এগুলো মানুষ খায়? নিজেকে গরুর মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘাস খাচ্ছি। রোজ রোজ এই অখাদ্যগুলো খাওয়ার থেকে না খাওয়া ভালো।
যামিনী জানে, নীচু গলায় বললেও মেয়ে তাকে শুনিয়ে কথাগুলো বলছে। এতদিন পরে হঠাৎ এসব কথা কেন! যামিনী কথার উত্তর দেয় না। মাথা নামিয়ে দ্রুত খেতে থাকে। আর উত্তর দেবারই বা কী আছে? মেয়ে তো ভুল বলছে না। সত্যি তো খাবার স্বাদহীন। বিজলীকে অনেকদিন ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। না দিয়ে উপায় ছিল না। এই সংসারে আলাদা করে রান্নার লোক রাখার সামর্থ্যও কোথায়? যামিনী নিজেই রান্না করে। সেই রান্নায় যত্ন, মন কিছুই থাকে না। করতে হয় তাই করা। দু-একদিন মন দেওয়ার চেষ্টা করেছে, পারেনি। মনে হয়েছে, ঠিকমতো রান্না করা সে ভুলেই গেছে। আর কোনওদিনও পারবে না। মাঝেমধ্যে ভয় করে। যদি দেবনাথ ফিরে আসে? তখনও কি রাঁধতে পারবে না?
যামিনী চুপ করে থাকলেও কিঙ্কিনি বলে চলে–
একেই তো মেনু জঘন্য, রোজই এক খাবার, তারওপর কোনওদিন নুন থাকে না, কোনওদিন গাদাখানেক চিনি। আজ মাছের ঝোলে নুন চিনি কিছুই নেই। বমি আসছে।
যামিনী আর পারল না। মুখ না তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, কাল থেকে নিজে রান্না করে নিও।
কিঙ্কিনি নাক মুখ কুঁচকে বলল, জানলে তাই করতাম।
শিখে নাও। ঘর সংসারের কাজ শেখার বয়স তোমার হয়ে গেছে। সারাদিন তো হয় ঘুমোচ্ছ, নয় টইটই করে বেড়াচ্ছ।
কিঙ্কিনি মুখ দিয়ে বিদ্রুপের আওয়াজ করল। বলল, হ্যাঁ, এখন সব ছেড়েছুঁড়ে রান্নাঘরে। ঢুকে হাঁড়ি ঠেলি আর কী। বয়ে গেছে। আমার কোনও বন্ধু রান্না করে না।
যামিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, বন্ধুদের সঙ্গে নিজেকে মেলাবে না।
কিঙ্কিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কেন মেলাব না কেন? তারা কি আলাদা?
যামিনী চোয়াল শক্ত করে বলল, হ্যাঁ, তারা আলাদা। তাদের বাবারা কেউ বউ-ছেলেমেয়ে ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়নি। তোমার বাবা গেছে।
কিঙ্কিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মা, তুমি এমন বলছ যেন বাবা আমাদের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। পানিশমেন্ট হিসেবে আমাকে রান্না করতে হবে, দাদাকে বাসন মাজতে হবে।
যামিনী মুখ তুলে বলল, আমি সেকথা বলিনি। তুমি এমন ভাবে কথা বলছ কেন?
আমি বলিনি, তুমি বলছ। আমি ডালের কথা বললাম, তুমি বাবার কথা বলছ। বাবার চলে যাওয়ার কথা। রান্না খারাপের সঙ্গে বাবার কথা আসে কীভাবে?
গলায় ঝাঁঝ এনে যামিনী বলল, তোমার বাবা গেছে বলেই বলছি। সব কথাতেই আসবে।
কিঙ্কিনি ঠোঁটের কোনায় বেঁকা হেসে বলল, বাবা আমার জন্য তো বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি। আমি কোন দুঃখে ঘাস পাতা খাব? কথাটার মধ্যে চাপা ইঙ্গিত ছিল।
যামিনী স্থির চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কার জন্য গেছে?
কিঙ্কিনি মায়ের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। গলা নামিয়ে বলল, আমরা কী জানি? আমি দাদা দুজনেই তখন যথেষ্ট ছোট ছিলাম। যদি জানার হয় তুমি জানবে। যদি কেন? বাবার বিষয়টা তোমারই জানা উচিত।
যামিনী থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুই কী বলতে চাইছিস?
কিঙ্কিনি গ্লাস তুলে জল খেল। তারপর টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে হালকা ভঙ্গিতে বলল, কী বলতে চাইছি তুমি ভালো করেই জানো মা। আমি কেন সবাই তোমাকে এই কথাটাই বলে। বলে না?
যামিনী কিছু বলতে গিয়ে থেমে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর হিসহিসিয়ে বলে উঠল, চুপ কর কিঙ্কি, চুপ কর। খুব সাহস হয়েছে তোর, খুব সাহস, মুখে যা আসছে বলে ফেলছিস।
যামিনীর ধমক কিঙ্কিনি পাত্তা দিল না। হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সহজ গলায় বলল, সাহস হওয়া তো খারাপ নয় মা। যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক কিছু বলতে পারিনি, অনেক কিছু অজানাও থেকে গেছে। এখন তো আর ছোট নেই। তারওপর অনেকে অনেকরকম বলে। সেটাই বলছি।
যামিনী উঠে দাঁড়ায়। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, কী বলে?
বাথরুম থেকে কিঙ্কিনি চিৎকার করে বলে, কী বলে তুমি ভালো করেই জানো। জানো না?
এরপর থেকে যামিনী মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। নীলাদ্রি শান্তপ্রকৃতির ছেলে। সে ঝগড়াঝাটি সহ্য করতে পারে না। পরদিন সকালে বোনকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করিস না।
দাদার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কিঙ্কিনি বলল, মা তোকে লাগিয়েছে?
নীলাদ্রি বলল, এর মধ্যে লাগানোর কী আছে? মায়ের মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। কাল রাতে খায়নি। উফ তোরা কি একটুও চুপ করে থাকতে পারিস না?
কিঙ্কিনি মুখ নামিয়ে বলল, আমি কিছু করিনি।
যে-ই করুক, দয়া করে ঝামেলা বন্ধ কর।
কিঙ্কিনি বলল, থামা বললেই কি থামবে দাদা? ঝামেলা তো শুধু আজ হচ্ছে না, বহুদিন ধরেই হচ্ছে। মা আমাকে সহ্য করতে পারে না। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই এই কাণ্ড চলছে। আমাকে দেখলেই তার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। মনে আছে দাদা, একবার সকালে বাবার মতো গরম চায়ের কাপ হাতে পেপার পড়ছিলাম বলে মা টেনে তুলে দেওয়ালে মাথা। ঠুকে দিয়েছিল? মনে আছে? এই দেখ এখনও দাগ রয়েছে। কপালের চুল সরায় কিঙ্কিনি। সত্যি বাঁদিকে ভুরুর পাশে দাগ রয়ে গেছে।
নীলাদ্রি জানে কিঙ্কিনি যা বলছে ভুল বলছে না। মায়ের ওপর তার রাগ আর শুধু রাগে আটকে নেই। খানিকটা যেন ঘৃণার চেহারা নিয়েছে। মা যে কেন কিঙ্কির ওপর এত বিরক্ত, এতদিনেও বুঝতে পারে না নীলাদ্রি। তবু সে বলল, জানিসই তো মায়ের মনমেজাজ সবসময় খারাপ হয়ে থাকে।