয়েছে? হিন্দোল ওয়ার্ড পর্যন্ত ঢুকে যেত। তখন নীলাদ্রির পরীক্ষা। তাকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়ার কেস দেখে সি আই ডি। তাদের দপ্তর কলকাতার ভবানীভবনে। দুদিন অন্তর সেখানেও ছুটতে হত। কোনওদিন সঙ্গে হিন্দোলও যেত। যে পুলিশ অফিসার তখন দেবনাথের ফাইলটা দেখতেন, তার কথাবার্তা কর্কশ, কিন্তু মানুষটা ভালো। শিক্ষিকা বলে যামিনীকে সম্মান দেখাতেন। কথা বলতেন দিদিমণি বলে। ভদ্রলোকের মা-ও নাকি স্কুলে পড়াতেন। সেই কারণেই বাড়তি খাতির। তবে গলায় সবসময় একটা ধমক ধমক ভাব। নিশ্চয় পুলিশে চাকরি করতে করতে গলাটা এরকম হয়ে গেছে।

আপনি রোজ রোজ আসছেন কেন দিদিমণি? পথ তো কম নয়।

যামিনী চুপ করে থাকে। কী বলবে? তার আসা ছাড়া উপায় কী? হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ আর কোথায় করবে? যদি পথে পথে ঘুরে করা যেত, তা হলে তাই করত। পুলিশ একমাত্র ভরসা। তখন সবে ছমাস পেরিয়েছে। সবসময় আশা মানুষটা ফিরে আসবে। একটু দৌড়াদৌড়ি করলেই হবে। চারপাশে সবাই কত কথা বলছে। কেউ বাড়ি এসে বলছে, কেউ টেলিফোন করছে। দূর সম্পর্কের এক ননদ বলল, অনেক সময় মানুষের স্মৃতি কিছুদিনের জন্য লোপ পায়। নিজের নাম-ঠিকানা সব ভুলে যায়। সেই স্মৃতি আবার ফিরে আসে নিজে থেকেই, তুমি চিন্তা কোরো না যামিনী। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার এক কাকার হয়েছিল। সাতদিন বাইরে ছিল।

যামিনী চোখের জল মুছে বলল, এর তো ছমাস হয়ে গেল।

ননদ ঢোঁক গিলে বলেছিল, আহা, সবার তো একরকম হবে না। কেউ অল্পদিন, কেউ বেশি। ফিরে এলেই তো হল।

সেই কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। এমনকী ছোট ছেলেমেয়েদুটোও নয়। তবু তখন কলিংবেল বাজলে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। তারা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। বিশেষ করে সন্ধের পর। দেবনাথ যখন অফিস থেকে ফিরত। বুকটা হাহাকার করে উঠত। কিঙ্কিনি কতদিন পড়তে পড়তে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছে। যামিনী নীচু গলায় বলেছে, কাদিস না। কাঁদবি কেন? তোর বাবা তো মারা যায়নি!

কে বলল তোমায় মারা যায়নি? মারা না গেলে কেন ফিরছে না?

যামিনীর চোখ ছাপিয়ে জল পড়ত। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় বলত, কেন সে তো মানুষটা ফিরে এসে বলবে। দেখবি ঠিক বলবে। রাতে খেতে বসে কত গল্প করবে।

কিঙ্কিনি ডুকরে উঠে বলে, আমি কিছু শুনব না, কিচ্ছু না। আমার বাবাকে চাই।

ভবানীভবনে অফিসারের ঘরের বাইরে বসে স্লিপ পাঠাত যামিনী। সময় হওয়ার আগেই ডাক পড়ত। অফিসার বলতেন, দিদিমণি, আপনাকে কতদিন টানতে হবে আপনি কি তা জানেন? জানেন না। এখনই দম ফুরিয়ে ফেললে চলবে কেন?

যামিনী বলত, আপনি একটু চেষ্টা করুন।

অফিসার বলত, এই তো ফাউল করে ফেললেন দিদিমণি। একটু চেষ্টা করুন কথাটার মানে কী? আমরা কি চেষ্টা করছি না? যথেষ্ট চেষ্টা করছি। আমাদের রাজ্যে গড়ে রোজ কতজন করে মিসিং হয় আপনি জানেন? হারিয়ে যাওয়ার মানুষ খোঁজার কতকগুলো পদ্ধতি আছে। আমরা তার বাইরে যেতে পারি না। সব থানায় মেসেজ গেছে। আপনার হাজব্যান্ডের ফটো গেছে। আমরা হাসপাতাল নার্সিংহোমগুলোতে খবর পাঠিয়েছি। ছোট বড় যতগুলোতে পারা যায়। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এর বেশি কী করব?

যামিনী বলল, বিজ্ঞাপনটা একটু বড় করে দেওয়া যায় না। একেবারে সকলের মধ্যে এইটুকু ফটো গেছে।

অফিসার ভুরু কুঁচকে যামিনীর দিকে তাকালেন। বললেন, সরকারের একটা বাজেট আছে। সবাইকে সেই বাজেট মেনে চলতে হয়। যে হারিয়ে যায়নি তাকেও মেনে চলতে হয়, যে হারিয়েছে তাকেও মেনে চলতে হয়। আপনি যদি চান কাগজে কাগজে বড় বিজ্ঞাপন দিন, রাস্তায় হোর্ডিং লাগান। তবে মনে রাখবেন দিদিমণি, সরকারিভাবে নিরুদ্দেশ বলতে কিন্তু আমাদের দেওয়া ওইটুকু বিজ্ঞাপনই বোঝাবে।

হিন্দোল তাড়াতাড়ি ম্যানেজের চেষ্টা করে। কাচুমাচু গলায় বলল আপনারা সব পারেন। স্যার।

না, সব পারি না। আবার অনেক কিছু পারি। দেবনাথবাবু যদি বাহান্ন বছরের পুরুষ মানুষ না হয়ে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে হত, আমাদের সুবিধে হত। মুম্বই পুলিশকে অ্যালার্ট করতাম। স্টেশনে স্টেশনে জিআরপি নজর রাখত। ঠিক কান ধরে নিয়ে আসতাম। নদশ বছরের মেয়ে হলেও হত। চাইল্ড ট্রাফিকিং-এর সুতোগুলো আমাদের জানা আছে। রেড লাইট এরিয়াগুলোতে সোর্স আছে। একটা না একটা খবর জুটে যেত। দেখবেন বাইরে একজন মহিলা বসে অছে। বসিরহাটের দিক থেকে এসেছে। কলকাতায় মেইড সারভেন্টের কাজ করে। ওর দুটো মেয়ে। কাছাকাছি বয়স। দশ-এগারো। একসঙ্গে দুটোই মিসিং। আমরা নিশ্চিত মিসিং নয়, টাকার লোভ দেখিয়ে কোনও টাউট নিয়ে গেছে; হয়তো চালানও করে দিয়েছে এতক্ষণে।

যামিনী আঁতকে উঠে বলল, সে কী! চালান করে দিয়েছে? কী হবে?

অফিসার হালকা গলায় বললেন, কী আর হবে? মুম্বই দিল্লি বা কলকাতার রেড লাইট এরিয়া রেড করে হয়তো একদিন পেয়ে যাব। কবে পাব জানি না, তবে পাব বলেই বিশ্বাস। টিপ-অফের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু একটা ধেড়ে লোক হারিয়ে গেলে আমাদের ধরে নিতে হবে নিজেই লুকিয়ে পড়েছে। তাকে খুঁজে বের করা কঠিন। অবশ্যই যদি না কোনও…।

অফিসার চুপ করলেন। যামিনী বলল, কী?

অফিসার ঠোঁটের কোনায় সামান্য হেসে বলল, বাদ দিন দিদিমণি। যখন যেমন হবে আপনাকে খবর দেব। আপনার নম্বর তো আমার কাছে রইল।

দেবনাথ নিখোঁজ হওয়ার দেড়বছরের মাথায় একদিন দুপুরে যামিনীর মোবাইল বেজে উঠল। যামিনী তখন স্কুলে। স্টাফরুমে বসে হাফইয়ারলি পরীক্ষার খাতা দেখছে। রিং টোনের মিহি আওয়াজে দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল বের করল। নম্বর দেখে চমকে উঠল। ভবানী ভবন থেকে অফিসারের ফোন। এতদিন পর! মানুষটার গলা থমথমে। মনে হচ্ছে ঠান্ডা লেগেছে। নাকি গলা এরকমই? অনেকদিন পর শুনছে বলে ভুলে গেছে!

একবার যে আসতে হবে দিদিমণি।

যামিনী ব্যস্ত হয়ে বলল, কবে?

কবে নয়, আজ। আজই আসতে হবে।

বুকটা ধক করে উঠল। কবজি উলটে ঘড়ি দেখল যামিনী। স্কুল থেকে বেরিয়ে স্টেশন, তারপর ট্রেন ধরে কলকাতা পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তা হোক। সে উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, আসছি, সময় লাগবে। আপনি অফিসে থাকবেন তো?

অফিসার ধমকের সুরে বললেন, কী অদ্ভুত কথা বলছেন! আপনাকে আসতে বলে আমি চলে যাব!

যামিনী তাড়াতাড়ি বলল, না, না আমি সেরকম কিছু বলিনি। কোনও খবর আছে?

অফিসার বোধহয় অল্প চুপ করে থেকে মেজাজ ঠিক করতে চাইলেন। পারলেন না।

খবর না থাকলে আপনাকে এতদূর কি গল্প করার জন্য ডেকে আনছি দিদিমণি? আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।

যামিনী টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে নিল। বলল, খারাপ কোনও খবর?

খারাপ ভালো আপনি বুঝবেন। আই অ্যাম ডুয়িং মাই ডিউটি। আর শুনুন, একা আসবেন না। কাউকে সঙ্গে আনবেন। পারলে ওই ছেলেটাকে নিয়ে আসুন। ওই যে আপনার কলিগের হাজব্যান্ড, হি জি আ স্মার্ট বয়। আমি রাখছি। আর হ্যাঁ, চিন্তা করবেন না। লাক ফেভার করলে ঘটনাটা আলটিমেটলি ভালোও হতে পারে।

বিশাখাকে বলতে সঙ্গে-সঙ্গে সে হিন্দোলকে ফোন করল। হিন্দোল লাফিয়ে উঠল। নিশ্চয় সুখবর। সুখবর ছাড়া পুলিশ এত তাড়াহুড়ো করত না।

কোনও চিন্তা নেই, ঠিক সময় ভবানীভবনের সামনে চলে আসছি।

বিশাখা বলল, তোমার অফিস?

উত্তেজিত হিন্দোল বলল, অফিসের গুলি মারো। দেড়বছর পর একজন হারানো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, আর আমি অফিস করব? আমি যে কী এক্সাইটেড ফিল করছি বিশাখা, তোমাকে বোঝাতে পারব না।

বিশাখা যামিনীর হাত চেপে বলল, আমিও যাব যামিনীদি। তুমি না বলবে না। আমি শাশুড়িকে ফোন করে দিচ্ছি।

অফিসার তিনজনকে দেখে একটু ভুরু কোঁচকালেও খুশি হলেন। চা দিতে বললেন। যামিনী বলল, আমরা চা খাব না, আপনি চলুন কোথায় যেতে হবে।

অফিসার হেসে বললেন, খান, সামনের মাসে আমি বদলি হয়ে যাচ্ছি। নর্থ বেঙ্গল চলে যাব। তখন আর চা খাওয়াতে পারব না। অবশ্য পুলিশের চা যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো। কথা শেষ করে অফিসার এবার জোরে হাসলেন।

হিন্দোল বলল, এরকম কেন বলছেন? ইউ হ্যাভ ডান আ লট। অনেক করেছেন।

অফিসার যামিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিসেস চ্যাটার্জি, আমি আপনাদের কয়েকটা কথা বলতে চাই। গত দেড়বছর ধরে আপনার হাজব্যান্ডকে ট্রেস করবার জন্য কিছু চেষ্টা আমি করেছি। আমাদের যা যা রুটিন পদ্ধতি আছে তার বাইরে গিয়েই করেছি। কেন করেছি জানেন? করেছি কারণ হাজার হাজার মিসিং-এর মধ্যে এই কেসটা সম্পর্কে আমার গোড়াতেই খটকা লেগেছিল। শুধু খটকা বলব না, খানিকটা ইন্টারেস্টিংও। একটা মানুষ নিজের বাড়ি পছন্দ করে, পরিবারের লোকদের পছন্দ করে, তাদের কোম্পানি সবসময় এনজয় করে, তা হলে কেন দুম করে হারিয়ে যাবে? পুলিশের কাজই অবিশ্বাস করা। আমিও আপনাকে অবিশ্বাস করলাম। বুঝলাম আপনি যা বলছেন সব ঠিক নয়। নয়তো কিছু কিছু জিনিস লুকিয়েছেন। আমি লোক লাগিয়ে আপনাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম, আপনার আর দেবনাথবাবুর। সম্পর্কের মধ্যে বড় কোনও গোলমাল পাব। পেলাম না। অন্তত বাইরে থেকে তো নয়ই। এরপর আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে লোক পাঠাই। ধারদেনা আছে কিনা জানতে চাই। অনেক সময় ফাইনানশিয়াল কোরাপশনে জড়িয়ে পড়লে এরকম হতে পারে। কিছুদিন ডুব দিয়ে দেয়। এরকম ঘটনা আমি দেখেছি। কিন্তু তা-ও কিছু পেলাম না। আমার লোকেরা খবর এনেছে, দেবনাথবাবু চাকরি বেশ ভালোই করতেন। টাকা পয়সা, প্রোমোশন, ইনক্রিমেন্টের ডিমান্ডও বেশি ছিল না, আবার আনসার্টেনিটিও কিছু ছিল না। যাকে বলে নিশ্চিন্ত জীবন। সব মিলিয়ে হি ওয়াজ আ হ্যাপি পারসেন। গুড ফ্যামিলি ম্যান। তা হলে উনি কোথায় গেলেন? কেন গেলেন? আদৌ কি গেছেন?

অফিসার থামলেন। পিওন চা এনেছে। সবাই চা নিল। বিশাখা চা খুব কম খায়। দিনে খুব বেশি হলে দুকাপ। সে-ও নিল। হিন্দোল গোড়ায় একটু উসখুস করছিল। অফিসারের কথা শুনতে শুনতে সেই উসকানি বন্ধ হয়ে গেছে। টেবিলের আড়ালে বিশাখা যামিনীর হাতটা চেপে ধরে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অফিসার আবার বলতে শুরু করেন।

আমি দেখলাম পসিবিলিটি দুটো। যেটার যুক্তি স্ট্রং সেটা হল উনি কোথাও যাননি। অ্যাক্সিডেন্ট ধরনের কিছু ঘটেছে। হয় বড় ধরনের ইনজুরি, নয় ফেটাল। আর দুর্বল পসিবিলিটি হল, সুখ শান্তি, নিশ্চয়তার পরও মানুষটার ঘরবাড়ি, সংসার ভালো লাগেনি। তাই সবাইকে ছেড়ে, সব ছেড়ে চলে গেছেন। তা হলে সেটা হবে একটা দার্শনিক ব্যাপার। এই সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিয়েছি। না দিয়ে উপায় ছিল না, এটা ধরে নিলে পুলিশের আর কোনও কাজ থাকত না। ফাইল বন্ধ করে দিতে হয়; দর্শনের রহস্য ভেদ করা পুলিশের কর্ম নয়। তাই ওটা সরিয়ে ভাবাই ভালো। এরপর থেকে আমি নিজে রেগুলার বিভিন্ন থানার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করলাম। হাওড়া শিয়ালদা জিআরপির সঙ্গে কথা বলেছি। এতদিন কাজের কাজ কিছু হয়নি। মনে হচ্ছে, এবার ফল পেয়েছি। মনে হচ্ছে বলছি এই কারণে যে আমি সিওর নই। আপনি সিওর করবেন। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশন যাব। জিআরপি লকআপ।

হিন্দোল চমকে উঠে বলল, লকআপ! লকআপে কী হয়েছে?

অফিসার হিন্দোলের দিকে তাকিয়ে বললেন, লকআপে কিছু হয়নি। যেখানে একজনকে রাখা হয়েছে। কাল রাতে আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ট্রেনে লোকটাকে জিআরপি ধরে। ভিখিরি, ভবঘুরে টাইপ। গেটের পাশে মেঝেতে বসে আসছিল, রাতে এক প্যাসেঞ্জারের খাবার কেড়ে নিতে যায়। বাধা দিতে গেলে গলা টিপে ধরে। প্যাসেঞ্জাররা সবাই মিলে ধরে তাকে রেল পুলিশের হাতে তুলে দেয়। দেখা যায়, লোকটা পুরোপুরি উন্মাদ। কখনও হাসছে, কখনও তেড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের কেসে জিআরপি সাধারণত আসামিকে গভীর রাতে কোনও স্টেশনে নামিয়ে দেয়। ভবঘুরে পাগলকে কে সামলাবে? এই লোক নাকি কিছুতেই নামতে চায়নি। বাধ্য হয়ে তাকে আজ সকালে হাওড়ায় নিয়ে আসা হয়েছে।

অফিসার চুপ করেন। টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র গোছগাছ করতে থাকেন। জলভরা চোখে যামিনী ফিসফিস করে বলল, তারপর কী হল?

অফিসার উঠে পড়লেন। বললেন, চলুন, এবার বেরোই। দুপুরে আমাকে হাওড়া থেকে ফোন করে ঘটনাটা জানিয়েছে। জানানোর কারণ, আমরা দেবনাথবাবুর যে ফটো পাঠিয়েছিলাম তার সঙ্গে লোকটার মিল আছে। কপালের কাটা দাগটাও রয়েছে। যে ছেলেটা ডিউটিতে ছিল তার কেমন সন্দেহ হয়। সে মিসিং ফাইল বের করে। এটাও একটা আশ্চর্য বিষয়। সন্দেহ করে কেউ পুরোনো ফাইল বের করছে সচরাচর দেখা যায় না। কে আবার আগ বাড়িয়ে খাটতে চায়? হয়তো আমি নিয়মিত লেগে ছিলাম বলেই করেছে। যাক, লোকটা নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারছে না। বলেছে, শুধু বউয়ের নামটা মনে আছে, যামিনী। বছর দেড়েক হয়ে গেল বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়েছিল, এখন আর চিনে ফিরে যেতে পারছে না। বাড়ির কেউ এলে চিনতে পারবে।

যামিনী মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, এক্ষুনি আমাকে নিয়ে চলুন..প্লিজ…।

বিশাখা যামিনীর কাঁধটা চেপে ধরে বলল, শান্ত হও যামিনীদি।

ডুকরে উঠে যামিনী বলল, ভিখিরি হয়ে গেছে!

অফিসার নরম গলায় বললেন, ভিখিরি হোক আর পাগল হোক, মানুষটাকে পাওয়াই আসল। অসুখের চিকিৎসা আছে। তবে ভুলও হতে পারে। ওরকম একটা লোক নিজের নাম বলতে পারছে না, শুধু স্ত্রীর নাম মনে আছে এটা এখনই বিশ্বাস করার কিছু নেই। ঠিক বললেও যামিনী যে একজনেরই নাম হবে এমনটাও ভাবার কারণ নেই। আমি জিআরপিকে বলেছি, আজই কোর্টে তুলবেন না, একটা দিন অপেক্ষা করুন। নিন, চলুন।

ভুলই হয়েছিল। মানুষটা যে তার স্বামী নয় সেটা বুঝতে এক ঝলকের বেশি সময় লাগেনি যামিনীর। রোগা চেহারায় একমুখ দাড়ি গোঁফ। গায়ে লুঙ্গি আর ছেঁড়া ফতুয়া। তীব্র দুর্গন্ধ। যামিনীকে দেখে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, কীরে খেতে দিবি না? খিদেতে তো মলুম রে হারামজাদি।

ভবানীভবনের অফিসারের দিকে তাকিয়ে ইনস্পেক্টর ছেলেটি নীচু গলায় বলল, স্যার বিকেল থেকে স্ত্রীর নামও বদলে ফেলেছে। কখনও বলছে জয়া, কখনও বলছে উমা। লেখাপড়া জানা লোক। আমার কীরকম সন্দেহ হচ্ছে।

কীরকম?

মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করে কনফিউজ করছে।

অফিসারের ভুরু কুঁচকে গেল। বললেন, আপনি ভালো করে দেখুন।

দেখছি স্যার।

সেদিন ট্রেনে গোটা পথটা কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিল যামিনী। বিশাখা পাশে বসে হাত ধরে রেখেছিল। মুখে কিছু বলেনি। স্পর্শ বলেছিল, আমি তোমার চোখের জলের কারণ বুঝতে পারছি যামিনীদি। তুমি কাঁদো।

.

যামিনীকে দেখতে পেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একদল ছাত্রীকে ঠেলে এগিয়ে এল বিশাখা। যামিনী দেখল মেয়েটার মুখটা যেন কেমন চিন্তিত হয়ে আছে।

কী হয়েছে?

বিশাখা গলা নামিয়ে বলল, একটা কথা আছে। স্কুলে বলা যাবে না।

যামিনী অবাক হয়ে বলল, কী কথা? স্কুলে বলা যাবে না কেন?

বিশাখা এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ভেবেছিলাম ফোনে বলব…হিন্দোল বলল, এসব কথা ফোনে বলা ঠিক নয়।

কী হয়েছে বলবি তো? যামিনীর গলায় অধৈর্য ভাব।

সামনের দিকে তাকিয়ে গলা আরও নীচু করল বিশাখা। বলল, এখন নয়, ওই যে রাজলক্ষ্মী আর আরতিদি আসছে। টিফিনের সময় স্কুল থেকে দুজন বেরিয়ে যাব। বীণাপাণিতে বসে কথা বলব।

বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার স্কুল থেকে খানিকটা দূরে। নামে মিষ্টির দোকান হলেও, শিঙাড়া, কচুরিতে বিখ্যাত। টিচাররা টিফিনের সময় লোক দিয়ে কিনে আনায়। ছুটির পর বা হাতে সময় থাকলে নিজেরাই দোকানে চলে যায়। দোকানে গিয়ে জমিয়ে বসে খেয়ে আসে।

বিশাখার কথা জানবার আগ্রহ হলেও যামিনী স্কুলে সুযোগ পেল না। বিশাখার টানা ক্লাস। মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য আরতিদির পাল্লায় পড়তে হল। ফাঁকা স্টাফরুমের টেবিলের উলটো দিক থেকে ঝুঁকে পড়ে মহিলা বললেন, তোমাদের পশুপতিদার লেটেস্ট কীর্তিটা শুনবে নাকি যামিনী?

যামিনী আজকাল স্কুলে যতটা পারে কম কথা বলে। যেটুকু না বললে নয়। কথা বলতে শুধু যে ভালো লাগে না এমন নয়, কথা শুনতেও তার ভালো লাগে না। অন্যের সংসারের গল্পের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে না। কী করে মেলাবে? তার সংসার যে একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। তাই বিরক্ত লাগে। ক্লাস না থাকলে ব্যাগ থেকে পত্রিকা বের করে ওলটায়। খাতা দেখে। সবসময়েই যেন মেজাজটা রুক্ষ হয়ে থাকে। এই রুক্ষ ভাবটা আরও বাড়ছে। অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলে। ছাত্রীরা আজকাল ভয় পায়। আরতিদির কথা শুনে বিরক্ত হয় যামিনী।

এখন থাক, ব্যস্ত আছি আরতিদি।

আরে বাবা শোনই না। ওই লোক সেদিন দেখি আমাকে আড়াল করে কী যেন দেখে। আমিও ছাড়বার পাত্রী নই। পা টিপে টিপে পিছনে গিয়ে উঁকি দিলাম। দেখি কোলের ওপর ইংরেজি ম্যাগাজিন। আমাকে দেখে ফট করে পাতা বন্ধ করে দিল।

যামিনী মুখ দিয়ে বিরক্তির আওয়াজ করে বলল, খাতা দেখছি, আপনি এবার থামুন।

রাখ তোমার খাতা। খাতা কি শুধু তুমিই দেখ? আমরা দেখি না? আগে কথাটা তো শুনবে। ঘরে কে ফট করে এসে যাবে তখন আর বলতে পারব না। আমি তারপর থেকে ওই ম্যাগাজিন দেখার জন্যে তক্কেতক্কে ছিলাম। তোমাদের পশুপতিদা বাথরুমে যেতেই টেবিলের তলা থেকে বের করে পাতা ওলটালাম। কী দেখি জানো?

আরতি মুখ ঘুরিয়ে দরজাটা দেখে নিলেন। যামিনী খানিকটা ধমকের সুরে বলল, আপনি থামুন তো। বয়স হচ্ছে তবু একই কথা বলে যান।

আরতিদি ধমক গায়ে না মেখে ফিসফিস করে বললেন, পাতা জোড়া জোড়া মেয়েদের সব ছবি। গায়ে বুকে কিচ্ছু নেই! কোমরে কোনওরকমে একফালি করে নেকড়া জড়ানো, সে ও না থাকার মতো। মাগো!

যামিনী ইচ্ছে করল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে। সে কষ্ট করে নিজেকে সামলাল। বাধা দিয়ে লাভ নেই। আরতিদি গজগজ করতে লাগলেন, সব পুরুষমানুষ এক, সুযোগ পেলেই নোলা লকলক করে। কাউকে বিশ্বাস করি না। একটু বউয়ের চোখের আড়াল হয়েছে কি হয়নি অমনি ঘাড়ে আঁপিয়ে পড়ে। মেয়েমানুষ একটা পেলেই হল। কোনও বাছবিচার নেই। এই তো আমাদের মোড়ের পন্টুর স্টেশনারি দোকান, অনেক সময় দোকানে পন্টু থাকে না, ওর বউটা এসে বসে। তোমায় কী বলব যামিনী, ওই মেয়েকে যে কী হতকুচ্ছিত দেখতে, একবারের বেশি দুবার মুখের দিকে তাকানো যায় না। কিন্তু হলে কী হবে তোমার পশুপতিদা একটু ফাঁক পেলেই বলে, যা-ই পন্টুর দোকান থেকে পাঁউরুটিটা নিয়ে আসি, একটু টুথপেস্ট কিনে আনি, যা বাবাঃ সিগারেট তো নেওয়া হল না। খালি ছুতোনাতা। পরশু সন্ধেবেলা মাথায় গেল আগুন ধরে, বললাম, অত বাহানার কী দরকার? যাও না, গিয়ে সরাসরি বল, অ্যাই মেয়ে তোমার বুকের কাপড়টা সরাও তো, আমি সাধ মিটিয়ে তোমার বুকদুটো দেখি। দেখে বাড়ি যাই। তা হলে আর বারবার ছুটে আসতে হবে না। ভালো বলেছি না?

আরতিদি ফাঁকা স্টাফরুমে আরও বকবকানি চালাতেন। দেবলীনা ঢুকতে চুপ করে গেলেন। ভয়ে নয়, এটাই তাঁর রীতি। তিনি তার স্বামীর গল্পগুলো সবসময় একজনকে ধরে বলেন। যখন যাকে একা পান। সন্দেহবাতিক অসুখের এটা একটা লক্ষণ। অসুস্থ মানুষ যখন কোনও অবিশ্বাসের কথা কাউকে বলে তখন এমন ভঙ্গি করে শুধু তাকেই কথাগুলো বলা হচ্ছে। তাদের সব সন্দেহের গল্পগুলোই বানানো বলেই এই ভানটা করতে হয়।

ঘণ্টা বাজতে ক্লাসে যাওয়ার জন্য উঠলেন আরতিদি। টেবিলটা ঘুরে যামিনীর পাশে। এসে দাঁড়ালেন। পিঠে হাত দিয়ে নীচু গলায় বললেন, সব পুরুষমানুষ বলায় রাগ করেছ নাকি? আমি কিন্তু দেবনাথের কথা বলতে চাইনি। তোমার স্বামী এই দলে পড়ে না। ও একদম আলাদা, আমি জানি।

যামিনী চমকে উঠল। এ আর একরকম আরতিদি! নিমেষে সব রাগ কমে গেল যামিনীর। হেসে বলল, আমি জানি আরতিদি।

বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এককোণায় দুটো বেঞ্চ আর টেবিল। দোকানের ছেলেটা জানে স্কুলের দিদিমণিরা এসে চট করে সেখানে বসবে না। তারা পিটপিটে স্বভাবের। আগে টেবিল বেঞ্চ ভালো করে মুছতে হবে। মোছা থাকলেও সামনে মুছতে হবে। কাপ প্লেট নিয়েও এক কারবার। এটা মোছো, ওটা ধোও করেই যায়। আজ কিন্তু দুই দিদিমণি এসে সে-সব কিছুই করল না। পিছনের বেঞ্চে মুখোমুখি বসে সামান্য কিছু খাবারের অর্ডার দিল।

যামিনী বলল, নে এবার বল। কী প্রবলেম হয়েছে? শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা করেছিস?

বিশাখা সরাসরি যামিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, না, আমার কোনও প্রবলমে নয়। দেবনাথদার ব্যাপার।

যামিনী চমকে উঠে বলল, দেবনাথ! দেবনাথের কী ব্যাপার!

যামিনীদি, হিন্দোল মনে হয়, দেবনাথদার একটা খবর পেয়েছে।

যামিনী হাত বাড়িয়ে বিশাখার একটা হাত চেপে ধরল।

কী খবর! খারাপ কিছু? মরে গেছে?

ছি ছি মারা যাওয়ার কথা কেন বলছ? সেরকম কিছু নয়। যেটুকু জেনেছি সুস্থ শরীরের কথাই জেনেছি। তবে খবরটা সেবারের মতো ভুলও হতে পারে। সেই যে সিআইডি অফিসার। ভুল করেছিল। একটা ভবঘুরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিল। এটাও হয়তো সেরকম…।

যামিনী বড় করে শ্বাস নিয়ে বিশাখার হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল। বলল, হোক ভুল, তুই বল। হিন্দোল কী খবর পেয়েছে?

বিশাখা মাথা নামাল।

খবরটা আমরা তোমাকে বলতে চাইনি, হিন্দোল তো একেবারেই নয়। তারপরেও অনেক আলোচনা করে দেখলাম, তোমাকে না জানানোটা অন্যায় হবে। আমরা চাই খবরটা ভুল হোক। ভালো নয় যামিনীদি। খবরটা খুব খারাপ।

যামিনীর শরীরটা কেঁপে উঠল।

 ০৪. কেমন আছ নীলাদ্রি

০৪.

কেমন আছ নীলাদ্রি?

ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?

আছি একরকম। বয়স বাড়ছে, শরীরে নানান গোলমাল শুরু হয়েছে। তোমার মা কেমন আছেন? বোন? তোমার বোনের নামটা যেন কী? খুব সুন্দর একটা নাম…আহা, মনে পড়ছে না…কী যেন…।

কিঙ্কিনি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে, কিঙ্কিনি। নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি–তোমার বাবা সুন্দর সুন্দর নাম রেখেছে।

বাবা নয়, আমার মায়ের দেওয়া নাম।

তাই নাকি! বাঃ। কিঙ্কিনি কেমন আছে? সে কত বড় হল?

এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছে।

সে কী! এত বড় হয়ে গেছে। আমি যখন দেখেছিলাম, এইট না নাইনে পড়ছে। কী খাবে নীলাদ্রি?

না না, আমি কিছু খাব না, খেয়ে এসেছি।

খেয়ে এসেছে তো কী হয়েছে? ট্রেন জার্নিতে সব হজম হয়ে গেছে।

সত্যি খাব না।

আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আগে কাজের কথা বলে নিই, তারপর দুজনে মিলে না হয়। বেরিয়ে গিয়ে কোথাও খাব। নাকি তোমারও তোমার বাবার মতো স্বভাব? সবসময় বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে? হা হা। তোমার বাবার ব্যাপারটা জানো তো? অফিস টাইমের পর একমিনিটও উনি অপেক্ষা করতেন না। ট্রেন ধরতে ছুটতেন।

অর্ধেন্দু দত্ত আওয়াজ করে হাসলেন। নীলাদ্রির অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তি হওয়ার কথা। সে বসে আছে তার বাবার অফিসে। অর্ধেন্দু দত্ত অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি। তিনি নীলাদ্রিকে একতলায় ইউনিয়নরুমেই বসিয়েছেন। যতই ইউনিয়নরুম তোক বাড়িটা তো এক। অস্বস্তি তো হবেই। দেবনাথ কখনও ছেলেমেয়েদের অফিসে নিয়ে আসেনি। ফ্যামিলি পিকনিক, অ্যানুয়াল ফাংশনে অনেকেই স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে আসত। সেখানেও নীলাদ্রিরা আসেনি। দেবনাথ নিজেই এ ধরনের গেটটুগেদার যতটা পারত এড়িয়ে যেত। তার ভালো লাগত না, আবার দূরত্বটাও একটা কারণ ছিল।

অর্ধেন্দু দত্ত কাল ফোন করেছিলেন। রাতে যামিনীকে কথাটা বলতে যামিনী ছেলের দিকে চমকে তাকাল। দু-বছর পর লোকটার নাম শুনছে। ভুরু কুঁচকে বলল, কখন করেছিল?

দুপুরে। বললেন, কাল সেকেন্ড হাফে যেন একবার বাবার অফিসে যাই।

যামিনী উৎসাহ গোপন করে বলল, কেন? কিছু বলেছে? তোর বাবার টাকা-পয়সার কিছু ব্যবস্থা করেছে?

না, বাবার কিছু নয়, আমার কাজের ব্যাপারে কথা বলতে চান। এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন জানতে চাইলেন। কী করি বল তো?

যামিনী আবার বিছানা করার কাজে মন দেয়। নিস্পৃহ ভাবে বলল, তুই যা ভালো বুঝবি কর। একটা পাকা কাজ পেলে তো ভালোই।

নীলাদ্রি বলল, তুমি আমার সঙ্গে যাবে মা?

যামিনী মুখ ঘুরিয়ে বলল, না। আমি কেন যাব? তোমাকে ডেকেছে তুমি যাও। যদিও ওই লোক কতটা কী পারবে আমার জানা নেই। তোর বাবারটা তো কিছুই পারল না। আবার কে জানে পারতেও পারে, ইউনিয়নের অনেক ক্ষমতা। একটা পারেনি বলে আর কিছু পারবে না এমন না-ও হতে পারে, তবে পারুক না পারুক তুমি আমাকে জড়াবে না।

নীলাদ্রি আর কথা বাড়ায়নি। তার কৌতূহল বেশি নয়। একটা সময় এই অর্ধেন্দু দত্ত লোকটার সঙ্গে মায়ের খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। মা ওঁর কাছে যেত। উনিও এ-বাড়িতে এসেছেন। ফোন করতেন। তাদের খবর নিতেন। হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেল। মনে আছে কিঙ্কি তাকে জিগ্যেস করেছিল, দাদা, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে মায়ের কী হয়েছে জানিস?

নীলাদ্রি অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে! কী হয়েছে?

কিঙ্কিনি ঠোঁটের কোণে বেঁকা হেসে বলল, মনে হয় ঝগড়া হয়েছে।

কী বলিস যা-তা, ওরা কি তোর মতো ছেলেমানুষ?

কিঙ্কিনি স্কুল ইউনিফর্ম পরে ছিল। চুলের বেণি পিঠ থেকে সামনে এনে, ফিক করে হেসে বলল, বড়মানুষদেরও ঝগড়া হয়। কাল রাতে অর্ধেন্দুকাকু ফোন করেছিল। মা বলল, আর কখনও এ বাড়িতে ফোন করবেন না। হি হি। আমি আড়াল থেকে শুনেছি। হি হি।

নীলাদ্রি অবাক হয়ে বলল, হাসছিস কেন?

ওমা বড়দের ঝগড়া দেখলে হাসি পাবে না! সবাই কি তোর মতো হাঁদা?

কথাটা সরল হলেও কিঙ্কিনি বলেছিল বেঁকা ভাবে। তারপর কাঁধে স্কুলের ব্যাগ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল একছুটে। নীলাদ্রি অবাক বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর ভুলেও গেল। কাল আবার অর্ধেন্দু দত্তর ফোন পেয়ে মনে পড়েছে। সত্যি অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে মায়ের কোনও সমস্যা হয়েছিল নাকি?

হ্যাঁ, সমস্যা হয়েছিল। সমস্যাটা বুঝতে পেরেও যামিনী ঠেকাতে পারছিল না। শুধু বুঝতে পারছিল, ভুল হচ্ছে। অন্যায় হচ্ছে। নিজেকে আটকাতে হবে। পারছিল না। চোরাস্রোতের মতো গোপন টানে ভেসে যাচ্ছিল। হঠাৎই একদিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সে। ভয় পায়। মনে হয় কিঙ্কিনি সব বুঝতে পারছে! সব দেখতে পাচ্ছে। কিঙ্কিনি নয়, কিঙ্কিনির চোখ দিয়ে দেখছে দেবনাথ! সেদিন থেকেই নিজেকে বেঁধে ফেলল যামিনী। অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে সম্পর্কের ইতি তখনই।

এই অফিসে নীলাদ্রি আগে একবারই এসেছে। তার মায়ের সঙ্গে। পাঁচ বছর আগে। দেবনাথের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা তখন সবে ঘটেছে। দশদিনও হয়নি। সেদিন দেবনাথের পরিচিতরা প্রায় সকলেই নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছিল। কেউ যামিনীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলেছিল, কেউ চুপ করে দূরে দাঁড়িয়েছিল। যারা দেবনাথের অতটা ঘনিষ্ঠ নয়, এক ডিপার্টমেন্টে কাজও করত না, তারা মা আর ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল হাঁ করে। সেই তাকানোয়

যতটা না সহানুভূতি ছিল তার থেকে বেশি ছিল কৌতূহল। হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্ত্রী, সন্তান। কেমন হয় তাই দেখার কৌতূহল। সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরি বলে এক ভদ্রলোক সেই সময় এই অফিসের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তার কাছেই এসেছিল যামিনী। খবর পেয়ে তিনি নিজে এসে দরজা খুলে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। দেবনাথ বলত, তাদের বস নাকি রাগী আর খিটখিটে। যামিনীরা সেরকম কিছু দেখল না। ভদ্রলোক খুবই আন্তরিকভাবে কথা বললেন। অথচ আদিখ্যেতা ধরনের সান্ত্বনাও দিলেন না। সোজা কথার মানুষ।

মিসেস চ্যাটার্জি, আপনাকে যদি বলি, চিন্তা করবেন না, সেটা মিথ্যে বলা হবে। অবশ্যই চিন্তা করবেন। আমরাও চিন্তা করব। যতদিন না ওঁর একটা খোঁজ পাওয়া যায় ততদিন এই চিন্তা থাকবে।

যামিনী বলল, আমি, আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি।

অবশ্যই, বলুন কী করতে পারি। আমরা ঠিক করেছি, পুলিশকে অফিস ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে চিঠি দেব। রিকোয়েস্ট করব যাতে বিষয়টা প্রপার গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুলিশ অনেক সময় কেস ফেলে রাখে। অথচ ওরা ইচ্ছে করলেই পারে। যাক, বলুন আমরা কী করতে পারি। মিস্টার চ্যাটার্জির খোঁজ পাওয়ার ব্যাপারে অফিস সবরকম কো-অপারেট করবে।

গত কটা দিন যামিনী উদভ্রান্তের মতো হয়েছিল। কী খাচ্ছে, কী পরছে খেয়াল ছিল না। দেবনাথের অফিসে আসছে বলে সেদিন খানিকটা পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়েছে। সেভাবে বাপের বাড়ি বলে যামিনীর কিছু নেই। মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। বাবা মারা যায় মেয়ের বিয়ে দেওয়ার একবছর পর। একমাত্র ভাই বহুদিন ধরে বাইরে। পড়াশোনায় ভালো ছেলে। পড়তেই আমেরিকা যাওয়া। সেখানেই চাকরি, জোহান নামে এক ফুটফুটে আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে। তারপর এদেশ-ওদেশ করে এখন কুইবেক শহরে বাড়ি বানিয়েছে। কলকাতায় আসে না। আমেরিকান বউ বাচ্চার সহ্য হয় না। বোনের বিয়ের সময় মাত্র দুদিনের জন্য এসেছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর তা-ও পারেনি। ওখান থেকে বোনকে বলেছিল–অতদিন ধরে বডি রাখার প্রশ্ন ওঠে না দিদি। তুই আর জামাইবাবু সব মিটিয়ে ফেল। আমি আর এখন যাচ্ছি না।

যামিনী অবাক হয়ে বলেছিল, আর কাজকর্ম?

কাজকর্ম মানে!

শ্রাদ্ধশান্তির কী হবে?

ভাই টেলিফোনে একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, তুই করবি। আমি খরচ-টরচ যা লাগে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

যামিনী রেগে গিয়ে বলে, খরচের কথা বলছিস কেন? ছেলে থাকতে আমি বাবার কাজ করব কী করে? আত্মীয়স্বজন কী বলবে?

দিদি, ইটস ইওর প্রবলেম। তোদের সমস্যা। আমি অনেকদিন ধরেই এসব নিয়মকানুনের বাইরে। প্লিজ আমাকে টানিস না। তা-ও মা বেঁচে থাকলে একটা মানে ছিল। অন্যরা কী বলল না বলল কিছু এসে যায় না। হু আর দে? ওরা কে? তুইও মাথা ঘামাস না দিদি। পুজোআচ্চা যে করতেই হবে এমনটাও নয়। না পারলে করবি না। তোদের বিষয়।

তোদের বিষয় বলছিস কেন? এ ব্যাপারে দেবনাথ কে? আমাদের বাড়ির কাজ। তোর একটা রেসপন্সিবিলিটি আছে।

রেসপন্সিবিলিটি! কীসের? তোর বিয়ের পর আমি বাবাকে বলিনি তুমি আমার সঙ্গে চল? বলিনি? বাবাই রাজি হয়নি। উনি নাকি দেশ ছাড়বেন না। বোগাস! আমি কী করব? আমি তো রেসপন্সিবিলিটি নিতেই চেয়েছিলাম, উনি অ্যালাও করেননি। এখন যদি তোরা ভাবিস কাজকর্ম ফেলে কাছা পরা আর নেড়া হওয়ার রেসপন্সিবিলিটি পালন করতে আমি দেশে ছুটে যাব, তোরা ভুল করবি।

যামিনী দুঃখ পেয়ে বলেছিল, তুই এভাবে বলছিস কেন? সবার কথা ভেবেই তো বলেছি।

ভাই বিরক্ত গলায় বলল, তুই আমার হয়ে ওদের সরি জানিয়ে দিস। বল কত টাকা পাঠাব? হাউ মাচ?

যামিনী বুঝেছিল, দেশের সঙ্গে সম্পর্কের যেটুকু সুতো ঝুলছিল, বাবার মৃত্যুর পর ভাই সেটুকুও ছিঁড়ে দিল। বাপেরবাড়ি বলে তার আর কিছু রইল না। সে বলল, থাক। টাকা লাগবে না।

রাসবিহারীর কাছে এক মাঠে ব্যবস্থা করে কোনওরকমে বাবার কাজ সেরেছিল যামিনী। সবাইকে বলেছিল, ভাই আমেরিকায় করছে। সমস্যা কিছু নেই। পুজোআচ্চা, বিয়ের মতো শ্রাদ্ধশান্তির কাজও আমেরিকায় সুন্দরভাবে করা যায়।

দেবনাথের ঘটনার পরপর দূর সম্পর্কের মাসতুতো বোন সংযুক্তা কটা দিন এখানে এসেছিল। দেবনাথের অফিসে যাওয়ার সময় বলল, একটু সেজেগুজে যা।

যামিনী বলেছিল, কী হবে সেজেগুজে?

আমি বেড়াতে যাওয়ার সাজ বলছি না, কিন্তু তা বলে এরকম আলুথালু হয়ে ঘোরাটাও ঠিক নয়। তোকে দেখে মনে হচ্ছে, সব শেষ হয়ে গেছে, আর কিছু করার নেই। বাকিরাও সেই সিগন্যাল পেলে দেবনাথদাকে তাদের খোঁজার ইচ্ছেটাই কমে যাবে। স্ত্রী যেখানে ভেঙে পড়েছে সেখানে অন্যরা উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে কেন?

কথাটা বুঝেছিল যামিনী। তাই দেবনাথের অফিসে গিয়েছিল যতটা সম্ভব ফিটফাট হয়েই। আঁচলটা কোলের ওপর নিয়ে যামিনী বলল, স্যার, সেদিন ও অফিসে কাউকে কি কিছু বলেছিল?

সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরী ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো?

যামিনী অস্বস্তি নিয়ে বলল, মানে কোনওরকম হিন্ট? আসলে পুলিশ আমাকে বলছে, অনেকসময় কেউ কোনও মেজর সিদ্ধান্ত নিলে আগে থেকে কাউকে না কাউকে জানিয়ে দেয়। হয়তো বাড়িতে বলতে পারেনি, কলিগদের কাউকে বলেছিল…।

সোমপ্রকাশ অবাক হলেন। বললেন, পুলিশ কি ভাবছে দেবনাথবাবু নিজেই কোথাও চলে গেছেন? স্ট্রেঞ্জ! তা কেন হবে?

যামিনী পাশে বসা ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, না না সেরকম কিছু নয়। তবে পুলিশকে সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে হয়।

জেনারেল ম্যানেজারের চোখ মুখ থেকে অবাক হওয়ার ভাবটা গেল না। তিনি বেল। টিপলেন।

তপনবাবুকে ডাকছি। উনি মিস্টার চ্যাটার্জির ঠিক পাশের টেবিলে বসেন।

মা ছেলে সেদিন বেশ খানিকটা সময় দেবনাথের অফিসে কাটিয়েছিল। প্রায় এক ঘণ্টার ওপর। কাজের কাজ কিছু হয়নি। দেবনাথের কোনও কলিগই এমন কোনও কথা বলতে পারেনি যা থেকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়। বরং দু-একজন জানাল, মানুষটা সেদিনও একই রকম হাসিখুশি ছিল। রোজকার মতো মজার মজার কথাও বলেছে। তপনবাবু মনে করে একটা বলতেই পারলেন।

সেকেন্ড হাফে কম্পিউটারে কী একটা সমস্যা হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়র এসে বলল, মনে হচ্ছে ভাইরাস। ক্লিন করতে হবে। দেবনাথ বললেন, ভাই, তাহলে একইসঙ্গে আমাদেরও ক্লিন করে দিয়ে যাবেন। আমরা সকলেই ভাইরাস-আক্রান্ত। কী বোর্ডে একরকম কমান্ড পাঠাচ্ছি কাজ করছে অন্যরকম। এ টিপলে স্ক্রিনে জেড পড়ছে। শুরু করতে গিয়ে শেষ করে বসছি।

ক্যান্টিনের দিব্যেন্দুকেও ডেকে আনা হল। তপনবাবু বললেন, খোঁজ-খবর যখন হচ্ছে, ভালো করেই হোক। টিফিনের সময় চ্যাটার্জিদা তো ক্যান্টিনেই ছিলেন।

দিব্যেন্দু কাঁচুমাচু মুখে জানাল, কই অন্যরকম তো কিছু মনে পড়ছে না! রোজকার মতোই তো অমলেট-টোস্ট খেলেন। পরপর দুকাপ চা।

তপনবাবু ঘাড়টা একটু কাত করে বললেন, কোনও কথা বলেছিলেন?

কী কথা?

এই ধর, কটা দিন থাকব না বা ভালো থাকিস ধরনের কিছু?

দিব্যেন্দু মনে করার চেষ্টা করে। বলে, কই না তো! বরং একশো টাকার একটা নোট দিয়েছিলেন স্যার। তখন আমার কাছে ভাঙানি ছিল না। বললেন, ঠিক আছে রেখে দাও। আমি টাকাটা ম্যাডামের হাতে ফেরত দিই?

যামিনী চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না সামলেছিল। বলেছিল, না থাক, উনি এলেই ফেরত দিও।

চলে যাওয়ার সময় সবাই বলেছিল, আবার আসবেন। দরকার হলে ফোন করবেন।

সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরি নিজে লিফট পর্যন্ত এলেন। ট্রেনে উঠে নীলাদ্রি মাকে বলেছিল, আমি আর কখনও বাবার অফিসে আসব না।

যামিনী অবাক হয়ে বলল, কেন? মানুষগুলো তো ভালো। কত যত্ন করল।

নীলাদ্রি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, সেইজন্যই আসব না। এত যত্ন আমার ভালো লাগছে না। তুমি কিঙ্কিকে নিয়ে এসো।

সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা নীলাদ্রির গলায় অভিমান।

যামিনী ছেলের গায়ে হাত রেখে বলল, কী করব বল? আমি তো আর বলতে পারি না, আপনারা এত যত্ন করবেন না।

বলতে হয়নি। দেবনাথের অফিসের যত্ন কমে গেল নিজে থেকেই। নীলাদ্রি বা কিঙ্কিনি আসেনি, কিন্তু যামিনীকে তারপরও বহুবার আসতে হয়েছে। টাকা-পয়সার জন্য আসতে হয়েছে। তিনমাসের মধ্যে দেবনাথের মাইনে বন্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে নো পে। নির্ধারিত পাওনা ছুটির পরও বেশ কিছুদিন অনুমোদন করেছিল অফিস, তারপর আর পারেনি। একসময় স্বামী নিখোঁজ হওয়ার শোক ছাপিয়ে টাকাপয়সার অভাব মাথা চাড়া দিল। দেবনাথের মাইনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না যামিনী। তাকে কেউ সতর্কও করেনি। হয়তো তারাও ঠিক জানত না। জানবেই বা কী করে? একজন চাকরি করা মানুষ মারা গেলে কী হয় কম-বেশি সকলেরই জানা আছে। কিন্তু হারিয়ে গেলে? দেবনাথের অফিসের ডিপার্টমেন্টাল হেড, ক্যাশিয়ার, অ্যাকাউন্টস ম্যানেজারের কাছে ছোটাছুটি করেও কোনও সুরাহা করতে পারল না যামিনী। সকলে নানান পরামর্শ দিল। সবটাই অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে পুলিশের ডায়েরির কপি, তিনমাসের ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জমা দেওয়া হল। প্রথম প্রথম সঙ্গে দেবনাথের। কলিগরা অনেকেই থাকত। দোতলা, তিনতলা, চারতলা করত। এই ডিপার্টমেন্ট, সেই ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেত যামিনীকে। ক্যান্টিনে বসে চা খাওয়াত। এগিয়ে গিয়ে হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার বাসে তুলে দিত। ক্রমশ সেই সংখ্যা কমতে লাগল। তপনবাবুর মতো একেবারে দেবনাথের পাশে বসা দু-একজনে এসে ঠেকল। তা-ও বন্ধ হল একসময়। সকলের কাজ আছে। তা ছাড়া নিষ্ফলা ছোটাছুটিতে লাভ কী? বরং যামিনীর মুখোমুখি হলে লজ্জা করছে। কী বলবে? সবাই হাল। ছাড়লেও যামিনীর পক্ষে হাল ছাড়া সম্ভব ছিল না। তার টাকা লাগবে। তাকে সংসার চালাতে হবে। ভাই আমেরিকা থেকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিল, নিতে রাজি হয়নি যামিনী। কেন সাহায্য নেবে? স্বামী হারিয়ে গেছে বলে কারও কাছেই হাত পাতা অসম্ভব। নিজের ভাইয়ের কাছেও নয়।

যামিনী আবার একদিন দেখা করল সুপ্রকাশ রায়চৌধুরির সঙ্গে। এবার একঘণ্টার ওপর অপেক্ষা করতে হল। জরুরি কোনও মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা নয়, লাঞ্চের পর উনি একটু বিশ্রাম নেন। তবে মানুষটা ব্যবহার করলেন আগের মতোই সুন্দর। গলায় সেই সহানুভূতি, আন্তরিকতা। অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিলেন। কিন্তু যা বললেন, তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যামিনীর।

সরি মিসেস চ্যাটার্জি, আমাদের আর কিছু করার নেই। আপনাদের সমস্যা আমরা বুঝতে পারছি। হঠাৎ করে এতগুলো টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়া যে কতটা ভয়ঙ্কর আমরা জানি। আমি নিয়মের বাইরে গিয়েই বোর্ড মিটিংয়ে আরও এক মাসের এক্সট্রা লিভ স্যাংশন করেছিলাম। কিন্তু আর তো সম্ভব নয়। এবার টাকা পেতে গেলে দ্য পারসেন স্যুড জয়েন। তাকে এবার অফিসে আসতেই হবে।

যামিনী বলল, কিন্তু উনি তো মারা যাননি।

ছি ছি এ-কথা বলছেন কেন? আমরা সবসময় আশা করব, উনি সুস্থ শরীরে ফিরে আসবেন। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই মিসেস চ্যাটার্জি। আপনি যতই সেটা ব্রেক করুন এক সময় সেটাও আবার নিয়মের মধ্যে পড়বে।

আমি অ্যাপ্লিকেশনে ইনভেসটিগেশন রিপোর্ট জমা দিয়েছি স্যার। সেখানে সিআইডি লিখে দিয়েছে, তদন্ত চলছে। তারা আশা করছে, খুব দ্রুতই কিনারা হবে।

সুপ্রকাশ রায়চৌধুরি মার্জিত গলায় বললেন, আমরাও একই আশা করছি। কিন্তু একটা কথা আপনি বোঝার চেষ্টা করুন, সব অফিসেরই হিসেবপত্র নিয়ে অডিট হয়। কোনও কোম্পানিই মাসের পর মাস এমন কারও নামে ব্যাঙ্কে স্যালারি ভরে যেতে পারে না যার কোনও ট্রেস নেই। অডিট অ্যালাও করবে না। আমাদের হাত-পা বাঁধা।

যামিনী চুপ করে থাকে। মাথা নামিয়ে বসে থাকে।

আপনি কি এক কাপ চা খাবেন মিসেস চ্যাটার্জি?

ভদ্রতার সঙ্গে কথাটা বললেও, বলার ভঙ্গিটা ছিল, না খেলেই ভালো হয়, এবার আপনি উঠুন ধরনের। যামিনী ভঙ্গিটা বুঝতে পারে। উঠে পড়ে সে।

এরও দেড়বছর পর আবার স্বামীর অফিসে যায় যামিনী। সুপ্রকাশ রায়চৌধুরি নেই। রিটায়ার করেছেন। নতুন জেনারেল ম্যানেজার অবাঙালি এক ভদ্রলোক। কেরল থেকে এসেছেন। তিনি সপ্তাহের অর্ধেক দিন বাইরে থাকেন। সেদিন অবশ্য অফিসে ছিলেন, কিন্তু যামিনীর সঙ্গে দেখা করলেন না। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই। দেখা করতে চাওয়ার কারণও বলতে হবে। পি. এ. মেয়েটিও নতুন। যামিনী তার কাছেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইল। পরের সপ্তাহে যদি কোনওদিন দেখা করা যায়। মেয়েটি খাতা বের করে বিরক্ত মুখে বলে, মনে হয় না এত আর্লি হবে। তা-ও দেখব। বলুন কী কারণে দেখা করতে চাইছেন। যামিনী কারণ বলে। লেখা থামিয়ে মেয়েটি মুখ তুলে অবাক চোখে তাকায়। ফের বাকিটুকু লিখে একটু বসতে বলে। ইন্টারকমে বসের সঙ্গে কথা বলে চাপা গলায়।

স্যার বললেন, ওর সঙ্গে দেখা করার কিছু নেই। বিষয়টা নিয়ে আপনি অ্যাকাউন্টস। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন। আজই বলুন। উনি বলে দিচ্ছেন।

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার পুরোনো। যামিনীকে যত্ন করে বসতে বললেন। যামিনী বলল, তা হলে আমি ওর গ্রাচুয়িটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করি।

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার একটু ভেবে বললেন, আমাকে দুটো দিন সময় দিন।

আমি পরশু আসব? বুঝতেই তো পারছেন টাকাটার কত দরকার। সংসার টানা কঠিন হয়ে পড়েছে।

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বিষয়টা দেখছি আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমি খবর দেব। এটা আমাদের ডিউটি। খুব খারাপ লাগছে ওর মতো একজন হাসিখুশি মানুষ…।

যামিনী বিড়বিড় করে বলল, মাঝেমাঝে মনে হয়, এটাও ওর একটা ঠাট্টা। আমাদের সর্বনাশ দেখে আড়াল থেকে হাসছে।

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার ডিউটি পালন করলেন। দুটো দিন লাগল না, পরদিনই বিকেলে ফোন করলেন যামিনীকে।

সরি ম্যাডাম, দেবনাথবাবুর কোনও পাওনাই এখন ক্লিয়ার হবে না।

যামিনী তখনও স্কুলে। ক্লাস নিয়ে স্টাফরুমে ফিরছিল। সিঁড়িতে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কেন!

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার ঢোঁক গিলে বললেন, কাকে টাকাটা দেওয়া হবে?

কেন আমাকে। আমি তার স্ত্রী, নিশ্চয় নমিনি করা আছে।

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার টেলিফোনের ওপাশে মনে হল সামান্য হাসলেন। বললেন, সবই ঠিক আছে, কিন্তু যে মানুষটা মারাই যাননি তার নমিনির হাতে টাকাপয়সা কীভাবে দেওয়া হবে! কেউ দেবেও না।

যামিনী মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে অসহায় গলায় বলল, তা হলে কী হবে?

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার চিন্তিত গলায় বললেন, অপেক্ষা করা ছাড়া তো কোনও পথ দেখছি না।

কতদিন!

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার চুপ করে রইলেন। যামিনী রুক্ষ গলায় বলল, কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? ও না ফেরা পর্যন্ত?

যতদিন না অফিশিয়ালি একটা কিছু…।

কী একটা কিছু? আমি তো আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না!

ক্লাস টেনের কটা মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল। যামিনী মিসের চাপা অথচ উত্তেজিত গলা তাদের কানে যায়। তারা দ্রুত সরে দাঁড়ায়। স্বামী বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মিসের হাবভাব বদলে গেছে। ভয় করে। যামিনী হাতের ইশারায় তাদের উঠে যেতে বলে।

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার বললেন, বিষয়টা এখন থানা পুলিশের হাতে। মিসিং কেস চলছে। গোটাটাই লিগাল প্রসিডিওরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, একটা অফিশিয়াল ডিক্লারেশন ছাড়া কিছুই করা যাবে না। আমরা মুভ করতে পারব না।

কীসের ডিক্লারেশন?

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার সম্ভবত বুঝলেন, এবার স্পষ্ট করে বলা দরকার। তিনি তাই করলেন।

দেবনাথবাবু বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সে বিষয় পুলিশকে জানাতে হবে। যদি ওরা বলে, বেঁচে আছেন তা হলে তো আপনাকে টাকা দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। যতই নমিনি থাকুক তাঁর অনুমতি ছাড়া টাকা উঠবে কী করে?

আর যদি উলটোটা বলে? মারা গেছে। কেটে কেটে বলে যামিনী।

অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার আবার একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, সেটা পারবে না। আমি খোঁজ নিয়েছি। সাত বছর পার না হলে নিখোঁজ মানুষকে মৃত ঘোষণা করা যায় না। পুলিশ পারবে না।

সেদিন ফোন ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে কিছুটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়েছিল যামিনী। সামনেই লম্বা কাচের জানলা। স্কুল মাঠটা দেখা যায়। স্কুল চলছে, ফলে মাঠটাও ফঁকা। একটু পরে ছুটি, তখন মেয়েতে কিলবিল করে উঠবে। বাংলা টিচার নিবেদিতা চক-ডাস্টার হাতে ক্লাসে যাচ্ছিল। যামিনীর থমথমে চোখমুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী হয়েছে যামিনীদি? নতুন কোনও সমস্যা?

যামিনী মলিন হেসে বলল, তোদের দেবনাথদা আমাকে এত বড় বিপদে কেন ফেলল বলতে পারিস?

নিবেদিতা যামিনীর কনুই স্পর্শ করে বলল, এত ভেঙে পোড়ো না। নিশ্চয় খোঁজ পাওয়া যাবে।

আর খোঁজের দরকার নেই, এখন মনে হচ্ছে, মানুষটা মারা গেলেই ভালো। আমাদের তো বাঁচতে হবে!

ছিঃ যামিনীদি, মোটে কটা দিন হয়েছে। এর মধ্যে এত ভেঙে পড়লে চলবে কী করে?

আমি আর চলতে চাই না নিবেদিতা।

অনেকদিন পরে অন্যের সামনে এই ধরনের ভেঙেপড়া আচরণ করে ফেলল যামিনী। নিবেদিতা বলল, ছিঃ এরকম বোলো না। তোমার ছেলেমেয়ে আছে না? তাদের মানুষ করতে হবে।

তীব্র মাথার যন্ত্রণা নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল যামিনী। গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতে চমকে উঠল। বাড়ির ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রাণখোলা হাসি। ঠিক এভাবে দেবনাথ হাসত! কে হাসছে! হাসতে হাসতেই দরজা খুলল কিঙ্কিনি। যামিনী অবাক হল। মেয়েটা বাবার গলা পেয়েছে! গলা তো নয় হাসি। এমনও কি হয়? সন্তান বাবা-মায়ের হাসি কান্নার ধরন পায়? যামিনী অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

দারুণ, একটা দারুণ মজার ঘটনা হয়েছে মা। অপালা ফোন করেছিল, মিঠু একটা কাণ্ড করেছে। আমাদের ক্লাসের মিঠুকে চেনো তো? এই যে খুব ফরসা মেয়েটা, কাল বাজারে…হি হি..অপালা ভেবে…হি হি…আমাদের টিচার চৈতালি ম্যাডামের চোখ চেপে ধরে বলেছে, বল তো কে…হি হি।

যামিনী থমথমে মুখে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

সেদিন সন্ধেবেলায় দেরি করে পড়তে বসার অপরাধে যামিনীর হাতে বেধড়ক মার খেল কিঙ্কিনি, অনেক রাত পর্যন্ত নিজের ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল মেয়েটা। মেয়ের কান্নায় খুব রাগী মায়ের মনও নরম হয়। মেয়েকে কাছে নিয়ে আদর করে। কিঙ্কিনি অবাক হয়ে দেখল। সেরকম কিছুই তার হচ্ছে না! সে অন্ধকার ঘরে শুয়ে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে লাগল মন দিয়ে। হাসির মতো মেয়েটার কান্নাও কি তার বাবার? হলেই বা বুঝবে কী করে? দেবনাথের কান্নার আওয়াজ কখনও শুনেছে বলে মনে পড়ছে না তার।

যামিনী ভাবছিল, ঘটনা এখানেই থেমে গেল। দেবনাথের অফিসে আর যেতে হবে না। কিন্তু তা হল না। অ্যাকাউন্টস ম্যানেজারের টেলিফোনে কথা বলার ঠিক এক সপ্তাহ পর একটা ফোন এল। গম্ভীর গলায় পুরুষমানুষ। মানুষটা এক নিশ্বাসে গাদাখানেক কথা বলে যায়–

নমস্কার আমি অর্ধেন্দু দত্ত। আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে চাকরি করি। যদিও আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিল। দেবনাথবাবুর সঙ্গে আমার সেভাবে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। আমি অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি। সবসময়েই ইউনিয়ন নিয়ে ব্যস্ত। উনি তো আবার এসবের মধ্যে ছিলেন না। ফলে দেখাসাক্ষাৎ তেমন হয়নি। যা-ই হোক, ওঁর খবরটা আমি শুনেছি, কিন্তু আমাদের ইন্টারফেয়ার করার কোনও ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এখন শুনছি, দেবনাথবাবুর পাওনা টাকাপয়সার ব্যাপারে অফিস আপনার সঙ্গে কোঅপারেশন করছে না। আপনি যদি চান আমরা ইউনিয়নের তরফ থেকে বিষয়টা নিয়ে মুভ করতে পারি।

ভদ্রলোক থামলে যামিনী বলল, ধন্যবাদ। আমি সকলেরই সাহায্য চাই।

ধন্যবাদের কোনও ব্যাপার নেই। আমরা দেবনাথবাবুকে আজও আমাদের কলিগ মনে করি। তাঁর পরিবারের সুবিধে অসুবিধে দেখাটা ইউনিয়নের কাজের মধ্যে পড়ে। আপনি যদি কাল বা পরশু একবার আসেন তা হলে আমরা কথা বলে নেব। ইউনিয়নের অন্যদেরও থাকতে বলব।

তখন থেকেই অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে যামিনীর পরিচয়। প্রথম সাক্ষাতেই মানুষটাকে পছন্দ হয়েছিল। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। পেটানো চেহারা। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। চেয়ারে বসে পিঠ সোজা করে। বসার মতো মানুষটার কথার মধ্যেও একধরনের সোজাসাপটা ভাব রয়েছে। ইউনিয়নের অফিসে বসে আর পাঁচজনের সঙ্গে যামিনীর সমস্যা শুনলেন। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন

নিয়ম নেই, হয় না, অসম্ভব–এসব হল ম্যানেজমেন্টের কথা। আমাদের শুনে লাভ নেই। ইউনিয়নের কাজই হল এর বিরুদ্ধে ফাইট করা। আমাদের একজন কলিগ নিখোঁজ হয়েছেন। কেন নিখোঁজ হয়েছে, বেঁচে আছেন না মারা গেছেন পুলিশ দেখছে। অফিস নিয়ম দেখিয়ে তার স্যালারি বন্ধ করে দিয়েছে, আইনের কথা বলে তাঁর পাওনা টাকা আটকে রেখেছে। বলছে, সাত বছর বসে থাকুন। মানে কী! এই সাত বছর দেবনাথবাবুর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কী হবে? নিয়ম আর আইন ধুয়ে জল খাবে? আইন কীসের জন্য? মানুষের উপকারের জন্য। মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য নয়। ঘটনাটা আজ দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হয়েছে, কাল অন্য কারও হতে পারে।

সকলেই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। কেউ বললেন, ছি ছি, কারও মতে, খুব অন্যায় হচ্ছে। দু-একজন আরও একটু এগিয়ে গেলেন।

হিউম্যানিটেরিয়ান গ্রাউন্ড বলে একটা জিনিস আছে তো। নাকি নেই? অফিস খানিকটা টাকা অ্যাডভান্স দিক। সাত বছর পরে মিটিয়ে দেওয়া হবে।

যামিনীর খুব ভালো লাগছে। মনে জোর পেল। অফিসের এতগুলো মানুষ তার পাশে! দেবনাথকে ভালোবাসত বলেই না…।

অর্ধেন্দু দত্ত যামিনীর দিকে ফিরে বললেন, আপনি ভাববেন না মিসেস চ্যাটার্জি, আমরা কেসটা নিয়ে এগোবো। আপনি ইউনিয়নের কাছে শুধু একটা লিখিত অ্যাপিল করুন।

অর্ধেন্দু দত্ত সত্যি এগোলেন। দীর্ঘ ছমাস ধরে এগোলেন। প্রথম তিন-চার মাস দল বেঁধে, তারপর একা। একা না হয়ে উপায় ছিল না। ইউনিয়নের অন্যরা ততক্ষণে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ম্যানেজমেন্টকে কোনওভাবেই রাজি করানো যাচ্ছে না। আর এই একা চলার সময়টাতেই সমস্যা শুরু হল। মাঝে মাঝে যামিনীকে কলকাতায় ডেকে নিতেন অর্ধেন্দু। প্রথমে অফিসে, তারপর বাইরেও। ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় বসে চা খেত দুজনে। ধীরে ধীরে কাজের কথার পাশাপাশি অল্প অল্প ব্যক্তিগত কথা চলে আসে। বেশিরভাগই দেবনাথের প্রতি যামিনীর দুঃখের কথা, অভিমানের কথা। অর্ধেন্দু দত্ত শান্ত ভাবে শুনতেন। সহানুভূতি নিয়ে উত্তর দিতেন।

আপনি এরকম ভাবছেন কেন মিসেস চ্যাটার্জি? দেবনাথবাবু যে নিজেই আপনাদের ছেড়ে চলে গেছেন এমনটা তো না-ও হতে পারে। তাঁর প্রতি আপনার এই রাগটা হয়তো ইনজাসটিস হচ্ছে।

তা হলে কী হয়েছে? কিডন্যাপ?

অর্ধেন্দু দত্ত হেসে বললেন, না না, তা হলে এতক্ষণে খবর চলে আসত। যারা কিডন্যাপ করেছে তারা তো মুক্তিপণ চাইত। চাইত না। তা ছাড়া ওকে কে কিডন্যাপ করবে?

যামিনী বলল, আপনি কী মনে করছেন, মারা গেছে?

নানা আমি সেকথা বলতে চাইনি। অর্ধেন্দু দত্ত নিজেকে সামলালেন। বললেন, যতক্ষণ না  পর্যন্ত ডেফিনিট কোনও প্রুফ পাওয়া যাচ্ছে কোনওটাই ধরে নেওয়া উচিত নয়।

রেস্তোরাঁর আধো আলো আধো অন্ধকারে বসে যামিনী ডুকরে কেঁদে ওঠে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, আমি জানি ও বেঁচে আছে। নিশ্চয় বেঁচে আছে। কোথাও লুকিয়ে থেকে ঠাট্টা করছে। যেদিন বুঝবে অন্যায় হচ্ছে সেদিন ঠিক ফিরে আসবে।

অর্ধেন্দু দত্ত একটু অপেক্ষা করলেন, তারপর যামিনীর হাত ধরে গাঢ় স্বরে বলেন, কেঁদো না যামিনী, তাই যেন হয়। দেবনাথবাবু যেন ফিরে আসে।

বহুদিন পর পুরুষের স্পর্শে চমকে উঠেছিল যামিনী। ভালোও কি লেগেছিল? নিশ্চয় লেগেছিল। নইলে সেদিন হাত কেন সরিয়ে নেয়নি সে? অথবা কে জানে সেই স্পর্শে হয়তো ভরসা ছিল। গভীর বিপদে পড়া কোনও নারী পুরুষের কাছ থেকে যে ভরসা খোঁজে সেই ভরসা। যামিনীর দুর্বল মন বুঝতে পারেন অর্ধেন্দু দত্ত। যামিনী নিজেই বুঝতে দেয়। কেন দেয়? পরে অনেক ভেবেছিল যামিনী। শুধুই কি আশ্রয়ের কারণ? নাকি শক্ত-সমর্থ এক পুরুষের জন্য শরীর সহসা জেগে ওঠে?

.

এক শনিবার সন্ধ্যায় অর্ধেন্দু দত্তর ফাঁকা ফ্ল্যাটে ব্লাউজ খুলে থমকে গিয়েছিল যামিনী। অর্ধেন্দু দত্ত তখন সামনে বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছে স্থির চোখে। যামিনী থেমে যেতে বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, কাম অন যামিনী। তাড়াতাড়ি করো।

যামিনী দু-হাতে বুক ঢেকে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, খারাপ লাগছে।

অর্ধেন্দু দত্ত তখন পুরোপুরি তৈরি। লোহায় পেটানো শরীরে কোনও আড়াল নেই। এমনকী একটা চাদর পর্যন্ত নেই! বোধহয় যামিনীকে প্রলুব্ধ করতেই নগ্ন হয়েছিল। পেশি, ত্বক, পুরুষের সব অঙ্গ যেন লোহার মতো! বাদামি, কঠিন। খানিকটা অবজ্ঞার সঙ্গেই তিনি বললেন, কার জন্য খারাপ লাগছে যামিনী?

আপনি জানেন না?

অর্ধেন্দু দত্ত ঠোঁট উলটে হাসলেন। বললেন, না, জানি না। নিশ্চয় সেই মানুষটার জন্য নয়, যে তোমার এই সুন্দর শরীরটা ছুঁড়ে ফেলে চলে গেছে।

চলে গেছে! মুখ তুলে তাকাল যামিনী।

তুমিই তো সেরকমই বল, বল চলে গেছে। আড়াল থেকে দেখে হাসছে বল না? বাদ দাও ওসব, এসো। মনে রেখো তোমারও জীবন আছে। শরীর আছে। চলে এসো, দেখবে সে জীবন শুধু হা-হুঁতাশ আর কান্নার জীবন নয়। সে জীবনও উপভোগ করার। বেঁচে থাকার। যদি রাজি হও, যদি ভালো লাগে আমি সঙ্গে থাকব চিরকাল।

রাজনীতি করে বলেই বোধহয় এমন মন ভোলানো কথা বলতে পারে মানুষটা। নিজের শেষ আবরণ সরিয়ে সেদিন দ্বিধা জড়ানো পায়ে যামিনী উঠে গিয়েছিল বিছানায়। মানুষটা যামিনীকে আদর করেছিলেন শান্ত অথচ পরিণত মুদ্রায়। তার অধিকাংশই যামিনীর অচেনা। দেবনাথ কি এসব জানত না! শেখেনি! এই বয়েসেও শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে যামিনীর। অর্ধেন্দুর কোলের কাছে বসে লজ্জায় চোখ ঢাকে। তার মাথার চুল ধরে নিজের মুখের ওপর টেনে নামান অর্ধেন্দু দত্ত। জড়ানো গলায় বলেছিলেন, কীসের অভাব তোমার? কীসের অভাব? আমি তো আছি, আছি না?

শরীরভরা যন্ত্রণা নিয়ে যামিনী বাড়ি ফিরে যেতে যেতে বুঝেছিল, এই অভিসারে কোথায় যেন প্রতিশোধ লুকিয়ে ছিল। দেবনাথের প্রতি প্রতিশোধ। মনে মনে বলেছিল, তুমি যদি না ফেরো আমিও চলে যাব। ঠিক চলে যাব তোমায় ছেড়ে।

সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বাথরুমে ছুটে গিয়েছিল যামিনী। বেসিন ভরিয়ে বমি করেছিল। বুঝেছিল, সমস্যা শুরু হয়েছে। কঠিন সমস্যা।

এই সমস্যার সমাধান হল কদিনের মধ্যেই। এক রবিবার বিকেলে কলকাতা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে যামিনী। বহুদিন পরে গালে হালকা পাউডার দিয়েছিল। কপালে টিপ। অর্ধেন্দুই। বলেছেন, একটু সেজেগুজে বেরোতে পার না? বাড়ির বিপদের কথা রাস্তার লোকদের জানিয়ে লাভ কী? বাড়ির গেট খুলে বেরোতেই মেয়ের মুখোমুখি পড়ল যামিনী। কিঙ্কিনি পড়ে ফিরছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। চোখে বিস্ময়। থতমত খেয়ে যায় যামিনী। নিজে থেকেই তাড়াতাড়ি বলে, তোর বাবার অফিসে যাচ্ছি।

আজ! আজ তো রবিবার। বিড়বিড় করে কিঙ্কিনি।

চমকে ওঠে যামিনী। নিজের ভুল বুঝতে পারে। সত্যি তো আজ রবিবার, অফিস বন্ধ। দ্রুত নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে। ভুল করে বসে ফের। বলে, ইউনিয়ন অফিস খোলা থাকবে। তারপর মাথা নামিয়ে হন হন করে হেঁটে যায়। পিছনে তাকায় না তবু বুঝতে পারে কিঙ্কিনি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কিঙ্কিনির নয়, সেই দৃষ্টি তার স্বামীর, দেবনাথের। বুকটা টনটন করে ওঠে যামিনীর। দেবনাথ হারিয়ে গিয়েও পুরোটা হারায়নি, তার মেয়ের মধ্যে থেকে গেছে অনেকটা।

মোবাইল ফোন বন্ধ করে স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরে আসে যামিনী। রাতে অর্ধেন্দু ল্যান্ড ফোনে ধরলে যামিনী শান্ত গলায় ফিসফিস করে বলে, দোহাই আপনাকে, আপনি আর কখনও আমাকে ফোন করবেন না। ওপাশের অপমানিত, ক্রুদ্ধ মানুষটা কিছু বলতে চান। যামিনী সুযোগ দেয়নি। ফোন নামিয়ে রেখেছিল।

সেই শেষ। আবার এতদিন পরে এবাড়িতে ফোন করেছিলেন অর্ধেন্দু দত্ত। সাড়ে তিনবছর পর। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নীলাদ্রি অফিসে এসেছে। ইউনিয়নরুমে লোকের আনাগোনা লেগেই আছে। প্রায় সকলেই নীলাদ্রির দিকে তাকাচ্ছে। মনে হয় না চিনতে পারছে। পারার কথাও নয়। নীলাদ্রির অস্বস্তি বাড়ছে। অর্ধেন্দুকাকু পরিচয় দিয়ে না বসে। সেরকম কিছু হল না। ঘর ফাঁকা হওয়ার পর উনি একটু হেসে বললেন, আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না নীলাদ্রি। তোমার মা বারণ করবেন।

নীলাদ্রি বলল, না না। বারণ করবে কেন!

অর্ধেন্দু দত্ত আবার একটু হাসলেন, তোমার বাবার টাকা পয়সার তো কিছুই করতে পারলাম না, রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।

ছি ছি এটা কী বলছেন! আপনি অনেক করেছেন, নিয়ম না থাকলে কী হবে?

যাই হোক, শোনো নীলাদ্রি, এই অফিসে লোক নেওয়া হবে। পার্মানেন্ট জব। মাইনেকড়ি খারাপ নয়। বড় কথা হল সব সুযোগ-সুবিধেও রয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি। আমাদের ইউনিয়নের কোটা আছে। দু-তিনজনের জন্য আমরা বার্গেন করি। শেষপর্যন্ত একজনে এসে ঠেকে। আমি তোমার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সমস্যা হল, তোমার যা কোয়ালিফিকেশন দেখছি। তাতে ওপরের দিকে কিছু করা যাবে না। তুমি তো জানো আজকাল প্লেইন গ্র্যাজুয়েট কোনও ব্যাপার নয়। এম এ পাসও পিওনের পোস্টে অ্যাপ্লাই করে। তুমি কি রাজি?

নীলাদ্রি বলল, কাজটা কী?

অর্ধেন্দু দত্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, তুমি যদি রাজি হও আমি ব্যবস্থা করে ডিরেক্ট আমার আন্ডারে নিয়ে আসব। আমার কাছে কাজ করলে তো আর তোমার অতটা খারাপ লাগবে না। তোমার বাবা নেই, টাকাটা তোমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

নীলাদ্রি অবাক হল। কাজ করতে খারাপ লাগবে! সে আবার বলল, কাজটা কী?

অর্ধেন্দু দত্ত হাতের পেনটা টেবিলে ঠুকে বললেন, খাতায় কলমে পিওন-টিওন যা-ই লেখা থাকুক, আমার কাছে থাকলে এই অ্যাসিসটেন্ট গোছেরই কাজ মনে করবে। চাকরিটা কিন্তু পাকা নীলাদ্রি, ভালো করে ভাব। পিওন হলে হতচ্ছেদ্দা করার কিছু নেই। বিদেশে তো সব কাজই সমান। বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। বলবে, আমি বলেছি।

নীলাদ্রি কাঁদে না। আজও কাঁদল না। বিকেলে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে নিজের মনের ফিসফিস করে বলল, বাবা, তুমি আমাদের এতবড় অপমানের মধ্যে ফেলে গেলে কেন? আমরা কী দোষ করেছিলাম?

 ০৫. কিঙ্কিনি সত্যি কথাই বলেছিল

০৫.

কিঙ্কিনি সত্যি কথাই বলেছিল। সে পিকনিক করতে যেখানে এসেছে সেটা জায়গা হিসেবে খানিকটা ভয়ঙ্করই। স্টেশন থেকে ভ্যানরিকশাতে চেপে চল্লিশ মিনিটেরও বেশি সময় লাগল। পাকা রাস্তার কোনও বালাই নেই। গোটাটাই গ্রামের এবড়ো-খেবড়ো মাটির পথ। খানিকটা আবার খেতের মধ্যে দিয়ে যেতে হল। ভ্যান লাফাতে লাফাতে চলেছে। যত এগিয়েছে পথ এই সকালেও জনমানব শূন্য হয়েছে। নির্জন পথের পাশে একটা ঝাপসা জারুলগাছ দেখে শালিনী হইহই করে উঠল–

অ্যাই থামো থামো। এই তো গাছ।

ভ্যান রিকশাতে ব্রেক নেই। বুড়ো চালক লাফ দিয়ে নেমে হ্যাঁন্ডেল টেনে ধরল। পিছনে পা ঝুলিয়ে বসা তিন মেয়ে ঝপাঝপ লাফ দিয়ে নামল। ভ্যানের মাঝখানে বাবু হয়ে বসেছিল বৈদর্ভী। সে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। মাটির ওপর উবু হয়ে পা চেপে ঝাঁকিয়ে উঠল, ওরে বাবা, মরে গেলাম।

বাকি তিনজন সেই কাতরানি পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেল। দোয়েল অবাক গলায় বলল, গাছ দিয়ে কী হবে রে শালিনী! আমরা কি গাছে বসে পিকনিক করব?

কিঙ্কিনি কোমরে হাত দিয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, সমস্যা কী? পিছনে একটা করে ল্যাজ লাগিয়ে উঠে যাব। তোর অবশ্য লাগাতে হবে না। ওরিজিনালটা বের করবি।

দোয়েল ছেলেদের মতো ঘুসি পাকিয়ে তেড়ে এল। শালিনী বলল, মারপিট পরে করবি। আগে চল।

কিঙ্কিনি সিরিয়াস গলায় বলল, তোর মামারবাড়ি কোথায় শালিনী! নদী? মিথ্যে কথা বলিসনি তো?

বৈদর্ভী কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়েছে। দু-পা খুঁড়িয়ে হেঁটে বলল, কোথায় যাব? আমি গাছে উঠতে পারব না বাবা। আমার পা ভেঙে গেছে।

দোয়েল বলল, চিন্তা করিস না তোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তুলে নেব। গাছ-পিকনিকে তুই আজ সারাক্ষণই দড়িতে ঝুলবি। ট্রাপিজের মতো।

হাসতে হাসতে চারজনেই আরও খানিকটা এগিয়ে গেল।

ভ্যান রিকশা চালক গোড়া থেকেই মজা পাচ্ছে। সেই স্টেশন থেকে যখন এই চার মেয়ে তার গাড়িতে উঠেছে তখন থেকেই। প্যান্ট-জামা পরা মেয়েরা কখনও তার ভ্যানে ওঠেনি। কাঁধে একটা করে ব্যাগ। সবথেকে বড় কথা, এরা নিজেরা ঠিক জানে না কোথায় যাচ্ছে। শুধু বলেছে, নদীর ধারে চল। একটা গাছ দেখলে নেমে পড়ব। অদ্ভুত! নদীর পাশে গাছ কি কম আছে? কথা শুনে মনে হয়েছিল, ঠাট্টা করছে। এখন দেখা যাচ্ছে ঘটনা সত্যি। সত্যি মেয়েগুলো গাছ দেখে নেমে পড়েছে। বাড়িতে ফিরে গল্প করার মতো ব্যাপার। শালিনী এসে ভাড়া মিটিয়ে দিল।

ভ্যানচালক বলল, তোমরা কখন ফিরবে? রাত কোরো না।

অন্য সময় অচেনা কেউ তুমি সম্বোধন করলে শালিনী আজকাল রেগে যায়। এই মানুষটার কথায় মজা পেল। লোকটা শুধু তুমি করে বলছে না, বাবা-কাকার মতো উপদেশও দিচ্ছে।

শালিনী হেসে বলল, কেন? দেরি করলে কী হবে? ভাবছি রাতে থাকব।

এ আবার কী কথা! খবরদার, ও কাজও করো না। রাতে থাকবে কী!

কেন সমস্যা কোথায়? এখানে ভূত আছে নাকি? শালিনী ভুরু কুঁচকে, মিটিমিটি হেসে বলল।

ভ্যানচালক তার গাড়ি পিছনে ঠেলে বলল, ভূত নেই, তবে ডাকাত আছে। জায়গা ভালো না। আলো থাকতে ফিরে যেও। মেয়েছেলে এখানে অন্ধকারে থাকে নাকি! তারওপর আজকাল সন্ধের পর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।

শালিনী ফিক করে হেসে বলল, মেয়েছেলেদের তুমি নিতে আসবে? আসবে বিকেলে?

ভ্যানচালক সিটে উঠে বলল, ঠিক আছে দেখব। অন্য ভাড়া না থাকলে আসব।

অন্য ভাড়ার কথা ভাবতে হবে না। তুমিও এসো, আমরা পুষিয়ে দেব।

রাস্তা ছেড়ে গাছের দিকে আরও কয়েক পা এগোতেই কিঙ্কিনি হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল–

ওই তো, ওই তো!

দোয়েল ছুটে গেল। বৈদর্ভী ছুটতে গিয়ে আউচ বলে পায়ে হাত দিয়ে থেমে গেল। সত্যি তার লেগেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে এবার বাড়িটা দেখা গেছে। ভেঙে পড়া একটা পুরোনো বাড়ি। বাড়ি খুব বড় কিছু নয়, তিনতলা। সারা গায়ে সিমেন্টের পলেস্তারা খসে খসে লালচে ইট বেরিয়ে পড়েছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, একটা ধ্বংসস্তূপ। গা ছমছম করে ওঠে। কিন্তু একটু তাকিয়ে থাকলেই ভালো লেগে যায়। মনে হয়, পেনসিলে আঁকা ছবির মতো। জারুল গাছটা বাড়িটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করে রেখেছিল।

কিঙ্কিনি হাত বাড়িয়ে শালিনীর গাল টিপে বলল, থ্যাঙ্কিউ ডার্লিং। তোমার জন্যই এমন দারুণ জায়গায় আসতে পারলাম।

দোয়েল বলল, এবার ঠিকমতো ফিরতে পারলে হয়।

কিঙ্কিনি হাত তুলে বলল, আসতে না আসতে ফেরার কথা বলছিস কেন! আমি সিওর এ বাড়িতে ভূত আছে। আজ ভূতেদের সঙ্গে থাকব।

বৈদর্ভী নাক টেনে বলল, তা থাক, কিন্তু দেখিস অসভ্য ভূতের পাল্লায় পড়িস না।

শালিনী বলল, পড়লে পড়ব। সভ্য মানুষের থেকে অসভ্য ভূত ভালো।

বৈদর্ভী কাঁধের ব্যাগটা শালিনীর দিকে এগিয়ে বলল, ধর তো। আমার পায়ে ব্যথা করছে। আমি একটা অসভ্য ভূতের কথা শুনেছিলাম, বেটা চান্স পেলে মেয়েদের আন্ডারগার্মেন্টস খুলে দিত।

শালিনী থমকে দাঁড়িয়ে বলল, মানে?

বৈদর্ভী বলল, মানে আবার কী! এই ধর একটু পরে দেখলি সব ঠিকঠাক আছে, শুধু তোর জামার ভেতরে ব্রা-টা ভ্যানিশ। তুই জানতেও পারিসনি ভূত কখন খুলে নিয়ে গেছে। এই নিয়ে বেশি লাফালাফি করলে আরও কেলেঙ্কারি করে দেবে। তখন দেখবি…।

বৈদর্ভীর বলার ভঙ্গিটা এমন ছিল, যেন ঘটনাটা সত্যি। সবাই হেসে উঠল। দোয়েল কানে হাত দিয়ে বলল, আর এগোবি না।

বৈদর্ভী আবার বলল, তা হলে নে ব্যাগটা ধর। নইলে কিন্তু সব বলব।

শালিনী মুখ বেঁকিয়ে বলল, পায়ে ব্যথা কাঁধে ব্যাগ নিতে অসুবিধে কোথায়? তুই দুম করে ভ্যান থেকে লাফ দিলি কেন? এই ছেলে-ছেলে ভাবটা এবার ছাড় বৈদর্ভী।

বৈদর্ভী তার ছোট করে কাটা চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ছাড়ব কেন? আমি তো ছেলেই। আজ তোরা সাবধানে থাকিস। এক জওয়ান আউর তিন জওয়ানি। সবকটাকে রেপ করব।

দোয়েল বলল, জওয়ান বলছিস কেন? এক খোঁড়া জওয়ান বল।

বৈদর্ভী মুখ পাকিয়ে বলল, চেপে ধরলে খোঁড়া জওয়ানের জোর বুঝতে পারবি।

কিঙ্কিনি ছাড়া সবাই হেসে উঠল। এই ব্যাপারে বৈদর্ভীকে নিয়ে কিঙ্কিনির চাপা একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এতদিন মেয়েটার যেসব কাজ ঠাট্টা-ইয়ার্কি বলে মনে হত, কদিন হল অন্যরকম লাগছে। গত সপ্তাহে বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। হল অন্ধকার হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বৈদর্ভী চুপিচুপি তার হাত ধরল। হাত ছাড়াতে গেলে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?

ইয়ার্কি মারিস না বৈদর্ভী। হাত ছাড়। নীচু গলায় বলল কিঙ্কিনি।

ঠিক আছে ছাড়ব। একটু তো ধরি। হাতটা কী নরম রে কিঙ্কিনি!

কিঙ্কিনির বাঁ-হাতের তালুতে আঙুল ঘষতে থাকে বৈদর্ভী। কিঙ্কিনির হাত, শরীর শিরশির করে উঠল।

না, একটুও নয়। হাত সরাতে গেল কিঙ্কিনি।

বৈদর্ভী গাঢ় গলায় বলল, প্লিজ।

কিঙ্কিনির বুকটা ছাত করে উঠল। মেয়েটার গলা অচেনা! সে হাত সরিয়ে পাশ ফিরে। বলল, কী ব্যাপার বল তো। তোর সমস্যাটা কী?

পিছনের সিটে-বসা কেউ বলে উঠল–

এই যে খুকিরা, ঝগড়াঝাটি হলের বাইরে গিয়ে করো। আমাদের ছবিটা দেখতে দাও।

বৈদর্ভী উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করতে যায়। তাকে টেনে বসায় কিঙ্কিনি। সেদিনের ঘটনাটায় খটকা লাগলেও ভুলে যেতে চায় কিঙ্কিনি। মনে মনে ভাবে, এটাও বৈদর্ভীর। মাত্রা ছাড়া ফাজলামি। কিন্তু দুদিন বাদে আবার হল। বেশি রাতে বৈদর্ভী ফোন করল। নীচু গলায় বলল, সত্যি তুই আমার সমস্যা বুঝতে পারছিস না?

কিঙ্কিনি ধমক দিয়ে বলল, কী সমস্যা?

বৈদর্ভী তরল গলায় হেসে বলল, ইস ন্যাকা, বুঝেও না বোঝার ভান করছে।

কিঙ্কিনি আমতা আমতা করে বলল, কী বুঝেছি? কী হয়েছে তোর?

আমি তোকে ভালোবাসি এটা তুই বুঝিস না? আই লাভ ইউ।

কী যা-তা শুরু করেছিস বৈদর্ভী? কিঙ্কিনি বোঝাতে চেষ্টা করে।

যা-তায়ের কী হয়েছে? মেয়েরা বুঝি মেয়েদের ভালোবাসতে পারে না।

কিঙ্কিনি একবার ভাবল বলে, বৈদর্ভী, তুই খুব বাড়াবাড়ি করছিস। এরকম করলে তোর। সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেব। তারপর নিজেকে সামলাল সে। যদি তার বুঝতে ভুল হয়? হতেই পারে। বৈদর্ভী হয়তো মাত্রা ছাড়া ঠাট্টাই করছে। ও তো সারাক্ষণই এসবের মধ্যে থাকে। খুব সহজেই খারাপ কথা বলতে পারে। এইজন্য বন্ধুরা ওর কোম্পানি চায়। বলে, ও না থাকলে জমে না। কিঙ্কিনির ঘাবড়ানোর কথাটা নিশ্চয়ই বন্ধুদের বলবে। সে একটা বিরাট লজ্জার ব্যাপার হবে।

কিঙ্কিনি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল।

ভালোবাসিস তো মাঝরাতে বলার কী আছে? বন্ধু বন্ধুকে ভালোবাসবে না তো কী করবে?

বৈদর্ভী ওপাশ থেকে বলল, দুর, ওই ভালোবাসা নয়।

কিঙ্কিনি সহজ গলায় হেসে বলল, কোন ভালোবাসা? টাকা-পয়সা চাই?

বৈদর্ভী এক মুহূর্ত দেরি না করে ফিসফিস করে বলল, আমি তোর শরীর চাই। বুঝতে পারিস না কিঙ্কি? দেখিস তোরও ভালো লাগবে। মেয়েদের সঙ্গে মেয়েরা সেক্স করলে নাকি খুব ভালো লাগে।

শরীর শিরশির করে উঠল কিঙ্কিনির। বলল, চুপ কর, চুপ কর, ইস মাগো।

বৈদর্ভী পাত্তা দিল না। বলল, মেয়েরাই একমাত্র মেয়েদের শরীর বোঝে। কোনখানটা ছুঁলে ভালো লাগবে পুরুষমানুষ জানবে কী করে? ওদের সব বাঁধাধরা ব্যাপার। হি হি।

এসব তুই কোথা থেকে শিখলি! কিঙ্কিনি অবাক হয়ে গেছে।

অনেক ম্যাগাজিন আছে, নেট সার্চ করলে ফটোও পাবি। মেয়েতে মেয়েতে ফটো। ওসব ছাড়, আমি তোকে এখন চুমু খেতে চাই।

কথাতেই থামল না মেয়েটা। সত্যি সত্যি টেলিফোনের মধ্যে আওয়াজ করে চুমু খেতে লাগল! কী করবে বুঝতে পারল না কিঙ্কিনি। একটু যেন ভয়ও পেল। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেছে!

এই পর্যন্ত হলে তা-ও কথা ছিল। সেদিন রাতে কিঙ্কিনি বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন দেখল। দেখল, সত্যি সত্যি বৈদর্ভী তাকে চুমু খাচ্ছে! সে বাধা দিচ্ছে না! উলটে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরছে। এটা কেন হবে? তার তো বাধা দেওয়ার কথা।

এরপর থেকে বৈদর্ভী সম্পর্কে অস্বস্তি শুরু হয়েছে। হালকা অস্বস্তি।

ডাকাডাকি করতে হল না, ভাঙা বাড়ির কাছাকাছি যেতেই জবুথবু ধরনের একটা মাঝবয়সি লোক এসে উঁচু লোহার গেটটা খুলে দিল। চার মেয়ে ঢুকে পড়ল হইহই করে। লক্ষ করার বিষয়, বাড়িটা ভাঙা হলেও গেট কিন্তু মজবুত। জং ধরেনি। তার মানে নিয়মিত রং করা হয়। কবজায় তেল পড়ে। বাড়ির মালিক বাড়ির দিকে নজর না দিলেও গেটের দিকে নজর রেখেছেন। সম্ভবত বুঝেছেন, সম্পত্তি রক্ষা করতে হলে, সম্পত্তির থেকে সম্পত্তির ফটকটাই আসল।

শালিনী এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনিই জনার্দনদা তো? এই বাড়ির কেয়ারটেকার?

মানুষটার গায়ে চাদর। একটু একটু কঁপছে যেন। অতিথিদের প্রতি বিন্দুমাত্র উৎসাহ না দেখিয়ে সে বলল, হ্যাঁ আমিই জনার্দন! কলকাতা থেকে বাবু খবর পাঠিয়েছেন। আমি দুটোতলায় একটা করে ঘর পরিষ্কার করে রেখেছি। এর বাইরে অন্য কোথাও যাবেন না।

শালিনী তাড়াতাড়ি বলল, আমি জানি। আর ছাদ? ছাদে যাওয়া যাবে তো?

না, যাওয়া যাবে না, ছাদের পাঁচিল ভাঙা। মেঝেতেও ফাটাফুটি হয়েছে। পা দিলে ধসে যেতে পারে।

শালিনী কাচুমাচু গলায় বলল, বড়মামা কিন্তু বলেছিল, আমরা ছাদের একটা দিকে যেতে পারব।

জবুথবু মানুষটা মাথা নীচু করে বিশ্রীভাবে কাশতে লাগল। বুক থেকে ঘঙ ঘঙ ধরনের আওয়াজ বেরোচ্ছে। কাশি শেষ হলে বলল, কলকাতায় উনি বলতে পারেন, কিন্তু কিছু ঘটলে তো আমার ঝামেলা। ছাদে যাওয়া যাবে না। ছাদের তালা খুলব না। বাড়ির বাইরেটা দেখছেন তো? জঙ্গল, আগাছায় ভরতি। সাপখোপ থাকতে পারে। বেশি বাইরে ঘোরাঘুরি না করাই ভালো। যতক্ষণ থাকবেন ঘরে থাকার চেষ্টা করবেন। একতলায় বাথরুম আছে, বাইরে কুয়ো আছে। কিছুটা জল তুলে দিয়ে এসেছি। বাকিটা নিজেদের তুলে নিতে হবে।

শালিনী হতাশ ভঙ্গিতে বলল, আপনাকে ডাকলে পাব তো?

না পাবেন না। আমার জ্বর হয়েছে, আমি ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব। আপনারা কি রান্নাবান্না করবেন?

মানুষটার কটকটে ধরনের কথা শুনে সবাই বিরক্ত। দোয়েল রাগ রাগ গলায় বলল, করলে করব। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

জনার্দন গায়ের চাদরটা ঠিক করতে করতে বলল, ব্যস্ত হতে বললেও হতে পারব না। এখানে উনুন বা জ্বালানির কোনও ব্যবস্থা নেই।

বৈদর্ভী বলল, আমরা গাছের ডালপালা জ্বেলে রান্না করব। আপনি নিশ্চিন্তে কথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে যান।

মানুষটা কাঁপা কাঁপা পায়ে বাড়ির পিছন দিকে চলে গেল। দোয়েল সেদিকে তাকিয়ে, বিড়বিড় করে বলল, ডেফিনিটলি হি ইজ আ গোস্ট। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। ওই মানুষটা ভূত ছাড়া কিছু নয়।

শালিনী চোখ দিয়ে দোয়েলের বুকের ইঙ্গিত করে বলল, ভেতরের ওটা আছে তো রে? অসভ্য ভূত হলে কিন্তু এতক্ষণে খুলে নিয়ে গেছে।

সবাই খুব জোরে হেসে উঠল। বাড়ির বাইরের জংলি বাগান থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল পাখার আওয়াজ করে। শালিনী হাত তুলে বলল, বন্ধুগণ, সিদ্ধান্ত মতো এবার তোমরা তোমাদের মোবাইল ফোন বন্ধ করে দাও। বহির্জগতের সঙ্গে আমাদের সব যোগাযোগ এখন থেকে কাট।

রান্নাবান্নার কথাটা ঠিক নয়। খাবার সঙ্গে আনা হয়েছে। কিছুটা কেনা হয়েছে, কিছুটা শালিনী আর দোয়েল বাড়ি থেকে রান্না করে এনেছে। কিঙ্কিনি, বৈদর্ভী বাড়ি থেকে কিছু করেনি বলে তার কেনা খাবারের পুরো খরচটাই দিয়েছে। যখন পিকনিকের পরিকল্পনা হয়, তখনই শালিনী বলেছিল, ওখানে কিন্তু রান্না করা যাবে না। বড়মামা বলেছে, বাড়িটা কয়েকঘণ্টার জন্য খুলে দিতে পারি তার বেশি নয়। রান্নাঘর ভেঙে গেছে। কাছাকাছির মধ্যে কোনও দোকান। বাজারও নেই। খাবারটাবার সব নিয়ে যেতে হবে।

কিঙ্কিনি বলেছিল, তাই হবে। এমন একটা দুর্দান্ত বাড়ি পাচ্ছি, আর কী চাই?

দোয়েল বলেছে, ঠিকই বলেছিস। একেই নদীর পাশে, তারওপর আবার ভাঙা বাড়ি। সোনায় সোহাগা। একেবারে ছোটবেলায় পড়া গল্পের বই।

বৈদর্ভী বলেছে, তুই তো ছোটই। হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছিস ঠিকই কিন্তু তোর সব এখনও ছোটই আছে। এইটুকু।

কথাটা বলে অশ্লীল ইঙ্গিত করেছে বৈদর্ভী। দোয়েল বলেছে, তোর বুঝি বিরাট বড়?

চুপ কর দোয়েল, চুপ কর, বৈদর্ভীর কিন্তু কিছু এসে যাবে না। জামা খুলে দেখিয়ে দেবে, লজ্জায় পালাবার পথ পাবি না।

বাজে কথা থামা। জায়গাটার নাম কী? এখান থেকে কতদূর? আমরা যাচ্ছি কবে?

শালিনী ডান হাত ছাড়িয়ে ঘোষণার ঢঙে বলে, জায়গার নাম ঘূর্ণী। ওখানকার নদীর নামও ঘূর্ণী। ট্রেনে তিন ঘণ্টা। তারপর ভ্যান রিকশাতে আধঘণ্টার একটু বেশি। বাসেও যাওয়া যাবে। ঘুরপথে যেতে হবে। ঘণ্টাখানেক বেশি সময় লাগবে। বন্ধুগণ, বড়মামা যে কোনও সময় ওই ভাঙা বাড়ি বিক্রি করে দেবেন। সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে সামনের রবিবার চল ঘুরে আসি।

দোয়েল বলে, রবিবার বাদ দিলে হয় না?

বৈদর্ভী বলে, হোয়াই? রবিবার বাদ কেন? রবিবারই তো ভালো। কম্পিউটার ক্লাস নেই। ট্রেনে ভিড় কম।

দোয়েল বেজার মুখে বলে, বাড়িতে বাবা থাকবে। খ্যাচ খ্যাচ করবে। কোথায় যাচ্ছ? কার সঙ্গে যাচ্ছ? কখন ফিরবে? এখনও ভাবে ক্লাস এইটে পড়ি।

শালিনী বলে, এদিক থেকে আমার কোনও সমস্যা নেই। বাবা আমাকে কিছুতে বারণ করে না। জানে আমি কখনও খারাপ কিছু করব না।

বৈদর্ভী কাধ আঁকায়। ঠোঁট উলটে বলে, এর মধ্যে বাবার কথা উঠছে কেন? আমি কোথায় যাব আমি বুঝব? আঠেরো বছর হয়ে গেছে। নাউ আই অ্যাম অ্যাডাল্ট।

দোয়েল মুখ দিয়ে ফুঃ ধরনের আওয়াজ করে বলে, রাখ তোর আঠেরো! ওসব বলতেই ভালো লাগে। আটতিরিশ হলেও বাবারা পিছনে পড়ে থাকে। আমার দিদির তো বিয়ে করে ছেলেমেয়ে হয়ে গেল। এখনও দেখি বাবা ফোন করে বলে, মিমি, বিকেলের দিকে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে ছাতা নিয়ে বেরোস কিন্তু।

কথাটা বলার সময় বাবার গলা নকল করে দোয়েল। শালিনী বলে, আহা, এটা আর পিছনে পড়ে থাকা কী হল? মেয়েকে বাবারা তো ভালোবেসে এসব বলবেই।

দোয়েল বলে, ও গড, এটা ভালোবাসা? এটাকে বলে বাড়াবাড়ি। একবার কী কেলেঙ্কারি হয়েছিল জানিস? শুনলে তোদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। বিশ্বাসই করবি না। তখন সবে দিদির বিয়ে হয়েছে। দিদি শ্বশুরবাড়িতে। বাবা মাঝেমাঝেই কলকাতায় যায়। একদিন দিদি মাকে ফোন করে বিরাট চেঁচামেচি শুরু করল। কী ব্যাপার না বাবা নাকি মাঝেমধ্যেই বালিগঞ্জে গিয়ে দিদির শ্বশুরবাড়ির সামনে ঘুরঘুর করে। যদি দিদিকে একবারে ছাদে বা বারান্দায় দেখা যায় এই ধান্দা। দিদির এক দেওর হাতেনাতে ধরে ফেলেছে।

শালিনী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বৈদর্ভী মুখ বেঁকিয়ে বলে, হাসিস না শালিনী। এটা হাসির ব্যাপার নয়। দোয়েলের দিদির অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ তো। কী এমব্যারাসিং। এইজন্যই বাঙালি মেয়েরা কমপ্লিট মানুষ হতে পারল না। বাবাদের আদিখ্যেতার কারণে শুধু মেয়ে হয়েই রইল। বাইরের দেশে এসব ফালতু জিনিস নেই।

কথাটা বলতে বলতে বৈদর্ভী কিঙ্কিনির দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। বাকিরাও তাকায়। বুঝতে পারল, প্রসঙ্গটা নিয়ে এতখানি আলোচনা ঠিক হয়নি। কিঙ্কিনি শুকনো হেসে বলল, তা হলে আমার কোনও সমস্যা নেই বল। বাবা নেই বলে আমি কমপ্লিট মানুষ হতে পারব। তাই না?

শালিনী তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলল, তা হলে রবিবার বাদ।

কিঙ্কিনি আবার হেসে বলল, আমি কী বলব? আমার তো বাবার কেস নেই। যাদের সে ঝামেলা আছে তারা বলবে।

বাবা না থাকলেও কিঙ্কিনি চায়নি, তাদের আউটিং রবিবার হোক। রবিবার মা বাড়িতে থাকবে। কথাবার্তা যতই কমে আসুক, সারাদিন বাইরে থাকলে একটা কৈফিয়ত তো দিতেই হয়। যদিও কিঙ্কিনি দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে আছে। মাকে বড় ধরনের একটা ধাক্কা দেবে। হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরোলেই দেবে। কলকাতার কোনও কলেজে ভরতি হবে। হোস্টেলে থাকবে। এখানকার পাট একেবারের মতো চুকিয়ে চলে যাবে। মা যদি হোস্টেলের খরচ দিয়ে রাজি না হয়, তা হলে নিজে টিউশন বা পার্টটাইম চাকরি করবে। আজকাল কলকাতায় ভদ্রসভ্য ভাবে মেয়েদের কাজের সুযোগ হয়েছে। দাদাকে বললে কোনও একটা কল সেন্টারে ঢুকিয়ে দিতে পারবে না? নিশ্চয় পারবে। ওই লাইনে ওর চেনা। তার খুব ইচ্ছে করে এফ এম রেডিয়োতে আর জে ধরনের কাজ করতে। অনেকেই তার গলার প্রশংসা করে। এই মফস্সল শহরে থাকলে কিচ্ছু হবে না। বাবার মতো একদিন পালাতে হবে।

তাই সপ্তাহের মাঝেই এই ঘূর্ণীতে, শালিনীর মামার ভাঙা বাড়িতে হুল্লোড় করতে আসা হয়েছে। কথায় কথায় একদিন এই বাড়িটার গল্প করেছিল শালিনী। বৈদর্ভী বলল, চল শালিনী, ওখানে আমরা ঘুরে আসি। ভাঙা বাড়িতে পিকনিক দারুণ জমবে। প্রস্তাব শুনে বাকিরা লাফিয়ে উঠল। সেদিন দুজন ছেলেও ছিল। অনীক আর প্রিয়ম। কম্পিউটার ক্লাসে একসঙ্গে পড়ে।

অনীক বলল, আজই সব ফাইনাল করে ফেল। চাঁদা কত করে?

শালিনী বলল, খেপেছিস নাকি? মরে গেলেও বড়মামা, ওই বাড়িতে আমাদের ঢুকতে দেবে না। বাড়ি ভেঙে পড়ছে। অনেক ঘরে দরজা-জানলাই তো নেই, চুরি হয়ে গেছে। কিছুদিন হল, একজন কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি পারে বাড়িটা বিক্রি করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। যতই নদীর ধারে হোক আর গাছপালা থাকুক, পোড়ো বাড়ি রেখে কী হবে? অনেক বছর আগে মামারা দল বেঁধে কলকাতা থেকে গাড়ি করে বেড়াতে যেত। আমিও গেছি। এখন আর কেউ ওদিকে পা বাড়ায় না। সে অবস্থা নেই। মেইনটেন হয় না। বাড়ি বেদখল হওয়ার জোগাড়।

প্রিয়ম বলল, বেদখল হওয়ার আগে আমরা একবার দখল নিতে চাই শালিনী প্লিজ। মাত্র একদিনের জন্য তুই পারমিশান জোগাড় কর। আমি ক্যামেরা নিয়ে যাব। পোড়ো বাড়ির ওপর একটা ফোটো ফিচার করার শখ আমার বহুদিনের। ফেসবুকে হন্টেড হাউস বলে একবার দিয়ে দিতে পারলে মারকাটারি কাণ্ড হবে। তোর বড়মামার বাড়ি দেশে-বিদেশে নাম করে যাবে। দলে দলে সবাই আসতে চাইবে।

শালিনী চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার, ওই সব একদম করবি না, বাড়িটা বিক্রি করতে হবে না? ভূতের বাড়ি বললে আর কেউ নেবে?

অনীক এগিয়ে এসে বলল, প্রিয়ম তা হলে বাদ, আমি যাব।

বৈদর্ভী আড়চোখে তাকিয়ে বলল, চারটে মেয়ের সঙ্গে একা যাবি? ভয় পাবি না?

অনীকের মধ্যে একটা হিরো সাজার শখ আছে। সবসময় ফিটফাট। চোখে সানগ্লাস। সাইকেলটা এমন ভাবে ধরে যেন সাইকেল নয় মোটরবাইক। বুদ্ধিও কমের দিকে। সুযোগ পেলেই মেয়েরা খেপায়। বৈদর্ভীর কথায় চোখ কুঁচকে বলল, কেন ভয় পাব কেন? তোরা কি রাক্ষস?

কিঙ্কিনি বলল, না, রাক্ষস নই মানুষ। কচি পাঁঠা ভালোবাসি।

অনীক ভুরু কুঁচকে বলল, মানে!

দোয়েল ফিক করে হেসে বলল, মানে বুঝে লাভ নেই। চাপ নিস না অনীক।

কিঙ্কিনি বলল, তুই আজই তোর বড়মামার সঙ্গে কথা বল শালিনী। আমরা এই ভয়ঙ্কর জায়গাতে যাব।

শালিনী বলল, কথা বলে লাভ নেই।

প্রিয়ম অতি উৎসাহে বলল, আমরা যদি কথা না বলে নিজেদের মতো চলে যাই? ব্যাপক হবে কিন্তু।

শালিনী মুখ ভেংচে বলল, ব্যাপক হবে না আমার পিঠে ব্যাপক পিটুনি পড়বে?

শেষপর্যন্ত সবই হল। শালিনীর বড়মামা তার ভাঙা বাড়িতে একবেলার জন্য পিকনিকের অনুমতি দিলেন। কিন্তু প্রিয়ম পড়ল জুরে।

বৈদর্ভী বলল, জ্বর না ছাই, মেয়েরা যাবে শুনে বাড়ি থেকে ছাড়ছে না।

অনীকও ডুব দিয়েছে। ফোন করলে তুলছে না। মেসেজ পাঠালে রিপ্লাই দিচ্ছে না। কিঙ্কিনি বলল, ছাগলটার বাড়িতে গিয়ে হামলা করব নাকি?

বৈদর্ভী হাত নেড়ে বলল, দুর দুর, ভয় পেয়ে গেছে। চারটে মেয়ের সঙ্গে একা যাবে শুনে নার্ভ ফেল করেছে। ছেলেদের আমার চিনতে বাকি আছে নাকি? চল আমরা চারজনেই যাব।

একতলা আর দোতলার যে ঘরদুটো জনার্দন খুলে পরিষ্কার করে দিয়েছে দুটোতেই বড় বড় খাট পাতা। তিনতলার ঘরে খাবারের ব্যাগট্যাগ রেখে বৈদর্ভী ছাড়া সকলেই ছুটল ছাদের দিকে। এখনও নদী দেখা হয়নি। ছাদে যেতেই হবে। ছাদের দরজায় সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হল। সত্যি তালা দেওয়া। তালার সাইজও বেশ বড়। কী হবে তা হলে? কিঙ্কিনি আর শালিনী তালা ধরে টানাটানি করল। দরজা নড়বড় করে উঠল, তালার কিছু হল না। একটু পরেই মচকে যাওয়া পা টানতে টানতে ওপরে উঠে এল বৈদর্ভী। তার হাতে একটা বড় সাইজের হাতুড়ি।

শালিনী বলল, এটা কী রে!

বৈদর্ভী মুখ কুঁচকে বলল, হাতুড়ি চিনিস না? মাথায় এক ঘা দিলে বুঝতে পারবি। সিঁড়ির নীচে পেয়ে গেলাম। কেয়ারটেকার কয়লা ভাঙে। এখানে এখনও কয়লা-ঘঁটের উনুন চলে। এটা না পেলেও অবশ্য কিছু এসে যেত না, দরজা খোলার একটা না একটা ব্যবস্থা তো করতেই হত। জনার্দন বলল আর আমরা ভালোমানুষের মতো মুখ করে নদী না দেখে ফিরে গেলাম, তা তো হতে পারে না। নে সর। তালাটা ভাঙতে দে।

তালা ভাঙা গেল না। কিন্তু মিনিট পনেরোর চেষ্টায় দরজা থেকে একটা কড়া উপড়ে ফেলা গেল। কাঠের গোড়ায় ঘুণ ধরেছিল। কড়াটা যেন এতদিন অপেক্ষা করছিল, কবে খুলে পড়বে। আজ খুলে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

ছাদে পা দিয়েই চারজনে লাফিয়ে উঠল। লাফিয়ে ওঠবার মতোই দৃশ্য। বাড়ির ঠিক পিছন দিয়েই নদী চলে গেছে। ঘূর্ণী নদী। ছাদ থেকে সেই নদীর অনেকটাই দেখা যায়।

শালিনী দু-হাত ছড়িয়ে বলল, আমার গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড ফাদার শুধু নদীটার জন্যই এখানে বাড়ি কিনেছিলেন। সন্ধের পর ছাদে মাদুর পেতে বসে এস্রাজ বাজাতেন।

কিঙ্কিনি বলল, উরিব্বাস সে তো বিরাট রোমান্টিক ব্যাপার।

নদী চওড়ায় খুব বড় কিছু নয়। ওপাড় দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ডানপাশে বাঁক নেওয়ার মুখে কয়েকটা নৌকো দাঁড়িয়ে আছে অলসভাবে। হয়, মাছ ধরছে, নয়তো রোদ পোয়াচ্ছে। জলে কোথাও মেঘের ছায়া কোথাও রোদ। হঠাৎ নদীর দিকে তাকালে মনে হবে, কোনও মেয়ে তার শাড়ির আঁচল পেতে দিয়েছে। সেই আঁচলে আলো ছায়ায় নকশা কাটা। চারজনেই ভাঙা পাঁচিলের ধারে গিয়ে নদী দেখতে লাগল।

শালিনী বলল, নদীর এটাই ম্যাজিক। মেয়েদের চট করে মাথা গুলিয়ে দেয়। নদী দেখার জন্য তারা যে-কোনওরকম ঝুঁকি নিতে পারে।

দোয়েল শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, আমি আরও ঝুঁকি নেব। নদীতে স্নান করব। ওই যে ঘাটটা রয়েছে, ওখান থেকে জলে লাফ দেব।

শালিনী হেসে বলল, তোর বাবা যদি জানতে পারে? একেই না বলে এসেছিস, তারপর নদীতে স্নান! বাপরে।

দোয়েল সুর করে বলল, আমি ভয় করব না, ভয় করব না। নদীতে ডুব না মেরে ফিরব না গো ফিরব না।

বৈদর্ভী দোয়েলের পিঠে চাপড় মেরে বলল, সত্যি বীর বটে, তুই হলি নদী বীরাঙ্গনা।

কিঙ্কিনি বলল, আমিও দোয়েলের সঙ্গে জলে নামব। আমাকে বাবা বকতে পারবে না, কারণ সেই সুযোগ নেই।

শালিনী বলল, এসব মাথা থেকে বাদ দে। জলে কারেন্ট আছে। নাম শুনে বুঝতে পারছ না? ঘূর্ণী নদী। তার ওপর এদিকটায় কোনও লোকজনও নেই। ডুবে যাওয়ার সময় যে কেউ লাফ দিয়ে বাঁচাবে, নো চান্স। হাজার চিৎকারেও কেউ আসবে না। শুধু পাখি উড়ে যাবে।

দোয়েল বলল, সেইজন্যেই তো সুবিধে, নিজেদের মতো জলকেলি করব। কেউ দেখবে। না।

বৈদর্ভী বলল, সুইমিং কস্টিউম এনেছিস?

কিঙ্কিনি বলল, দুর নদীতে আবার সুইমিং কস্টিউম কী?

দোয়েল এক দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, বিকিনি পরে সমুদ্রে নামা যায়, নদীতে যায় না।

শালিনী হেসে বলল, নদীতে মনে হয় শাড়ি ফিট করে। ভেজা গা, কাঁধে কলসি, যেন যমুনার জল থেকে রাধা উঠছে।

সবাই হেসে উঠল। বৈদর্ভী বলল, এক কাজ করি চল, সবাই নুড হয়ে জলে নামি। দেখবি নিমেষের মধ্যে আশপাশে সব গ্রামে খবর হয়ে গেছে, চারটে মেয়ে জামাকাপড় খুলে নদীতে স্নান করছে। দলে দলে লোক আমাদের দেখতে ছুটে আসবে। নদীর পাড় দেখবি মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে। আমরা ডুবে যাচ্ছি দেখলে একসঙ্গে হাজার লোক জলে ঝাঁপ মারবে। ভেসে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না। হি হি।

দোয়েল বলল, বৈদর্ভীর প্ল্যানটা নট ব্যাড।

শালিনী আঁতকে উঠল, কোনটা? ন্যুড হয়ে জলে নামাটা?

দোয়েল হাত উলটে বলল, সমস্যা কোথায়? ছেলেরা যদি থাকত, এতক্ষণে দেখতিস জামা প্যান্ট খুলে নেমে গেছে।

কিঙ্কিনি বলল, ছেলেরা যা পারে আমরা তা পারি নাকি?

বৈদর্ভী ভাঙা পাঁচিলে হেলান দিয়ে বলল, আমি পারি। যদি তোরা চ্যালেঞ্জ করিস, তা হলে আমি জামাকাপড় খুলে নদীতে গিয়ে সাঁতার কেটে আসতে পারি। আমি ছেলেদের থেকে কম কিছু নই। তোরা কি চ্যালেঞ্জ করছিস?

দোয়েল হেসে বলল, হ্যাঁ করছি। আমি চ্যালেঞ্জ করছি, তুই পারবি না।

বৈদর্ভী সহজভাবে বলল, কী দিবি?

কিঙ্কিনি বলল, অ্যাই তোরা অসভ্যতামি থামাবি?

দেখা গেল, নদী আছে শুনে সকলেই স্নানের জন্য কমবেশি তৈরি হয়ে এসেছে। সুইমিং কস্টিউম না আনলেও অতিরিক্ত একসেট জামা কাপড়, বড় তোয়ালে এনেছে। কিঙ্কিনি আর শালিনী শালোয়ার বের করে পরল, দোয়েল ছোটো ঝুলের পায়জামা। বৈদর্ভীর পোশাকটাই একটু গোলমেলে। শর্ট প্যান্ট স্লিভলেস গেঞ্জি পরে এসে কিঙ্কিনিকে বলল, কেমন দেখাচ্ছে ডার্লিং?

কিঙ্কিনি একটু চমকেই উঠল। বাঃ সুন্দর লাগছে! সুন্দরের থেকে অন্যরকম লাগছে বেশি। গায়ের রং বাদামি আর কালোর মাঝামাঝি হওয়ার কারণে মেয়েটার শরীরে একটা বুনো ভাব ফুটেছে। বৈদর্ভীর এই রূপের কথা আগে জানা ছিল না কিঙ্কিনির। জানার কথাও নয়। এতটা খোলামেলা ভাবে আগে কখনও বৈদর্ভীকে দেখেনি সে। কলকাতায় যে পোশাক রাস্তাঘাটে কোনও ব্যাপার নয়, মফস্সলে সেটাই অসম্ভব। তাই এসব পরে রাস্তায় বেরোনোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। স্প্যাগেটি পরার কারণে বৈদর্ভীর বুক, পিঠ দেখা যাচ্ছে অনেকটা। বুকদুটো তার মতো বড় না, ছোটই। যেন আলগোছে ছুঁয়ে আছে। চওড়া কাঁধে একটু পুরুষালি ধরন। হাত, পায়ের পেশিগুলোও স্পষ্ট। শরীরে মেয়ের নরমসরম ভাবের বদলে একটা কাঠিন্য।

বৈদর্ভী জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, হাঁ করে কী দেখছিস?

কিঙ্কিনি দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, তোর বেহায়াপনা দেখছি। আর বাকি কী রাখলি? এটা তো কলকাতা নয়, পাড়াগাঁয়ের মানুষ এসব দেখলে ভিরমি খাবে। গায়ে টাওয়াল চাপা দিয়ে চল।

বৈদর্ভী কাছে সরে নীচু গলায় দ্রুত বলল, আমি নদীতে যাব না। আমার পায়ে টান পড়েছে, জলে নেমে মরব নাকি? ওদের রেখে তুই একটু পরেই চলে আয়।

কিঙ্কিনি চারপাশ তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, পাগলামি করিস না বৈদর্ভী। আমি এবার সবাইকে বলে দেব ঠিক করেছি।

একইরকম গলা নীচু করে বৈদর্ভী বলল, যা খুশি বল। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি তোকে চাই।

বৈদর্ভী এগিয়ে এসে কিঙ্কিনির হাত চেপে ধরল। কিঙ্কিনি হাত সরিয়ে বলল, ছিঃ এসব কী খারাপ কথা বলছিস তুই!

বৈদর্ভী ঠোঁটের কোনায় হেসে বলল, দেখবি খারাপ হলেও খুব ভালো লাগবে। এমনভাবে আদর করব তুই ছাড়তেই চাইবি না।

কানে হাত চাপা দিয়ে কাতর গলায় কিঙ্কিনি বলল, প্লিজ এরকম করিস না। কেউ জানলে বাজে একটা ব্যাপার হবে।

বৈদর্ভী হিসহিসে গলায় বলল, বাজে হলে হবে। অনেক তো ভালো ছিলি লাভ কী হল? আমি তোর জন্য এই ঘরে অপেক্ষা করব।

কিঙ্কিনি বুঝতে পারল তার অসুবিধে হচ্ছে, বৈদর্ভীর কথায় ঝিমঝিম করছে শরীর। আজ নতুন নয়। সেদিন ফোনে কথা বলার সময়ও হয়েছে। তবে এতটা নয়। আজ মেয়েটার শরীর অনেকটা দেখতে পাচ্ছে বলে? জড়তা ঝেড়ে ফেলতে চাইল কিঙ্কিনি। বলল, একদম না।

ঠিক নীচে নামার মুহূর্তে বৈদর্ভী সত্যি সত্যি ঘোষণা করল, সে যাবে না। তার পা ব্যথা করছে। জলে নামার ঝুঁকি নেবে না।

শালিনী বলল, তুই মগ নিয়ে চল, পাড়ে বসে মাথায় জল ঢালবি।

বৈদর্ভী বলল, তোরা যা, ততক্ষণ আমি আমার ইনজিওরড পা-টাকে রেস্ট দিই। তা ছাড়া হঠাৎ মনে পড়ে গেল, জলে আমার ফঁড়া আছে। হয়তো বা ডুবব না, দেখলি কুমির টেনে নিয়ে গেল। বরং একটা কাজ করিস, কিঙ্কিনিকে দিয়ে এক বালতি নদীর জল পাঠিয়ে দিস। নদীতে নামতেও হবে না, আবার নদীর জলে স্নান করাও হবে। হি হি।

দোয়েল বলল, দেখেছিস তো প্রথমে কত বড় বড় কথা বললি, ন্যুড হয়ে জলে নামবি, এই করবি সেই করবি, এখন ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবি বলছিস। ভালোই হয়েছে তোকে যেতে হবে না। টাওয়ালটা দে।

শালিনী বলল, কেন তুই টাওয়াল আনিসনি?

দোয়েল বলল, এনেছি, আমার দুটো লাগবে।

বৈদর্ভী চোখ নাচিয়ে বলল, ওনার একটায় ঢাকে না।

দোয়েল এগিয়ে গিয়ে বৈদর্ভীর পিঠে কিল বসাল।

নির্জন নদীর কাছে পৌঁছে হঠাই মনখারাপ হয়ে গেল কিঙ্কিনির। বৈদর্ভী কেন তার সঙ্গে এমন আচরণ করছে? কই অন্যদের সঙ্গে তো করছে না। তাকে কি খারাপ ভাবে? নিশ্চয় তাই। বাবা চলে যাওয়ার পর তাদের বাড়িটাকে তো অনেকে খারাপ ভাবে। এই পাঁচ বছরে সে কত কী শুনছে। সামনাসামনি বলেনি, আড়ালে আবডালে বলেছে। যখন বয়স ছোট ছিল, বন্ধুদের মায়েরা তার সঙ্গে মেয়েদের মিশতে দিত না। আজও মনে হচ্ছে, সেইসময় অনেকেই বাসে তার পাশে বসত না। ছুতোনাতা করে উঠে যেত। তপজা তো বলেই ফেলেছিল, কিছু মনে করিস না কিঙ্কি, তোর পাশে বসলে মা রাগ করবে। এ তো অল্প কানাঘুষো, আরও কত কী শুনতে হয়েছে! কেউ বলেছে, বাবা নাকি মায়ের জন্যই চলে গেছে। মায়ের অন্য পুরুষমানুষ আছে। অন্য পুরুষমানুষ ব্যাপারটা কী তখন বুঝত না। পরে অর্ধেন্দু দত্তকে দেখে বুঝতে পারল। লোকটা রাতবিরেতে ফোন করত, মা কলকাতায় যাওয়ার আগে গালে পাউডার দিত। একসময় মনে হত, তার প্রতি মায়ের রাগের কারণ, সে এসব জানে বলে। পরে বুঝেছিল না, কারণ অন্য। সে নাকি অনেকটা তার বাবার মতো। নদীর দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা অনেকদিন পরে হাহাকার করে উঠল কিঙ্কিনির। কেন সে বাবার মতো! কেন? চলে যাওয়ার সময় বাবা কি তার কথা মনে রেখেছিল? ছোট মেয়েটার জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিল এক মুহূর্ত? দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আবেগ সামলালো কিঙ্কিনি।

ঘাটের অবস্থা বাড়ির মতো অতটা বিপজ্জনক নয়। দোয়েল আর শালিনী ভালো সাঁতার জানে। কিঙ্কিনিও সাঁতার জানে। খুব ছোটবেলায় দেবনাথ ছেলেমেয়েদের পাড়ার সুইমিংপুলে নিয়ে গিয়ে সাঁতার শিখিয়েছিল। তারপর বহু বছর জলে নামা হয়নি। জলে পা দিয়েই কিঙ্কিনির বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। অভ্যেস নেই, যদি কোনও বিপদ হয়? বাড়িতে বলে আসেনি। কাদের সঙ্গে কোথায় গেছে দাদার খুঁজে বের করতে করতেই অনেকটা সময় চলে যাবে। তার থেকে বড় কথা মুডটা হঠাৎই চলে গেছে।

শালিনী চিৎকার করে উঠল, কী হল তোর? থম মেরে গেলি কেন?

কিঙ্কিনি শুকনো হেসে বলল, কই! কিছু হয়নি তো?

দোয়েল বলল, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে।

কিঙ্কিনি হেসে বল, আমাদের বংশে ওটি নেই। বাড়ির জন্য মন কেমন করা কী বস্তু আমরা জানি না। আমার বাবার কাণ্ড দেখে বুঝতে পারিস না?

দোয়েল বলল, সরি কিঙ্কি, আমি কিছু মিন করে বলিনি।

কিঙ্কিনি বড় করে হেসে বলল, দুর, আমি কি তাই ভেবেছি? কথাটা মনে হল তাই বললাম। মজার কথা বলতে ভালো লাগে।

শালিনী বলল, ঠিক আছে আয় এবার জলে ঝাঁপ দিই।

দোয়েল বলল, ঝাঁপ-টাপ হবে না, নীচে কী আছে কে জানে বাবা, এমনি সিঁড়ি দিয়ে নামছি। আয় কিঙ্কি।

তারা জলে নেমে পড়ল। এবং দ্রুত খানিকটা দূর চলেও গেল। কিঙ্কিনি সাঁতার কাটতে গেল না, কোনওরকমে কটা ডুব দিয়ে উঠে এল। তোয়ালে দিয়ে মাথা মোছার পর মুখ তুলে দেখল, ভাঙা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে বৈদর্ভী। হাসছে। পিছনে ফিরল কিঙ্কিনি। শালিনী আর দোয়েল ঘাট থেকে খানিকটা দূরে জলে হুটোপুটি করছে। ফাঁকা নদীতে কোথা থেকে যেন দুটো বালক এসে জুটেছে! আশ্চর্য! এরা কি জলের তলায় লুকিয়ে ছিল? নাকি ভেসে এল? কিছু একটা হবে। শালিনীদের সঙ্গে ওরা দিদি দিদি বলে মিশে গেছে। গাছের ডালপাতা নিয়ে কী। যেন খোল বানিয়ে খেলছে চারজনে। হাসছে খিলখিল করে। যেন কতদিনের চেনা!

কিঙ্কিনি ভেবেছিল জলে ডুব দিলে মন খারাপ ভাবটা কাটবে। কাটল না। সে শালিনীদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।

দোয়েল চিৎকার করে বলল, এখন যাব না। অনেকক্ষণ থাকব।

গায়ে ভেজা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিঙ্কিনি। শীত শীত করছে। কতক্ষণ এভাবে থাকবে? আবার মুখ তুলে ছাদের দিকে তাকাল। বৈদর্ভী হাতছানি দিয়ে ডাকছে। খারাপ হওয়ার হাতছানি? শরীর কেঁপে উঠল কিঙ্কিনির! কী করবে সে? সে কি খারাপ হবে? দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় যে খারাপ মানুষ ছিলেন না। তা হলে? কিঙ্কিনি সিদ্ধান্ত নিল সে বৈদর্ভীর কাছে যাবে। সে খারাপ হবে।

ঘাটে খালি পায়ের জলছাপ রেখে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে।

দরজা ভেজিয়ে বৈদর্ভী ঝাঁপিয়ে পড়ল উন্মত্তের মতো। কিঙ্কিনির শরীর থেকে জলমাখা পোশাক টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে মুখ ঘষতে লাগল বুকে, ঘাড়ে, গলায়। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল স্তনদুটো। তারপর নতজানু হয়ে বসল কিঙ্কিনির সামনে। দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ নামিয়ে দিল চরম আশ্লেষে। চাপা ঘর ঘর আওয়াজ তুলতে লাগল। শিহরণ আর লজ্জায় শীৎকার তুলল কিঙ্কিনি।

একসময় মাথা উঁচু করে জড়ানো গলায় বৈদর্ভী বলল, হয়েছে? হয়েছে তোর?

বৈদর্ভীর পুরুষালী কাঁধে নখ বসিয়ে চোখ বোজা কিঙ্কিনি বলল, প্লিজ, আর একবার… ওয়ানস মোর সোনা…।

ঠোঁটে মুখ নামাল বৈদর্ভী।

বিকেলে রওনা দেবার ঠিক আগে ব্যাগ থেকে মাঝারি মাপের একটা বোতল বের করল দোয়েল। লাজুক হেসে বলল, এটা ভদকা। তোদের জন্য সারপ্রাইজ। যাবার আগে ছাদে বসে। এক ছিপি করে খাব। কেমন হবে?

বৈদর্ভী লাফ দিয়ে বলল, ফাটাফাটি।

শালিনী মাথায় হাত দিয়ে বলল, সর্বনাশ! এই মেয়ে যে বাড়াবাড়ির চরম করছে। বাবাকে না জানিয়ে এসেছে, নদীতে স্নান করেছে, এবার মদের বোতলও বের করছে! কী হবে গো!

কিঙ্কিনি বলল, আমি এসবে নেই বাবা। আমি খাব না।

বৈদর্ভী বলল, আরে বাবা, মোটে তো এক ছিপি খাবি। আর দেরি না করে বসে যা সবাই। পিকনিক মেমরেবল করে রাখি।

শালিনী নাক কুঁচকে বলল, মুখে গন্ধ-টন্ধ থাকবে না তো?

দোয়েল বলল, থাকলে থাকবে। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি এখন অ্যাডাল্ট।

বৈদর্ভী বলল, আর বীরত্ব ফলাতে হবে না। তাড়াতাড়ি দাও দেখি, ট্রেন ধরতে হবে।

শালিনী ভয় পাওয়া গলায় বলল, জনার্দনদা দেখে ফেললে কেলো, বড়মামাকে বলে দেবে।

বৈদর্ভী বলল, চিন্তা করিস না আমি নীচের দরজা আটকে এসেছি। চারটে মেয়ে বাড়িতে রয়েছে, কেউ হুট করে ঢুকলেই হল। তোর জনার্দনদা জানবে কী করে?

কাগজের গ্লাসেই ভদকা ঢালা হল। প্রথম চুমুকে গা গুলিয়ে ওঠে, জ্বালা করে ওঠে পেট। তারপর ধীরে ধীরে অজানা একরকমের ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়তে লাগল শরীর জুড়ে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। তখন আকাশে কালো করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। নদী থেকে উড়ে আসছে বাতাস। এবার ভদকার সঙ্গে মাপ করে সফট ড্রিঙ্কস মেশানোর দায়িত্ব নিয়েছে। দোয়েল। তার এই গুণ দেখে বাকিরা বিস্মিত! সে নাকি বাবা কাকাকে দেখে শিখেছে। যত সময় যেতে লাগল, জিনিসটার স্বাদ আরও ঘন হয়ে আসতে লাগল।

দুবার গ্লাস শেষ করে যখন তিন নম্বরের পালা শুরু হয়েছে তখন আকাশ পুরোপুরি কালো। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। অসময়ের কালবৈশাখী। অসময়ের কালবৈশাখী কি অতিরিক্ত জোর পায়? কে জানে পায় কিনা। তবে মেয়েরা দারুণ মজা পেল। তারা ঠিক করল ঝড়ের মধ্যেই নদীর কাছে যাবে। শালিনী প্রায় টলতে টলতে বলছে, ঝড়ের সময়ে নদীতে একধরনের সঙ্গীত তৈরি হয়। জল ছুঁলে সেই সুর শরীরেও বাজে। কথাটায় বাকিরা হইহই করে উঠল। এখনই নদীর জল ছোঁয়া হবে। জনার্দন বারণ করলে কোনও পাত্তা দেওয়া হবে না।

শালিনী জড়ানো গলায় বলল, হু ইজ জনার্দন? হি ইজ নো বডি।

বৈদর্ভী বলল, বেশি বকবক করলে চ্যাংদোলা করে ছাদ থেকে ফেলে দেব শালাকে।

কিঙ্কিনি হুংকার দিল, চল, নদীতে চল।

.

রাত এগারোটার অল্প কিছু পর বাড়ি ফিরল কিঙ্কিনি। কিছু করার ছিল না। ঝড়ে ওভারহেড তার ছিঁড়ে গেছে। ট্রেন বন্ধ। রাত নটার লাস্ট বাস ধরে ঘুরপথে ফিরতে হয়েছে। নীলাদ্রি সাইকেল নিয়ে স্টেশনে গেছে।

রান্নাঘরের জানলা থেকে মেয়েকে দেখতে পেল যামিনী। দরজা খুলতেই বিশ্রী বিশ্রী গন্ধ ভেসে এল। চমকে উঠল যামিনী। কীসের গন্ধ, মদের না?

ঘরে পা রেখে কিঙ্কিনি জড়ানো গলায় বলল, চমকে উঠলে কেন মা? কী ভেবেছিলে? বাবা এসেছে? হি হি। ঠিক এক কায়দায় বেল বাজিয়েছি না টিং টিং, টিং টিং।

নাকে আঁচল চাপা দিয়ে সরে দাঁড়াল যামিনী।

 ০৬. বাড়িটা হলুদ রঙের

বাড়িটা হলুদ রঙের। তবে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার কারণে রং ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। শেষ বিকেলের আলোকে বলে কনে দেখা আলো। এই আলোয় কালো মেয়েও নাকি ফরসা হয়ে ওঠে। অথচ এই বাড়িটাকে দেখাচ্ছে মলিন। মলিন বাড়ির দরজা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল। নীলাদ্রি। কোনওরকমে সিঁড়িকটা টপকে হুড়মুড়িয়ে নেমে গেল নীচে, পেট চেপে উবু হয়ে বসে পড়ল ফুটপাথের ওপর।

রাস্তার দুপাশে অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ একা দাঁড়িয়ে, কেউ এসেছে দল বেঁধে। তারা চাপা গলায় কথা বলছে। প্রায় সকলেরই চোখেমুখে উদ্‌বেগ। বড় রাস্তা থেকে একটু ঢুকে এই গলিটাই থমথমে। কয়েকজন নির্লিপ্ত ভঙ্গির মানুষও রয়েছে। তারা বসে আছে ফুটপাথে, ব্যাটারির খোল আর আধলা ইটের ওপর। বেশিরভাগেরই লুঙ্গির ওপর খালি গা, থলথলে শরীর। কেউ বিড়ি টানছে, কেউ কানের কাছে রেডিয়ো ধরে গান শুনছে। একজনের হাতে অ্যালুমিনিয়ামের থালা। কিছু খাচ্ছে। নীলাদ্রি পাশে বসে বমি করায় তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। পুলিশ মর্গ থেকে ছিটকে বেরিয়ে মানুষ বমি করবে না তো কী করবে? আর এই ছেলে তো নেহাতই ছোট।

রেডিয়োতে গান শোনা লোকটা কাছে ছিল। পাশে রাখা একটা মগ তুলে এগিয়ে দিল হাত বাড়িয়ে। নীলাদ্রি অবাক হয়েই মগটা ধরল। খানিকটা জল রয়েছে। লোকটা গানের তালে মাথা নাড়তে নাড়তেই ইঙ্গিত করল। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত। নীলাদ্রি তাই করল। মগ ফেরত দিয়ে বলল, থ্যাঙ্কিউ। লোকটা গা করল না। মগটা পাশে রেখে ফের মন দিয়ে গান শুনতে লাগল। যেন ঘটনাটা কিছুই না।

মর্গের দরজার মুখে একটা লোক এসে চিৎকার করছে—

নেক্সট, নেক্সট…পরের জন কে আছেন? কৌন হ্যায়… তাড়াতাড়ি আসুন। জলদি জলদি…।

বাইরে অপেক্ষা করা কয়েকজন ছুটে গেল দরজার দিকে। দরজায় দাঁড়ানো লোকটা বাংলা হিন্দি মিলিয়ে ধমক দিয়ে বলল, আরে আরে, এ কেয়া করতা হ্যায়! এক এক করকে আইয়ে। এ ডেডবডি আছে, ভাগ নেহি সকতা। ঠেলাঠেলি করবেন না। ঝামেলা পাকালে দরজা বন্ধ করে দেব।

ধমক শুনে ছুটে যাওয়া মানুষগুলো থমকে দাঁড়াল। ভাবটা এমন যেন, সত্যি তারা ভুলে গিয়েছিল, তারা মৃতদেহ দেখতে যাচ্ছে। ধীরেসুস্থে গেলেও কোনও সমস্যা নেই। তারা একই। ভাবে শুয়ে থাকবে।

পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল নীলাদ্রি। হাঁটতে শুরু করল। জায়গাটা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সরে যাওয়া যায় তত ভালো। মুখটা তেতো লাগছে। থুতু কাটছে। মোবাইল বের করে সময় দেখল। শ্রীময়ীর আসতে এখনও একঘণ্টা দেরি। নন্দনের গেটে ঠিক ছটায় দাঁড়াবে। নীলাদ্রি ঠিক করে হাঁটবে। নন্দন পর্যন্ত না পারুক, যতটা পারে ততটা হাঁটবে। তারপর বাসে উঠবে। তার আগে ভালো করে মুখ ধোয়া দরকার। মোবাইল বেজে উঠল। নীলাদ্রি তুলে দেখল পরদায় মা ফুটে উঠেছে।

বল।

গিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

যামিনী চুপ করে রইল। নীলাদ্রির সংক্ষিপ্ত উত্তরেই বোঝা যাচ্ছে, কোনও লাভ হয়নি। তবু তার রাগ হল। লাভ হোক বা না হোক ছেলেটা ফোন তো করবে।

আমাকে ফোন করলি না তো!

কিছু হলে করতাম।

যামিনী আবার চুপ করে রইল মুহূর্তখানেক। তারপর বলল, বাঃ আমাকে একবার জানাবি না?

বলছি তো কিছু হলে সঙ্গে-সঙ্গে তোমাকে জানাতাম। একই কথা কী বলব?

যামিনী বলল, কী আর বলবি, মা ওকে পেয়েছি?

নীলাদ্রি বুঝতে পারল কাজটা ভুল হয়েছে। একবার ফোন করা উচিত ছিল। সে বলল, উফ তুমি শান্ত হও তো মা। সবসময় হাইপার হয়ে থাক কেন। এই কারণে কিঙ্কির সঙ্গে তোমার এত লাগে। একটু বাদেই তোমাকে ফোন করতাম। আসলে দিনের পর দিন কী একই কথা বলব? সকালে তুমিই তো বললে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। বলনি? এখন আবার রাগারাগি করছ!

যামিনী কথাটা যেন শুনতে পেল না। বলল, আমি জানি, তোরা আমাকে গুরুত্ব দিস না। একটা মানুষ যে অপেক্ষা করে বসে আছে সেটুকুও পর্যন্ত মাথায় থাকে না। যাক, আমি ফোন রাখছি, আমার আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।

কোথায় যাবে?

যাব একটা জায়গায়। বিশাখা থাকবে।

যামিনী ফোন কেটে দেওয়ার পরও মোবাইলের দিকে একটু সময় তাকিয়ে হইল নীলাদ্রি। মা কোথায় যাবে এটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। নিশ্চয় কোথাও পুজো দিতে বা মানত করতে। পাঁচ বছরে কম করে পাঁচশো জায়গায় পুজো দেওয়া হয়ে গেছে। যে যেমন বুঝিয়েছে। প্রথম বছর সপ্তাহে একদিন উপোস পর্যন্ত শুরু করেছিল। আশ্চর্যের কথা হল, পাঁচ বছর পরেও মানুষটা বাবার জন্য অপেক্ষা করে আছে! সে আর কিঙ্কিনিও কি অপেক্ষা করে? কিঙ্কিনি করে না। বহুদিন আগে সে বলে দিয়েছে, প্লিজ দাদা, এবার তোরা খোঁজাখুঁজি বন্ধ কর। যে লোকটা নিজেই লুকিয়ে আছে তাকে তুই কোথায় পাবি?

লুকিয়ে আছে বলছিস কেন? অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে।

কী বলছিস তুই, অ্যাক্সিডেন্ট হলে ঠিক জানা যেত। এতগুলো থানায় খবর দেওয়া আছে, ফটো পাঠানো হয়েছে, কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে।

দুর বোকা, এত বড় দেশ রোজ কোথায় কী ঘটছে জানা যায়। পুলিশ জানতে পারে? দেখিস না রোজ কত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে? তাদের কোনও ট্রেস পাওয়া যায় না। পেপারে পড়িস না? বিদেশেও তো কিছু হতে পারে। ধর বাবা ফরেনে কোথাও গিয়ে…।

কিঙ্কিনি ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, তোদের মতো বুদ্ধিমান না হলেও আমি একেবারে বোকাও নই দাদা। বাবা রাতারাতি পাসপোর্ট বানিয়ে ভিসা করে জাপান, আমেরিকা বা আবুধাবি চলে গেছে এ কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস? সরি। আর যদি দেশের অন্য কোথাও অঘটন কিছু ঘটে থাকে আমি মনে করি সেটাও একই হল। আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছে বলেই তো কোথাও গেছে। অতবড় একটা মানুষকে তো ছেলেধরা ধরে পাচার করে দেয়নি। নাকি তোর মনে হয় দিয়েছে?

নীলাদ্রি চুপ করে গিয়েছিল সেদিন। বোনের যুক্তি ভাঙতে পারেনি। আজ বোঝে যতটা না সে তার হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য অপেক্ষা করে আছে তার থেকে অনেক বেশি কর্তব্য করছে। শুধু কি কর্তব্য? নাকি আরও কিছু?

মর্গে মৃতদেহ দেখতে আসা নীলাদ্রির এই প্রথম নয়। গত পাঁচ বছরে তাকে বহুবার আসতে হয়েছে। থানা থেকে আনক্লেইমড ডেডবডির খবর দিলেই দেখে যেতে হত। মৃত্যুর তালিকায় কিছুই বাদ যায়নি। বাসে চাপা, ট্রেনে কাটা, জলে ডোবা, আগুনে পোড়া সব পেয়েছে। নীলাদ্রি যখন আসত সঙ্গে কেউ না কেউ থেকেছে। হিন্দোল বেশ কয়েকবার গেছে। পাড়ার আর কলেজের বন্ধুরাও ছিল। একবার দেবনাথের অফিসের অনেকে এল। সেবার সবাই প্রায় নিশ্চিত ছিল, দেবনাথের মৃতদেহই আছে। পুলিশ সেরকমই বলেছিল। একেবারে প্রথম দিকের ঘটনা। হারিয়ে যাওয়ার মাস তিনেকও হয়নি। বড় ধরনের একটা বাস অ্যাক্সিডেন্ট ছিল সেটা। বাস খালে পড়ে গিয়েছিল। ঘটনার পনেরো দিন পরে জানা গেল, তিনটে মৃতদেহ এখনও আনক্লেইমড, নাম-ঠিকানা নেই, খুঁজতেও আসেনি। তার মধ্যে একজনকে নাকি অবিকল দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দেখতে। গায়ের জামা, হাতের আংটি, কপালে কাটা দাগ–সব মিলে যাচ্ছে। সবাই ছুটে এল মর্গে। কীভাবে মৃতদহ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে তা-ও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দেহ। দেখেছিল নীলাদ্রিই। জামা, আংটি দেখতে হয়নি, একঝলক মুখ দেখেই বুঝেছিল, না, মানুষটা তার বাবা নয়। মর্গে অনেকে এলেও ভিতরে ভিড় বাড়ানোর নিয়ম নেই। একা গিয়ে মৃতদেহ দেখে আসত নীলাদ্রি। কোনও রকম সন্দেহ হলে আর একজনকে ডেকে নেওয়া যেত। সেরকম সন্দেহ খুব কমই হয়েছে। হাতে গুনে বার দুই বিভ্রান্ত হয়েছে। মনে হয়েছে হলেও হতে পারে। এই রকম একটা শার্ট ছিল না বাবার? ঘড়ির ব্যান্ডটাও তো এক! প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। বীভৎস মৃতদেহের সারি দেখে শিউরে শিউরে উঠত। ভয় করত। রাতে ঘুম হত না। একেকদিন যামিনীকে ডেকে তুলত।

মা আর পারছি না। রোজ রোজ মরা মানুষের মুখ দেখে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

কী করবি বল? যামিনী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলত।

আমি আর যাব না।

যামিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত, ঠিক আছে আমি যাব। আমিই তো যেতে চাই, পুলিশ বলে বাড়িতে পুরুষমানুষ কেউ থাকলে তাকে পাঠাবেন।

নীলাদ্রি বলল, পুলিশকে বলে দেবে, আমরা কেউ যাব না। তুমি আমি কেউ নয়; দয়া করে তারা আমাদের যেন আর খবর না দেয়। অনেক হয়েছে। এনাফ ইজ এনাফ।

যামিনী চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা, তাই বলে দেব।

কদিন পরেই থানা থেকে আবার ফোন আসে–

বাগনানের কাছে রেললাইনের পাশে একটা বডি পাওয়া গেছে ম্যাডাম। অবস্থা খুব খারাপ। মুখ প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। রেলেকাটা যেমন হয় আর কী। একবার যদি চান কাল মর্গে গিয়ে দেখে আসতে পারেন।

আমরা আর ডেডবডি দেখব না বলতে গিয়েও থমকে যায় যামিনী। বুঝতে পারে একথা বলার ক্ষমতা তাদের নেই। ক্লান্ত গলায় বলে, ঠিক আছে আমি যাব।

আপনি!

কেন আমি হলে অসুবিধে?

ওপাশের লোকটা সামান্য হাসল। বলল, আমাদের আর সুবিধে-অসুবিধে কী বলুন। ম্যাডাম? আমাদের কিছু নয়, আমরা বলি, মেয়েমানুষের ওসব সিন না দেখাই ভালো।

মেয়েমানুষ শুনে যামিনী বিরক্ত হয়। কঠিন গলায় বলে, যাদের ঘরে পুরুষমানুষ নেই তারা কী করে?

সে না থাকলে আর কী করা যাবে? আপনি যদি যেতে চান তো যাবেন।

যামিনী খানিকটা আপনমনে বলল, হ্যাঁ, এবার থেকে আমিই যাব।

যামিনীর নাকে-মুখে আঁচল। মর্গের থলথলে চেহারার ডোম প্রথমে ভুরু কুঁচকে যামিনীকে। দেখেছিল। তারপর খানিকটা দ্বিধা নিয়েই মৃতদেহের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দিল। মুখ নয়, একটা খোবলানো মাংস পিণ্ড! মাথা ঘুরে সেখানেই পড়ে যায় যামিনী। মর্গের কর্মীরা বাইরে ছুটে আসে। খোঁজ নেয়, জ্ঞান হারানো মহিলার সঙ্গে কেউ এসেছে কিনা। না, কেউ আসেনি।

সবাই খুব বকাবকি করেছিল সেবার। বিশাখা বলেছিল, এটা তোমার খুব অন্যায় হয়েছে যামিনীদি। অন্তত নীলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

যামিনী বিষণ্ণগলায় বলেছিল, নীল আর পারছে না। আমার কিছু হত না, আসলে ডেডবডিটা খুব খারাপ ছিল। রেল অ্যাক্সিডেন্ট। মুখটা একেবারে বিকৃত হয়ে গেছে। মনে পড়তে শিউরে উঠল যামিনী।

হিন্দোলকে বলতে পারতে।

কত বলব? ছেলেটা তো সবই করছে। অনেকবার মর্গেও তো গেছে। ডেডবডি ঘাঁটার জন্য মানুষকে রোজ রোজ বলতে লজ্জা লাগে। তোদের দেবনাথদা তার বউ, ছেলের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। ডেডবডি দেখার ব্যবস্থা। খুব ভাগ্য করলে সংসার এমন মানুষ পায়।

বিশাখা বলে, এমন করে বলছ কেন যামিনীদি? এমন করে বোলো না।

যামিনী আর পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, এর থেকে যদি দুটো লাইন চিঠি লিখে বলত, আমি ভালো আছি, তোমরা চিন্তা করো না। আমি আর বাড়ি ফিরব না। তা হলে এই খুঁজে বেড়ানোর যন্ত্রণা থেকে আমরা মুক্তি পেতাম।

তারপর থেকে আর কখনও মর্গে যায় না যামিনী। নীলাদ্রিই আবার শুরু করেছে। তবে যত দিন যাচ্ছে, ডাক কমে আসছে। প্রায় এক বছর পরে ভবানীভবন থেকে আজ সকালে ফোন এল। বসার ঘরে ফোনটা বেজে যাচ্ছিল, যামিনী ধরছিল না। কাউকে ধরতে বলছিলও না। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কাল রাতের পর থেকে কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। কিঙ্কিনি ফেরার পর নীলাদ্রিকে মোবাইলে ফোন করেছিল।

ফিরে এসো।

কিঙ্কি ফিরেছে?

যামিনী থমথমে গলায় বলল, হ্যাঁ, ফিরেছে।

নীলাদ্রি উদবিগ্ন হয়ে বলল, কী হয়েছিল?

জানি না। জানতে চাইও না। মদ খেয়ে ফিরেছে।

নীলাদ্রি একটু চুপ করে থেকে বলে, কী আজেবাজে কথা বলছ মা!

যামিনী বলল, ঠিকই বলছি। তোমার বোন শুধু মদ খায়নি, বাড়িতে ঢুকে মাতালের। মতো আচরণ করছে। তুমি চলে এসো।

হতভম্ব নীলাদ্রি দ্রুত সাইকেল চালিয়ে ফিরেছে। সন্ধের ঝড়-বৃষ্টিতে চারপাশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার ওপর অনেক রাত। কিঙ্কি মদ খেয়েছে! হতেই পারে না। মা নিশ্চয় বানিয়ে বলছে। মেয়েটার ওপর মায়ের খুব রাগ। বানিয়ে বানিয়ে দোষ খোঁজে। তবে যতই রাগ থাকুক মেয়ে সম্পর্কে এমন বিশ্রী কথা বানিয়ে বলাও ঠিক নয়। কিঙ্কি শুনলে কী হবে? মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও তেতো হবে। এর একটা শেষ দরকার। তবে কিঙ্কিটা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। পাড়ার দু-একজন পুরোনো বন্ধু তাকে বলেছে। বদ্র একদিন বলেছিল, একটা কথা বলব নীল? কিছু মনে করবি না তো?

কী হয়েছে?

বদ্রু একটু দ্বিধা করেই বলল, তোর বোন বলেই বলছি।

কিঙ্কি! কী করেছে কিঙ্কি!

বদ্রু একটা হাত নীলাদ্রির কাঁধে রেখে বলল, তোর বোন তো আমাদেরই বোনের মতো, সেদিন দেখলাম ঠা ঠা দুপুরে রেল গেটের কাছ দিয়ে যাচ্ছে।

নীলাদ্রি বিড়বিড় করে বলল, হয়তো কাজে যাচ্ছিল, পড়তৌড়তে যায়।

পড়তে যাচ্ছিল না, ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। জায়গাটা তো ভালো নয়। রেলগেটের ভাঙা শিবমন্দিরে একটা বাজে আখড়া আছে, জানিসই তো। মদ-গাঁজা খাওয়া হয়।

নীলাদ্রি বোনকে ডেকে বলেছিল। ভালোভাবেই বলেছিল, রাগারাগি করেনি।

জায়গাটা বাজে, ওদিকে যাসনি।

কিঙ্কিনি উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, কত বাজে? আমার বাড়ির থেকে বাজে তো নয়। আমি আজকাল বাজে জায়গাই পছন্দ করছি দাদা। ভাবছি একদিন ওই ভাঙা মন্দিরে যাব। তুই যদি চাস, চল না।

সেদিন হাসাহাসি করলেও আজ মারাত্মক অন্যায় করেছে কিঙ্কি। কোনওভাবেই তাকে ক্ষমা করা যায় না। এত রাত করা তার উচিত হয়নি। মোবাইল ফোনটাও বন্ধ রেখেছিল! হায়ার সেকেন্ডারি কেন চাকরি করলেও কোনও মেয়ে এই কাজ করতে পারে না। না বলে এত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে! বাবা থাকলে, ও এই সাহস পেত? কিঙ্কি কেন? ছেলে হয়ে সে নিজেও একাজ করতে পারত না। নীলাদ্রি ঠিক করেছিল, বাড়ি ফিরেই কিঙ্কিনিকে বকাঝকা করবে। সে সুযোগ পায়নি। কিঙ্কিনি দরজা আটকে শুয়ে পড়েছিল। সেই দরজা সকালেও খোলেনি। মা বাড়ি থাকা পর্যন্ত সে খুলবে না তা-ও বোঝা যাচ্ছিল।

ফোনটা বেজেই যাচ্ছিল। নীলাদ্রি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ধরল। ভবানীভবন শুনে বিরক্ত গলায় বলল, বলুন কী ব্যাপার।

একটা সুইসাইড কেস হয়েছে। মিডল এজেড মেইল। দুবছর হল বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। বাড়ি মানে একতলার একটা ঘর। কাল বিকেলে গলায় দড়ি দিয়েছে। পুলিশ গিয়ে জানতে পেরেছে, লোকটা বাড়িওলার কাছে নাম ঠিকানা সবই মিথ্যে দিয়েছিল। সুটকেসের একপাশে শুধু লেখা আছে ডি. চট্টোপাধ্যায়।

নীলাদ্রি বলল, ডি মানেই দেবনাথ হবে এমনটা ভাবলেন কেন? ডি দিয়ে অনেক নাম হতে পারে।

ওপাশ থেকে লোকটি বলল, আমরা কিছুই ভাবিনি। আপনাদের জানানোটা ডিউটি তাই জানালাম। নইলে আপনারাই তো বলবেন পুলিশ কিছু করে না। এখন বুঝতে পারছেন, পুলিশ করে। পাঁচ বছরের পুরোনো কেসও আমরা তামাদি করিনি।

নীলাদ্রি চাপা গলায় বলল, লাভ তো কিছু হচ্ছে না, অকারণ ছোটাছুটি করছি।

আর দুটো বছর কষ্ট করুন।

তারপর কী? নীলাদ্রি অবাক হল।

সাত বছর হয়ে গেলে গভর্মেন্ট থেকেই ডেথ ডিক্লেয়ার করে দেয় বলে শুনেছি। সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন।

নীলাদ্রি মুখ দিয়ে আওয়াজ করে বলল, জানি, কিন্তু তারপর কি আর ডেডবডি দেখতে হবে না?

লোকটা ব্যঙ্গের গলায় বলল, না দেখলেও চলবে। এত বিরক্ত হতে হবে না।

নীলাদ্রি লজ্জা পেল। বিরক্ত ভাবটা বেশি দেখানো হয়েছে। সত্যি তো পুলিশ কী করবে? তারা যে আজও খবর দিচ্ছে, এটাই অনেক।

যামিনী কোনও উৎসাহ দেখাল না। নীলাদ্রি আত্মহত্যার কথাটা গোপন রেখে বলল, সুটকেসের গায়ে না কোথায় ডি চট্টোপাধ্যায় লেখা পেয়েছে। কী করব? যাব?

তুমি যদি চাও যাবে।

নীলাদ্রি খবরের কাগজ টেনে নিয়ে বলল, যা চাই তা কি করা যায়? পাঁচ বছরে পেরেছি?

যামিনী খানিকটা নিজের মনেই বলল, গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

জানি, তবু যেতে হবে। নীলাদ্রি কাগজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল।

যামিনী বলল, যদি যাও সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেও, একা যেও না।

নীলাদ্রি মুখ তুলে বলল, না, যাওয়ার হলে এবার থেকে আমি একাই যাব। কাউকে বলতে অপমান লাগে। মনে আছে, গতবার প্রণবকে বলেছিলাম, কেমন অ্যাভয়েড করে গেল। বলল ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। আর নয়।

যামিনী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাল ওখানে গিয়েছিলি না?

কোথায়? বাবার অফিসে?

কিছু হল? কিছু বলল? যামিনী দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

কাগজের পাতা উলটোতে উলটোতে নীলাদ্রি এমন ভান করল যেন কথাটা শুনতে পায়নি। যামিনী আবার বলল, কীরে, কী হল বললি না তো?

নীলাদ্রি বলল, না, কিছু হয়নি। কথাটা বলেই বুঝল, মিথ্যেটা সহজভাবে বলা হল না।

যামিনী ভুরু কোঁচকালো, হয়নি মানে!

নীলাদ্রি মুখ নামিয়ে বলল, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে দেখা হয়নি।

ও, তুই আর ফোন করেছিলি?

নীলাদ্রি কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, না, পরে করব। মা শোনো, কিঙ্কিকে নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

যামিনী রান্নাঘরে ঢুকে যেতে যেতে বলল, আমার নেই।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর ওপর মিষ্টির দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নীলাদ্রি। এখানে জল পাওয়া যাবে। চা-ও রয়েছে। চা খেলে কি মুখের তেতো ভাবটা কমবে? চায়ের অর্ডার দিয়ে। ভালো করে মুখ ধুল নীলাদ্রি। দোকানের কিশোর ছেলেটি এগিয়ে বলল, আর কিছু খাবেন?

না।

খান না ভালো শিঙাড়া আছে। গরম।

নীলাদ্রি হেসে হাত নাড়ল। ছেলেটা যদি জানত, খানিকক্ষণ আগে তার খদ্দের মর্গের ভেতর ছিল, তা হলে কি এত সহজে শিঙাড়ার কথা বলতে পারত? শ্রীময়ীকে না বললে সে ও কি বুঝতে পারবে? পরশু যখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল, তখন অবশ্য মর্গের বিষয়টা ছিল না। ফোনে শ্রীময়ী বলেছিল, ছটার সময় নন্দনের সামনে দাঁড়াই তা হলে?

নীলাদ্রি বলল, আবার সেই নন্দন? তোমাকে বলেছি না, জায়গাটা আমার পছন্দ হয় না।

শ্রীময়ী হেসে বলল, কেন বল তো, তোমার নন্দন নিয়ে এত অ্যালার্জি কীসের?

নন্দন নিয়ে নয়, কবিদের ভিড় নিয়ে। শরীরের ভেতর আমার কেমন যেন করে? ইরিটেশন হয়।

আমিও তো কবিতা লিখি। আমাকে নিয়ে ইরিটেশন হয় না তো? কথাটা বলে সুন্দর করে হাসল শ্রীময়ী।

শ্রীময়ীর এই সুন্দর হাসি নীলাদ্রি প্রথম দেখে ঠিক দু-বছর আগে। কলকাতার কোনও এক বিয়েবাড়িতে। মেয়েটাকে আহামরি কিছু দেখতে নয়, চট করে চোখেও পড়েনি। হঠাৎ নীলাদ্রির নজর কাড়ল হাসি। চমকে উঠেছিল। মেয়েটা হেসে শুধু নিজেই সুন্দর হয়নি, চারপাশটাও বদলে দিয়েছে! ঝলমলিয়ে উঠেছে। মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়। সেদিন সেই মেয়ে যতবার হেসেছে লুকিয়ে দেখেছিল নীলাদ্রি। বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়, সিঁড়ির কোনায় মেয়েটাই তাকে ধরে। সহজভাবে বলে, খেলেন, অথচ মেনুটা নিয়ে গেলেন না? খাবারের নাম তো সব ভুলেই যাবেন। নিন ধরুন। হাতে একটা কাগজ গুঁজে তরতরিয়ে ওপরে উঠে যায় একইরকম সহজ ভঙ্গিতে।

হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে সেই কাগজ খুলেছিল নীলাদ্রি। কাগজে দ্রুত হাতে লেখা–

একটা অচেনা মেয়ের দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে হয়? ছিঃ। আমি খুব রাগ করেছি। আপনি কে? আমি শ্রীময়ী। আমার মোবাইল নম্বর নীচে লিখে দিলাম। আপনি কাল বিকেলে ফোন করে ক্ষমা চাইবেন। আমি অপেক্ষা করব।

নীলাদ্রি পরদিন সকালেই ফোন করেছিল। সেদিন তার অফিসে কাজ ছিল। যাওয়ার পথেই করে। বিকেলে ছুটির পর দেখা করে শ্রীময়ী।

শ্রীময়ী একদিন জিগ্যেস করেছিল, শুধু কি আমার হাসিও সুন্দর, আমি সুন্দর নই?

নীলাদ্রি বলল, হাসি কান্না সুন্দর হলে তবেই মানুষ সুন্দর হয়।

তোমার হাসিও সুন্দর নীল।

নীলাদ্রি মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, মনে হয় না।

শ্রীময়ী হেসে বলে, তুমি কী করে বুঝবে? তুমি কি কখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাসি দেখেছ? আজই বাড়ি ফিরে দেখবে।

নীলাদ্রি ম্লান হেসে বলল, আমাদের বাড়িতে বহুদিন হাসি বন্ধ শ্রীময়ী। হাসতে ইচ্ছে করলেও আমি বা আমার বোন হাসতে পারি না। কেন পারি না জানো? পাছে লোকে কিছু বলে, বলে এদের বাবা এদের ছেড়ে চলে গেছে তবু এরা হাসে কী করে! এদের লজ্জা করে না!

শ্রীময়ী ঘন হয়ে আসে। নীলাদ্রির পিঠে হাত রেখে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

হবে না শ্রীময়ী। মানুষ মারা গেলে একদিন সব ঠিক হয়ে যায়। হারিয়ে গেলে হয় না। মাঝেমধ্যে বড় অপমানিত লাগে।

শ্রীময়ী থামিয়ে দেয়। নীলাদ্রির হাত ধরে বলল, ওসব কথা রাখো। এখন আমার দিকে তাকাও তো, অ্যাই তাকাও বলছি। একটা কবিতা লিখেছি শুনবে?

নীলাদ্রি মুখ ফিরিয়ে হেসে ফেলে। বলে, আমাকে কবিতা শোনাবে! খেয়েছে, আমি কবিতার কী বুঝব?

শ্রীময়ী হেসে বলল, কেন তুমি কি শুধু হাসি বোঝ? হাসিবিশারদবাবু? এবার থেকে তোমাকে কবিতাও বুঝতে হবে। কবিতা রাগ দুঃখ অপমান সব মুছে দিতে পারে।

চায়ের কাপ মুখে তুলতে গিয়ে নীলাদ্রি হাত সরিয়ে নেয়। একটু আগে দেখে আসা মুখটা আবার মনে পড়ল। কী ভয়ঙ্কর! গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে মানুষের মুখ এত ভয়াবহ হয়ে যায়! এত বীভৎস। জিভ ঝুলে পড়েছে, চোখ বেরিয়ে এসেছে ঠিকরে। যেন শেষ মুহূর্তে সবটা দেখে নিতে চেয়েছিল! একটা জীবনে যতটা দেখা যায়, যতটা বাকি রয়ে গেল– সব। ভাগ্যিস মানুষটা তার বাবা ছিল না। মা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারত না।

আবার গা গুলিয়ে উঠল নীলাদ্রির। সে ভরা চায়ের কাপ রেখে দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এল। ফোন করে আজ আসতে বারণ করে দেবে শ্রীময়ীকে? বাড়ি ফিরে যাবে? না থাক, শ্রীময়ীর সঙ্গে থাকলে মনটা ভালো হয়।

মন ভালো হল না নীলাদ্রির। মর্গের কথা শুনে শ্রীময়ীও মুষড়ে পড়ল।

নীলাদ্রি বলল, সরি, তোমাকে বলা ঠিক হয়নি।

শ্রীময়ী ফিসফিস করে বলল, না, তুমি সবই বলবে। সব।

নীলাদ্রি বিষণ্ণ হেসে বলল, একটা সুন্দর হাসির মেয়ে কেমন দুঃখের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল বল দেখি।

একশোবার পড়ব। তুমি কিছু লুকোবে না, তোমার সব কষ্ট আমাকে জানাবে। নীলাদ্রি আবার হাসল। সব জানাবে কী করে? সব কি জানানো যায়? সব কি সে নিজেও জানে? জানে না। কেন কিঙ্কির ওপর মায়ের এত রাগ, এত ঘৃণা? কেন অর্ধেন্দু দত্ত তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাবার অফিসে পিওনের কাজ দিতে চায়? কীসের প্রতিশোধে সে এই অপমান করে? কেন কিঙ্কির মতো চমৎকার মেয়ে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে? তার থেকেও বড় কথা পাঁচ পাঁচটা বছর পার হয়ে গেল, আজও জানা হল না, সেই মানুষটা কেন সব ছেড়ে চলে গেল? সবাইকে ছেড়ে?

 ০৭. রাস্তাটা কেমন অন্ধকার

০৭.

এই দুপুরেও রাস্তাটা কেমন অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। পথ ভুল হয়নি তো?

পথ ভুল হওয়ার কথা নয়। যামিনী নিজে চিনে আসেনি, রিকশাওলা নিয়ে এসেছে। সে এখানকার লোক। তার ভুল হবে কী করে? বাস স্টপে নেমে হাতের কাছে প্রথম যে রিকশা দেখতে পেয়েছিল তার দিকেই যামিনী এগিয়ে যায়।

শহিদ বলরাম কলোনিতে যাব।

রিকশাওলা সিটে বসে দাঁত খুঁটছিল। জায়গার নাম শুনে লোকটা ভুরু কুঁচকে তাকাল। যামিনীকে আপাদমস্তক দেখল ভালো করে। যেন জায়গার নামের সঙ্গে যামিনীকে মানায় না।

কলোনির মুখে নামবেন তো?

না ভেতরে যাব। সাতাশ বাই তিন নম্বর শহিদ বলরাম কলোনি।

রিকশাওলা জিভ দিয়ে মুখে চকাস ধরনের আওয়াজ করে বলল, ভিতরে যাব না। মুখে নামিয়ে দিতে পারি।

কেন? ভেতরে যাওয়া যায় না? যামিনী অবাক হল।

না যায় না, রাস্তা খারাপ আছে, রিকশা যাবে না।

যামিনী বলল, ঠিক আছে এক্সট্রা পয়সা দেব, চল।

রিকশাওলা গায়ের জালি গেঞ্জি তুলে পেট চুলকোতে চুলকোতে বলল, বেশি দিলেও যাব না, আপনি অন্য গাড়ি দেখুন দিদি। তবে মনে হয় না কেউ ভিতরে ঢুকবে। কলোনির মুখে নামিয়ে দেবে।

ঠিক আছে তাই চল, মুখেই নামিয়ে দেবে। যামিনী বুঝতে পারল কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না। নিশ্চয় জায়গাটায় কোনও গোলমাল আছে। সে রিকশাতে উঠে বসল।

যামিনী আজ স্কুলে যাব বলে বেরিয়েও স্কুলে যায়নি। স্টেশনে এসে বর্ধমানের গাড়ি ধরে। সেখান থেকে বাস। হিন্দোল যেমন বলেছিল।

বাস থেকে নেমে কীভাবে যেতে হবে আমি বলতে পারব না। মনে হয় হেঁটেই যাওয়া যায়।

যামিনী শান্ত গলায় বলল, তোমার ওই যাদব লোকটার সঙ্গে একবার কথা বলা যায় না হিন্দোল?

হিন্দোল উৎসাহের সঙ্গে বলল, কেন যাবে না? আসানসোলে থাকে। যেদিন ইচ্ছে ফোনে কথা বলতে পারেন। সেরকম হলে একদিন দেখা করতে বলি?

বিশাখা বলল, এটা কী বলছ? যামিনীদি এই বিষয়টা নিয়ে বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি নাকি! ছিঃ!

যামিনী ঠোঁটের ফাঁকে ব্যঙ্গের হেসে বলল, লজ্জার আর বাকি কী আছে বিশাখা? লুকিয়ে কী লাভ? ভাবছি কিঙ্কি আর নীলকেও বলে রাখব। মনের দিক থেকে ওরা তৈরি হয়ে থাকুক।

বিশাখা হাত নেড়ে বলল, না না একেবারেই নয়, কে কী উড়ো খবর দিল সেটা বিশ্বাস করে বসে থাকতে হবে নাকি?

যামিনী সোফায় হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, এরকম একটা উড়ো খবর শুনতে হচ্ছে এটাই তো অপমানের। আমি কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি, দেবনাথের নামে একথা শুনতে হবে।

হিন্দোল মাথা নামিয়ে বলল, সরি যামিনীদি, ভেরি সরি। আমি সেই জন্যই বিশাখাকে বলেছিলাম, এই ধরনের খবর হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর না হয়ে বলা উচিত নয়। কিন্তু পরে কী ভাবলাম জানেন, ভাবলাম যতই হোক আপনাকে গোপন করাটা উচিত নয়। আপনার স্বামী…।

সেদিন বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে একই কথা বলেছিল বিশাখা।

আমিই হিন্দোলকে বললাম সত্যি হোক মিথ্যে হোক কথাটা যামিনীদিকে জানানো দরকার। হিন্দোল বলেছিল, একবার নিজে গিয়ে দেখে আসবে কিনা। আমি বললাম, তোমাকে না জানিয়ে সেটা করা যায় না।

যামিনী বিশাখার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, খারাপ খবরটা কী?

বিশাখা একটু এগিয়ে এল। নীচু গলায় বলতে শুরু করল–

হিন্দোলের কোম্পানিতে যাদব নামে একটা ছেলে কাজ করে। আসানসোলে পোস্টেড। সেখানকার ফ্যাক্টরিতে মেশিন চালায়। একসময় খুব নেশা ভাঙ করত, বাজে সঙ্গে মিশত। আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনও ছিল। ওইসব দিকে এরকম হয়। ওর বাবা হিন্দোলকে খুব করে ধরেছিল। একটা কাজ পেলে হয়তো ছেলেটা বদলে যাবে। এসব ছেলেকে কাজে ঢোকানো মুশকিল। ঝুঁকি থাকে। তবে হিন্দোল ঝুঁকি নিল। কাজ দিল ছেলেটাকে। ফরচুনেটলি ছেলেটা ভালোও হয়ে গেছে। হিন্দোলকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। রেগুলার যোগাযোগ রাখে। অফিসের কাজের বাইরেও রাখে। হিন্দোল ওকে নানা কথার মধ্যে দেবনাথদার কথাও বলেছিল একদিন। ও দেবনাথদার একটা ফটো চায়। হিন্দোল বলেছিল, ফটো নিয়ে তুই কী করবি? যাদব বলেছিল, দাও না। যদি কোনওদিন খবর পাই। চার বছর পর সেই খবর পাঠিয়েছে।

যামিনী শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল, ঘাড় মুছল। চোয়াল শক্ত করে বলল, কী খবর?

বিশাখা দুপাশে তাকাল। দোকানের এদিকটা ফাঁকা। দিদিমণিরা থাকলে কেউ এপাশে আসে না। মাঝেমধ্যে শুধু জিগ্যেস করে যায়, কিছু লাগবে কিনা। বিশাখা মাথা নামিয়ে অপরাধীর মতো বলল, দেবনাথদা মনে হয় আর একটা সংসার করেছে।

যামিনী সোজা হয়ে বসে। বলে, কী বললি! কী করেছে?

বিয়ে করেছে। একটা মেয়ে আছে।

যামিনী টেবিলে চাপড় মেরে বলল, আমি বিশ্বাস করি না। কিছুতেই বিশ্বাস করি না।

বিশাখা মুখ তুলে তাড়াতাড়ি বলল, আস্তে, যামিনীদি। আমিও বিশ্বাস করি না। তুমি উত্তেজিত হয়ো না। লোকে শুনতে পাবে। এইজন্যই হিন্দোলকে সকালে বলেছিলাম, এসব কথা বাইরে বলা ঠিক নয়। তোমাকে বাড়িতে ডেকে নিই। হিন্দোল বলল, বাড়িতে বাবা-মা আছে, সেখানে আলোচনা না হওয়াই ভালো। তোমার বাড়িতেও তো নীল, কিঙ্কি কেউ না কেউ থাকে। ওদের সামনে অন্য সব কথা বললেও এটা তো বলা যাবে না।

বিশাখার কথা শুনতে পেল না যামিনী। সে কঠিন গলায় বলল, ওই যাদব ছেলেটা কোথা থেকে খবর পেল?

বললাম না ওর আন্ডারওয়ার্ল্ডে যোগাযোগ আছে।

আন্ডারওয়ার্ল্ড! দেবনাথ কি ওই সব করছে!

যামিনীর মনে হচ্ছে তার সারা শরীরে কেউ গলানো সীসে ঢেলে দিচ্ছে। কিন্তু সে কিছু বুঝতে পারছে না। তবে অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে।

বিশাখা বলল, না না তা নয়, আসলে…।

আসলে কী?

থাক, বাকিটা হিন্দোল তোমাকে বলবে। ও আজ অফিস থেকে ট্যুরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সোমবার ফিরবে, তারপর ওর কাছে…

তুই যতটুকু জানিস বল আমাকে। প্লিজ বল।

যামিনী অবাক হয়ে দেখল, তার চোখে জল আসছে না! বিশাখা কিন্তু হাতের রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মুছল। বলল, আমি জানি খবরটা মিথ্যে। এতগুলো খবর মিথ্যে হয়েছে, আর এটা হবে না?

তুই আমার কাছে কিছু গোপন করিস না বিশাখা। তোরা ছাড়া আমার পাশে আর কেউ নেই।

বিশাখা হাত বাড়িয়ে যামিনীকে ছুঁল।

আগে বল তুমি বিশ্বাস করবে না।

তুই বল।

বিশাখা আমতা আমতা করে বলল, দেবনাথদা যে মহিলার সঙ্গে থাকে সে নাকি…।

যামিনী শ্বাস টেনে বলল, সে কী?

শি ইজ আ প্রস্টিটিউট। দেবনাথদার সঙ্গে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল।

.

রিকশা নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর যামিনী খানিকটা ইতস্তত করল। যদিও তার কোনও কারণ ছিল না। রিকশাওয়ালা প্রথমে খারাপভাবে কথা বললেও নামার পর হাত দিয়ে কলোনিতে ঢোকার রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছে।

এটা দিয়ে চলে যান, সোজা যাবেন একদম। কলোনির ভিতর পৌঁছে যাবেন। একটা পুকুর পড়বে। দুদিকে রাস্তা, বাঁদিকটায় ঢুকবেন না।

ঢুকব না? কেন?

রিকশাওলা জিভ দিয়ে আওয়াজ করে বলল, গেলেই বুঝবেন।

যামিনী সোজাই যাচ্ছে। রাস্তা সরু ছিল। যত এগোচ্ছে আরও ছোট হয়ে আসছে। খানিকটা এগিয়ে থমকে দাঁড়াতে হল। রাস্তার ওপর অনেকটা জায়গা জুড়ে জল জমে আছে। নোংরা জল। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। গলিটাতে ঢুকতেই একটা বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এসেছিল। সেই গন্ধ ক্রমশ বাড়ছে। দুহাতে শাড়ি সামান্য উঁচু করে যামিনী নোংরা জলে তার জুতো পরা পা রাখল। শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল। শুধু শরীর নয়, মনও। এখানে এসে থাকে দেবনাথ! অবশ্য তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? নোংরা জীবন কাটাতে হলে নোংরা জায়গাই লাগে।

বিশাখার কাছ থেকে খবর শোনার পর কটা দিন একেবারে চুপ করে গেল যামিনী। শান্ত হয়ে গেল যেন। কিঙ্কিনি মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার পরও কিছু বলেনি। এর মধ্যে একদিন মোবাইলে দেবনাথের অফিসের নম্বর ভেসে উঠল। ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে অর্ধেন্দু দত্তর গলা।

আপনি! অবাক হল যামিনী।

ফোনটা কেটে দেবে নাকি? যদি চাও দিতে পারো।

কী ব্যাপার বলুন। বুক কেঁপে উঠলেও যতটা সম্ভব উত্তাপহীন গলায় বলল যামিনী।

ছেলে কিছু বলেনি?

কী বিষয়?

অর্ধেন্দু দত্ত হেসে বললেন, বাঃ বেশ ডিপ্লোমেটিক কায়দায় কথা বলা ধরেছ দেখছি। গুড। এমন ভান করছ যেন কিছু জানো না।

এই কবছরে মানুষটা গলার স্বরে একটা ভাঙা ভাব এসেছে, আর কিছু বদলায়নি। যামিনী বুঝতে পারছিল না কী করবে। ফোনটা কি রেখে দেবে? অস্ফুটে বলল, নীল আমাকে কিছু বলেনি।

ঠিক আছে কষ্ট করে আর মিথ্যে বলতে হবে না, ইটস ওকে, আমি সব বুঝেছি। আমি তোমাকে একটা কথা বলতে ফোন করেছি, আমার নিজের পক্ষ থেকে নয়, অন বিহাফ অফ মাই অফিস ইউনিয়ন তোমায় ফোন করেছি। তুমি নিশ্চয় জানো নীলাদ্রিকে চাকরির ব্যাপারে আমরা ডেকেছিলাম। অনেকটা কমপেনসেটরি গ্রাউন্ডের মতো। আমাদের অফিসের ভ্যাকেন্সির সঙ্গে ওর কোয়ালিফিকেশন যেরকম ম্যাচ করেছিল, সেই অনুযায়ী কাজের অফার দেওয়া হয় ওকে। কাজটা ছিল পার্মানেন্ট। সেই কাজ তোমার ছেলের সম্ভবত পছন্দ হয়নি। এটা হতেই পারে। কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম, ও একটা উত্তর দেবে। ও যে কাজটা করবে না সেটা তো অন্তত জানাবে। বাট হি ডিডন্ট গিভ এনি রিপ্লাই। আমরা ইউনিয়ন থেকে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে কাজটা ধরে রেখেছিলাম, তোমার বা তোমার ছেলের নাম করে নয়, দেবনাথের নাম করে। আমাদের লস অব ফেস হল।

যামিনী অবাক হয়। নীল তাকে এসব কিছুই বলেনি! সে আমতা আমতা করে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

অর্ধেন্দু দত্ত একটু থামলেন। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, মিসেস চ্যাটার্জি কথাটা শুনতে আপনার খারাপ লাগবে, কিন্তু সরি তা-ও আমাকে বলতে হচ্ছে, আজ অফিসে অনেকেই দুঃখ করে বলছিল, দেবনাথবাবু একজন ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁর ফ্যামিলি এরকম হবে আশা করা যায় না।

যামিনী কাতর গলায়, বিশ্বাস করুন আমি কিছুই জানি না।

অর্ধেন্দু দত্ত ফোনেই যেন একটা হাই তুললেন। অবিশ্বাসের হাই। তারপর মুচকি হেসে চাপা গলায় বললেন, এত কী ব্যস্ত থাক যামিনী যে ছেলেমেয়েদের খবর জানতে পারো না? আমার অবশ্য বোঝা উচিত ছিল, বিছানায় তুমি যা পটু তাতে বাড়তি দুটো পয়সা রোজগার করা তোমার পক্ষে কিছুই নয়। ছেলের চাকরিবাকরি নিয়ে তুমি অত চিন্তিত নও। শুনেছি দেবনাথবাবুর বাড়ি ছাড়ার পিছনে নাকি এটাই কারণ। তোমার ঘন ঘন বিছানা বদল। সত্যি নাকি? আই ডোন্ট বিলিভ।

ফোন হাতে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে পাশে রাখা টুলে বসে পড়েছিল যামিনী। বিড়বিড় করে বলেছিল, স্কাউনড্রেল।

আওয়াজ করে হেসে উঠেলেন অর্ধেন্দু দত্ত। বলেছিলেন, ডোন্ট বি সো এক্সাইটেড যামিনী। অত উত্তেজনার কী আছে? তুমি যদি সেদিন টাকা চাইতে আমি কি দিতাম না? অবশ্যই দিতাম। রাজনীতি করি মানে এই নয় প্রফেশনালদের অপছন্দ করি। যাক, যা হবার হয়ে গেছে, পরে কোনওদিন যোগাযোগ হলে রেট বোলো, গুড বাই।

বিপর্যস্ত যামিনী ভেবেছিল পরদিনই দেবনাথের অফিসে চলে যাবে। সবার সামনে অর্ধেন্দু দত্তকে চড় মেরে আসবে। পারেনি। চুপ করে গিয়েছিল। বার বার মনে পড়েছে, দেবনাথের আর একটা সংসারের কথা। তার কাছে সব মান অপমান তুচ্ছ মনে হয়েছে। যখন চোখে জল এসেছে তখনই ভেবেছে, কাঁদবে না। ঘটনা যদি সত্যি হয় তা হলে সে কান্না নিজের কাছে বড় লজ্জার হবে। অর্ধেন্দু দত্ত বেশ্যা বলার থেকেও বেশি লজ্জার। নিজেকে কঠোর করেছে যামিনী। কান্না পেলেও কাঁদেনি, চোখ খুলে রাত জেগেছে। নিজেকে বলেছে শান্ত থাকতে হবে। আরও কটাদিন শান্ত থাকতে হবে। হিন্দোল ফিরলে দেবনাথের নতুন সংসারের ঠিকানা জেনে সে নিজে যাবে।

এই কটা দিন মূলত শান্তই ছিল যামিনী। তবু দুটো গোলমাল করে বসল। তার মধ্যে প্রথমটা ছিল বেশি ঝামেলার।

স্কুলে ক্লাস নিতে গিয়ে একদিন মেজাজ হারাল যামিনী। মেজাজ অনেকদিনই হারাচ্ছিল। একসময়ের হাসিখুশি, মিষ্টি মিস গত কয়েকবছরে খিটখিটে হয়ে উঠেছে ক্রমশ। যে টিচারের কাছে মেয়েদের দোষ এতদিন প্রায় সাত খুন মাপ-এর মতো ছিল, সে-ই অল্পেতেই ধমকধামক দেয়, চাপড় মারে। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা বলাবলি করত, বর চলে যাওয়ার পর থেকেই যামিনী মিস বিগড়ে গেছে। আড়ালে তার নাম দিয়েছিল, বিপি মিস, বর পালানো মিস। যামিনী রাগারাগি করলে তারা আড়ালে নিজেদের মধ্যে বলত, এই রে, বিপি মিস খেপেছে।

সেদিন মেজাজ হারানোর ঘটনা বেশি মাত্রায় হয়ে গেল। ক্লাসে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার মতো অতি সামান্য অপরাধে ক্লাস নাইনের এক মেয়েকে বেধড়ক মারল যামিনী। মারতে মারতে বেঞ্চ থেকে টেনে বের করে আনল। মেয়েটি এতই বিস্মিত হয় যে কাঁদতেও ভুলে যায়। কান্না না দেখে আরও রেগে যায় যামিনী। উন্মত্তের মতো হয়ে যায়। এবার হাতের ডাস্টার দিয়ে মারতে থাকে মেয়েটির পিঠে। মেয়েটি যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে।

পরদিন খুব স্বাভাবিক কারণেই যা ঘটবার তাই হল। সকাল থেকে স্কুলে তুলকালাম কাণ্ড। স্কুল শুরুর আগেই মেয়েটির বাবা-মা এসে হইচই শুরু করল। মেয়ের বাবা হেডমিস্ট্রেসকে হুমকি দিয়ে গেল, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যামিনী চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তারা পুলিশের কাছে যাবে। মেয়ের মা স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে বলতে লাগল, যে মহিলা নিজের স্বামীকে ভালোবেসে ধরে রাখতে পারেনি, সে আবার স্টুডেন্টদের ভালোবাসবে কী করে? আরে, তুই নিজের বরকে শাসন কর, তারপর পরের মেয়ের গায়ে হাত দিবি।

তখনও যামিনী স্কুলে আসেনি। একে একে টিচাররা আসছে। নিমেষে স্টাফরুমে দুটো দল তৈরি হয়ে গেল। যামিনীর বিরুদ্ধে দল অনেক ভারী। তারা বলতে লাগল, খুব অন্যায় কাজ হয়েছে। ছি ছি। স্কুলের সুনাম নষ্ট হল। একটু আধটু বকাঝকা ঠিক আছে, তাবলে ওরকম চোরের মার মারবে?

বিশাখা মৃদু স্বরে বলে, তোমরা ওর দিকটাও বিচার করো। কতবড় টেনশনের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছে যামিনীদি।

কয়েকজন তেড়ে এল প্রায়।

তুমি চুপ করো। বাড়ির টেনশন বাড়িতে রেখে কাজে আসতে হয়। আমাদের বুঝি টেনশন নেই, চিন্তা নেই? পাঁচ বছর ধরেই তো আহারে উঁহুরে শুনছি। ওকে কিছু বলা যাবে না, ওকে বেশি ক্লাস দেওয়া যাবে না, খাতা দেওয়া যাবে না, উনি চাপ নিতে পারবেন না। কী ব্যাপার না বর পালিয়েছে। মনে হয় আমাদের বর হারালে ভালো হত! সন্তানের মতো মেয়েগুলোর ওপর এখন রাগ ফলাচ্ছে।

আরতিদি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার হাত তুলে বললেন, থাম দেখি, অত বড় বড় কথা বোলো না। মারধোর আমিও সমর্থন করছি না, তাবলে তোমাদের কথাও মানব না। সত্যি যদি ছাত্রীদের নিজের মেয়ের মতো দেখতাম তা হলে টিউশনগুলোর কী হত? একেকটা ব্যাচে পঁচিশজন করে তো বসাচ্ছে সবাই।

আপনিও বাদ যান না আরতিদি। টিউশন আপনিও করেন।

করি তো, করি বলেই তোমাদের মতো কান্নাকাটির আদিখ্যেতা দেখাচ্ছি না।

ইতিহাসের টিচার দেবলীনা একবছর হল জয়েন করেছে। মূলত চুপ করেই থাকে। সে বলল, শুধু টিউশন নয়, টিউশনের জন্য মেয়েদের চাপ দেওয়ার দুর্নামও তো আমাদের নামে রয়েছে।

তুমি মাত্র কদিন জয়েন করেই এত জেনে গেলে! ভূগোলের পর্ণা ব্যঙ্গ করে বলে।

বিশাখা বলল, সত্যি ঘটনা জানতে সময় লাগে না। ইচ্ছে লাগে।

রাজলক্ষ্মী ইংরেজির টিচার। অনেক বছর হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে গাড়ি করে স্কুলে আসেন। মুখে বলেন, স্বামীর টাকায় কেনা, কিন্তু সকলেই জানে টিউশনের জন্যই এই রমরমা। কথাবার্তায় মহিলা অতি মার্জিত। দেবলীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা অভিযোগ ছুঁড়ে দিলেই হয় না দেবলীনা, স্পেসিফিক প্রমাণ দিতে হয়। মনে রেখো এখানে আমরা যারা আছি তারা সকলেই লেখাপড়া করে এসেছি। পড়ানোর মতো একটা পবিত্র পেশায় আমরা যুক্ত। তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তিনবার ভাবতে হয়।

পূর্ণিমা চোখের চশমাটা নাকের ওপর নামিয়ে বললেন, সব অপরাধের কি প্রমাণ হয় রাজলক্ষ্মী? ধর, কেউ স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। দেখা গেল, তার কাছে যারা টিউশন নেয় তারা সব গ্রামারে ফুল মার্কস পাচ্ছে, বাকিরা বেশিরভাগই তিন চার। খুব বেশি হলে পাঁচ।

কথাটা বলে একটু হাসলেন পূর্ণিমা। সকলেই ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। রাজলক্ষ্মী হাত উলটে বললেন, এ কথার মানে কী! কোনও টিচার যদি প্রাইভেট টিউশনে ভালো করে পড়ায় সেটা তো অন্যায় নয়। বাবা-মায়েরাই বা টিউটরের কাছে পাঠাচ্ছে কেন? আমরা তো হাতে পায়ে ধরে আনছি না!

দেবলীনা বলল, এটাই তো কথা রাজলক্ষ্মীদি। বাবা-মায়েরা কেন টিউশনে পাঠাচ্ছে। বাধ্য হচ্ছে না তো?

কীসের বাধ্য।

পূর্ণিমা বাংলার টিচার। সোজাসাপটা কথা বলে স্টাফরুমে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন অনেকদিন। বললেন, আহা, এই সহজ কথাটা বুঝলে না রাজলক্ষ্মী? টিউশন ছাড়া গ্রামারে ফুলমার্কস আসবে কী করে? কোয়েশ্চনটাই তো জানা হবে না।

আপনি কী বলতে চাইছেন? আমি টিউশনে কোয়েশ্চন বলে দিই? আই স্ট্রংলি প্রোটেস্ট। আমি হেডমিস্ট্রেসকে কমপ্লেইন করব।

কমপ্লেইনের কথা শুনে পূর্ণিমা বিন্দুমাত্র ভয় পেলেন না। বললেন, মন্দ হয় না। ইংরেজি প্রশ্নটা একবার হাত বদল করে পরীক্ষা করা যেতে পারে। সত্যি সত্যি টিউশন মেয়েরা ভালো না, অন্যরা?

আপনার বাংলাটা তা হলে করতে হবে।

দেবলীনা মুচকি হেসে বলল, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে লাভ কী? স্কুলে মারধর বন্ধ করে ঠিক হয়েছে। লেখাপড়া করতে আসা ছেলেমেয়েদের কান্না বন্ধ করাটা জরুরি। কিন্তু টিউশনের অত্যাচার বন্ধ করতে তাদের বাবা-মায়ের কান্না বন্ধ করাটাও কম জরুরি নয়। যে কান্না দেখা যায় সেটা নিয়ে আমরা লাফালাফি করছি, যেটা দেখা যায় না সেটার ব্যাপারে চুপ করে থাকাটাও সমর্থনযোগ্য নয়।

রাজলক্ষ্মী বললেন, লেকচার তো অনেক হল, আসল কালপ্রিট কোথায়? শ্রীমতী যামিনী চট্টোপাধ্যায়?

স্কুলে ঢুকতেই হেডমিস্ট্রেস যামিনীকে ঘরে ডেকে নিলেন। তার আগেই মোবাইলে ধরে ঘটনা জানিয়ে দিয়েছে বিশাখা।

বিষয়টা খুব সিরিয়াস জায়গায় চলে গেছে। প্লিজ যামিনীদি, বড়দির সঙ্গে একদম রাগারাগি করবে না। ওই মেয়ের বাবা-মা এসে শাসিয়ে গেছে। যে করেই হোক একটা মিটমাট করতে হবে। ছোটখাটো গোলমালে জড়িয়ে পড়লে এখন মুশকিল, মনে রেখো তোমার সামনে অনেক বড় সমস্যা। বড়দি কিন্তু চাইবে ব্যাপারটা নিয়ে ঘোঁট পাকাতে।

হেডমিস্ট্রেসের সামনে যামিনী মাথা নামিয়ে বসে রইল। বিশাখা ঠিক বলছে, বিষয়টা মিটিয়ে ফেলতে হবে। ওই ভাবে মারধর ঠিক হয়নি। নিজের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে খানিকটা শান্ত ভাব এসেছিল। আবার নতুন করে গোলমাল শুরু হয়েছে। সবথেকে বড় কথা হল চাকরিটা তো বাঁচাতে হবে। হিন্দোলের খবর যদি সত্যি হয় তা হলে আরও বেশি রক্ষা করতে হবে।

খানিকটা ক্ষমা চাওয়ার ঢঙেই যামিনী বলল, আমার মনমেজাজ ঠিক ছিল না ম্যাডাম।

মায়াদি কঠিন গলায় বললেন, আমি জানি, তোমার মেজাজ ঠিক থাকার কথাও নয়, তোমার পারিবারিক সমস্যা আছে। কিন্তু বাইরের লোক তো আর সেটা বুঝবে না। তারা মেয়েকে স্কুলে পড়তে পাঠায়, মার খেতে পাঠায়নি।

ওইভাবে মারাটা আমার ঠিক হয়নি। পরে আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল। মেয়েটাকে আমি এইটুকু বয়স থেকে দেখছি।

হেডমিস্ট্রেস ভেবেছিলেন যামিনী তার সঙ্গে ঝগড়াতে যাবে। ঊ্যাক ট্যাক করে কথা বলবে। এই মেয়ের সেদিকে ঝোঁক বাড়ছে। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সবসময় যেন একটা হীনমন্যতায় ভোগে। সাধারণ কথাতেও আপত্তি তোলে। মাস কয়েক আগেই ঘরে এসে রুটিন নিয়ে ঝামেলা করে গেছে। অন্য কোনও ঘটনা হলে এই মেয়েকে বেশ খানিকটা প্যাঁচে ফেলা যেত। নাকের জলে চোখের জলে করে তবে ছাড়া যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে খুব একটা কিছু করা যাবে না। ছাত্রছাত্রীকে মারধোরের ব্যাপারে আজকাল আইনকানুন খুব শক্ত হয়েছে। ঘটনাটা নিয়ে যামিনীর বিরুদ্ধে বেশি প্যাঁচ কষতে গেলে জল অনেকদুর গড়াবে। পত্রপত্রিকা এসে যেতে পারে। তখন হেডমিস্ট্রেসও ছাড় পাবে না। পাশাপাশি অন্য টিচাররাও জল ঘোলা করতে শুরু করবে। এরা একবার জল ঘোলা করতে পারলে আর কিছু চায় না। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব জিনিসটা মিটিয়ে ফেলতে হবে। তবে একেবারে ছেড়ে দেওয়াও যায় না। যামিনী চট্টোপাধ্যায়কে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। যাতে ভবিষ্যতে বেশি টা-ফুঁ না করে। ও সারেন্ডার করেছে। তার মানে ভয় পেয়েছে। এটাই সময়।

শুধু নিজের খারাপ লাগলে তো হবে না যামিনী, একটা কিছু করতে হবে।

যামিনী মুখ তুলে বলল, কী করব বলুন।

মায়াদি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একটা কাজ করলে কেমন হয়, আজ সন্ধেবেলা আমরা কয়েকজন টিচার যদি ওই মেয়ের বাড়ি যাই? তুমিও যাবে।

তারপর?

মায়াদি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, তারপর আর কী, তুমি বলবে তুমি অনুতপ্ত। তোমারও খারাপ লাগছে। এই যেমন আমাকে বললে আর কী।

যামিনী মুখ তুলে শান্ত গলায় বলল, ছাত্রীর পা ধরে ক্ষমা চাইতে বলছেন?

হেডমিস্ট্রেস স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, দরকার হলে তাই চাইতে হবে যামিনী। এখন স্টুডেন্টদের গায়ে হাত তুললে কী হয় তুমি বোধহয় জানো না। ওরা যদি থানায় নালিশ করে আগে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। অবশ্য তুমি যদি মনে করো, মিটমাট না করে লকআপে রাত কাটাবে সে তোমার ব্যাপার। স্কুল বোর্ড তো সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সাসপেনশন অর্ডার ধরাতে বলবে। আমি একদিন, খুব বেশি হলে দুদিন ঠেকাতে পারব, তার বেশি তো নয়। এনকোয়ারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাইনেটাও আটকে যাবে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যদি চাও সেই প্রক্রিয়ায় যেতে পারো। তা ছাড়া আরও আছে। ঠোঁটের ফাঁকে নিষ্ঠুর হাসলেন মায়াদি। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, তোমার কলিগরাই পত্রিকাওলাদের খবর দেবে। যে সময় পুলিশ তোমায় অ্যারেস্ট করতে তোমার বাড়িতে যাবে সেইসময় ক্যামেরা হাতে ফটোগ্রাফার পৌঁছে যাবে। পরদিন কাগজে ফটো উঠবে তুমি পুলিশের জিপে উঠছ। আমি জাস্ট কী কী ঘটতে পারে অনুমান করে বললাম। পরে বলতে পারবে না, আমি সতর্ক করে দিইনি। আমি আমার ডিউটি করলাম, আমার টিচারদের মান-সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আমার।

যামিনীর চোখ ফেটে জল আসছে। ঠোঁট কামড়ে বলল, আমি ওই মেয়ের বাড়ি যাব। আপনাকে যেতে হবে না, আমি একাই যাব।

মায়াদি চেয়ারে হেলান দিয়ে জয়ের হাসি হাসলেন। বললেন, গুড, কিন্তু একা যাওয়াটা ঠিক হবে না, ওরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আছে। আমাকেও রেসপনসিবিলিটি নিতে হবে। তুমি ওই মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাওয়া পর, আমি ওর বাবা মায়ের কাছে দুঃখপ্রকাশ করব।

যামিনী বলল, আসলে আপনি চাইছেন আমি যেন আরও পাঁচজন টিচারের সামনে মেয়েটির হাতে-পায়ে ধরি তাই তো? আমার অপমানটা ওরাও দেখে আসুক, পরে যেন সবাইকে রসিয়ে গল্প করতে পারে। ঠিক আছে, তাই হবে। একটা ভুল যখন করে ফেলেছি, শাস্তি তো পেতেই হবে। চলুন, কাকে কাকে নেবেন ঠিক করে নিন।

ঘটনার মিটমাট হল খুব আশ্চর্য ভাবে। একেবারে নাটকের মতো!

ক্ষমা চাইতে হল না যামিনীকে। দরজা খুলে যামিনীকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল ছাত্রী।

মিস আপনি!

যামিনী তার কাঁধে হাত রেখে বলল, তোর কাছে এসেছি।

খুব বেশি হলে মুহূর্তখানেক সময় লাগল। মেয়েটি হাউ হাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরল যামিনীকে। এই দৃশ্যের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। না যামিনী, না হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে আসা আরও তিন টিচার। যামিনীও চোখের জল মুছে মেয়েটির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল পরম স্নেহে। ক্ষমা চাইল মেয়ের মা। বলল, রাগের মাথায় আপনার নামে খারাপ কথা বলে এসেছি, আপনি কিছু মনে করবেন না দিদি।

দ্বিতীয় গোলমালটা যামিনীদের বাড়ি সংক্রান্ত।

এই শহরে দেবনাথ মোট তিনবার বাড়ি বদল করেছে। শেষ পর্যন্ত এই বাড়িতেই থিতু হয়। বাড়িটা সবদিক থেকে সুবিধের। দোতলা, কিন্তু ছড়ানো। একতলায় মোট তিনটে ঘর। বসা খাওয়ার জায়গা আলাদা। দক্ষিণে মাঝারি একটা বারান্দাও আছে। দোতলায় থাকেন বাড়িওলা জানকীবাবু। বিপত্নীক, ছেলেপুলেও নেই। একাই থাকেন। বাড়ি নেওয়ার সময়েই ভদ্রলোকের বয়স ছিল পঞ্চান্নছাপ্পান্ন। এখন আরও পাঁচটা বছর বেড়ে গেছে। ভাড়া নেওয়ার সময় দেবনাথ খোঁজখবর নিয়েছিল। ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেকটা সময় একলা থাকবে যামিনী। পাড়ার সবাই এককথায় বলল, বাড়িওলা খুব ভালো মানুষ। অল্পদিনেই বোঝা গিয়েছিল, সত্যি তাই। মানুষটা ভদ্রলোক। আর পাঁচটা খিটখিটে বাড়িওলার মতো নয়। কোনও ঝামেলা করেননি কখনও। একটার বেশি দুটো কথা বলতে চাইতেন না। মুখোমুখি হলে শুধু মৃদু হেসে, মাথা নাড়তেন। দেবনাথের ঘটনার পর হাসিটাও বন্ধ করে দিলেন। যামিনীর সঙ্গে দেখা হলে মাথা নামিয়ে নিতেন। নীচু গলায় বলতেন, কোনও দরকার হলে আমাকে বলবেন। আমার এক শালা পুলিশে কাজ করে, যদি মনে করেন…। আমি জানি আপনারা সব ব্যবস্থাই করছেন…তবু যদি..। বলার মধ্যেও কুণ্ঠা, যেন অনধিকারচর্চা না হয়। কখনওই অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাননি ভদ্রলোক। দুটো সহানুভূতির কথা বলতে নেমে আসেননি একতলায়। হঠাৎ শুনলে মনে হবে, এ কেমন মানুষ! বাড়ির নীচেই এতবড় একটা ঘটনা ঘটছে, কোনও তাপ উত্তাপ নেই! কিন্তু যামিনীরা খুশি হয়েছিল। একজনের কাছ থেকে অন্তত রেহাই পাওয়া গেছে। সহানুভূতি, করুণা, পরামর্শের ধাক্কায় তারা বিপর্যস্ত। একদিন দুদিন নয়, বছরের পর বছর চেনা অচেনা মানুষ প্রশ্নে প্রশ্নে অতিষ্ঠ করে তুলেছে

কী হয়েছিল? বাড়িতে ঝগড়া? ব্যাগ সুটকেস সঙ্গে নিয়েছে? নাকি ঝাড়া হাত-পায়ে গেল? শুনলাম মোবাইল ফোনটা নাকি ফেলে গেছে? সত্যি নাকি? আত্মীয়দের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছ? বাইরে কোথাও রাগারাগি ছিল না তো? গোপনে ব্যবসাট্যাবসা করত কিছু? পার্টনার ছিল? দিনকাল খুব খারাপ। কাগজে কত কী পড়ি। সামান্য রাগ থেকে বন্ধুতে বন্ধুতে খুনোখুনি পর্যন্ত হচ্ছে। আচ্ছা, ধার-দেনা করেনি তো? অনেকে আবার ওতে ঘাবড়ে যায়। ভয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে।

জানকীবাবু বোধহয় একমাত্র মানুষ যিনি কোনও প্রশ্ন করতেন না। একটা সময় পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া নিজের হাতে দিয়ে আসত যামিনী। জানকীবাবু ব্যস্ত হয়ে বলতেন, অসুবিধে থাকলে পরে না হয় দিতে।

যামিনী বলত, অসুবিধে নিয়েই তো আছি দাদা। তবু চলতে তো হবে। আপনি টাকা রাখুন।

জানকীবাবু বিষণ্ণ গলায় বিড়বিড় করে বলতেন, কী যে হল…হঠাৎ কী যে হল..অমন সুন্দর মানুষটা…। লোকে যাই বলুক, আমি তো জানি কত সুখে ছিলে তোমরা…ফুটফুটে দুটো ছেলেমেয়ে…হইচই শুনতাম, হাসি শুনতাম…মাঝেমধ্যে কী মনে হয় জানো? মনে হয় সংসারের মায়া বড় কঠিন, বড় নির্মম, সেখানে সুখের থেকে দুঃখটাই বেশি।

যামিনী বুঝতে পারে মানুষটা তাঁর স্ত্রীর কথা মনে করছেন। সে নিজেও আবেগতাড়িত হত। ধরা গলায় বলত, আপনি একদিন এসে চা খেয়ে যাবেন।

ছি ছি, তোমাদের বিরক্ত করব! আমি তো কিছুই করতে পারি না। কোনও অসুবিধে হলে বলবে। ছেলেকে পাঠিয়ে দিও।

বছর তিন যামিনী নিশ্চিন্তে ছিল। এরকম একটা সময় ছেলেময়ে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাটা খুব জরুরি। দেবনাথের দাদা ঘটনার পর থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। দু-চারদিন এসেছিল, বউদি ফোন করেছিল বারকয়েক, ব্যস সেখানেই শেষ। তারপর আত্মীয়স্বজনকে বলে বেড়াতে লাগল, আমরা বুঝেছি আসলে যামিনীরই গোলমাল। ওর জন্যই দেবনাথ ঘর ছেড়েছে। পুলিশ দু-ঘা দিলে সব বেরিয়ে আসবে। পিছনে আর একটা কেউ আছে। শোনা যায়, ওরা পুলিশের কাছে কমপ্লেইনও করতে গিয়েছিল। পুলিশ তাড়িয়ে দেয়। এসব শুনে যামিনী কিছু মনে করেনি, এছাড়া ওদের উপায়টা বা কী ছিল? নইলে গোটা পরিবারটাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে তুলতে হত। ভাইয়ের খোঁজে কাজকর্ম শিকেয় তুলে ছোটাছুটি করতে হত সর্বক্ষণ। এই ঝামেলা কাঁধে নেওয়া থেকে দোষ দেখিয়ে সরে যাওয়া অনেক বুদ্ধিমানের। এর ফাঁকে পৈতৃক বাড়িটা যদি বিক্রি করা যায় তা হলে একাই টাকাটা ভোগ করা যাবে। সে করুক। দেবনাথকে খুঁজে বের করা ছাড়া অন্য কিছুই মাথায় রাখেনি যামিনী। শুধু বুঝেছিল নিজেদের আশ্রয় নিজেরাই জোগাড় করতে হবে। সেদিক থেকে এই বাড়িই সবথেকে সুবিধেজনক।

কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা শুরু হল পরে। জানকীবাবু রিটায়ার করে বাড়িতে বসে যাওয়ার পর। তখন নীলাদ্রি সবে কাজে ঢুকেছে। মাঝেমধ্যেই ভাড়ার টাকা ওপরে দিতে যেত কিঙ্কিনি। যামিনী স্কুলে যাওয়ার সময় মেয়ের হাতে খাম দিয়ে বলত, একসময় ওপরে গিয়ে দিয়ে আসবি।

এক সন্ধেবেলায় যামিনী স্কুল থেকে ফেরার পর কিঙ্কিনি বলল, আর আমাকে পাঠাবে না।

যামিনী অবাক হয়ে বলল, কেন!

এমনি, আমার ভালো লাগে না।

যামিনী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ভালো লাগে না মানে, এইটুকু দায়িত্ব নিতে পারবে না? শুধু খাবে দাবে আর ঘুরে বেড়াবে? নীচ থেকে ওপরে যেতেও কষ্ট হয়!

কিঙ্কিনি তার মায়ের দিকে মুখ তুলে বলেছিল, জানকীকাকু লোকটা ভালো নয়।

ভালো নয় মানে! ছি ছি, এসব কী বলছ কিঙ্কি! ওঁর মতো মানুষ চট করে পাওয়া যাবে না। বাড়িওলারা কেমন হয় তুমি জানো না। এই মানুষটা কোনওদিন ঝামেলা করেননি। তোমার বাবার ঘটনার পর অন্য যে কেউ হলে বলত বাড়ি ছাড়ুন। তা ছাড়া, তা ছাড়া দেখা হলে কী সুন্দর ব্যবহার করেন! বাড়তি একটা কথা পর্যন্ত বলেন না। অন্য যে কোনও পুরুষমানুষ হলে গায়ে পড়ত।

বাঃ, ভালো মানুষ খারাপ হয়ে যায় না? উনি তাই হয়েছেন, খারাপ হয়ে গেছেন।

যামিনী বলল, এ বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। নিশ্চয় তুমি কিছু ভুল বুঝেছ।

আমি এতদিন যাচ্ছি, হঠাৎ ভুল বুঝব কেন মা? আমি ভুল বুঝিনি। ঠান্ডা গলায় কিশোরী কিঙ্কিনি প্রতিবাদ করে।

যামিনী এবার বিচলিত হয়। ভুরু কুঁচকে বলল, কী হয়েছে?

আমি বলতে চাইছি না, তবু তুমি যখন জোরাজুরি করছ তখন বলেই ফেলি, আজ উনি আমার বুকের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন।

যামিনী চমকে উঠল, হঠাৎ এটা কীরকম কাজ করলেন জানকীবাবু! তবু হাত নাড়িয়ে সে বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে, এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই। যতই হোক উনি পুরুষমানুষ, বড় হচ্ছ এখন এরকম কিছু কিছু সমস্যা হবে। যেটা ছোট সমস্যা, সেটাকেও বড় বলে মনে হবে। আচ্ছা, তোমাকে আর ওপরে যেতে হবে না, এবার থেকে নীল ভাড়া দিয়ে আসবে।

কিঙ্কিনি বলল, আসলে কী জানো মা, মেয়েদের বুকের দিকে ছেলেরা তাকাবে এটা আমরা জেনে গেছি। এতে অবাক হই না, মাথাও ঘামাই না, কিন্তু যে মানুষটার তাকানোর কথা ছিল না, সে যদি এরকম করে তখন বড় গা ঘিনঘিন করে। তখন মনে হয়, মানুষটা খারাপ, একটু নয়, খুব বেশি খারাপ।

যামিনী উঠে পড়ল। এই বিষয়ে আর সে মেয়ের সঙ্গে কথা বাড়াতে চায় না। কত মানুষই তো যা করার নয়, তাই করে। দেবনাথের কি এভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল? সতর্ক থাকতে হবে। কিঙ্কিনি একা থাকে। সামান্য ঘটনায় হয়তো বেশি ভাবছে, তবু কিছু তো ঘটেছে। তাই-ই বা হবে কেন?

বহুদিন আর কিছু হল না। বরং দেখা হলে জানকীবাবু বিষণ্ণ মুখে মাথা নামিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন। যামিনীর মনে হয়েছিল, মানুষটা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাই লজ্জিত। তারপর একসময় ঘটনাটা ভুলেও গেল।

কাল রাতে বাড়ি ফিরে যামিনী দেখল, গেটের মুখে জানকীবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।

আপনি! যামিনী অবাক হল।

আপনার সঙ্গে কথা বলব বলেই অপেক্ষা করছি। জানকীবাবু নীচু গলায় বললেন।

যামিনী বলল, ছি ছি, এখানে কেন? ঘরে আসুন।

না না তার দরকার নেই। একটা কথা বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু না বলেও পারছি না। আপনারা এবার বাড়িটা ছেড়ে দিন যামিনীদেবী।

যামিনী অবাক হয়ে বলল, সে কী! কেন?

না, এমনি কিছু হয়নি।

যামিনী একটু এগিয়ে এসে বলল,  নিশ্চয় কিছু হয়েছে, কী হয়েছে? ভাড়া বাড়াবেন?

জানকীবাবু মাথা নামিয়ে বললেন, সেদিন আপনার মেয়ে ড্রাঙ্ক হয়ে বাড়ি ফিরেছে। রিকশা থেকে নামার সময় টলছিল। রাত বেশি হলেও পাড়ার কেউ কেউ দেখেছে।

যামিনীর মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। একটু চুপ করে থেকে বলল, তাতে আপনার কী সমস্যা?

জানকীবাবু মাথা নেড়ে একইরকম নীচু গলায় বললেন, না, তেমন কোনও সমস্যা নয়, কিন্তু বাড়িটা তো আমার, ছোট একটা মেয়ে মদ খেয়ে বাড়িতে ঢুকলে বাড়ির বদনাম হয়।

যামিনীর ইচ্ছে করল বলে, ছোট মেয়ের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে সমস্যা নেই, সে একদিন মদ খেলেই সমস্যা! চমৎকার তো! কিন্তু সেকথা বলল না।

আমার মেয়ের বিষয়টা আমাকেই বুঝতে দিন। দরকার হলে পাড়ার লোকদেরও কথাটা বলে দেবেন। আর শুনুন হুট বললেই তো বাড়ি ছাড়া যায় না। আমি শুনলাম, যেদিন অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করতে পারব নিশ্চয় চলে যাব।

জানকীবাবু দুঃখ পাওয়া গলায় বললেন, ব্যস তা হলেই হবে।

বাড়িওলার কথাটা কাউকেই বলেনি যামিনী। কী বলবে? তা হলে কিঙ্কিনির মদ খাওয়ার কথাটাও বলতে হয়। একটার পর একটা অপমানে সে যেন ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

ট্যুর থেকে ফিরতেই হিন্দোলের সঙ্গে কথা বলল যামিনী। দেবনাথের নতুন সংসারের ঠিকানা নেই। যাদবের সঙ্গে কথা বলে হিন্দোলই জোগাড় করে দিল। সাতাশ বাই তিন নম্বর শহিদ বলরাম কলোনি। বাস স্টপ থেকে রিকশা ধরতে হবে।

যামিনী বলল, মেয়েটার নাম কী?

হিন্দোল বলল, যাদব তো বলেছে মঞ্জু। না-ও হতে পারে, ওই ধরনের মেয়েরা ঘন ঘন নাম পালটায়।

আমরাও যাব। বিশাখা বলে।

যামিনী চোয়াল শক্ত করে বলল, না, এখানে আমি একাই যাব।

বিশাখা হিন্দোল চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। বিশাখা বলে, ঠিক আছে, আমরা বাড়িতে ঢুকব না, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। সঙ্গে পুলিশ নেওয়া যায় না?

হিন্দোল বিরক্ত গলায় বলল, খেপেছ? যাদব তার চোর ডাকাত স্মাগলার বন্ধুদের কাছ থেকে কী খবর এনেছে তার ঠিক নেই, আমরা একেবারে পুলিশ নিয়ে গিয়ে হাজির হব?

যামিনী ঠোঁটের কোনায় ব্যঙ্গের হেসে বলল, পুলিশ নিয়ে গিয়ে কী হবে? কী করবে? গোপনে আর একটা সংসার করেছে বলে, তোদের দেবনাথকে কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে আসবে? কাউকে লাগবে না। আমি একাই যাব, একদম একা। খবর যদি সত্যি হয়, শুধু জিগ্যেস করব, কেন আমাকে বলে এলে না? আমি কি বারণ করতাম?

মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠল যামিনী। বিশাখা মুখ ঘুরিয়ে নিল।

.

কলোনির পথটা আরও অপরিসর এবং নোংরা হয়ে একটা পুকুরের কাছে এসে পৌঁছল। পুকুর না বলে ডোবা বলাই ভালো। রিকশাচালক ঠিক বলেছে। ডোবাটাকে ঘিরে দুপাশে দুটো রাস্তা। বিশ্রী গন্ধটা বেড়ে নাকে এসে জোরে ধাক্কা মারল যামিনীর। গা পাক মেরে উঠল। শাড়ির আঁচল তুলে নাকে চেপে ধরল জোরে। ডোবার একপাশে আবর্জনার স্তূপ। প্রায় ছোটখাটো একটা টিবি হয়ে আছে। এঁটো শালপাতা, কাপড়ের টুকরো থেকে মদের শিশি। গন্ধ সেখান থেকেই আসছে। যামিনী থমকে দাঁড়াল। দুটো পথের কোনদিকে যাবে? আরও কিছুটা এগোতে যামিনী দেখতে পেল, ডোবার গায়ে ঘাটের মতো খানিকটা জায়গা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। বেশ কিছু মহিলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ কাপড় কাঁচছে, কেউ স্নান করছে, কেউ পা ছড়িয়ে বসে শুধু উঁচু গলায় কথাই বলে চলেছে। আড়াল আবডালের কোনও ব্যাপার নেই। একঝলক তাকিয়ে যামিনী বুঝল, আব্রু নিয়ে এরা চিন্তিত নয়। অনেকেই হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে রেখেছে, এমনকী থাই পর্যন্ত। বুকের কাপড় আলুথালু। বেশির ভাগেরই জামা নেই। জলে পা ডুবিয়ে খালি গায়ে সাবান ঘষছে। গামছার যেটুকু আড়াল বানিয়েছে সেটা না থাকারই মতো। আশপাশ দিয়ে যে দু-চারজন পুরুষ হেঁটে যাচ্ছে তারা মুখ ফিরিয়ে দেখছেও না। বোঝাই যাচ্ছে, এই দৃশ্যে তারা অভ্যস্ত। যামিনী কী করবে বুঝতে পারছে না। এই পরিবেশ সে কখনও দেখেনি। এই পরিবেশে কী করা উচিত সে জানে না। এটা কি মর্গের থেকেও খারাপ কোনও জায়গা? এক মহিলা চিৎকার করে বলল, ওই মাগিকে একদিন দেখে নেব আমি। ঠিক দেখে নেব। কতদিন বাবু দেখিয়ে ফুটানি করবে? খানকি পাড়ায় বেইমানি করার শাস্তি হাড়ে হাড়ে টের পাবে। নেংটা হয়ে জুতো মুখে এই পুকুরপাড়ে ঘুরতে হবে শালিকে, নইলে তোরা মালতীর নামে কুকুর পুষিস, এই বলে রাখলাম, হ্যাঁ।

যামিনীর ইচ্ছে করল কানে হাত চাপা দিতে। দ্রুত নিজেকে সামলালো। কীসের সঙ্কোচ? জেনেশুনেই তো সে এখানে এসেছে। যামিনী মন শক্ত করে এগিয়ে গেল।

ভাই, সাতাশ বাই তিন নম্বরটা কোনদিকে বলতে পারেন?

অচেনা গলা পেয়ে মহিলাদের কয়েকজন মুখ তুলে তাকাল।

০৮. একটা রিভলভার

০৮.

আমাকে একটা রিভলভার জোগাড় করে দিবি?

কেন?

আমি একজনকে খুন করব।

ওরে বাবা, কাকে খুন করবি?

বলব না।

আমাকে নয় তো?

হতে পারে। ঠিক বুঝতে পারছি না।

কিঙ্কিনি সোফার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে আছে। সে পরে আছে জিনস আর টপ। টপটা উঠে গিয়ে কিঙ্কিনির পেটের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। কিঙ্কিনির সেদিকে মন নেই। তার পা দুটো সোফার হাতলের ওপর তোলা। হাতে একটা নেল কাটার। আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে নখের পরিচর্যা করছে।

একই সোফার গায়ে হেলান দিতে মেঝেতে বসে আছে বৈদর্ভী। হাঁটু দুটো ভাজ করে বুকের কাছে রেখেছে। হাফ প্যান্ট আর টি শার্টে তাকে আজ যেন বেশি ছিপছিপে লাগছে। বৈদর্ভীর এই ঘরে দুটো জানলা। দুটোতেই পরদা টানা। আলোও জ্বলছে না। ফলে এই কড়া রোদের দুপুরেও ঘর বেশ অন্ধকার। এই অন্ধকারেও কিঙ্কিনি কী করে যে নখ পরিচর্যা করছে। সেটা একটা বিস্ময়। ঘর শুধু অন্ধকার নয়। ঘরে প্রচুর ধোঁয়া আর কটু গন্ধ। গন্ধটা গাঁজার। একটু আগেই কিঙ্কিনি আর বৈদর্ভী একটা গাঁজা ভরা সিগারেট ভাগ করে খেয়েছে। সকালে বৈদর্ভী কিঙ্কিনিকে ফোন করে বলল, কিঙ্কিনি, আজ আমাদের বাড়িতে দুপুরে চলে আয়। বাবা মা কেউ থাকছে না। ওরা কলকাতায় যাবে, ফিরতে রাত।

কিঙ্কিনি তখনও বিছানায় ছিল। জড়ানো গলায় বলল, গিয়ে কী হবে?

সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেব। কম্পিউটারে ভালো ভালো জিনিস দেখব। একটা সাইটে হলিউডের হিরো হিরোইনদের নেংটুপুঁংটো ফটো আছে। বাবা-মা থাকলে তো দরজা আটকেও দেখতে পারি না। সন্দেহ করে। আজ প্রাণ খুলে দেখব।

কিঙ্কিনি পাশ বালিশ জড়িয়ে বলল, দুর হলিউড দেখতে তোর বাড়িতে কষ্ট করে যাব কেন? আমারই তো নেট আছে।

বৈদর্ভী কাতর গলায় বলল, কেন আয় না বাবা, সবাই মিলে হইচই হবে।

কিঙ্কিনি হাই তুলে বলল, আমাকে ছাড়া হইচই কর। আজ আমি দুপুরে বাড়ি থেকে বেরোব না। হায়ার সেকেন্ডারির পর বিছানা থেকে না নামবার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। অথচ দেখ একদিনও ভালো করে শুতে পারছি না।

বৈদর্ভী এবার প্রায় কেঁদে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, তুই না এলে প্রোগ্রাম ক্যানসেল। কাউকে ডাকব না।

কিঙ্কিনি তড়াক করে লাফ দিয়ে বসল। চাপা গলায় বলল, সেটাই ভালো। কাউকে ডাকতে হবে না। শুধু তুই আর আমি।

বৈদর্ভী একটু চুপ করে থেকে গাঢ় গলায় বলল, মিথ্যে বলছিস না তো কিনি?

না, সত্যি বলছি। কিন্তু ওয়ান কন্ডিশন। একটা জিনিস খাওয়াতে হবে।

কী? বৈদর্ভী উগ্রীব হয়ে বলল, কী খাবি?

কিঙ্কিনি মুখ ফিরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, মদ খাওয়াতে হবে, ভদকা। পাতি লেবুর রস দিয়ে খাব; দোয়েল সেদিন বলল না, ওর বাবা খায়। ওরকমভাবে খাব। খাওয়াবি কিনা বল।

বাপরে তুই তো দেখছিস বিরাট মদখোর হয়ে গেছিস! একদিন খেয়েই নেশায় পড়ে গেলি?

ইয়ার্কি না, তুই অ্যারেঞ্জ করতে পারবি কিনা বল। কিঙ্কিনির গলায় উত্তেজনা। বলল, মদ খাওয়ার পর…।

বৈদর্ভী বলল, খাওয়ার পর কী?

কিঙ্কিনি হেসে বলল, জানো না কী। ন্যাকা?

বৈদর্ভী হেসে বলল, তোর দেখছি একদিনেই ভালো সবকটা জিনিসে নেশা ধরেছে। যাক তুই চলে আয়, আমি শিবুকে দিয়ে ব্যবস্থা করে রাখছি।

কপাল কুঁচকি কিঙ্কিনি বলল, শিবুটা আবার কে? একে কোথা থেকে জোটালি?

বৈদর্ভী মুখ দিয়ে বিদ্রুপের আওয়াজ করে বলল, আমি কি তোদের মতো শুধু গুডবয় আর গুডগার্লদের সঙ্গে থাকি? ব্যাডদের সঙ্গেও আমার দোস্তি রয়েছে। রেলগেটের ঠেকে যাতায়াত আছে শিবুর। আমি তো আর দোকানে ঢুকে মদ কিনতে পারব না। ওই-ই এনে দেবে।

শিবু মদ আনেনি। সে বৈদর্ভীকে দিয়ে গেছে কতগুলো গাঁজাভরা সিগারেট। বলেছে, বাড়িতে মদ খেলে ঝামেলায় পড়ে যাবে দিদিভাই। মাসিমা, মেসোমশাই এসে ঠিক গন্ধ পাবে। তার থেকে এই জিনিস নাও। কোন ঝুট ঝামেলা নেই, টানার পর অ্যাসট্রে ঝেড়ে ফেলে দেবে। অথচ নেশা ডবল।

সবে একটা করে সিগারেট খাওয়া হয়েছে। প্রথম কটা টানে কাশি হয়েছে বেশি। আদ্দেক ধোঁয়াই নাক-মুখ দিয়ে ফসকে গেছে। পরের দিকে বৈদর্ভী, কিঙ্কিনি দুজনেই ম্যানেজ করেছে। নেশা ডবল না হাফ বোঝা না গেলেও, বেশ একটা ঝিম ভাব এসেছে।

বৈদর্ভীর সামনে টিভি চলছে। তবে কোনও চ্যানেলই কয়েক সেকেন্ডের বেশি স্থির নয়। কারণ বৈদর্ভী ক্রমাগত রিমোট সার্ফ করে যাচ্ছে। একটা চ্যানেলে বৈদর্ভী থমকে গেল। হিন্দি সিনেমার নাচ গান। টিভির ভলুম কম থাকায় গান তেমন করে শোনা যাচ্ছে না। ফিসফিসানির মতো লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে বৈদর্ভী বলল, তোর হঠাৎ খুনের ইচ্ছে মাথায় চাপল কেন কিনি?

হঠাৎ কেন চাপবে? অনেকদিন ধরেই প্ল্যান করছি। সেই ছোটবেলা থেকে। আজ তোকে বলে ফেললাম।

রিভলভার দিয়েই খুন করতে হবে? অন্য কিছু দিয়ে হবে না? এই ধর ছুরি বা বিষ?

কিঙ্কিনি বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের নখ ঘষতে ঘষতে বলল, জানি না। এমনভাবে বলছিস যেন আগেও আমি খুন করেছি আর খুনের ওয়েপন বিষয়ে আমার বিরাট এক্সপিরিয়েন্স আছে। রিভলভার দিয়ে মারলে একটা প্রেস্টিজ হয় তাই রিভলভার বললাম। বিষটি কেমন হেঁদো ব্যাপার। পুলিশ যখন আমাকে ধরে নিয়ে যাবে কাগজে ফটো বেরোবে, আমার হাতে রিভলভার। হি হি।

চ্যানেল বদলাতে লাগল বৈদর্ভী। খবরের চ্যানেলে এসে আটকে গেল। কোথাও গোলমাল হয়েছে। পরদায় ছবি দেখাচ্ছে। বাসে আগুন জ্বলছে। ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। কোথায় গোলমাল? নিশ্চয়ই কলকাতার কোনও কলেজে। কলেজগুলোতে আজকাল রোজ গোলমাল হয়। ভাগ্যিস সে কলকাতায় থাকে না। গোলমালে পড়তে হত। পা দুটো সামনের দিকে মেলে দিল বৈদর্ভী। মাথাটা হালকা টাল খেল। না, শিবু ব্যবস্থাটা ভালোই করেছে। জল, গেলাস, পাতিলেবুর রস কিছুই দরকার হল না। মদ খেলে সত্যি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যেত। এতে সে সমস্যা নেই। একটু পরে জানলা দরজা খুলে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দিলেই হবে। রুম স্প্রে, ধূপ তো আছেই। ঘরটা অন্ধকার করায় ঝিম ভাবটা বেশি লাগছে।

কাকে খুন করবি সে তো বলবি না, কিন্তু কেন করবি সেটা কি জানতে পারি?

কিঙ্কিনি বলল, আসলে কী জানিস বৈদর্ভী, যাকে খুন করব ভাবি তার নাম রোজই বদলে বদলে যাচ্ছে।

বৈদর্ভী হেসে ফেলল। বলল, মানে? খুনি ঠিক আছে কিন্তু টার্গেট পালটাচ্ছে?

অনেকটা তাই, এই ধর আজ তোকে খুন করতে ইচ্ছে, কাল মনে হচ্ছে, তোকে নয়, শিবুটাকে মারলে ঠিক হবে। হারামজাদাটা আমাদের একটা বাজে নেশা ধরিয়ে দিতে চাইছে। দেখবি ওই ছেলে নিজে গাঁজার পুরিয়া বেচে। তবে জিনিসটা কাজ করছে ভালো।

আর আমাকে? আমাকে কেন খুন করতে ইচ্ছে করবে?

কিঙ্কিনি উঠে বসল। মনে হচ্ছে এবার সে পায়ের নখ নিয়ে পড়বে।

তুই খুব বিশ্রী একটা কাজে আমাকে জড়িয়ে ফেলেছিস। যদিও পুরো দোষটা তোর নয়। আমি ইচ্ছে করে খারাপ হব ভেবে ঝাঁপ দিয়েছিলাম, তারপর দেখলাম ব্যাপারটা মন্দ নয়। জীবনে ছেলেদের যত কম লাগে তত ভালো। এখন থেকেই জানা রইল।

বৈদর্ভী চ্যানেল বদলাল। হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটা ধুমসো চেহারার পুরুষ মানুষ গান। করছে। জঘন্য। টিভি বন্ধ করে দিল বৈদর্ভী। ঘরটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল। পাশে সেন্টার। টেবিলে সিগারেটগুলো সাজানো হয়েছে। একটা নিয়ে দেশলাই জ্বালালো বৈদর্ভী। লম্বা টান দিল চোখ বুজে। কাশি একটু হল বটে, তবে আগের তুলনায় কম। কিঙ্কিনি না খেলেও, আগে বেশ কয়েকবার সিগারেট খেয়েছে বৈদর্ভী। সিগারেটের ধোঁয়ায় তার অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এই ধোঁয়াটায় একটা জ্বালা ভাব আছে। কিঙ্কিনি ঝুঁকে পড়ে বৈদর্ভীর হাত থেকে সিগারেটটা নিল। পরপর দুটো টান দিল চৌখস কায়দায়। নাক মুখ দিয়ে ঘন ধোঁয়া ছাড়ল গল গল করে।

বৈদর্ভী বলল, বাঃ ওস্তাদ হয়ে গেছিস!

দেখছি খারাপ জিনিসগুলো রপ্ত করতে বেশি সময় লাগছে না। ঘূর্ণীর পারফরমেন্স নিশ্চয়ই তোর মনে আছে।

আজ দেখব ইমপ্রুভ করেছিস কিনা। চোখ নাচিয়ে বলল বৈদর্ভী।

মনে হয় করব। সহজ গলায় বলল কিঙ্কিনি।

বৈদর্ভী সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অ্যাশট্রের মধ্যে গুঁজে দিল। হেসে বলল, তা হলে আর দেরি করে লাভ কী? তুই যেভাবে মার্ডারের প্ল্যান করছিস তাতে কখন গলা টিপে ধরবি তার ঠিক নেই।

কিঙ্কিনি সত্যি সত্যি এবার পায়ের নখ নিয়ে পড়ল। মাথাটা ঘুরছে। মাথা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল, তুই তো বাদ পড়ে গেছিস। বললাম না? আমার একজন যায় একজন। আসে। অথবা বলতে পারিস আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে পড়ি। বুঝতে পারি না কাকে মারলে ঠিক হবে।

তোর নেশা হয়ে গেছে কিনি। তুই আর খাস না। শেষে সেদিনকার মতো কাণ্ড করবি।

কিঙ্কিনি বুঝতে পারল বৈদর্ভী ঠিকই বলছে। তার নেশা হয়ে গেছে। বেশ লাগছে। কেমন যেন নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।

বুঝলি বৈদর্ভী, একটা বয়স পর্যন্ত খুনের জন্য অনেকগুলো নাম মাথায় ঘুরত। কখনও মনে হত, হাতের কাছে পেলে আমার আমেরিকা প্রবাসী মামাকে খুন করব। তার দিদির এতবড় একটা শোকের সময়ে সে একবারও আসেনি। শুনেছিলাম, মাকে নাকি বলেছিল, জামাইবাবু যখন চলে গেছেন তখন তাকে যেতে দাও। লেট হিম গো। এটা নিয়ে বেশি সময় নষ্ট কোরো না। ধরে নাও হি ইজ ডেড। ধরে নাও ইটস আ কেস অব ডিভোর্স। বরং আমি তোমাদের কিছু ডলার পাঠাচ্ছি ফর আ নিউ বিগিনিং। দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ভুলে নতুন করে শুরু কর। তারপর থেকেই মামাকে ঠিক কপালের মাঝখানে গুলি করে মারার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

বৈদর্ভী মেঝে থেকে উঠে পাশের সোফাটায় বসল। চোখ বড় করে বলল, মামাকে খুন করবি! বলিস কীরে কিঙ্কি!

কিঙ্কিনি হাসল। বলল, কিছুদিনের মধ্যেই মামাকে ক্ষমা করে দিলাম। দেখলাম আরও বড় ক্রিমিনাল আছে। তারা হল আমার জেঠা আর জেঠিমা। খুন যদি করতে হয় এদের করাই উচিত। ওরা বলে বেড়াত বাবার হারিয়ে যাওয়ার জন্য আমরাই নাকি দায়ী। দাদা একদিন জেঠুকে ফোন করেছিল। প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলেন জেঠিমা। ভেবে দেখ বৈদর্ভী, ওইরকম ভয়ঙ্কর সময়ে…যাক এরাও আমার লিস্ট থেকে বাদ পড়ে গেল। এলেন অর্ধেন্দু দত্ত।

অর্ধেন্দু দত্ত! সেটা আবার কে?

বৈদর্ভী সবটা যে বুঝতে পারছে এমন নয়। কিন্তু না শুনে পারছেও না। বাবার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কিঙ্কিনি কখনওই বন্ধুদের কাছে কিছু বলে না। যে পাঁচ-ছজন কাছাকাছির বন্ধু তারা এই প্রসঙ্গ তুলতে চায় না। কম্পিউটার ক্লাসে ভরতি হওয়ার পর অনীক একবার বলেছিল, কিঙ্কিনি, একটা কথা বলব কিছু মনে করবি না তো? অনীকের সঙ্গে সৌগত, সৌম্য শুভমও ছিল।

কিঙ্কিনি হেসে বলেছিল, তোরা যদি কিছু মনে না করিস আমি করব কেন?

সৌগত বললে, শুনলাম তোর বাবা নাকি…।

কিঙ্কিনি সাইকেলে উঠতে উঠতে সহজভাবে বলেছিল, ঠিকই শুনেছিস। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

সৌম্য ফট করে বলে বসল, কেন?

কিঙ্কিনি সাইকেলের ঘন্টিটা দুবার বাজিয়ে বলল, মানুষ কেন সংসার ছেড়ে চলে যায়। সে কি কেউ বলতে পারে রে? গৌতম বুদ্ধর কথাই ধর না, তিনিও তো স্ত্রী পুত্র রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কেন কেউ কি জানে? ভাবছি আর কটা দিন অপেক্ষা করব, তারপর বাবার নামে গাছের তলায় একটা বেদি বানাব। বলব, আমাদের পিতা সংসার ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং এই স্থানে আসিয়া মোক্ষ লাভের হেতু ধ্যান করিয়াছিলেন। তোরা মাঝেমাঝে বেদির কাছে গিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়াবি। পারবি না? হি হি।

এরপর অনীকরা আর কখনও কিঙ্কিনির বাবা সম্পর্কিত কোনও প্রশ্নের মধ্যে যায়নি। কিঙ্কিনিও বলেনি। আজ বহুদিন পরে সে অনেক কথা বলছে।

অর্ধেন্দু দত্ত আমার হারিয়ে যাওয়া বাবার অফিসের কলিগ। ইউনিয়নের নেতা। অসহায় পরিবারকে সাহায্য এবং সহযোগিতা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং মায়ের হাতটা খপ করে চেপে ধরলেন। চেপে ধরারই কথা। সেই সময় মায়ের হাত সুন্দর ছিল। বহুদিন পর্যন্ত উনি স্বাস্থ্য ধরে রেখেছিলেন। যাই হোক, সেই অর্ধেন্দু দত্ত বাড়িতে আসতে লাগলেন, গভীর রাতে ফোন করলেন, মা সেজেগুজে বেরোতে লাগল। বেশ লাটুস পুটুস চলতে লাগল। আমি সিওর, কেসটা আরও দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আমি তো ভেবেছিলাম, একটা বাবা গেছে আর একটা বাবা এসে গেল। হি হি। ঠিক করলাম মা বিয়ে করলেই নতুন বাবাকে পেটে গুলি করে। মারব। যাক, সেও গেল। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক কাটল। ও এর মধ্যে আরও একজনকেও মারবার। প্ল্যান করেছিলাম রে।

বৈদর্ভী বলল, সত্যি তোর মাথাটা আজ গেছে।

বৈদর্ভী হাত বাড়িয়ে শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল। টান দিয়ে এগিয়ে গেল কিঙ্কিনির দিকে। কিঙ্কিনি নখের পরিচর্যা বন্ধ করেছে। মাথা যেভাবে টলটল করছে তাতে বকবকানি ছাড়া আর কিছু করা অসম্ভব।

একবার আমাদের বাড়িওলা লোকটা আমার সঙ্গে খুব খারাপ একটা কাজ করল।

কে? জানকীকাকু? সে কী! উনি তো ভালোমানুষ বলেই জানি। বৈদর্ভী অবাক হল।

মুখ ভরতি ধোঁয়া নিয়েই কিঙ্কিনি হাসল। বলল, আমরাও তাই জানতাম। ভালোমানুষ। হি হি। পছন্দও করতাম। একদিন মা আমাকে ভাড়া দিতে ওপরে পাঠাল। আগেও বহুবার গেছি। উনি বেশি কথা বলতেন না। বাবার কথা তো একেবারেই না। সেই কারণেই ভালো লাগত। সেদিন দরজা খোলার পর আমি ভেতরে ঢুকে খামটা দিতেই উনি ফট করে হাত বাড়িয়ে আমার বুকটা ধরলেন। ধরেই রাখলেন। ঘটনাটা আমার কাছে এত আকস্মিক ছিল যে আমি চিৎকার করতে পারিনি। ছুটে নেমে এসেছিলাম একতলায়। বাড়িতে কেউ ছিল না। দরজা আটকে থরথর করে কেঁপেছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভেবেছিলাম মাকে বলে দেব। পরে দেখলাম, একটা ভয়ঙ্কর। সমস্যার মধ্যে দুমড়েমুচড়ে পড়ে থাকা মাকে আরও একটা বিপদে ফেলা হবে। কোথায় বাড়ি খুঁজতে যাবে তখন? স্বামী-পালানো মহিলাকে কে-ই বা বাড়ি দেবে? তাই শুধু বলেছিলাম, উনি আমার বুকের দিকে তাকিয়েছেন। ঠিক করেছিলাম, কোনওদিন সুযোগ পেলে ওই লোকটাকে খুন করব। ওখানে গুলি করব। কোমরের নীচে। পরে সেটাও বদলে গেল। ঠিক করলাম, এই সব ছোটখাটো রাগ পুষে লাভ নেই। তার থেকে বরং মাকেই ফিনিশ করে দিই। দে শেষ টানটা আমি দিই।

বৈদর্ভী সিগারেটটা এগিয়ে বলল, ইটস টু মাচ কিনি। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এবার থাম।

সিগারেটে টান দিয়ে মুখ লাল করে অনেকটা কাশল কিঙ্কিনি।

বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমার ওপর মায়ের খুব রাগ। বকাঝকা মারধর লেগেই থাকত। তুচ্ছ সব কারণে বেদম মার খেতাম। আজও মনে আছে একদিন দুপুরে খেতে বসে বলেছিলাম, লাউ করেছ চিংড়ি দাওনি কেন? লাউয়ের সঙ্গে চিংড়ি সবথেকে ভালো যায়। যদি কই মাছ হত তা হলে ফুলকপির কথা বলতাম। মা সেদিন ডালের হাতা দিয়ে আমাকে খুব মেরেছিল। দুপুরে খেতে পর্যন্ত দেয়নি। বলেছিল, খাওয়া নিয়ে বায়না করলে গোটা দিন উপোস করিয়ে রাখব। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি কী করেছি! বাবাই তো আমাদের এ সব বলত। বাজারের কম্বিনেশন শেখাত। গরম চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজ পড়েছিলাম বলে মা চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে ঠুকে দিয়েছিল। পরে মারধর বন্ধ হল কিন্তু মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো হয়নি। মায়ের রাগের কারণ প্রথমে বুঝতে পারতাম না। পরে পারলাম।

কী? অস্ফুটে বলল বৈদর্ভী।

আসলে একটা সময় পর্যন্ত আমি অনেকটাই বাবার মতো আচরণ করে ফেলতাম। বাবার মতো ভালো স্বভাব, বাবার মতো হাসিখুশি, বাবার মতো মজাদার। মা এটা নিতে পারত না। আমাকে মেরে বাবার ওপর রাগ ফলাত। আমি বোকা ছিলাম তাই ধরতে পারিনি, হি হি। আশ্চর্য না? যখন বুঝতে পারলাম, তখন ঠিক করলাম, খারাপ হয়ে যাব। বাজে মেয়ে। মদ খাব, গাঁজা খাব, রাত করে বাড়ি ফিরব, মেয়ে হয়ে মেয়ের সঙ্গে শোব। সেইসঙ্গে ওই মহিলাকেও মারব, আমার মাকে। মেরেই ফেলব। হি হি।

হাসতে লাগল কিঙ্কিনি। হাসতে হাসতে সোফার ওপর গড়িয়ে পড়ল। গড়াতে গড়াতে বলল, অ্যাই বৈদর্ভী এখান থেকে বেরিয়ে আমরা রেলগেটে যাব। ভাঙা মন্দিরের ঠেকে বসে ভদকা খাব। তুই শিবুকে খবর দে। শুনেছি জায়গাটা খারাপ। গিয়ে দেখব কত খারাপ হয়। শিবুকে এক্ষুনি খবর দে। হি হি।

বৈদর্ভী বলল, আচ্ছা সে দেব, আগে তুই হাসি থামা।

কিঙ্কিনি হেসে যেতেই থাকে। বলল, উফ পারছি না, পারছি না রে থামাতে…হি হি..।

বৈদর্ভীও হেসে উঠল বলল, বেটা গাঁজাখোর। দাঁড়া আমি তোর হাসি থামাচ্ছি।

গায়ের টি শার্টটা দ্রুত খুলে ফেলে দিয়ে বৈদর্ভী কিঙ্কিনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পড়ে থমকে গেল। কিঙ্কিনি হাসছে কোথায়! তার দুটো চোখই যে ভেসে যাচ্ছে জলে! তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল বৈদর্ভী। চোখ খুলে জল মুছতে মুছতে কিঙ্কিনি বলল, মাকেও শেষ পর্যন্ত লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছি। বেচারি মা আমার, কী হবে তাকে খুন করে? তার কী দোষ? কোনও দোষ নেই। যদি মারতেই হয়, আসল কালপ্রিটকে মারতে হবে। তার জন্যই তো সব। সে-ই যত নষ্টের গোড়া। আসল কালপ্রিটকে চিনিস বৈদর্ভী? হি ইজি মাই ফাদার। আমার বাবা শ্রীদেবনাথ চট্টোপাধ্যায়। একটা রিভলভার পেলে, ঢিসুম।

হাতে গুলি করার ভঙ্গি করল কিঙ্কিনি। তারপর পাশ ফিরে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

.

রাত আটটা নাগাদ পুলিশ হানা দেয় রেলগেটের ভাঙা মন্দিরে। রুটিন রেইড। মাঝেমধ্যেই পুলিশ এটা করে। নেশাখোরদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ছোটখাটো ছিঁচকে চোর, ছিনতাইবাজ, গুন্ডা মস্তানরাও থাকে। কোনও কোনও দিন এক-দুজন মহিলাকেও পাওয়া যায়। পুলিশ এলে তারা ব্লাউজের ভেতর থেকে মুঠো করে কোঁচকানো দশ টাকার নোট বের করে। হাতে গুঁজে রেললাইন দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দ্রুত। অনেক সময় পুলিশ যাদের ধরে কটা লাঠির ঘা দিয়ে ছেড়ে দেয়। কখনও আবার একরাত লকআপে রেখে পরদিন সকালে কোর্টে চালান করে। আজকের রুটিন রেইডে কজন যুবকের সঙ্গে দুটি অল্পবয়সি মেয়েও ধরা পড়েছে। একবার তাকিয়েই পুলিশ বুঝতে পারে, এরা জামার ভেতর থেকে টাকা বের করে দেওয়ার মেয়ে নয়। অন্য কোনও গোলমাল রয়েছে। জটিল কিছু। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অন্ধকার চাতালের একপাশে জড়ামড়ি করে পড়েছিল দুজনে। প্রায় জ্ঞান হারানো অবস্থা। তাদের টেনে হিঁচড়ে যখন ভ্যানে তোলা হচ্ছে, একটি মেয়ে জড়ানো গলায় বলল, দাদা, একটা রিভলভার হবে?

০৯. লোকটা জালিয়াত

০৯.

এক ঝলক দেখেই নীলাদ্রি বুঝতে পারল, লোকটা জালিয়াত। ছোটখাটো জালিয়াতি নয়, বড় ধরনের জালিয়াত। বড় ধরনের জালিয়াতরা আজকাল টিয়াপাখির বদলে কম্পিউটার, মোবাইল সাজিয়ে এমন কায়দায় বসে যেন বিজ্ঞান প্রযুক্তি ছাড়া এক পা-ও নড়ে না। মানুষের ভাগ্য, কুষ্ঠি বিচার, আংটির পাথর, মাদুলির সাইজ সব কী বোর্ড টিপে বলে দেয়। এই লোকও তাই করেছে। টেবিলের ওপর ল্যাপটপ সাজিয়ে বসেছে। প্রতি কথার পরেই খটখট আওয়াজ করে কী বোর্ড টিপছে। এখানে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। তবু সে চুপ করে আছে। কারণ এই লোকের কাছে তাকে নিয়ে এসেছে শ্রীময়ী। দুম করে উঠে গেলে শ্রীময়ীকে অপমান করা হবে।

লোকটা মুখ না তুলে বলল, কী হারিয়েছে ভাইটি?

নীলাদ্রি পাশে বসা শ্রীময়ীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, কী নয়, কে। আমার বাবা পাঁচ বছর হল নিখোঁজ।

লোকটা মুখ তুলে একবার নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকাল। বলল, ও। ফের ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তা বাবার নাম কী ভাইটি?

ভাইটি ভাইটি শুনতে অসহ্য লাগছে নীলাদ্রির। শুধু ভাইটি নয়, তুমি সম্বোধনেও তার আপত্তি। এই ধরনের বুজরুকদের এগুলো এক একটা অংশ।

বাবার নামটা বললে না?

দেবনাথ। দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়।

বয়স কত?

কোন বয়সটা বলব? যখন হারিয়ে গেছে? ফিফটি টু। তারপর পাঁচ বছর হয়ে গেল।

ও তা হলে সাতান্ন হল, মা আছেন?

হ্যাঁ যামিনী চট্টোপাধ্যায়।

ভাইটি, মায়ের বয়স কত?

এখনকার বয়স?

না, এখনকার নয়, তোমার বাবা যখন বাড়ি ছাড়লেন সেই সময়ের বয়সটা বল।

নীলাদ্রি বিরক্ত হয়ে ভুরু কোঁচকালো। পাশে বসা শ্রীময়ীর মুখের দিকে আবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, ঠিক জানি না।

ভাইটি এটা যে জানতে হবে। মায়ের বয়স না জানলে বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ বোঝা যাবে কী করে?

নীলাদ্রির ভুরু আরও কুঁচকে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ল। লোকটা কী বলতে চাইছে? সে নড়েচড়ে বসল। রুক্ষ গলায় বলল, আমি তো আপনার কাছে বাবার চলে যাওয়ার কারণ জানতে আসিনি। শুনলাম, আপনি নাকি হারানো জিনিস, মানুষ খুঁজে দেন। যদিও আমি এসব বিশ্বাস করি না।

লোকটা দাঁত বের করা ধরনের হেসে বলল, বিশ্বাস যে কর না দেখেই বুঝতে পারছি ভাইটি। তাতে কিছু এসে যায় না। আমার এই কাজ ধম্মকম্ম, পুজোআচ্চা নয়, এতে অং বং চং মন্ত্র নেই যে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। জ্যোতিষীদের মতো পাথর, মাদুলি বিক্রির ব্যবসাও খুলে বসিনি। ওদের মতো তুমি কি আমার গায়ে নামাবলি বা কপালে তিলক দেখতে পাচ্ছ? পাচ্ছ না। কারও বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপর আমার কাজ নির্ভর করে না। আমি অন্য পদ্ধতিতে কাজ করি। দেখছই তো তোমার কাছ থেকে পাওয়া ইনফরমেশনগুলো আগে কম্পিউটারে তুলে নিচ্ছি। তারপর আমার পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করব।

কথাটা বলে লোকটা আবার সামনে রাখা ল্যাপটপে খটাখট আওয়াজ করল। নীলাদ্রির খুব ইচ্ছে করল জিগ্যেস করে, পদ্ধতিটা কী? আপনি কি হারিয়ে যাওয়া খুঁজে পাওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের কোনও সফটওয়্যার ব্যবহার করেন? তার আগেই শ্রীময়ী টেবিলের ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, আসলে আমরা চাইছিলাম, আপনি যদি মানুষটার কোনও হদিস দিতে পারেন। শুনেছি…।

লোকটা মুখ তুলে একইরকম অতি বিনয় মাখা গলায় বলল, তুমি কে বোনটি? দেবনাথবাবুর কন্যা?

শ্রীময়ী তাড়াতাড়ি বলল, না না, আমি কেউ নই, আমি এর বন্ধু।

তা হলে তো বোনটি তোমাকে একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়।

নীলাদ্রি কড়া গলায় বলল, ও এখানেই থাকবে। ও-ই আমাকে আপনার কাছে এনেছে।

সেটা খুব আনন্দের কথা। কিন্তু বোনটিকে এখন ঘরে রাখা যাবে না। কোনও অনাত্মীয়কে সামনে রেখে আমি কাজ করব কী করে? ডাক্তার যখন রোগীকে পরীক্ষা করে বাইরের লোককে থাকতে দেয়?

নীলাদ্রি দেখল এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এটা সুযোগ। প্রতিবাদ জানিয়ে শ্রীময়ীর সঙ্গে সেও বেরিয়ে যাবে। শ্রীময়ী তার আগেই উঠে পড়ল। নীলাদ্রির কাঁধে হাত রেখে নীচু গলায় বলল, প্লিজ তুমি কথা বল। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

অনেকক্ষণ থেকেই নীলাদ্রির মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। শ্রীময়ী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সেটা আরও বাড়ল। সে এখানে একেবারেই আসতে চায়নি। শ্রীময়ীর জন্য বাধ্য হয়েছে। সেদিন। শ্রীময়ীকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিল। শ্রীময়ী বলল, একটা কথা বলব? রাখবে?

নীলাদ্রি অবাক হয়ে বলল, বাবা, এমনভাবে বলছ যেন গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে আসতে হবে।

তোমাকে একজনের কাছে নিয়ে যাব, যাবে?

কার কাছে?

শ্রীময়ী বলল, সে একজন আছে। আগে বল যাবে। তোমার বাবার ব্যাপারে।

নীলাদ্রি ঠোঁটের ফাঁকে একটু হেসে বলল, কার কাছে? তোমার চেনা কোনও পুলিশ অফিসার? কোনও লাভ নেই শ্রীময়ী। থানা পুলিশ করে করে ফেডআপ হয়ে গেছি। পাঁচ বছর তো কম সময় নয়।

না, থানা পুলিশ নয়, একজন লোক আছে সে নাকি হারানো জিনিস, হারানো মানুষ খুঁজে দিতে পারে।

নীলাদ্রি হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে।

ধ্যুৎ, তুমি জ্যোতিষে বিশ্বাস কর নাকি শ্রীময়ী! ছি ছি, একজন কবি হয়ে তুমি শেষ। পর্যন্ত কিনা আমাকে জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হতে বলছ!

শ্রীময়ী তাড়াতাড়ি বলে, আমি মোটেও ওসব বিশ্বাস করি না। আর যার কাছে যেতে বলছি তিনিও মোটে জ্যোতিষী নন।

তা ছাড়া আর কী হবে? হারানো মানুষ কোথায় আছে সে তো আর চোখ বুজে সাধারণ মানুষ বলতে পারবে না, তার জন্য অমুকবাবা তমুকবাবা কিছু একটা হতে হবে। যত সব ভণ্ড।

শ্রীময়ী হাঁটতে শুরু করল। বলল, শুনেছি এই লোকটা অন্যরকম। আমাদের রান্নার মাসি সোনারপুরের দিক থেকে আসে। ও-ই গল্প করেছিল, লোকটা সোনারপুরে বসে। তিন চারটে করে জায়গার কথা বলে দেয়। তার মধ্যে একটায় হারানো জিনিস পাওয়া যায়।

নীলাদ্রি বলল, এই রে, তুমি তোমাদের রান্নার লোকের কাছেও বাবার ঘটনা বলেছ!

মোটেও না, আমি কিছুই বলিনি। মাসিই সেদিন গল্প করছিল। মেয়ের কানের দুল হারিয়ে যেতে ওরা সেই লোকের কাছে গিয়েছিল। লোকটা অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে, তিন জায়গার নাম বলে দিল। দ্বিতীয়টাতেই দুল পাওয়া যায়। বাড়ির পিছনে লঙ্কা গাছের টবে। আরও নাকি আছে। গ্রামের কে ছাগল হারিয়েছিল। পরদিন সেই লোকের কাছে যেতে…।

নীলাদ্রি জেরে হেসে উঠল। পথচলতি কয়েকজন মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। নীলাদ্রি বলল, আমার বাবা কানের দুল নয়, ছাগলও নয়। এভাবে মানুষ পাওয়া যাবে না।

একটা ছেলেকেও খুঁজে দিয়েছে। আট-নবছরের ছেলে। বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিল। বড়বাজার গিয়ে পাওয়া গেল। সে নাকি ট্রাকে চেপে মুম্বই যাবে। আমি রান্নার মাসির কাছ থেকে লোকটার ঠিকানা রেখে দিয়েছি। সোনারপুর স্টেশনে নেমে একটুখানি যেতে হবে।

শ্রীময়ী, এগুলো বুজরুকি ছাড়া কিছুই নয়। শুনে মনে হচ্ছে, লোকটা কথাবার্তা বলে কয়েকটা প্রব্যাবিলিটি বুঝতে পারে। হারানো জিনিস কোথায় থাকতে পারে তার সম্ভাবনা। দু একটা কেস মিলে যায়। সেগুলিই মুখে মুখে ছড়ায়। বুজরুকের ব্যবসা বাড়ে। যেসব কেস ফেল। করে সেগুলো কেউ জানতে পারে না। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের ব্যাপারগুলো সব এরকমই। মুখে মুখে শুনে মানুষ পাগলের মতো ছোটে। কাগজে দেখনি, মানুষ যখন চাঁদে জমি কেনার কথা ভাবছে তখন এখানে অসুখ সারাতে একদল মানুষ কাদায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল! কোনও বহুদূরের গণ্ডগ্রামে নয়, কলকাতার কাছেই এ ঘটনা ঘটেছে। এইসব জালিয়াতদের পেইড এজেন্টও থাকে। তারা মুখে মুখে গপ্প ছড়ায়। তোমার এই রান্নার মাসি নিশ্চয় সেরকম একজন। কেন্স পিছু কমিশন পাবে। এসব একদম বিশ্বাস কর না।

শ্রীময়ী বলল, আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু একবার যেতে অসুবিধেটা কোথায়? পাঁচ বছর ধরে কত জায়গায় তো ছুটোছুটি করছ। যে যেরকম বলেছে সেখানেই গেছ। এখানে কত আর খরচ হবে?

নীলাদ্রি এবার বিরক্ত হলে বলল, খরচটা বিষয় নয়, বিষয়টা অন্য। যত বড়ই বিপদ হোক, তা বলে একজন বুজরুকের কাছে ছুটব; নিজেকে সারেন্ডার করব!

সারেন্ডারের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! শুনে চলে এলেই হবে। নতুন একটা সম্ভাবনার কথাও তো লোকটা বলতে পারে। না বুঝেও বলতে পারে। তোমাদের খোঁজার একটা নতুন দিক খুলে যাবে। দেখ নীলাদ্রি, তোমার বাবাকে পাওয়া গেলে আমি তোমাদের থেকে কম খুশি হব না। তার কারণ তোমার বাবা নন, তুমি। কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও সত্যি, আমার ভালোবাসার মানুষটাকে রোজ মন খারাপ করতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।

নীলাদ্রি হতাশ গলায় বলল, ঠিক আছে চল, দেখি তোমার সাধুবাবা কী বলেন। তবে একটা কথা বলে দিচ্ছি, মেজাজ ঠিক থাকবে কিনা জানি না। ঘোরতর অবিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি তো, রাগ না চড়ে যায়। মাকে পাঠালেই ভালো হত। কিন্তু সেটা করব না। মা ওই লোকের কথা বিশ্বাস করে ফেলতে পারে। একবার কোন পুরোহিত মশাই মায়ের হাত দেখে বলেছিল, আপনার স্বামী ফিরে আসবে, আপনি তিনদিন ধরে যজ্ঞ করুন। মা বলল, তিন দিন ধরে! সে তো বিরাট ঝামেলা। পুরুত মশাই বললেন, সে তো ঝামেলাই। তবে শাস্ত্রে বিকল্প ব্যবস্থা আছে। মা বলল, কী ব্যবস্থা? পুরুতমশাই বললেন যজ্ঞ করতে না পারলে তিন হাজার তিন টাকা ধরে দিন। মা বলল, তিন হাজার! এত টাকা? পুরুতমশাই বললেন, স্বামী তিন বছর নিখোঁজ, তাই তিন হাজার। মা টাকা দিয়ে দিল। এই কারণেই মাকে এখানে পাঠাব না।

লোকটাকে মোটেই জ্যোতিষী বা পুরোহিতের মতো দেখতে নয়। ব্যস্ত রাস্তার ওপর একফালি চেম্বার। বাইরে ছোট একটা টিনের সাইনবোর্ডে এঁকাবেঁকা করে ভুল বানানে লেখা–

মধুসূদন কুইল্যা। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সাহায্যে হারানো জিনিস খুঁজে পাবার পরামর্শ দেন। ভিজিট একশত টাকা মাত্র।

ঘরে ঢুকে দেখা গেল লোহার টেবিলের ওদিকে কারুকাজ করা পাঞ্জাবি পরে চিমসে চেহারার একজন বসে আছে। লোকটার চেহারার মধ্যেই একটা ধূর্ত ভাব। চোখগুলো ঢুলু ঢুলু। গলায় একটা মোটা সোনার চেইন। সোনার না-ও হতে পারে, হয়তো ইমিটেশন। পাড়া গাঁয়ের লোকদের ঘাবড়ে দেবার জন্য পরে রেখেছে। অনেকসময় গরিব মানুষ বড়লোকদের বাড়তি বিশ্বাস করে। টেবিলে ল্যাপটপ খোলা। লোকটা সেই ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। পিছনের দেয়ালে অজস্র ঠাকুর দেবতার ফটো। কোনওটায় শুকনো মালা ঝুলছে। টেবিলের এপাশে দুটো লোহার চেয়ার। নীলাদ্রি, শ্রীময়ী এসে সেখানেই বসেছিল। শ্রীময়ী বেরিয়ে যাওয়ার পর নীলাদ্রি বলল, একটু তাড়াতাড়ি করবেন মধুসূদনবাবু।

লোকটা চোখ তুলে গা জ্বালানো ধরনের হাসল।

বন্ধুকে চলে যেতে বলেছি বলে রাগ হল ভাইটি?

রাগে গা রি রি করে উঠল নীলাদ্রির। উপায় নেই সহ্য করতে হবে।

কী করব বল, তোমার সঙ্গে এমন সব কথা হবে যা পরিবারের বাইরের কারও শোনা উচিত নয়। জিনিস হলে একটা কথা ছিল। তার পাপপুণ্য থাকে না। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হবার নয় ভাইটি। তার অনেক লজ্জার ব্যাপার থাকে। সেসব অন্যরা শুনলে চলবে কেন? আমিই বা বলব কেন? যাক, ওসব বাদ দাও। মানুষ খোঁজার ভিজিট কিন্তু আমার বেশি।

কত? ঠোঁট কামড়ে বলল নীলাদ্রি।

বেশি নয়, তিনশত। হাত তুলে তিনটে আঙুল দেখাল মধুসূদন।

নীলাদ্রি দ্রুত পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিল। আগে টাকা দিয়ে যদি আগে মুক্তি পাওয়া যায়।

ধন্যবাদ। তুমি শিক্ষিত ছেলে বলে আগে টাকা দিলে। গাঁইয়াগুলো এটাই বুঝতে চায় না। বলে আগে জিনিস পাই তারপর ভিজিট। আরে বাপু, জিনিস কি আমি খুঁজে দেব বলেছি? তুই হারিয়েছিস তুই বুঝে নিবি। আমি শুধু পরামর্শ দেব। অ্যাডভাইস। ঠিক কিনা?

নীলাদ্রি এসব কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, বুঝতেই পারছেন মধুসুদনবাবু আমরা পাঁচ বছর ধরে কম খোঁজাখুঁজি করিনি। আজও করছি। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন চলছে। এখনও ফোন করে ডেকে পাঠায়। সুতরাং বাদ প্রায় কিছুই নেই। আপনি সেটা মাথায় রাখবেন, তাতে আপনার পরিশ্রম কম হবে।

মধুসূদন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল, এতে পরিশ্রম বাড়ল ভাইটি। আগে এলে কাজ সহজ হত। রোগী মর মর হলে তবে ডাক্তার বদ্যি ছেড়ে আত্মীয়রা মন্দিরে ছোটে। তখন ভগবান কিছু করতে পারেন না। কারণ ততক্ষণে কেস জটিল হয়ে গেছে, বেচারি ভগবান কী করবেন? তোমার বাবা মানুষটি কীরকম ছিলেন? রাগী না ঠান্ডা মাথার? খরুচে না কিপটে? ভীতু প্রকৃতির?

নীলাদ্রি হেসে ফেলে বলল, এগুলো সব বলতে পারব না, তবে, মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। ইনফরমেশনটা কাজে লাগবে?

তুমি কি ঠাট্টা করছ ভাইটি?

নীলাদ্রি সহজভাবে বলল, তা একটু করছি বইকি। ধরা যাক, আমার বাবা সাহসী ছিলেন, তাতে কী প্রমাণ হয়? উনি জঙ্গলে গিয়ে বাঘ-ভাল্লুকের সঙ্গে গা ঢাকা দিয়ে আছেন? এ সব জেনে আপনার লাভ?

মধুসূদন চিবিয়ে বলল, ভাইটি, আমার লাভ ক্ষতিটা আমি বুঝলেই ভালো নয় কি? গোড়া থেকেই দেখছি তুমি তেড়েফুঁড়ে কথা বলছ। ব্যাপারটা কী বল তো? আমি তো হাতে পায়ে ধরে তোমাকে এখানে ডেকে আনিনি বাপু।

নীলাদ্রি নিজেকে সামলে টেবিলের ওপর ঝুঁকে বলল, আমার বাবা একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। আমাকে আর আমার বোনকে ভালোবাসতেন খুব। অফিস ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোতেই চাইতেন না। যতটা পারেন হইচই করে সময় কাটাতেন।

স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল? তোমার মায়ের সঙ্গে?

নীলাদ্রি হেসে বলল, এই আপনার গোপন প্রশ্ন? লাভ নেই। ওই লাইনে অনেক তদন্ত হয়ে গেছে। আমার মায়ের সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক ছিল লোহার শিকলে বাঁধা।

মধুসূদন মুচকি হেসে বলল, লোহাতেও যে জং ধরে ভাইটি।

সরি, আমার বাবা মানুষটা অন্যরকম।

সব ছেলেমেয়েই এ কথা বলে। বাপ-মায়ের চরিত্রকে নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র দেখে। তারপর এরকম একটা কাণ্ড ঘটলে সব ফঁস হয়। তখন মুখ লুকোনোর জায়গা পায় না।

নীলাদ্রির চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। তারপরই মনে হল, এই লোকের ওপর রাগ করার কি কোনও মানে হয়? এই বুজরুক কি রাগ করার যোগ্য? সে গম্ভীর গলায় বলল, আমার বাবা আর পাঁচজনের মতো নয়।

না, হলেই ভালো। কিছু মনে কোরো না ভাইটি, তোমার মা মানুষটি কেমন জানতে পারি কি? এই ধরনের গৃহত্যাগের ক্ষেত্রে স্ত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্ত্রীর চরিত্র গোলমাল থাকলে পুরুষমানুষের ঘরে মন টেকে না।

নীলাদ্রি পিঠ সোজা করে বসল। বলল, মনে হচ্ছে আপনি একটু বেশি বলছেন। লিমিট ক্রস হয়ে যাচ্ছে না কি?

মধুসূদন অবাক হওয়ার ভান করে বলল, এর মধ্যে কম বেশির কী হল? ঘরে আর কাউকে রাখিনি তো এই কারণেই। ডাক্তার, উকিল আর আমাদের মতো মানুষদের কাছে কিছু লুকোতে নেই। বাপ মায়ের কোনও দোষ থাকলে বলে দাও, আমার হিসেব করতে সুবিধে হবে। এই যে তুমি মাকে এখানে না এনে নিজে এসেছ, এটা একটি বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। সে তো তার নিজের মুখে নিজের চরিত্রের কথা বলতে পারত না। নাও বল।

কথা শেষ করে মধুসূদন কুইল্যা ফের তাকাল ল্যাপটপের দিকে।

দাঁতে দাঁত চেপে নীলাদ্রি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে না পারা যাবে। এই বদ লোকটাকে ভালোমতো শিক্ষা দেওয়া দরকার।

আমার মায়ের চরিত্র কেমন বলতে পারব না, তবে উনি বুজরুক দেখলে আমার মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না এটা জানি। ঠাটিয়ে চড় লাগান।

মধুসূদন কুইল্যা চকিতে মুখ তুলে তাকাল। নীলাদ্রি নির্লিপ্ত ভাবে বলল, নিন এবার বলুন আপনার হিসেব কী বলছে?

মধুসূদন পাশে রাখা মোবাইলটা তুলে কাকে যেন মেসেজ পাঠাল। তারপর বলল, অত হুটোপুটি করলে কী করে হবে? তা ছাড়া তুমি তো ইনফরমেশন প্রায় কিছু দিতেই পারছ না।

যা পেরেছি সেটুকুতে কিছু হবে না? শুনেছি আপনি নাকি কেস পিছু খান তিন-চার অপশন দেন। আমার বাবার ক্ষেত্রে একটা অন্তত দিন। সেখানে গিয়ে একবার হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ করে দেখি।

মধুসুদন কুইল্যার চোখ এখন আর ঢুলু ঢুলু নয়। পুরো খুলে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে রাগ। রাগ দেখে নীলাদ্রির নিজের রাগ একটু কমল। লোকটার মোবাইলে বিপ বিপ আওয়াজ করে আবার মেসেজ এল। লোকটা ফোন তুলে মেসেজ পড়ে জবাবও দিল। তারপর মুখ তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, দেখুন, তিনশো টাকার আদ্দেকটা ফিরিয়ে দিচ্ছি, আপনি চলে যান। আমার অনেক সময় নষ্ট করেছেন। বাইরে অন্য কাস্টমাররা আছে। ঝামেলা করবেন না।

তুমি থেকে সম্বোধন আপনি-তে উঠে যাওয়ায় নীলাদ্রি হাসল। হুমকি তা হলে ভালোই কাজ করেছে। চোখ বড় করে বলল, চলে যাব! সে কী দাদাভাই! চলে যাব কেন? বাবার কোনও হদিস দেবেন না? অত দূর থেকে এত কষ্ট করে এলাম। আমি তো ভিজিটের টাকা ফেরত চাই না, হারানো মানুষের খোঁজ চাই। সেই খোঁজ না পেলে তো এখান থেকে উঠব না।

মধুসূদন কুইল্যা এবার চেয়ারে হেলান দিল। ঠোঁট দুটোকে সরু করে বলল, কী করবেন? মারবেন?

নীলাদ্রি ডান পায়ের ওপর বাঁ-পাটা তুলে বলল, আমি তো সেরকম কিছু বলিনি। আমাকে দেখে আপনার গুন্ডা বলে মনে হচ্ছে? আপনি শুধু বাবা থাকতে পারেন এমন একটা জায়গা বলে দিন, আমি সেখানে চলে যাই। ব্যস, সমস্যা মিটে গেল।

মধুসূদন কুইল্যা দুলতে দুলতে বলল, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।

নীলাদ্রির মজা লাগছে। লোকটা ঘাবড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, একটু পরেই কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। ব্যস, তারপরেই উঠে পড়া যাবে।

বাড়াবাড়ির এখনই কী দেখলেন? নিন, বলুন। নইলে আরও বাড়াবাড়ি হবে।

মধুসূধন ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, জায়গা বললে আপনি সেখানে যেতে পারবেন?

নীলাদ্রিও পালটা হেসে বলল, চেষ্টা করব।

মধুসূদন একটু চুপ করে রইল। তারপর জিভ দিয়ে মুখে বিশ্রী একটা আওয়াজ করে বলল, হিসেবটিসেব কষে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে, আপনার বাবা জেলখানায় আছে। ছেলেকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে বাপটি কেমন। খুন বা রেপ করে পাকাপাকিভাবে ভেতরে ঢুকে গেছে। সেখানে তো আপনি যেতে পারবেন না ভাইটি।

কথাটা বলে মধুসূধন কুইল্যা ফিক করে হাসলেন। নীলাদ্রি শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল। বলল, কে বলেছে পারব না, খুব পারব।

কীভাবে? চোখে কৌতুক নিয়ে মধুসূদন কুইল্যা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

এক মুহূর্তও সময় নিল নীলাদ্রি। মনে হয় দম টানল। তারপর গায়ের সব শক্তি দিয়ে চড় বসাল গালে। চিমসে লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলের ওপর। নীলাদ্রি আঙুল তুলে বলল, আর একটু আছে দাদাভাই। ল্যাপটপটা তুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ঝনঝন আওয়াজে বাইরে থেকে প্রথম দরজা ঠেলে ঢুকল শ্রীময়ী। টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা মধুসূদন কুইল্যা হিসহিস করে বলল, কাজটা ভালো করলে না ছোকরা, ভালো করলে না।

রাগে কাঁপতে থাকা নীলাদ্রি শ্রীময়ীর হাত ধরে বলল, এবার চল, এই লোকটার একটা শিক্ষা দরকার ছিল।

রিকশা ধরেও পালানো গেল না। নীলাদ্রিরা সোনারপুর স্টেশনে পৌঁছোনোর আগেই দুটো মোটরবাইক পথ আটকে দাঁড়াল। মোট চারজন এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে, ঝামেলা হতে পারে ভেবে অনেক আগে থেকেই মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এদের ডেকে নিয়েছিল মধুসূদন। নইলে এত তাড়াতাড়ি আসবে কী করে! তারা খুব ঠান্ডা গলায় নীলাদ্রিকে বলল, নেমে আয় শুয়োরের বাচ্চা।

মোট দুদফায় মারা হল নীলাদ্রিকে। প্রথমবার রিকশা থেকে নামিয়ে রাস্তায়। দ্বিতীয়বার মধুসূধন কুইল্যার চেম্বারের সামনে। মধুসূদন নিজে লোহার রড এনে মারল। রক্তে ভেসে যাওয়া নীলাদ্রিকে আবার রিকশাতে তুলেও দিল ওরা যত্ন করে।

গোটা পথটা তাকে জড়িয়ে শ্রীময়ী থরথর কাপল আর বিড়বিড় করে বলল, আমার জন্য হল, সব আমার জন্য হল…।

রিকশা স্টেশনে পৌঁছনোর পরপরই নীলাদ্রি পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

১০. দেবনাথের খোঁজে গিয়ে

১০.

দেবনাথের খোঁজে গিয়ে যখনই ব্যর্থ হয়েছে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে যামিনী। এমনকী কয়েক বছর হল, মৃতদেহ শনাক্ত করার ডাক পেলেও কামনা করেছে, যেন দেবনাথই হয়। হারিয়ে যাওয়ার থেকে মৃত্যু ভালো। মৃত্যুতে শোক আছে, হারিয়ে যাওয়ার মতো অপমান নেই। মৃত্যুতে শেষ আছে। হারিয়ে যাওয়ার কোনও শেষ নেই। অনন্তকাল ধরে কুরে কুরে খায়।

এই প্রথম স্বামীর খোঁজে ব্যর্থ হয়ে দারুণ খুশি হল যামিনী। দুপুরে শহিদ বলরাম কলোনি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার মনে হচ্ছিল, শরীর হালকা হয়ে গেছে। সে উড়ে যেতে পারে! খারাপ পাড়ার অশ্লীল গালি, আবর্জনার দুর্গন্ধ, পথ জুড়ে পড়ে থাকা নোংরা জল যেন কিছুই নয়! এমনকী নাকে শাড়ির আঁচল পর্যন্ত চাপা দিতে হয়নি তাকে।

পুকুরঘাটে বসে থাকা মহিলারাই যামিনীকে সাতাশ বাই দুই-এর পথ দেখিয়ে দেয়। রিকশাচালকের বারণ করা সেই বাঁহাতের পথটাই ছিল। যামিনী ধীর পায়ে হেঁটে পৌঁছে যায়। দ্রুত। বিবর্ণ দোতলা বাড়ি একটা। টিনের চাল। বারান্দায় সারি দিয়ে শুকোতে দেওয়া আছে শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রা, ফ্রক। ফ্রক কার? দেবনাথের মেয়ের শরীর কেঁপে ওঠে যামিনীর। পাঁচ বছর ধরে এখানে থাকে দেবনাথ! মঞ্জু মেয়েটা এখানেই শরীর বেচে! দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করে যামিনী। সে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, কোনওভাবে ভেঙে পড়বে না। কিছুতেই নয়। দেবনাথকে খোঁজার ব্যাপারে কোনও ছলছাতুরিও করবে না। যদি প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা হয় তা হলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কটা কথা বলবে। কান্না পেলে আটকানোর চেষ্টা করবে। আটকাতে না পারলে আর কী হবে, কাঁদতে কাঁদতেই বলবে।

কেমন আছ তুমি? আমাকে কি ভেতরে একটু বসতে দেবে? এটা তোমার কেমন ছেলেমানুষি? নাকি এটাও তোমার রসিকতা? এখানে আছ আমাদের জানাবে না একবার! একটা ফোন করতে কী হয়েছিল? আমি কি জোর করে ধরে নিয়ে যেতাম? তুমি কি ছেলেমানুষ যে জোর করলেই মেনে নিতে? নাকি আমার বয়স হয়নি। তোমার কোনটা পছন্দ বুঝতে পারব না? ছেলেমেয়ে দুটো পাঁচ বছর ধরে চিন্তা করে। যাক, তোমার বউ কোথায়? মেয়েকে একবার ডাকবে? হুট বলতে অফিসে যাওয়া বন্ধ করলে কেন? খারাপ মেয়ের সঙ্গে সংসার বাঁধার লজ্জায়? দুর, খারাপ ভালো ওভাবে মাপা যায় নাকি? এই দেখ না তোমার অফিসের অর্ধেন্দু দত্ত…।

আর যদি দেবনাথের বদলে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়? তাও ঠিক করা ছিল যামিনীর। কোনও লুকোচাপা নয়, একেবারে সরাসরি অনুরোধ করবে। অনুরোধ করা ছাড়া আর অন্য কী পথই বা আছে তার?

দেখুন ভাই, আমি একজনকে খুঁজছি। তিনি আমার স্বামী। পাঁচ বছর হল তিনি নিরুদ্দেশ। কদিন আগে শুনলাম, পাঁচ বছর হল এক ভদ্রলোক আপনার কাছে এসে রয়েছেন। যতদূর শুনেছি তিনি আপনার স্বামী। আমি শুধু অনুরোধ করব, ওই মানুষটার সঙ্গে আপনি একবার আমাকে দেখা করিয়ে দিন। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমি কেন একথা বলছি। আমার সন্দেহ দূর হোক। যদি কথা না বলাতে চান তাহলে দূর থেকে দেখান। তবু দেখান। আমি কথা দিচ্ছি, কোনওরকম জোরজবরদস্তি করব না। করার অধিকার বা ইচ্ছে কোনওটাই আমার নেই। আমি খুব ক্লান্ত। একজন মহিলা হিসেবে আর একজন মহিলার এই অনুরোধ আপনি রাখবেন এই আশা কি আমি করতে পারি না?

দুটো ভাবনার একটাও মিলল না।

বাড়ির সামনে দাঁড়ানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে একজন পুরুষ মানুষ বেরিয়ে এল। গায়ে ময়লা পাজামা পাঞ্জাবি। কাঁধে ঝোলা ধরনের ব্যাগ। পাট করে চুল আঁচড়ানো। বুকটা ধক করে উঠেছিল যামিনীর। ডান হাত মুঠো হয়ে গেল। না, এ সেই মানুষ নয়। যামিনীর সাজ-পোশাক দেখে মানুষটার বোধহয় সন্দেহ হয়। কাছে এসে দাঁড়ায়।

কাকে চান?

ঢোঁক গিলে যামিনী বলল, আমি একজনকে খুঁজছি। এই বাড়িতে থাকেন।

কাকে? মানুষটা বিরক্ত গলায় বলে।

মঞ্জু নামে একজনকে।

হ্যাঁ, উনি আমার স্ত্রী। কী ব্যাপার বলুন।

বড় করে শ্বাস ফেলল যামিনী। দম বন্ধ করে থাকার পর যেন অনেক দিন পরে নিশ্বাস নিতে পারল। সামান্য হেসে বলল, কোনও ব্যাপার নয়। উনি কখন ফিরবেন?

লোকটা আরও বিরক্ত হল। বলল, জানি না। কাজে গেছে। আজ না-ও ফিরতে পারে। মোবাইলটা ফেলে গেছে, নইলে জেনে বলে দিতাম। কী দরকার আমাকে বলুন।

যামিনী বলল, তেমন কিছু নয়, আসলে উনি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা পেতেন, বেশি নয়, এই শ তিনেক। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে যামিনী বলল, বলবেন, যামিনী টাকাটা দিয়ে গেছে। যামিনী চিনতে না পারলে বলবেন দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী।

বাস এবং ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল যামিনীর। তার মধ্যেই ফোনে বিশাখা এবং হিন্দোলের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।

হিন্দোল ট্যুরে নর্থ বেঙ্গল। শিলিগুড়ি না জলপাইগুড়ি। সেখান থেকেই চিৎকার করে বলল, আমি যাদবের মাথা ভাঙব। ছি ছি।

যামিনী বহুদিন পর প্রাণ খুলে হাসল। বলল, কী যে বল হিন্দোল, আমি তো ঠিক করেছি ওকে মিষ্টি খাওয়াব। ভুল খবর দেওয়ার উপহার।

বাড়ি এসে লক খুলে ঘরে ঢুকল যামিনী। ছেলেমেয়ে কাউকে না দেখে চিন্তিত হল। সামান্য। নীলকে নিয়ে চিন্তা নয়। চিন্তা মেয়েটাকে নিয়ে। মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নীলই বা আজ এত দেরি করছে কেন? এই সপ্তাহে তো কাজ নেই। সেক্টর ফাইভে যেতে হয়নি। পরের সপ্তাহ থেকে নাকি লম্বা ডিউটি হবে। দুটো শিফটেও কাজ করতে হবে। নীল সেদিন বলল, চাকরির জন্য ভিক্ষা চেয়ে লাভ কী? শুধু শুধু অপমানিত হওয়া। পরীক্ষা দিয়ে ঠিক একটা কিছু পেয়ে যাব। ততদিন এই ফুরনের কাজই ভালো। টাকা তো মন্দ নয়। কথাটা ঠিক বলেছে। ছেলেটা শান্ত হয়েছে। মা বা বোনের মতো চট করে রেগে যায় না। বুদ্ধিও আছে। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক জীবন পেলে লেখাপড়াতেও ভালো করত। সেদিন বলল, কিঙ্কিকে মামার কাছে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও মা। ওকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। তুমি বুঝিয়ে বললে মামা না করবে না। মামার যত প্রবলেম এখানে আসা নিয়ে। কিঙ্কির যাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না। আর একবার। চলে গেলে নিজে ঠিক কিছু করে নিতে পারবে। তুমি কথা বল মা। এটাও ভালো পরামর্শ।

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে স্নান করল যামিনী। সাবান মাখল ভালো করে। আজ অনেকটা সময় নোংরা জায়গায় কেটেছে। জলে ভেজা গায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যামিনী নিজের ওপর রেগে গেল। কী করে সে ভেবেছিল দেবনাথের মতো সুন্দর একজন মানুষ অমন বিশ্রী একটা কাজ করবে! ছি ছি। যদি কোনওদিন লোকটা ফিরে এসে শোনে, যামিনী রেড লাইট এলাকায় তাকে খুঁজতে গিয়েছিল? কী ভাববে? ছি ছি। গা মুছতে মুছতে যামিনী শুনতে পেল, বাইরে দুটো ফোনই বাজছে। মোবাইল আর ল্যান্ড ফোন। আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি বিছানায় শুয়ে পড়ি।

কিঙ্কিনির খবরটা এল মোবাইলে। থানার সেকেন্ড অফিসার ফোন করেছে। বড়বাবু থানায় ছিলেন না। টহলে গিয়েছিলেন। রাতে ফিরে এসে চিনতে পেরেছেন। হারিয়ে যাওয়া দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে। কিঙ্কিনি থানার বেঞ্চ বমি করে ভাসিয়ে তার ওপরেই শুয়ে আছে। বড়বাবু বলেছেন, মেয়ের মা যেন এখনই থানায় এসে বন্ড লিখে মেয়েকে নিয়ে যায়। এই মেয়েকে হাসপাতালে ভরতি করতে না পারলে বিপদ আছে। মনে হচ্ছে, ডি হাইড্রেশন শুরু হয়েছে। পুলিশ এসব ঝামেলা নিতে পারবে না।

অন্য ফোনটা এসেছে সোনারপুরের এক নার্সিংহোম থেকে। সেই ফোনে শ্রীময়ী নামে। এক অচেনা তরুণী হাউ হাউ করে কাঁদছে আর বলছে, আপনি এক্ষুনি আসুন, এক্ষুনি আসুন। নীলাদ্রি মরে যাচ্ছে, নীলাদ্রি মরে যাচ্ছে…।

যামিনী ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো। তার গা মাথা থেকে টুপ টুপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। সে কী করবে? এই বিপদে কার কাছে যাবে? এমনকী একটা মানুষও আছে যে ছুটে গিয়ে তার ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে পারবে?

.

রিকশা থেকে যে মানুষটা নামল সে কে? চেহারা উদ্ভ্রান্তের মতো। কঁচা পাকা উসকোখুসকো চুল। গাল ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চশমার উঁটিটা একপাশে ভাঙা। স্ট্র্যাপ ছেঁড়া কাঁধের ব্যাগটা চেপে ধরা আছে বুকের কাছে। নামার সময় মানুষটা সাবধানে হাতলটা ধরল। মনে হয় বাঁ-হাতটায় কোনও ব্যথা আছে।

রিকশাওলাকে নীচু গলায় বল, ভাই, কটা বাজে বলতে পারো?

না, সঙ্গে ঘড়ি নেই।

মানুষটা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, মনে হয় দেরি হয়ে গেছে। রিকশা চলে গেছে। মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম অন্ধকারে। সে কোন বাড়িতে যাবে?

Exit mobile version