সকলেই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। কেউ বললেন, ছি ছি, কারও মতে, খুব অন্যায় হচ্ছে। দু-একজন আরও একটু এগিয়ে গেলেন।
হিউম্যানিটেরিয়ান গ্রাউন্ড বলে একটা জিনিস আছে তো। নাকি নেই? অফিস খানিকটা টাকা অ্যাডভান্স দিক। সাত বছর পরে মিটিয়ে দেওয়া হবে।
যামিনীর খুব ভালো লাগছে। মনে জোর পেল। অফিসের এতগুলো মানুষ তার পাশে! দেবনাথকে ভালোবাসত বলেই না…।
অর্ধেন্দু দত্ত যামিনীর দিকে ফিরে বললেন, আপনি ভাববেন না মিসেস চ্যাটার্জি, আমরা কেসটা নিয়ে এগোবো। আপনি ইউনিয়নের কাছে শুধু একটা লিখিত অ্যাপিল করুন।
অর্ধেন্দু দত্ত সত্যি এগোলেন। দীর্ঘ ছমাস ধরে এগোলেন। প্রথম তিন-চার মাস দল বেঁধে, তারপর একা। একা না হয়ে উপায় ছিল না। ইউনিয়নের অন্যরা ততক্ষণে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ম্যানেজমেন্টকে কোনওভাবেই রাজি করানো যাচ্ছে না। আর এই একা চলার সময়টাতেই সমস্যা শুরু হল। মাঝে মাঝে যামিনীকে কলকাতায় ডেকে নিতেন অর্ধেন্দু। প্রথমে অফিসে, তারপর বাইরেও। ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় বসে চা খেত দুজনে। ধীরে ধীরে কাজের কথার পাশাপাশি অল্প অল্প ব্যক্তিগত কথা চলে আসে। বেশিরভাগই দেবনাথের প্রতি যামিনীর দুঃখের কথা, অভিমানের কথা। অর্ধেন্দু দত্ত শান্ত ভাবে শুনতেন। সহানুভূতি নিয়ে উত্তর দিতেন।
আপনি এরকম ভাবছেন কেন মিসেস চ্যাটার্জি? দেবনাথবাবু যে নিজেই আপনাদের ছেড়ে চলে গেছেন এমনটা তো না-ও হতে পারে। তাঁর প্রতি আপনার এই রাগটা হয়তো ইনজাসটিস হচ্ছে।
তা হলে কী হয়েছে? কিডন্যাপ?
অর্ধেন্দু দত্ত হেসে বললেন, না না, তা হলে এতক্ষণে খবর চলে আসত। যারা কিডন্যাপ করেছে তারা তো মুক্তিপণ চাইত। চাইত না। তা ছাড়া ওকে কে কিডন্যাপ করবে?
যামিনী বলল, আপনি কী মনে করছেন, মারা গেছে?
নানা আমি সেকথা বলতে চাইনি। অর্ধেন্দু দত্ত নিজেকে সামলালেন। বললেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত ডেফিনিট কোনও প্রুফ পাওয়া যাচ্ছে কোনওটাই ধরে নেওয়া উচিত নয়।
রেস্তোরাঁর আধো আলো আধো অন্ধকারে বসে যামিনী ডুকরে কেঁদে ওঠে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, আমি জানি ও বেঁচে আছে। নিশ্চয় বেঁচে আছে। কোথাও লুকিয়ে থেকে ঠাট্টা করছে। যেদিন বুঝবে অন্যায় হচ্ছে সেদিন ঠিক ফিরে আসবে।
অর্ধেন্দু দত্ত একটু অপেক্ষা করলেন, তারপর যামিনীর হাত ধরে গাঢ় স্বরে বলেন, কেঁদো না যামিনী, তাই যেন হয়। দেবনাথবাবু যেন ফিরে আসে।
বহুদিন পর পুরুষের স্পর্শে চমকে উঠেছিল যামিনী। ভালোও কি লেগেছিল? নিশ্চয় লেগেছিল। নইলে সেদিন হাত কেন সরিয়ে নেয়নি সে? অথবা কে জানে সেই স্পর্শে হয়তো ভরসা ছিল। গভীর বিপদে পড়া কোনও নারী পুরুষের কাছ থেকে যে ভরসা খোঁজে সেই ভরসা। যামিনীর দুর্বল মন বুঝতে পারেন অর্ধেন্দু দত্ত। যামিনী নিজেই বুঝতে দেয়। কেন দেয়? পরে অনেক ভেবেছিল যামিনী। শুধুই কি আশ্রয়ের কারণ? নাকি শক্ত-সমর্থ এক পুরুষের জন্য শরীর সহসা জেগে ওঠে?
.
এক শনিবার সন্ধ্যায় অর্ধেন্দু দত্তর ফাঁকা ফ্ল্যাটে ব্লাউজ খুলে থমকে গিয়েছিল যামিনী। অর্ধেন্দু দত্ত তখন সামনে বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছে স্থির চোখে। যামিনী থেমে যেতে বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, কাম অন যামিনী। তাড়াতাড়ি করো।
যামিনী দু-হাতে বুক ঢেকে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, খারাপ লাগছে।
অর্ধেন্দু দত্ত তখন পুরোপুরি তৈরি। লোহায় পেটানো শরীরে কোনও আড়াল নেই। এমনকী একটা চাদর পর্যন্ত নেই! বোধহয় যামিনীকে প্রলুব্ধ করতেই নগ্ন হয়েছিল। পেশি, ত্বক, পুরুষের সব অঙ্গ যেন লোহার মতো! বাদামি, কঠিন। খানিকটা অবজ্ঞার সঙ্গেই তিনি বললেন, কার জন্য খারাপ লাগছে যামিনী?
আপনি জানেন না?
অর্ধেন্দু দত্ত ঠোঁট উলটে হাসলেন। বললেন, না, জানি না। নিশ্চয় সেই মানুষটার জন্য নয়, যে তোমার এই সুন্দর শরীরটা ছুঁড়ে ফেলে চলে গেছে।
চলে গেছে! মুখ তুলে তাকাল যামিনী।
তুমিই তো সেরকমই বল, বল চলে গেছে। আড়াল থেকে দেখে হাসছে বল না? বাদ দাও ওসব, এসো। মনে রেখো তোমারও জীবন আছে। শরীর আছে। চলে এসো, দেখবে সে জীবন শুধু হা-হুঁতাশ আর কান্নার জীবন নয়। সে জীবনও উপভোগ করার। বেঁচে থাকার। যদি রাজি হও, যদি ভালো লাগে আমি সঙ্গে থাকব চিরকাল।
রাজনীতি করে বলেই বোধহয় এমন মন ভোলানো কথা বলতে পারে মানুষটা। নিজের শেষ আবরণ সরিয়ে সেদিন দ্বিধা জড়ানো পায়ে যামিনী উঠে গিয়েছিল বিছানায়। মানুষটা যামিনীকে আদর করেছিলেন শান্ত অথচ পরিণত মুদ্রায়। তার অধিকাংশই যামিনীর অচেনা। দেবনাথ কি এসব জানত না! শেখেনি! এই বয়েসেও শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে যামিনীর। অর্ধেন্দুর কোলের কাছে বসে লজ্জায় চোখ ঢাকে। তার মাথার চুল ধরে নিজের মুখের ওপর টেনে নামান অর্ধেন্দু দত্ত। জড়ানো গলায় বলেছিলেন, কীসের অভাব তোমার? কীসের অভাব? আমি তো আছি, আছি না?
শরীরভরা যন্ত্রণা নিয়ে যামিনী বাড়ি ফিরে যেতে যেতে বুঝেছিল, এই অভিসারে কোথায় যেন প্রতিশোধ লুকিয়ে ছিল। দেবনাথের প্রতি প্রতিশোধ। মনে মনে বলেছিল, তুমি যদি না ফেরো আমিও চলে যাব। ঠিক চলে যাব তোমায় ছেড়ে।
সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বাথরুমে ছুটে গিয়েছিল যামিনী। বেসিন ভরিয়ে বমি করেছিল। বুঝেছিল, সমস্যা শুরু হয়েছে। কঠিন সমস্যা।