কাকে চান?
ঢোঁক গিলে যামিনী বলল, আমি একজনকে খুঁজছি। এই বাড়িতে থাকেন।
কাকে? মানুষটা বিরক্ত গলায় বলে।
মঞ্জু নামে একজনকে।
হ্যাঁ, উনি আমার স্ত্রী। কী ব্যাপার বলুন।
বড় করে শ্বাস ফেলল যামিনী। দম বন্ধ করে থাকার পর যেন অনেক দিন পরে নিশ্বাস নিতে পারল। সামান্য হেসে বলল, কোনও ব্যাপার নয়। উনি কখন ফিরবেন?
লোকটা আরও বিরক্ত হল। বলল, জানি না। কাজে গেছে। আজ না-ও ফিরতে পারে। মোবাইলটা ফেলে গেছে, নইলে জেনে বলে দিতাম। কী দরকার আমাকে বলুন।
যামিনী বলল, তেমন কিছু নয়, আসলে উনি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা পেতেন, বেশি নয়, এই শ তিনেক। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে যামিনী বলল, বলবেন, যামিনী টাকাটা দিয়ে গেছে। যামিনী চিনতে না পারলে বলবেন দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী।
বাস এবং ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল যামিনীর। তার মধ্যেই ফোনে বিশাখা এবং হিন্দোলের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।
হিন্দোল ট্যুরে নর্থ বেঙ্গল। শিলিগুড়ি না জলপাইগুড়ি। সেখান থেকেই চিৎকার করে বলল, আমি যাদবের মাথা ভাঙব। ছি ছি।
যামিনী বহুদিন পর প্রাণ খুলে হাসল। বলল, কী যে বল হিন্দোল, আমি তো ঠিক করেছি ওকে মিষ্টি খাওয়াব। ভুল খবর দেওয়ার উপহার।
বাড়ি এসে লক খুলে ঘরে ঢুকল যামিনী। ছেলেমেয়ে কাউকে না দেখে চিন্তিত হল। সামান্য। নীলকে নিয়ে চিন্তা নয়। চিন্তা মেয়েটাকে নিয়ে। মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নীলই বা আজ এত দেরি করছে কেন? এই সপ্তাহে তো কাজ নেই। সেক্টর ফাইভে যেতে হয়নি। পরের সপ্তাহ থেকে নাকি লম্বা ডিউটি হবে। দুটো শিফটেও কাজ করতে হবে। নীল সেদিন বলল, চাকরির জন্য ভিক্ষা চেয়ে লাভ কী? শুধু শুধু অপমানিত হওয়া। পরীক্ষা দিয়ে ঠিক একটা কিছু পেয়ে যাব। ততদিন এই ফুরনের কাজই ভালো। টাকা তো মন্দ নয়। কথাটা ঠিক বলেছে। ছেলেটা শান্ত হয়েছে। মা বা বোনের মতো চট করে রেগে যায় না। বুদ্ধিও আছে। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক জীবন পেলে লেখাপড়াতেও ভালো করত। সেদিন বলল, কিঙ্কিকে মামার কাছে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও মা। ওকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। তুমি বুঝিয়ে বললে মামা না করবে না। মামার যত প্রবলেম এখানে আসা নিয়ে। কিঙ্কির যাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না। আর একবার। চলে গেলে নিজে ঠিক কিছু করে নিতে পারবে। তুমি কথা বল মা। এটাও ভালো পরামর্শ।
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে স্নান করল যামিনী। সাবান মাখল ভালো করে। আজ অনেকটা সময় নোংরা জায়গায় কেটেছে। জলে ভেজা গায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যামিনী নিজের ওপর রেগে গেল। কী করে সে ভেবেছিল দেবনাথের মতো সুন্দর একজন মানুষ অমন বিশ্রী একটা কাজ করবে! ছি ছি। যদি কোনওদিন লোকটা ফিরে এসে শোনে, যামিনী রেড লাইট এলাকায় তাকে খুঁজতে গিয়েছিল? কী ভাববে? ছি ছি। গা মুছতে মুছতে যামিনী শুনতে পেল, বাইরে দুটো ফোনই বাজছে। মোবাইল আর ল্যান্ড ফোন। আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি বিছানায় শুয়ে পড়ি।
কিঙ্কিনির খবরটা এল মোবাইলে। থানার সেকেন্ড অফিসার ফোন করেছে। বড়বাবু থানায় ছিলেন না। টহলে গিয়েছিলেন। রাতে ফিরে এসে চিনতে পেরেছেন। হারিয়ে যাওয়া দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে। কিঙ্কিনি থানার বেঞ্চ বমি করে ভাসিয়ে তার ওপরেই শুয়ে আছে। বড়বাবু বলেছেন, মেয়ের মা যেন এখনই থানায় এসে বন্ড লিখে মেয়েকে নিয়ে যায়। এই মেয়েকে হাসপাতালে ভরতি করতে না পারলে বিপদ আছে। মনে হচ্ছে, ডি হাইড্রেশন শুরু হয়েছে। পুলিশ এসব ঝামেলা নিতে পারবে না।
অন্য ফোনটা এসেছে সোনারপুরের এক নার্সিংহোম থেকে। সেই ফোনে শ্রীময়ী নামে। এক অচেনা তরুণী হাউ হাউ করে কাঁদছে আর বলছে, আপনি এক্ষুনি আসুন, এক্ষুনি আসুন। নীলাদ্রি মরে যাচ্ছে, নীলাদ্রি মরে যাচ্ছে…।
যামিনী ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো। তার গা মাথা থেকে টুপ টুপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। সে কী করবে? এই বিপদে কার কাছে যাবে? এমনকী একটা মানুষও আছে যে ছুটে গিয়ে তার ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে পারবে?
.
রিকশা থেকে যে মানুষটা নামল সে কে? চেহারা উদ্ভ্রান্তের মতো। কঁচা পাকা উসকোখুসকো চুল। গাল ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চশমার উঁটিটা একপাশে ভাঙা। স্ট্র্যাপ ছেঁড়া কাঁধের ব্যাগটা চেপে ধরা আছে বুকের কাছে। নামার সময় মানুষটা সাবধানে হাতলটা ধরল। মনে হয় বাঁ-হাতটায় কোনও ব্যথা আছে।
রিকশাওলাকে নীচু গলায় বল, ভাই, কটা বাজে বলতে পারো?
না, সঙ্গে ঘড়ি নেই।
মানুষটা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, মনে হয় দেরি হয়ে গেছে। রিকশা চলে গেছে। মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম অন্ধকারে। সে কোন বাড়িতে যাবে?