কথাটা বলে মধুসূধন কুইল্যা ফিক করে হাসলেন। নীলাদ্রি শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল। বলল, কে বলেছে পারব না, খুব পারব।
কীভাবে? চোখে কৌতুক নিয়ে মধুসূদন কুইল্যা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
এক মুহূর্তও সময় নিল নীলাদ্রি। মনে হয় দম টানল। তারপর গায়ের সব শক্তি দিয়ে চড় বসাল গালে। চিমসে লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলের ওপর। নীলাদ্রি আঙুল তুলে বলল, আর একটু আছে দাদাভাই। ল্যাপটপটা তুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ঝনঝন আওয়াজে বাইরে থেকে প্রথম দরজা ঠেলে ঢুকল শ্রীময়ী। টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা মধুসূদন কুইল্যা হিসহিস করে বলল, কাজটা ভালো করলে না ছোকরা, ভালো করলে না।
রাগে কাঁপতে থাকা নীলাদ্রি শ্রীময়ীর হাত ধরে বলল, এবার চল, এই লোকটার একটা শিক্ষা দরকার ছিল।
রিকশা ধরেও পালানো গেল না। নীলাদ্রিরা সোনারপুর স্টেশনে পৌঁছোনোর আগেই দুটো মোটরবাইক পথ আটকে দাঁড়াল। মোট চারজন এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে, ঝামেলা হতে পারে ভেবে অনেক আগে থেকেই মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এদের ডেকে নিয়েছিল মধুসূদন। নইলে এত তাড়াতাড়ি আসবে কী করে! তারা খুব ঠান্ডা গলায় নীলাদ্রিকে বলল, নেমে আয় শুয়োরের বাচ্চা।
মোট দুদফায় মারা হল নীলাদ্রিকে। প্রথমবার রিকশা থেকে নামিয়ে রাস্তায়। দ্বিতীয়বার মধুসূধন কুইল্যার চেম্বারের সামনে। মধুসূদন নিজে লোহার রড এনে মারল। রক্তে ভেসে যাওয়া নীলাদ্রিকে আবার রিকশাতে তুলেও দিল ওরা যত্ন করে।
গোটা পথটা তাকে জড়িয়ে শ্রীময়ী থরথর কাপল আর বিড়বিড় করে বলল, আমার জন্য হল, সব আমার জন্য হল…।
রিকশা স্টেশনে পৌঁছনোর পরপরই নীলাদ্রি পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
১০. দেবনাথের খোঁজে গিয়ে
১০.
দেবনাথের খোঁজে গিয়ে যখনই ব্যর্থ হয়েছে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে যামিনী। এমনকী কয়েক বছর হল, মৃতদেহ শনাক্ত করার ডাক পেলেও কামনা করেছে, যেন দেবনাথই হয়। হারিয়ে যাওয়ার থেকে মৃত্যু ভালো। মৃত্যুতে শোক আছে, হারিয়ে যাওয়ার মতো অপমান নেই। মৃত্যুতে শেষ আছে। হারিয়ে যাওয়ার কোনও শেষ নেই। অনন্তকাল ধরে কুরে কুরে খায়।
এই প্রথম স্বামীর খোঁজে ব্যর্থ হয়ে দারুণ খুশি হল যামিনী। দুপুরে শহিদ বলরাম কলোনি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার মনে হচ্ছিল, শরীর হালকা হয়ে গেছে। সে উড়ে যেতে পারে! খারাপ পাড়ার অশ্লীল গালি, আবর্জনার দুর্গন্ধ, পথ জুড়ে পড়ে থাকা নোংরা জল যেন কিছুই নয়! এমনকী নাকে শাড়ির আঁচল পর্যন্ত চাপা দিতে হয়নি তাকে।
পুকুরঘাটে বসে থাকা মহিলারাই যামিনীকে সাতাশ বাই দুই-এর পথ দেখিয়ে দেয়। রিকশাচালকের বারণ করা সেই বাঁহাতের পথটাই ছিল। যামিনী ধীর পায়ে হেঁটে পৌঁছে যায়। দ্রুত। বিবর্ণ দোতলা বাড়ি একটা। টিনের চাল। বারান্দায় সারি দিয়ে শুকোতে দেওয়া আছে শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রা, ফ্রক। ফ্রক কার? দেবনাথের মেয়ের শরীর কেঁপে ওঠে যামিনীর। পাঁচ বছর ধরে এখানে থাকে দেবনাথ! মঞ্জু মেয়েটা এখানেই শরীর বেচে! দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করে যামিনী। সে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, কোনওভাবে ভেঙে পড়বে না। কিছুতেই নয়। দেবনাথকে খোঁজার ব্যাপারে কোনও ছলছাতুরিও করবে না। যদি প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা হয় তা হলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কটা কথা বলবে। কান্না পেলে আটকানোর চেষ্টা করবে। আটকাতে না পারলে আর কী হবে, কাঁদতে কাঁদতেই বলবে।
কেমন আছ তুমি? আমাকে কি ভেতরে একটু বসতে দেবে? এটা তোমার কেমন ছেলেমানুষি? নাকি এটাও তোমার রসিকতা? এখানে আছ আমাদের জানাবে না একবার! একটা ফোন করতে কী হয়েছিল? আমি কি জোর করে ধরে নিয়ে যেতাম? তুমি কি ছেলেমানুষ যে জোর করলেই মেনে নিতে? নাকি আমার বয়স হয়নি। তোমার কোনটা পছন্দ বুঝতে পারব না? ছেলেমেয়ে দুটো পাঁচ বছর ধরে চিন্তা করে। যাক, তোমার বউ কোথায়? মেয়েকে একবার ডাকবে? হুট বলতে অফিসে যাওয়া বন্ধ করলে কেন? খারাপ মেয়ের সঙ্গে সংসার বাঁধার লজ্জায়? দুর, খারাপ ভালো ওভাবে মাপা যায় নাকি? এই দেখ না তোমার অফিসের অর্ধেন্দু দত্ত…।
আর যদি দেবনাথের বদলে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়? তাও ঠিক করা ছিল যামিনীর। কোনও লুকোচাপা নয়, একেবারে সরাসরি অনুরোধ করবে। অনুরোধ করা ছাড়া আর অন্য কী পথই বা আছে তার?
দেখুন ভাই, আমি একজনকে খুঁজছি। তিনি আমার স্বামী। পাঁচ বছর হল তিনি নিরুদ্দেশ। কদিন আগে শুনলাম, পাঁচ বছর হল এক ভদ্রলোক আপনার কাছে এসে রয়েছেন। যতদূর শুনেছি তিনি আপনার স্বামী। আমি শুধু অনুরোধ করব, ওই মানুষটার সঙ্গে আপনি একবার আমাকে দেখা করিয়ে দিন। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমি কেন একথা বলছি। আমার সন্দেহ দূর হোক। যদি কথা না বলাতে চান তাহলে দূর থেকে দেখান। তবু দেখান। আমি কথা দিচ্ছি, কোনওরকম জোরজবরদস্তি করব না। করার অধিকার বা ইচ্ছে কোনওটাই আমার নেই। আমি খুব ক্লান্ত। একজন মহিলা হিসেবে আর একজন মহিলার এই অনুরোধ আপনি রাখবেন এই আশা কি আমি করতে পারি না?
দুটো ভাবনার একটাও মিলল না।
বাড়ির সামনে দাঁড়ানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে একজন পুরুষ মানুষ বেরিয়ে এল। গায়ে ময়লা পাজামা পাঞ্জাবি। কাঁধে ঝোলা ধরনের ব্যাগ। পাট করে চুল আঁচড়ানো। বুকটা ধক করে উঠেছিল যামিনীর। ডান হাত মুঠো হয়ে গেল। না, এ সেই মানুষ নয়। যামিনীর সাজ-পোশাক দেখে মানুষটার বোধহয় সন্দেহ হয়। কাছে এসে দাঁড়ায়।