নীলাদ্রি হেসে ফেলে বলল, এগুলো সব বলতে পারব না, তবে, মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। ইনফরমেশনটা কাজে লাগবে?
তুমি কি ঠাট্টা করছ ভাইটি?
নীলাদ্রি সহজভাবে বলল, তা একটু করছি বইকি। ধরা যাক, আমার বাবা সাহসী ছিলেন, তাতে কী প্রমাণ হয়? উনি জঙ্গলে গিয়ে বাঘ-ভাল্লুকের সঙ্গে গা ঢাকা দিয়ে আছেন? এ সব জেনে আপনার লাভ?
মধুসূদন চিবিয়ে বলল, ভাইটি, আমার লাভ ক্ষতিটা আমি বুঝলেই ভালো নয় কি? গোড়া থেকেই দেখছি তুমি তেড়েফুঁড়ে কথা বলছ। ব্যাপারটা কী বল তো? আমি তো হাতে পায়ে ধরে তোমাকে এখানে ডেকে আনিনি বাপু।
নীলাদ্রি নিজেকে সামলে টেবিলের ওপর ঝুঁকে বলল, আমার বাবা একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। আমাকে আর আমার বোনকে ভালোবাসতেন খুব। অফিস ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোতেই চাইতেন না। যতটা পারেন হইচই করে সময় কাটাতেন।
স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল? তোমার মায়ের সঙ্গে?
নীলাদ্রি হেসে বলল, এই আপনার গোপন প্রশ্ন? লাভ নেই। ওই লাইনে অনেক তদন্ত হয়ে গেছে। আমার মায়ের সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক ছিল লোহার শিকলে বাঁধা।
মধুসূদন মুচকি হেসে বলল, লোহাতেও যে জং ধরে ভাইটি।
সরি, আমার বাবা মানুষটা অন্যরকম।
সব ছেলেমেয়েই এ কথা বলে। বাপ-মায়ের চরিত্রকে নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র দেখে। তারপর এরকম একটা কাণ্ড ঘটলে সব ফঁস হয়। তখন মুখ লুকোনোর জায়গা পায় না।
নীলাদ্রির চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। তারপরই মনে হল, এই লোকের ওপর রাগ করার কি কোনও মানে হয়? এই বুজরুক কি রাগ করার যোগ্য? সে গম্ভীর গলায় বলল, আমার বাবা আর পাঁচজনের মতো নয়।
না, হলেই ভালো। কিছু মনে কোরো না ভাইটি, তোমার মা মানুষটি কেমন জানতে পারি কি? এই ধরনের গৃহত্যাগের ক্ষেত্রে স্ত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্ত্রীর চরিত্র গোলমাল থাকলে পুরুষমানুষের ঘরে মন টেকে না।
নীলাদ্রি পিঠ সোজা করে বসল। বলল, মনে হচ্ছে আপনি একটু বেশি বলছেন। লিমিট ক্রস হয়ে যাচ্ছে না কি?
মধুসূদন অবাক হওয়ার ভান করে বলল, এর মধ্যে কম বেশির কী হল? ঘরে আর কাউকে রাখিনি তো এই কারণেই। ডাক্তার, উকিল আর আমাদের মতো মানুষদের কাছে কিছু লুকোতে নেই। বাপ মায়ের কোনও দোষ থাকলে বলে দাও, আমার হিসেব করতে সুবিধে হবে। এই যে তুমি মাকে এখানে না এনে নিজে এসেছ, এটা একটি বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। সে তো তার নিজের মুখে নিজের চরিত্রের কথা বলতে পারত না। নাও বল।
কথা শেষ করে মধুসূদন কুইল্যা ফের তাকাল ল্যাপটপের দিকে।
দাঁতে দাঁত চেপে নীলাদ্রি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে না পারা যাবে। এই বদ লোকটাকে ভালোমতো শিক্ষা দেওয়া দরকার।
আমার মায়ের চরিত্র কেমন বলতে পারব না, তবে উনি বুজরুক দেখলে আমার মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না এটা জানি। ঠাটিয়ে চড় লাগান।
মধুসূদন কুইল্যা চকিতে মুখ তুলে তাকাল। নীলাদ্রি নির্লিপ্ত ভাবে বলল, নিন এবার বলুন আপনার হিসেব কী বলছে?
মধুসূদন পাশে রাখা মোবাইলটা তুলে কাকে যেন মেসেজ পাঠাল। তারপর বলল, অত হুটোপুটি করলে কী করে হবে? তা ছাড়া তুমি তো ইনফরমেশন প্রায় কিছু দিতেই পারছ না।
যা পেরেছি সেটুকুতে কিছু হবে না? শুনেছি আপনি নাকি কেস পিছু খান তিন-চার অপশন দেন। আমার বাবার ক্ষেত্রে একটা অন্তত দিন। সেখানে গিয়ে একবার হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ করে দেখি।
মধুসুদন কুইল্যার চোখ এখন আর ঢুলু ঢুলু নয়। পুরো খুলে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে রাগ। রাগ দেখে নীলাদ্রির নিজের রাগ একটু কমল। লোকটার মোবাইলে বিপ বিপ আওয়াজ করে আবার মেসেজ এল। লোকটা ফোন তুলে মেসেজ পড়ে জবাবও দিল। তারপর মুখ তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, দেখুন, তিনশো টাকার আদ্দেকটা ফিরিয়ে দিচ্ছি, আপনি চলে যান। আমার অনেক সময় নষ্ট করেছেন। বাইরে অন্য কাস্টমাররা আছে। ঝামেলা করবেন না।
তুমি থেকে সম্বোধন আপনি-তে উঠে যাওয়ায় নীলাদ্রি হাসল। হুমকি তা হলে ভালোই কাজ করেছে। চোখ বড় করে বলল, চলে যাব! সে কী দাদাভাই! চলে যাব কেন? বাবার কোনও হদিস দেবেন না? অত দূর থেকে এত কষ্ট করে এলাম। আমি তো ভিজিটের টাকা ফেরত চাই না, হারানো মানুষের খোঁজ চাই। সেই খোঁজ না পেলে তো এখান থেকে উঠব না।
মধুসূদন কুইল্যা এবার চেয়ারে হেলান দিল। ঠোঁট দুটোকে সরু করে বলল, কী করবেন? মারবেন?
নীলাদ্রি ডান পায়ের ওপর বাঁ-পাটা তুলে বলল, আমি তো সেরকম কিছু বলিনি। আমাকে দেখে আপনার গুন্ডা বলে মনে হচ্ছে? আপনি শুধু বাবা থাকতে পারেন এমন একটা জায়গা বলে দিন, আমি সেখানে চলে যাই। ব্যস, সমস্যা মিটে গেল।
মধুসূদন কুইল্যা দুলতে দুলতে বলল, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।
নীলাদ্রির মজা লাগছে। লোকটা ঘাবড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, একটু পরেই কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। ব্যস, তারপরেই উঠে পড়া যাবে।
বাড়াবাড়ির এখনই কী দেখলেন? নিন, বলুন। নইলে আরও বাড়াবাড়ি হবে।
মধুসূধন ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, জায়গা বললে আপনি সেখানে যেতে পারবেন?
নীলাদ্রিও পালটা হেসে বলল, চেষ্টা করব।
মধুসূদন একটু চুপ করে রইল। তারপর জিভ দিয়ে মুখে বিশ্রী একটা আওয়াজ করে বলল, হিসেবটিসেব কষে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে, আপনার বাবা জেলখানায় আছে। ছেলেকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে বাপটি কেমন। খুন বা রেপ করে পাকাপাকিভাবে ভেতরে ঢুকে গেছে। সেখানে তো আপনি যেতে পারবেন না ভাইটি।