কিঙ্কিনি চুল বাঁধছিল। তার চুলের ব্যান্ড হারিয়ে গেছে। সামনে ছড়িয়ে থাকা বইখাতা, কাগজপত্র সরিয়ে ব্যান্ডটা খুঁজতে লাগল। আলগোছে বলল, কেন? মনমেজাজ খারাপ কেন?
নীলাদ্রি বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, জানিস না কেন? ঠাট্টা করছিস? বাবার ঘটনাটার পর থেকেই তো এরকম হয়ে গেছে। সেটাই নরমাল।
কিঙ্কিনি ব্যান্ড খুঁজে পায়। চুলে লাগাতে লাগাতে বলল, জানবো না কেন? আমি তো আর ছোট খুকি নই, কিন্তু মা এমন ছোট খুকির মতো ব্যবহার করে কেন বলতে পারিস? মা কি মনে করে দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় নামের মানুষটা শুধু তার স্বামী ছিল? আমাদের বাবা ছিল না? মানুষটা হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের মনমেজাজ খারাপ হতে নেই? দুঃখ অপমান হতে পারে না? বাবা শুধু তার সম্পত্তি? তার মানুষ?
নীলাদ্রি চুপ করে এই অভিমানের কথা শোনে। এগিয়ে এসে বোনের পিঠে হাত রেখে বলল, এইটুকু বয়েসে খুব পাকাঁপাকা কথা শিখেছিস।
কিঙ্কিনি চুপ থেকে শান্ত গলায় বলল, শিখতে বাধ্য হয়েছি। যেসব ছেলেমেয়ের বাবা কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তারা সবাই কম বয়েসে পাকা কথা শিখে যায়। তুইও শিখেছিস। তুই ভালো ছেলে তাই বলিস না। আমি বলে বিপদে পড়ি।
না বললেই পারিস। ওসব বলে মাকে রাগিয়ে দিস কেন?
কিঙ্কিনি দাদার কথার উত্তর না দিয়ে বলে, আমি জানি মা কেন আমার ওপর এত খাপ্পা। নীলাদ্রি ভুরু কোঁচকালো। কিঙ্কিনি বলল, আগে বুঝতে পারতাম না, এখন বুঝি।
নীলাদ্রি বলল, কেন?
কিঙ্কিনি দাদার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল। বলল, থাক, শুনলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।
নীলাদ্রি সেদিন অবাক হয়েছিল। মেয়েটা এই কম বয়সেও কত ম্যাচিওরড হয়ে গেছে। রাগ অভিমানের মধ্যেও গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। বাবাও এরকম গুছিয়ে কথা বলত।
আজও অবাক হল নীলাদ্রি। এই সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে টাকা চাইছেও কেমন সুন্দর করে!
কিঙ্কিনি মাথা কাত করে বলল, কীরে দাদা টাকা হবে?
কত হবে জানি না। পার্সটা দেখ, যা থাকে নিয়ে নে।
কিঙ্কিনি খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, সব নিয়ে নিলে তোর চলবে কী করে।
নীলাদ্রি এবার উঠে বসল। আড়মোড়া ভেঙে বলল, সে আমি বুঝব।
নীলাদ্রিকে তার বাবা-মা কারও মতোই দেখতে হয়নি। তাকে চট করে সুন্দর বলা যাবে না। একজন সাধারণ চেহারার যুবক। ভিড়ে মিশে যাওয়া ধরনের। একসময় আত্মীয়রা বলত, নীলাদ্রি নাকি তার মামার মতো চেহারা পেয়েছে। রোগা আর লম্বাটে গড়ন। শুধু চেহারায় সাধারণ নয়, শান্তস্বভাবের এই ছেলে লেখাপড়াতেও সাধারণ হয়ে গেছে। যে ছেলে চারটে লেটার নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেছিল, সে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় তেমন কিছু করতে পারল না। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার, হল না। হওয়ার কথাও নয়। তখন সবে কদিন হল দেবনাথ নিরুদ্দেশ হয়েছে। গোটা পরিবার বিপর্যস্ত, দিশেহারা। সাজানো গোছানো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। যেন নাটক শেষ হওয়ার আগে মঞ্চের সামনে কেউ কালো, ভারী পরদা টেনে দিল। কদিন পরেই যে নীলাদ্রি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষায় বসবে সেকথা কারও মাথায় রইল না। এমনকী নীলাদ্রিরও নয়। তখন বেঁচে থাকাটাই একটা পরীক্ষা। যেন প্রতিটা মুহূর্তে কঠিন প্রশ্নপত্রের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
হায়ার সেকেন্ডারির মতো গ্র্যাজুয়েশনেও সাধারণ, মাঝারি রেজাল্ট। তাও যামিনী চেয়েছিল, ছেলেটা আরও পড়ুক। আজকাল রেজাল্ট খারাপ হলেও টাকা খরচ করে কেরিয়ার করবার অনেক ব্যবস্থা হয়েছে। ম্যানেজমেন্টে পড়া যায়। নীলাদ্রি সে পথে যায়নি। সে বুঝেছিল, এ-বাড়ির পক্ষে আর টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। উলটে টাকা রোজগার করতে হবে। ছোটখাটো একটা ট্রেনিং করে আই টি সেক্টরে কাজ করছে। প্রজেক্ট অ্যাসিটেন্ট গোছের কাজ। আরও পাঁচজনের সঙ্গে বসে ডাটাবেস তৈরি করতে হয়। সবসময় কাজ থাকে না। এজেন্সির কাছে নাম লেখানো রয়েছে। তারা দরকার মতো খবর দেয়। তখন ছুটতে হয় সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে। তবে কাজ থাকলে পেমেন্ট খারাপ নয়। টানা কাজ থাকাটাই সমস্যা। আই টি সেক্টর বাইরে থেকে শুনতেই গালভারী। নীচের দিকে ভিড় বাড়ছে। অনেকটা সময় হাত গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে হয়। এখন যেমন বেশ কিছুদিন হল নীলাদ্রির বেকারদশা চলছে। নীলাদ্রি বুঝতে পারছে এভাবে চলবে না, একটা অন্য কিছু দেখতে হবে। পাকাপাকি কিছু। চেষ্টাও করছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো কয়েকটা দিয়েছে। এখনও লাগেনি।
নীলাদ্রির ব্যাগে দুশো তিরিশ টাকা মতো পড়ে আছে। একশো টাকার নোটদুটো নিয়ে কিঙ্কিনি বলল, আজ আমাদের বন্ধুদের পিকনিক। আড়াইশো করে চাঁদা।
নীলাদ্রি বলল, পিকনিক! এখন তো শীত নয়, পিকনিক কীসের?
কিঙ্কিনি হেসে বলল, শুধু শীতেই পিকনিক করা যায় এমন কোনও কথা আছে নাকি? আর থাকলেও সে আমরা ভাঙছি। কোথায় যাচ্ছি জানিস দাদা?
কোথায়?
কিঙ্কিনি ঘাড় কাত করে নীলাদ্রির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মিটিমিটি হেসে বলল, উঁহু, বলব না। বললে তুই চিন্তা করবি। সবাই পিকনিক করতে সুন্দর জায়গায় যায়, আমরা একটা ভয়ংকর জায়গায় যাচ্ছি। সেখানে আমাদের ভয়ঙ্কর পিকনিক হবে।
কিঙ্কিনি হাসি ঠাট্টা করলেও নীলাদ্রির বিষয়টা পছন্দ হচ্ছে না। যতই গুছিয়ে সুন্দর করে হাসি মুখে কথা বলুক আজকাল এই মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হয়। কিঙ্কিনির মধ্যে কেমন একটা বেপরোয়া ভাব এসে যাচ্ছে। ধুম ধাড়াক্কা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মা বলেছে, দু-একদিন রাত করেও নাকি বাড়ি ফিরেছে। কখনও আবার টানা তিনদিন নিজের ঘরেই দরজা আটকে বসে থাকে। শুধু খেতে আর স্নান করতে বেরোয়। কারও সঙ্গে কথা বলে না। কিছু বলতে গেলে রেগে যায়। মায়ের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়াও করে। খারাপ কথা বলে। বাইরে থেকে কেউ দেখলে মনে করবে, শাসন নেই। মেয়েটা বিগড়ে যাচ্ছে। মাও তাই বলে। নীলাদ্রির সেরকম মনে হয় না। তার মনে হয়, ছোটবেলায় মায়ের অতিরিক্তি বকাঝকা গোলমাল করে দিয়েছে। এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। মায়ের প্রতি একটা প্রতিশোধ। কই তার সঙ্গে তো কিঙ্কি খারাপ ব্যবহার করে না। পরীক্ষার পর কম্পিউটার ক্লাসে ভরতি হতে বলেছিল, হয়েছেও। মনে হচ্ছে, এবার একদিন মা-কিঙ্কি দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে বসতে হবে। ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে। মায়ের ওপর রাগ করে এই বয়েসে বড় কিছু গোলমাল করে ফেললে সর্বনাশ হবে। তবে কাজটা করতে হবে খুব সতর্ক হয়ে। এই মেয়ে যদি মনে করে দাদাও তাকে শাসন করতে চাইছে, তখন তার হাত থেকেও বেরিয়ে যাবে।