দেবনাথ ভুরু কুঁচকে বলল, কী আদিখ্যেতা করলাম?
যামিনী সরে গিয়ে বলল, জানি না।
দেবনাথ দু-হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে টানতে যায়। ফিসফিস করে বলল, জানি না বললে ছাড়ব কেন?
যামিনী বলল, অ্যাই ছাড়ো, ছেলেমেয়ে জেগে আছে। আওয়াজ পাবে।
ঠিক আছে, আওয়াজ হবে না। সাইলেন্ট মুভি।
যামিনী স্বামীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে করতে বলল, বুড়ো বয়েসে শখ গেল না। অসভ্য! তাড়াতাড়ি করো।
দেবনাথ দ্রুত হাতে যামিনীর নাইটি খুলতে খুলতে বলল, শখ যাবে কী করে? বউ এরকম সুন্দরী থাকলে মরার সময়েও শখ যাবে না।
কথাটা মিথ্যে নয়। দুই সন্তানের মা হলেও যামিনীর শরীর এখনও নষ্ট হয়নি। হিসেব মতো এতদিনে একটা ছাড়া-ছাড়া ভাব এসে যাওয়ার কথা। যামিনীর বেলায় এখনও আঁটোসাঁটো রয়েছে। পেটে মেদ জমেনি। বুকদুটো আজও অল্পবয়সিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এই বয়েসে গায়ের চামড়া ঠিক রাখাটা বিরাট সমস্যা। ঘরে-বাইরে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। যামিনীর হাতে-পায়ে বা নাকের পাশে কোথাও চামড়া এতটুকু কোঁচকায়নি। রাতে মেয়ের কাছে শোয় যামিনী। ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সপ্তাহে দু-তিনদিন দেবনাথের কাছে আসে। মুখে বিরক্তি দেখালেও আসতে ভালো লাগে। এই দিনগুলোর জন্য মনে মনে অপেক্ষা করে। মাঝেমাঝে। যামিনী অবাকও হয়। এই বয়েসে স্বামীর আদর এত কেন ভালো লাগবে! শরীরের কারণে? নাকি ভালোবাসা?
বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে নামিয়ে দেবনাথ বলল, ঝটপট চা দাও। তখনও তার মুখে হাসি হাসি ভাব। যামিনী আড়চোখে তাকিয়ে বলল, রিকশা করে এলে যে? ব্যথা বেড়েছে?
আরে না না, আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে।
যামিনী চুপ করে রইল। দেবনাথের মজার গল্প শোনার মতো সময় তার নেই। মেয়ে। স্কুলে চলে গেছে। ছেলে এখনই বেরোবে। আজ তার কেমিস্ট্রি না ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল। নীল বলে ল্যাব আছে। তাকেও কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময় স্কুলে ছুটতে হবে। আজ থেকে স্কুলে হাফইয়ারলি শুরু। টানা সাতদিনের ঝামেলা। কামাই চলবে না। এদিকে কিঙ্কিনির পরীক্ষা শুরু হবে পরের সপ্তাহ থেকে। পরীক্ষার আগের কটাদিন মেয়েটার পাশে না বসলে হয় না। ঘ্যানঘ্যান করে।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দেবনাথ বলল, মজার কথাটা শুনবে?
না, শুনব না, তোমার মজা শোনার সময় নেই। তুমি এই উইকটা ছুটি নাও। কিঙ্কির পরীক্ষা। আমি কামাই করতে পারব না।
দেবনাথ বলল, আচ্ছা সে দেখা যাবে। ঘটনাটা শোনো তো আগে।
যামিনী না শুনতে চাইলেও দেবনাথ রসিয়ে ঘটনা বলতে শুরু করল–
আমি বাজারে যাচ্ছি, দেখি মলয়বাবু হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলাম। ভাবলাম, এই রে, মলয়বাবু মানেই সময় নষ্ট। বুড়োমানুষ একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একশোবার বলবে। পালাতেও পারব না। পুরোনো বাড়িওলা বলে কথা। প্রথম যখন এখানে আসি, কিছু চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না, কেউ চট করে ভাড়া দিতে চায় না, তখন ঘর দিয়ে মানুষটা উপকার করেছিল। সেই মানুষকে পাশ কাটিয়ে যাই কী করে? বুঝলাম, আজ বিপদ কেউ ঠেকাতে পারবে না। মলয়বাবু টানতে টানতে চায়ের দোকানে ঢোকাবেন। আগেও উনি এই কাজ করেছেন। গাদাখানেক সময় নিয়ে তবে ছেড়েছেন। আশ্চর্যের কথা কী জানো যামিনী, ভদ্রলোক আজ সেরকম কিছুই করলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। বেচারা ধরনের হাসি। বললেন, আজ চলি কেমন? দেরি হয়ে গেছে। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে বললাম, বেশ হয়েছে। তোমার দেরি না হলে আজ আমার ঝামেলা হত। তারপর মন দিয়ে বাজার করলাম। ভালো ইলিশ এসেছে। মাঝারি দেখে একটা নিয়েছি। মিলিয়ে বেগুন নিয়েছি, কুমড়ো নিয়েছি। বহুদিন কুমড়ো, বেগুন দিয়ে ইলিশমাছের হালকা ঝোল খাওয়া হয় না।
.
দেবনাথ বেশি খেতে পারে না, কিন্তু খাদ্যরসিক। তার থেকে বলা ভালো বাজার এক্সপার্ট। মিলিয়ে মিলিয়ে বাজার করতে ওস্তাদ। মোচা কিনলে নারকেল, ছোলা কেনে। লাউ নিলে সঙ্গে ধনেপাতা আনতে ভোলে না। ছুটির দিন খেতে বসে ছেলেমেয়েকেও বলে, আচ্ছা, নীল বল তো, কই মাছের সঙ্গে কোন আনাজ ভালো যায়?
নীলাদ্রি মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। সেই তাকানোয় একইসঙ্গে বিরক্তি এবং বিস্ময়। তারপর মাথা নামিয়ে আবার খাওয়ায় মন দেয়।
যামিনী বলে, আহা, ও এসব জানবে কী করে?
দেবনাথ ভাত মাখতে মাখতে বলে, শিখবে। শুধু লেখাপড়া শিখলেই তো হবে না খাওয়া দাওয়াও শিখতে হবে। আমি বুড়ো হলে কী হবে? বাজার করবে কে? সেইজন্যই তো ইজি দিয়ে শুরু করেছি। আচ্ছা কিঙ্কি, এবার তুমি বল, লাউয়ের ঘন্টে কোন মাছ দিলে মুখে জল আসে? এটা কিন্তু তোমার পারা উচিত। ভেরি ইজি।
কিঙ্কিনি মুখ না তুলে বলে, বাবা, তুমি ঠাকুমার কাছে রান্না শিখেছ না?
দেবনাথ হো হো আওয়াজে হেসে ওঠে। বলে, দুর, রান্নার আমি কী জানি? আমাকে। কখনও রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেছিস? এসব নিজে নিজেই শিখতে হয়। তোরাও শিখবি। এই ধর না তোর মা, রান্নার কিস্যু জানত না। এখন কত কী পারে। কেন পারে জানিস? আমরা কী খেতে ভালোবাসি সেটা বুঝে গেছে। রান্নাটা বড় কথা নয়, নিজের লোক কী ভালোবাসে এটা জানাই বড় কথা। জানলে রান্নাও আসে ভালো হবে।
যামিনী বলে, উফ তুমি লেকচার থামাবে? খেতে বসে বকবক!