ছেলেমেয়ে বাবার এই স্বভাব পছন্দ করে না। মায়ের কাছে বিরক্তি দেখায়। নীলাদ্রি বলে, যতসব ব্যাকডেটেড ব্যাপার। খাওয়া নিয়ে বাবার এসব বাড়াবাড়ির কোনও মানে হয় না। পেট ভরাতে একটা কিছু খেয়ে নিলেই হল।
কিঙ্কিনি বলে, আমি পেট ভরাতেও চাই না। ভাত খেতেই আমার জঘন্য লাগে। মাছ তো হরিবল। ইস মাছ খাওয়া কে যে আবিষ্কার করল। আমি দুপুরে শুধু স্যান্ডুইচ খেতে চাই। যামিনী শাসন করে। বলে, ছিঃ, বাবার সামনে এসব বোলো না। দুঃখ পাবে। আমাদের সকলের জন্য মানুষটা কত যত্নে বাজার করে, সেটা তো দেখবে।
নীলাদ্রি মুখ ঘুরিয়ে বলল, মায়ের সবসময় বাবাকে সাপোর্ট।
কিঙ্কিনি মাথার চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক বলেছিস। আমাদের ফ্যামিলিতে দুটো দল। বাবা-মা একদিকে, আমরা দুজন অন্যদিকে।
যামিনী হেসে ফেলে। বলে, থাক, অনেক পাকা পাকা কথা হয়েছে। এবার কাজে যাও।
.
ইলিশ, বেগুনের ফিরিস্তি শোনার পর যামিনী রাগী গলায় বলল, এই তোমার মজার কথা!
দেবনাথ চায়ের কাপে চুমুক দিল। বলল না, এটা মজার কথা নয়। মজার কথা অন্য। বাজার সেরে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই হঠাৎ খেয়াল হল, আরে, মলয়বাবুর কথাটা মাথায় ঢুকে গেছে! ঢুকে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেরি হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে…। বোঝে কাণ্ড! একটা অতি সাধারণ কথা, দিনের মধ্যে চোদ্দোবার বলি, আজ হঠাৎ খচ করে মাথায় ঢুকে যাবে কেন! আমি অন্য কথা ভাবতে শুরু করলাম। বাজারে কেমন ঠকলাম, মেয়েটার অঙ্কের জন্য একজন ভালো টিউটর দিলে কেমন হয়, ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে কত টাকা লাগবে? ব্যাঙ্ক লোন পাব? এখন থেকেই খোঁজখবর নেওয়া দরকার। ঠিক করলাম, কোন্নগরে দাদার কাছে দু-একদিনের মধ্যেই যাব, এক মাসেই বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা ফাইনাল করব। টাকা পেলেই ফ্ল্যাট কিনব। ভাড়া বাড়ি থেকে বিদায় নেব। কিন্তু তাতেও দেখলাম লাভ হল না। মলয়বাবুর দেরি হয়ে গেছের ভূত ঘাড় থেকে নামছে না। শুধু তা-ই নয় যামিনী, একটু পরে দেখি, আমার নিজেরও একইরকম মনে হতে শুরু করেছে! দেরি হয়ে গেছে। কীসের দেরি, কেন দেরি কিছু বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে দেরি হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলাম। তারপর থেকেই হাসছি। ঘটনা মজার না?
কথার উত্তর না দিয়ে যামিনী রান্নাঘরে ছুটল। এখন প্রতিটা মুহূর্তই জরুরি। ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়োতে হবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই কেলেঙ্কারি। সংসার নিখুঁত ভাবে চালানো সোজা কথা নয়।
সারাদিন সবকিছু নিখুঁত ভাবেই চলল। নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি স্কুল শেষ করে, কোচিং থেকে পড়ে বাড়ি ফিরল সন্ধের মুখে। যামিনী জলখাবার বানিয়ে দিল। মেয়েকে জিওগ্রাফির ম্যাপ দেখিয়ে দিল। সাউথ আফ্রিকার নদ-নদী। টিভিতে সিরিয়াল দেখল। কোন্ননগরে জা-কে ফোন করল। ভাশুরের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। প্রেশারের সমস্যা। বিজলি সকালেই সব বেঁধে গেছে। তবু যামিনী রান্নাঘরে গেল। সামান্য রান্না করল। একেবারেই সামান্য। বেসন মাখিয়ে কটা আলু ভাজল। দেবনাথ পছন্দ করে। মেয়েটাও চায়। কিঙ্কিনি বাবার মতো হয়েছে।
সবই ঠিকঠাক চলল, শুধু দেবনাথ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল না। যামিনী, নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি অপেক্ষা করে রইল। একদিন, দুদিন, তিনদিন…। দেবনাথ বাড়ি ফিরল না।
০২. নীলাদ্রির ঘুম ভাঙল
০২.
নীলাদ্রির ঘুম ভাঙল কান্নার আওয়াজে। হইচই করে কান্না নয়, চাপা ফোঁপানি। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে। নীলাদ্রি মাথার বালিশটা টেনে কানে চাপা দিল। পাঁচ বছর ধরে এই একই জিনিস চলছে। এ বাড়িতে সকাল হয় কান্নার আওয়াজ দিয়ে। রান্নাঘরে মা চা করে আর কাঁদে। কাপ, ডিশ, চামচের টুং-টাং শব্দের সঙ্গে সেই কান্নার আওয়াজ ভেসে-ভেসে বেড়ায়।
দরজা ঠেলে কিঙ্কিনি ঘরে ঢুকল। এত সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে না। আজকাল তার বিছানা ছাড়তে অনেক বেলা হয়। মাত্র উনিশদিন হল তার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার শেষদিন কিঙ্কিনি তার বন্ধুদের কাছে ঘোষণা করেছিল–
রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত আমি বিছানা থেকে নামব না। বিছানায় বসে খাব, গল্পের বই পড়ব, টিভি দেখব, কম্পিউটারে চ্যাট করব, আর মাঝেমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ব। আমার খাটের পাশে চেয়ার থাকবে। তোরা এলে সেই চেয়ারে বসবি। আড্ডা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলবি, চল কিঙ্কি, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিবি। আমি বলব, সরি, আমি যেতে পারছি না। রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত আমার খাট থেকে নামা বারণ। পলিটিক্যাল নেতারা যেমন গৃহবন্দি হয়, আমি তেমন খাটবন্দি হয়েছি।
শুধুমাত্র পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলেই যে কিঙ্কিনি বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে এমন নয়। অনেক সময় ভোরে তার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে। যামিনী কখন স্কুলে বেরিয়ে যাবে তার জন্য অপেক্ষা। যতটা মায়ের মুখোমুখি না হওয়া যায়। যামিনীর ছুটিছাটার দিনগুলোয় সে পারতপক্ষে বাড়ি থাকতে চায় না। বন্ধুর বাড়ি, সিনেমা হলে চলে যায়। কিছু না থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। সবদিন অবশ্য দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। কদিন হল নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে। কম্পিউটার ক্লাস। সপ্তাহে দুদিন করে। সকালে উঠে যেতে হয়। দাদার জোরাজুরিতে ভরতি হতে বাধ্য হয়েছে কিঙ্কিনি। আড়াল থেকে মায়ের চাপ থাকতে পারে। পারে কেন? নিশ্চয় ছিল। কিঙ্কিনির একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। তার কম্পিউটারে চ্যাট করতে, গান শুনতে ভালো লাগে। কোর্স শিখতে ইচ্ছে করে না। অঙ্কের কিছু থাকলে তো একেবারেই নয়। ছোটবেলায় তার অঙ্ক নিয়ে যে সমস্যা ছিল। তা কাটেনি, বরং বেড়েছে। সেই কারণেই আর্টস নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়া। কিঙ্কিনি জানে তাতেও খুব কিছু লাভ হবে না। তার রেজাল্ট বেশ খারাপই হবে। মাঝারি ধরনের সেকেন্ড ডিভিশন পেতে পারে। পড়াশোনা তার মাথায় ঢোকে না এমন নয়, কিন্তু পরীক্ষার জন্য যতটা পড়ার দরকার তা সে পড়েনি। যত দিন যাচ্ছে বুঝতে পারছে, লেখাপড়া তার বিষয় নয়। পড়তে তার ভালো লাগে না। তার বিষয় অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুটা কী?