বাবার নামটা বললে না?
দেবনাথ। দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়।
বয়স কত?
কোন বয়সটা বলব? যখন হারিয়ে গেছে? ফিফটি টু। তারপর পাঁচ বছর হয়ে গেল।
ও তা হলে সাতান্ন হল, মা আছেন?
হ্যাঁ যামিনী চট্টোপাধ্যায়।
ভাইটি, মায়ের বয়স কত?
এখনকার বয়স?
না, এখনকার নয়, তোমার বাবা যখন বাড়ি ছাড়লেন সেই সময়ের বয়সটা বল।
নীলাদ্রি বিরক্ত হয়ে ভুরু কোঁচকালো। পাশে বসা শ্রীময়ীর মুখের দিকে আবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, ঠিক জানি না।
ভাইটি এটা যে জানতে হবে। মায়ের বয়স না জানলে বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ বোঝা যাবে কী করে?
নীলাদ্রির ভুরু আরও কুঁচকে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ল। লোকটা কী বলতে চাইছে? সে নড়েচড়ে বসল। রুক্ষ গলায় বলল, আমি তো আপনার কাছে বাবার চলে যাওয়ার কারণ জানতে আসিনি। শুনলাম, আপনি নাকি হারানো জিনিস, মানুষ খুঁজে দেন। যদিও আমি এসব বিশ্বাস করি না।
লোকটা দাঁত বের করা ধরনের হেসে বলল, বিশ্বাস যে কর না দেখেই বুঝতে পারছি ভাইটি। তাতে কিছু এসে যায় না। আমার এই কাজ ধম্মকম্ম, পুজোআচ্চা নয়, এতে অং বং চং মন্ত্র নেই যে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। জ্যোতিষীদের মতো পাথর, মাদুলি বিক্রির ব্যবসাও খুলে বসিনি। ওদের মতো তুমি কি আমার গায়ে নামাবলি বা কপালে তিলক দেখতে পাচ্ছ? পাচ্ছ না। কারও বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপর আমার কাজ নির্ভর করে না। আমি অন্য পদ্ধতিতে কাজ করি। দেখছই তো তোমার কাছ থেকে পাওয়া ইনফরমেশনগুলো আগে কম্পিউটারে তুলে নিচ্ছি। তারপর আমার পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করব।
কথাটা বলে লোকটা আবার সামনে রাখা ল্যাপটপে খটাখট আওয়াজ করল। নীলাদ্রির খুব ইচ্ছে করল জিগ্যেস করে, পদ্ধতিটা কী? আপনি কি হারিয়ে যাওয়া খুঁজে পাওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের কোনও সফটওয়্যার ব্যবহার করেন? তার আগেই শ্রীময়ী টেবিলের ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, আসলে আমরা চাইছিলাম, আপনি যদি মানুষটার কোনও হদিস দিতে পারেন। শুনেছি…।
লোকটা মুখ তুলে একইরকম অতি বিনয় মাখা গলায় বলল, তুমি কে বোনটি? দেবনাথবাবুর কন্যা?
শ্রীময়ী তাড়াতাড়ি বলল, না না, আমি কেউ নই, আমি এর বন্ধু।
তা হলে তো বোনটি তোমাকে একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
নীলাদ্রি কড়া গলায় বলল, ও এখানেই থাকবে। ও-ই আমাকে আপনার কাছে এনেছে।
সেটা খুব আনন্দের কথা। কিন্তু বোনটিকে এখন ঘরে রাখা যাবে না। কোনও অনাত্মীয়কে সামনে রেখে আমি কাজ করব কী করে? ডাক্তার যখন রোগীকে পরীক্ষা করে বাইরের লোককে থাকতে দেয়?
নীলাদ্রি দেখল এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এটা সুযোগ। প্রতিবাদ জানিয়ে শ্রীময়ীর সঙ্গে সেও বেরিয়ে যাবে। শ্রীময়ী তার আগেই উঠে পড়ল। নীলাদ্রির কাঁধে হাত রেখে নীচু গলায় বলল, প্লিজ তুমি কথা বল। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
অনেকক্ষণ থেকেই নীলাদ্রির মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। শ্রীময়ী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সেটা আরও বাড়ল। সে এখানে একেবারেই আসতে চায়নি। শ্রীময়ীর জন্য বাধ্য হয়েছে। সেদিন। শ্রীময়ীকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিল। শ্রীময়ী বলল, একটা কথা বলব? রাখবে?
নীলাদ্রি অবাক হয়ে বলল, বাবা, এমনভাবে বলছ যেন গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে আসতে হবে।
তোমাকে একজনের কাছে নিয়ে যাব, যাবে?
কার কাছে?
শ্রীময়ী বলল, সে একজন আছে। আগে বল যাবে। তোমার বাবার ব্যাপারে।
নীলাদ্রি ঠোঁটের ফাঁকে একটু হেসে বলল, কার কাছে? তোমার চেনা কোনও পুলিশ অফিসার? কোনও লাভ নেই শ্রীময়ী। থানা পুলিশ করে করে ফেডআপ হয়ে গেছি। পাঁচ বছর তো কম সময় নয়।
না, থানা পুলিশ নয়, একজন লোক আছে সে নাকি হারানো জিনিস, হারানো মানুষ খুঁজে দিতে পারে।
নীলাদ্রি হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ধ্যুৎ, তুমি জ্যোতিষে বিশ্বাস কর নাকি শ্রীময়ী! ছি ছি, একজন কবি হয়ে তুমি শেষ। পর্যন্ত কিনা আমাকে জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হতে বলছ!
শ্রীময়ী তাড়াতাড়ি বলে, আমি মোটেও ওসব বিশ্বাস করি না। আর যার কাছে যেতে বলছি তিনিও মোটে জ্যোতিষী নন।
তা ছাড়া আর কী হবে? হারানো মানুষ কোথায় আছে সে তো আর চোখ বুজে সাধারণ মানুষ বলতে পারবে না, তার জন্য অমুকবাবা তমুকবাবা কিছু একটা হতে হবে। যত সব ভণ্ড।
শ্রীময়ী হাঁটতে শুরু করল। বলল, শুনেছি এই লোকটা অন্যরকম। আমাদের রান্নার মাসি সোনারপুরের দিক থেকে আসে। ও-ই গল্প করেছিল, লোকটা সোনারপুরে বসে। তিন চারটে করে জায়গার কথা বলে দেয়। তার মধ্যে একটায় হারানো জিনিস পাওয়া যায়।
নীলাদ্রি বলল, এই রে, তুমি তোমাদের রান্নার লোকের কাছেও বাবার ঘটনা বলেছ!
মোটেও না, আমি কিছুই বলিনি। মাসিই সেদিন গল্প করছিল। মেয়ের কানের দুল হারিয়ে যেতে ওরা সেই লোকের কাছে গিয়েছিল। লোকটা অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে, তিন জায়গার নাম বলে দিল। দ্বিতীয়টাতেই দুল পাওয়া যায়। বাড়ির পিছনে লঙ্কা গাছের টবে। আরও নাকি আছে। গ্রামের কে ছাগল হারিয়েছিল। পরদিন সেই লোকের কাছে যেতে…।
নীলাদ্রি জেরে হেসে উঠল। পথচলতি কয়েকজন মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। নীলাদ্রি বলল, আমার বাবা কানের দুল নয়, ছাগলও নয়। এভাবে মানুষ পাওয়া যাবে না।
একটা ছেলেকেও খুঁজে দিয়েছে। আট-নবছরের ছেলে। বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিল। বড়বাজার গিয়ে পাওয়া গেল। সে নাকি ট্রাকে চেপে মুম্বই যাবে। আমি রান্নার মাসির কাছ থেকে লোকটার ঠিকানা রেখে দিয়েছি। সোনারপুর স্টেশনে নেমে একটুখানি যেতে হবে।