.
স্কুলের স্টাফরুমে ঘর সংসার, ছেলেমেয়ে নিয়ে সবসময়েই আলোচনা চলছে। এতবছর পরেও দেবনাথের স্বভাব নিয়ে কথা ওঠে। হিস্ট্রির বিশাখা ভারি সুন্দর মেয়ে। নরম মন। যামিনীকে পছন্দ করে খুব। যামিনীদি, যামিনীদি করে। সে-ও দেবনাথকে নিয়ে মজা করে। বিশাখার চার বছর হল বিয়ে হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে। হিন্দোল চমৎকার ছেলে। পছন্দ করার মতোই ছেলে। চাকরিটা ভালো, তবে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। প্রথম প্রথম বিশাখার কোনও সমস্যা হয়নি। সব ঠিকঠাক ছিল। শ্বশুরবাড়িতে নানারকম জটিলতা দেখা দিল। এদিকে ছেলে বড় হচ্ছে। তার হাজারটা ঝামেলা। বিশাখাকে একা হাতে ঘর-বাইরে সব সামলাতে হয়। কাজের লোক দিয়ে পুরোটা হয় না, শ্বশুরশাশুড়ির সেবাযত্নের ওপর নিজে নজর না রাখলে তাদের মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। এমন অনেক সমস্যা আসে যেগুলোর ডিসিশন চট করে একা নেওয়া কঠিন। হিন্দোলের সঙ্গে পরামর্শের দরকার হয়। কিন্তু তাকে পাবে কোথায়? হিন্দোলকে বললে সে অবাক হয়।
কেন! মোবাইলে পাবে। মোবাইল তো সবসময় খোলা।
রেগে যায় বিশাখা। বলে, ঠিকই বলেছ। সুন্দর দেখতে একটা মোবাইল ফোনকে বিয়ে করলেই পারতে। দরকারে অদরকারে তোমার সঙ্গে কথা বলত, গানও শোনাত। আজকাল চমৎকার সব রিং টোন পাওয়া যায়।
সেদিনই স্টাফরুমে বিশাখা বলল, যামিনীদি, আই ফিল জেলাস ফর ইউ। তোমার জন্য হিংসে হয়; একটা বর পেয়েছে বটে! বোতল-দৈত্যের মতো সারাক্ষণ গিন্নির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কী করতে হবে প্রিয়তমা? একবার শুধু হুকুম করো।
কথাটা বলতে বলতে হাতজোড় করে দেখায় বিশাখা। সবাই হেসে ওঠে। যামিনী চোখ পাকিয়ে হেসে বলল, অ্যাই, নজর দিচ্ছিস কেন? আমি সুখে আছি সহ্য হচ্ছে না বুঝি?
বিশাখা জিভ কেটে, হেসে বলল, ছি ছি নজর দেব কেন? চিরকাল তোমরা এরকম ভাবে থাক। যখন পৃথিবীর দাম্পত্য- ইতিহাস লেখা হবে তোমাদের নাম থাকবে সবার ওপরে।
যামিনী হাসতে হাসতে বলল, তুই তো হিস্ট্রির ছাত্রী, তুই লেখ না!
অঙ্কের আরতিদি বিষয়টা কোনওদিনই ভালো চোখে দেখে না। মহিলা টিপিক্যাল পুরোনো-দিনের দিদিমণি টাইপ। খিটখিটে স্বভাব থেকে যতটা না বেরোতে পারে, তার থেকে বেশি বেরোতে চায় না। ব্যক্তিগত জীবনও গোলমেলে। দুটো বিয়ে। প্রথমজন ডিভোর্স করে সরে গেছে। দ্বিতীয়জন বিয়ের সময় খুব আহা উঁহু করেছিল। এখন সে-ও নাকি পালাতে পারলে বাঁচে। সকাল হতে না হতে বেরিয়ে পড়ে, বাড়িতে ঢোকে গভীর রাতে। উপায় কী? কয়েকবছর হল, আরতিদির সন্দেহবাতিক অসুখ দেখা দিয়েছে। সবসময় সন্দেহ। বাড়িতে স্বামী থাকলে কাজের লোককে পর্যন্ত একা ছেড়ে বেরোতে চায় না। স্কুলে এসে তাকে নীচু গলায় মাঝেমধ্যে এসব বলেও। যামিনী শুনতে চায় না, তা-ও জোর করে।
তুই জানিস না যামিনী, লোকটা খুব পাজি। মেয়েমানুষ দেখলেই উসখুস করে।
যামিনী চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, উফ আরতিদি, আবার শুরু করলে? পশুপতিদার নামে তুমি মিছিমিছি এ সব বল।
মিছিমিছি! একদিন আমার সঙ্গে থাকলে বুঝতে পারতিস তোদের পশুপতিদা কত বড় দুশ্চরিত্র।
যামিনী হাত তুলে বাধা দেয়। বলে, ঠিক আছে, তোমার কথাই মেনে নিলাম। এবার চুপ কর দেখি।
আরতিদি চুপ করে না। বলে, সেদিন উমা ঘর মুছছিল। গায়ে কাপড়চোপড় ঠিক ছিল না। তোর পশুপতিদা দেখি মেয়েটার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিশ্চিত, আড়ালে ওই লোক উমার গায়ে হাত দেয়।
কাজের লোক ছাড়িয়ে দিলেই হয়!
আরতিদি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। বলে, লোক কম ছাড়িয়েছি? কোনও লাভ হয়নি। আমার বিশ্বাস পাশের বাড়ির বউটার সঙ্গেও ওর লটঘট আছে। বউটা কাপড় শুকোতে দেওয়ার সময় ওকে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে দেখেছি। বউটা বদ। হাত তুলে বগল দেখায়!
যামিনী চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, উফ থামবে? এবার কিন্তু আমি উঠে যাব। আরতিদি থামে না। বলতেই থাকে। আমার বোনের সঙ্গেও চেষ্টা করে। হেসে হেসে কথা বলে। ঢলানি করে। যামিনী এবার হেসে ফেলল। বলল, শালির সঙ্গে হেসে কথা বলবে না তো কী করবে? কেঁদে কথা বলবে? এর সঙ্গে চরিত্রের কী সম্পর্ক আরতিদি!
আরতিদি হাসে না, গম্ভীর গলায় বলল, সম্পর্ক আছে। বোনকে বলেছি, আমি না থাকলে বাড়িতে আসবি না।
ক্লাসের ঘণ্টা বেজে যায়। যামিনী চক-ডাস্টার নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নামিয়ে বলে, তুমি এবার মাথার ডাক্তার দেখাও। নইলে প্রবলেম বাড়বে।
সেই আরতিদি বিশাখার কথায় ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, অত আদিখ্যেতা ভালো নয়। এ আবার কী! পুরুষমানুষ সারাক্ষণ বউয়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকবে? ইস মাগো! অসহ্য।
যামিনী বলল, সারাক্ষণ কোথায়? কাজকর্ম করে না বুঝি? অফিস যায় না? সকাল আটটা বাজতে না বাজতে সেই কলকাতায় ছোটে।
আরতিদি বলে, ওই একই হল। বেটাছেলে সন্ধের পর একটু-আধটু বাইরে না থাকলে মানায় না। একটু তাস-পাশা, একটু মেয়েমানুষ, একটু নেশাভাঙ করবে তবেই না পুরুষ!
বিশাখা মুখ টিপে হাসে। কিছু একটা বলতে চায়। যামিনী চোখের ইশারায় বারণ করে। পাগলকে সাঁকো নাড়ানোর মানে হয় না।
তবে যে যা-ই বলুক, যামিনী খুশি। দেবনাথের সংসারের দায়দায়িত্ব যে খুব কিছু ভাগ করে নিয়েছে এমন নয়, সত্যি সে কিছুটা অলস প্রকৃতির। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে ঘরদোর সামলানোর প্রায় পুরোটাই যামিনীর ম্যানেজমেন্ট। বাসন মাজা, কাপড় কাঁচার লোক আছে। গনাইয়ের মা করিতকর্মা মহিলা। আটটা বাজতে না বাজতে কাজ গুছিয়ে চলে যায়। তারপর রান্নার জন্য বিজলি আসে। বাড়িতে থাকলে দেবনাথের কাজ হল, চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিভিতে খবর দেখা, ম্যাগাজিন উলটানো। সিডি চালিয়ে কখনও গান শোনে। চাপাচাপি করলে মেয়েকে অঙ্ক দেখিয়ে দেয়। মেয়েটা অঙ্কে কাঁচা। তবে বাবার নেওটা। বাবা বাবা করে। হাতের কাছে পাওয়ার কারণে মানুষটাকে দিয়ে যে সবসময় বিরাট কোনও কাজের কাজ হয় এমন নয়। কিন্তু তার উপস্থিতিটাই এই বাড়ির পক্ষে স্বস্তিদায়ক। অভ্যেস হয়ে গেছে।