.
জানলার দিকে এক পা এগিয়ে গেল যামিনী। দেবনাথ রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিচ্ছে। মুখটা এবার দেখা যাচ্ছে। শরীর খারাপের কিছু নেই, বরং মুখ হাসি-হাসি। যামিনী নিশ্চিন্ত হল, আবার অবাকও হল। সাতসকালে রিকশাওলার সঙ্গে হাসাহাসি কীসের! এই লোক কি না হেসে পারে না! জানলা থেকে ফিরে রাগ-রাগ মুখে চায়ের কাপে মন দিল যামিনী।
ভাড়া বাড়িতে রান্নাঘর মাপে ছোট হয়। অনেক সময় একেবারে এক চিলতে। বাতাস চলাচলের ব্যাপার থাকে না। দিনেরবেলাতেও অন্ধকার। সবসময় মনে হয়, বাইরে মেঘ করেছে, এখনই শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে হবে। সেই তুলনায় এই জানলা যথেষ্ট বড়। যামিনীর পছন্দের। পছন্দ জানলার মাপের জন্য নয়, পছন্দ জানলা থেকে বাড়ির গেট পর্যন্ত দেখা যায় সেই কারণে। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে বাড়িতে কে আসছে যাচ্ছে জানা যায়। এটা একটা অ্যাডভান্টেজ। ছেলেমেয়ে দুজনেই স্কুলে পড়ে। স্কুলে পড়ে মানে অবশ্য একেবারে ছোটও নয়। নীলাদ্রি এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। কিঙ্কিনির ক্লাস সেভেন শেষ হতে চলল। দুজনের কারওরই আতুপুতুর বয়স নেই। তবু তারা বাড়ি থেকে বেরোলে চিন্তা হয়। আগে এতটা ছিল না। তখন ছেলেমেয়েরা সত্যি-সত্যি বেশ ছোট ছিল। গুট-গুট করে বাড়ির কাছে স্কুলে যেত। রিকশাতে ষোলো-সতেরো মিনিটের পথ। রেলগেটে আটকে পড়লে আরও খানিকটা বাড়তি সময় লাগত। তবে সে তো আর রোজ নয়, যেদিন লেট হত সেদিন। আসলে শহরটাই ছোট। একপাশে রেলস্টেশন, অন্যপাশে হাইওয়ে। তার ওপর এখানে দেখতে দেখতে অনেকটা দিন থাকা হয়ে গেল। কিঙ্কিনির যখন দু-বছর বয়েস তখন এসেছিল। এতদিনে কম বেশি প্রায় সকলেই মুখ চেনা হয়ে গেছে। আর পাঁচটা ছোট মফসল শহরের চেহারা যেমন হয়। শহর বাড়ছে। দোকান বাজার, ফ্ল্যাটবাড়ি, সাইবার কাফে হয়েছে। যামিনীর ছেলেমেয়ে দুজনেই এখন দূরের স্কুলে যায়। ছেলে যায় ট্রেনে। চারটে স্টেশন পেরোতে হয়। মেয়েও তিন বছর হয়ে গেল হাইওয়ের ধারে নতুন স্কুলে গেছে। স্কুলের বাস আছে। বাস অবশ্য বাড়ির সামনে পর্যন্ত আসে না। গলি থেকে বেরিয়ে মিনিট দশ হাঁটতে হয়। ব্যবস্থা সব ঠিকঠাক হলেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে যামিনীর উদ্বেগ কমে না। চাকরি করতে গিয়েও চিন্তা করে। রাতে শোয়ার সময় দেবনাথকে বলে, বাচ্চাদের নিয়ে আমার টেনশন হয়। অতটা সময় স্কুলে থাকি। ওরাও বাইরে। তোমার তো কোনও খেয়াল নেই। আজ কী শুনলাম জান?
কী শুনলে?
বাসবীদির মেয়ের একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছে।
বাসবীদিটা কে? দেবনাথ অবাক হয়ে বলল।
আমার কলিগ, সায়েন্সের টিচার।
কাণ্ডটা কী হয়েছে?
ট্রেনে একটা ছেলে চিঠি দিয়েছে। হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়েছে। আতঙ্কিত গলায় বলল যামিনী।
দেবনাথ আওয়াজ করে হেসে উঠল। যামিনী রেগে গিয়ে বলল, হাসছ! হাসছ কেন?
দেবনাথ হাসতে হাসতে বলল, হাসব না! একটা মেয়েকে একটা ছেলে চিঠি দেবে না তো কাকে দেবে? আমরাও দিয়েছি। মনে আছে নুপুর বলে একটা মেয়েকে চিঠি দিয়েছিলাম।
চুপ কর। একটা ক্লাস এইটে পড়া মেয়েকে প্রেমপত্র দেবে! ছি ছি।
দেবনাথ স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, শুনে বেশ ভালোই লাগছে যামিনী। আজকাল এসব হাতে লেখা চিঠি এখনও আছে তা হলে, আমি তো জানতাম উঠেই গেছে! মফস্সল বলে। চলছে। কলকাতা হলে এস এম এস আর চ্যাট হত। এখানেও কদিন পরে আর থাকবে না।
যামিনী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, থামো তো। আমার নীল আর কিঙ্কিকে নিয়ে ভয় করছে আর উনি চিঠির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করছেন!
দেবনাথ স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, আরে বাবা, ওরা তো বড় হচ্ছে, সব সময় চোখ। পেতে রাখলে হবে? এবার একটু নিজের মতো থাকতে দাও, ওদের শিখতে হবে না?
যামিনী বিরক্ত গলায় বলে, কী বলছ যা-তা? নিজের মতো থাকবে কথাটার মানে কী? এই বয়সটাই গোলমেলে। ছেলেমেয়ে দুজনের জন্য আলাদা-আলাদা করে গোলমেলে। বাইরে হাজারটা হাতছানি। এখনই তো বাবা-মায়ের বেশি করে নজর রাখার সময়। আজ বাদে কাল ছেলের ফাইনাল পরীক্ষা, একবার মন অন্যদিকে চলে গেলে কী হয় জান না? ফুলদির ননদের ছেলেটার কী হল? রাত করে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে, পরে জানা গেল নেশা করে।
দেবনাথ বিদ্রুপের গলায় বলল, তুমি দেখছি চিড়ে-মুড়ি সব এক করে ফেললে যামিনী। মনে রাখবে চিড়ে ইজ চিঁড়ে, মুড়ি ইজ মুড়ি। তোমার দিদির হাজব্যান্ডটি কেমন সেটা তো দেখবে। সারাদিন ব্যবসা আর সন্ধের পর পার্টি। মধ্যরাতে মদ্যপান করে বাড়ি ফেরা। বাবাকে দেখে ছেলেও বখে যাচ্ছে। আমাদের নীলকে নিয়ে ওসব চিন্তা কোরো না। তার বাবার লাইফ স্টাইলে কোনও ইনিডিসিপ্লিন নেই। অফিসের পর হাওড়ায় গিয়ে ছটা দশের গাড়ি ধরে কাটায় কাটায় আটটা চল্লিশে ইন। নটার মধ্যে বাড়ির ডোরবেলে আওয়াজ। টিং টং, টিং টং। আওয়াজ পাও কিনা?
কথাটা সত্যি। স্বামীকে নিয়ে চিন্তা নেই যামিনীর। বিয়ের পর থেকেই নেই। ঝড়বৃষ্টি, ট্রেনের সমস্যা বা কলকাতায় ঝামেলা কিছু না হলে দেবনাথের বাড়ি ফেরা ঘড়ি ধরে। সেরকম কিছু হলে খবর দেয়।
দেবনাথ এবার গাঢ় গলায় বলল, ছেলেমেয়ে নিয়ে অকারণে চিন্তা করলে মুখে ছাপ পড়বে, দেখতে বিচ্ছিরি হয়ে যাবে।
যামিনী রাগী গলায় বলল, বুড়ো বয়েসে আদিখ্যেতা কোরো না তো।