কিঙ্কিনি নীলাদ্রির খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। ঝুঁকে পড়ে ডাকল, দাদা, অ্যাই দাদা।
নীলাদ্রি কোনও উত্তর দিল না। নড়েচড়ে শুল মাত্র। কিঙ্কিনি মশারির ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে নীলাদ্রির মাথার বালিশ ধরে টান দিল। নীচু গলায় আবার ডাকল, কীরে উঠবি তো!
চোখ বোজা অবস্থাতে নীলাদ্রি বিরক্ত গলায় বলল, কী হয়েছে?
আগে ওঠ, তারপর বলছি।
উঠতে পারব না। কী হয়েছে বল।
কিঙ্কিনি খাটের একপাশে বসল। এক ঝলক দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসে গলায় বলল, আড়াইশো টাকা দিতে পারবি? ঠিক আছে আড়াইশো দিতে হবে না, দুশো কুড়ি পঁচিশ হলেই হবে। আছে?
নীলাদ্রি এবার বালিশ সরিয়ে চিত হয়ে শুল। চোখ খুলল। আড়াইশো টাকা! কিঙ্কিনি তার কাছে মাঝেমধ্যে টাকা চায় বটে, কিন্তু সে তো পাঁচ দশ। খুব বেশি হলে পঞ্চাশ। কোনও কোনও সময় মোবাইল রিচার্জ করিয়ে দিতে হবে। একসঙ্গে এত টাকা তো কখনও চায়নি!
কিঙ্কিনি হেসে বলল, কেন চাইছি জানতে চাইবি না কিন্তু।
কিঙ্কিনি দেখতে সুন্দর হয়েছে। তবে যামিনীর মতো নরমসরম সুন্দর নয়। কিঙ্কিনির চেহারার মধ্যে একটা ঝকঝকে ছাপ রয়েছে। দেবনাথের মতো। চোখমুখ শার্প। হাঁটাচলা, হাবভাবের মধ্যেও দেবনাথের মতো চাপা কনফিডেন্স। ভাবটা এমন যেন আমি যা করি ভেবেচিন্তে করি, ঠিক করি। দেখলে মনে হয়, এই মেয়ের বুদ্ধি বেশি। শুধু দেখতে নয়, কথাবার্তাতেও সে তার বাবার মতো রসিকতা তৈরি করতে শিখেছে।
কিঙ্কিনি এই সাতসকালেই বাইরে বেরোনোর জন্য তৈরি। স্নান সেরে জিনস আর কালো টপ পরেছে। মেয়েদের পছন্দের রং কালো নয়। তবু কিঙ্কিনি মাঝেমধ্যেই কালো রঙের পোশাক পরে। কারণ সে জানে তার গায়ের ফরসা রঙে কালো ঝলমল করে। নিজের সৌন্দর্যের বিষয়ে। বেশি মাত্রায় সচেতন কিঙ্কিনি। সে বুঝতে পারছে, শুধু নিছক সৌন্দর্য নয়, তার চেহারা ইতিমধ্যেই একধরনের আকর্ষণ তৈরি করতে শুরু করেছে। সম্ভবত একেই বলে শরীরী আকর্ষণ। খুব জোরালো নয়, কিন্তু তৈরি হয়েছে। অতি সাধারণ সাজগোজ করলেও রাস্তাঘাটে ছেলেরা তার দিকে না তাকিয়ে পারে না। বন্ধুরাও বিষয়টা জানে। ঠাট্টা করে বলে, তোর সঙ্গে বেরোতে ইচ্ছে করে না। আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। বৈদভটিা অসভ্য। একটু গোলমেলেও আছে। একদিন আড়ালে ফট করে বুকে হাত দিয়ে বসল। বলল, হাউ নাইস কিঙ্কি! আউচ! কত বড় হয়ে গেছে!
নীলাদ্রি ভুরু কুঁচকে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বোনকে সে ভালোবাসে। দেবনাথের নিরুদ্দেশ হওয়ায় সেই ভালোবাসা খানিকটা আশকারার চেহারা নিয়েছে। শুধু দেবনাথের নিরুদ্দেশ হওয়া নয়, আশকারার অন্য কারণও আছে। স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মেয়ের প্রতি যামিনী ক্রমশ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে। যত দিন। গেছে সেই ভাব বেড়েছে। মেয়েদের কোনও কিছু যেন তার পছন্দ হয় না। আচার-আচরণ, কথাবার্তা সবেতেই বিরক্ত হয়! ছোটখাটো বিষয়ে বকাঝকা করে, খোঁচা দিয়ে কথা বলে। একটা সময় মারধোরও করেছে। কঠিন মার। কিঙ্কিনি প্রথম প্রথম মায়ের এই ব্যবহারে অবাক হত। অভিমান করত। মা তার সঙ্গে কেন এমন করে! কই দাদার সঙ্গে তো করে না! সে কী দোষ। করল? তাকে বলার জন্য মা কেন খুঁজে খুঁজে কারণ বের করে? কারণ না পেলে, বানিয়ে বানিয়ে কারণ তৈরি করে। স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে চুলের মুঠি চেপে ধরেছে। কিঙ্কিনি বলার চেষ্টা করেছে, দেরি সে করেনি, তার স্কুলবাস খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মা শোনেনি। টিভি দেখলে রেগে যেত। টিভিতে সিনেমা বা সিরিয়াল নয়, ছোটবেলা থেকেই কিঙ্কিনির চ্যানেল ঘুরিয়ে খবর দেখার নেশা। দেবনাথের মতো। খবর কিছু বুঝত না। তবু দেখত। যামিনী রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে চড় মারত। পাড়ার কোন বখাটে ছেলে দুদিন বাড়ির সামনে সাইকেলের বেল বাজিয়ে চলে গেছে, কিঙ্কিনি জানেও না। বেধড়ক মার খেয়েছে কিঙ্কিনি। অপমানের মার। পায়ের চটি খুলে মেরেছে যামিনী। তখন মাকে ভয় পেত কিঙ্কিনি, লুকিয়ে কাঁদত। একটা বয়সের পর যামিনী মেয়েকে মারধোর বন্ধ করল, কিন্তু বকাঝকা চলতে লাগল। কিঙ্কিনি খানিকটা বড় হয়ে কান্নাকাটি, মান অভিমান সব বন্ধ করে দিয়েছে। মায়ের বকাঝকা, বেঁকা কথা এখন আর তার গায়ে লাগে না, সে ভয়ও পায় না। হয় অবজ্ঞা করে, নয় মুখে মুখে কথা বলে। কিছুদিন আগেও মেয়ের তর্ক শুনলে যামিনী চিৎকার করে উঠত। কিঙ্কিনি শান্ত গলায় বলত, মা, তুমি যদি চিৎকার কর আমি তোমার ডবল চিৎকার করব। তুমি চিৎকার করতে করতে হাঁপিয়ে যাবে। আমি হাঁপাব না, কারণ আমার বয়স তোমার থেকে কম। আমার দম বেশি।
তারপর থেকে যামিনী চিৎকার করা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছে। যেটুকু না বললে নয়। গত সোমবারের কথা কাটাকাটির পর থেকে তা-ও বন্ধ। এখন পরোক্ষ ভাবে খাবার দেওয়া হয়েছে, ড্রেসিং টেবিলের ওপর টাকা রইল, ছাদ থেকে জামাটা তুলতে হবে গোছের কথা চলে। বাকিটুকু ভায়া নীলাদ্রি।
মা-মেয়ে একসঙ্গে খেতে বসে না আজকাল। হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকেই কিঙ্কিনি এই নিয়ম চালু করেছে। পড়ার চাপ। সময় ধরে খাওয়াদাওয়া সম্ভব নয়। কোনওদিন ভাত খেতে বেলা গড়িয়ে যায়, কখনও ডিনারে বসতে রাত হয়। সুতরাং যে যার মতো খেয়ে নিতে হবে। তবু গত সোমবার দুজনে একসঙ্গে টেবিলে বসেছিল। মা-মেয়ে দুজনেরই তাড়া। কিঙ্কিনি শালিনীর সঙ্গে কলকাতায় যাবে। শালিনীর বড়মামা হাসপাতালে, ভাগনিকে দেখতে চেয়েছেন। সে একা যাবে না, বন্ধুকে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে হাসপাতালে যাওয়ার আগে সিনেমা দেখবে দুজনে। ফেরা নিয়ে চিন্তা নেই। শালিনীর বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে ওদের নিয়ে আসবে। চুপচাপই খাচ্ছিল দুজনে। টেবিলের দুদিকে বসে। মেনু নিয়ে আপত্তি তুলল কিঙ্কিনি। নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল। ছাপোষা ডাল-ভাত আর মাছের ঝোল তার আর সহ্য হচ্ছে না। অরুচি ধরে গেছে। তারওপর রান্নাও খারাপ। স্বাদ নেই। নীচু গলায় কিঙ্কিনি একটানা বলতে থাকে