এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না যামিনী। বলল, ভূতের জন্য! মানে?
দেবনাথ শোয়া অবস্থাতে বাঁ-পায়ের হাঁটুর ওপর ডান পা তুলে নাড়তে লাগল। বলল, আমার খুব ভূতের ভয় যামিনী। রাতে ঘুম ভাঙলেই খুটখাট আওয়াজ পাই। ছোটবেলায় ছিল না, বয়েস হওয়ার পর শুরু হয়েছে। মনে হয়, কে যেন পাশে এসে বসল! মাথার বালিশটা ঠিক করে গায়ের চাদরটা টেনে দিল! ঠান্ডা লাগলে ফ্যানের রেগুলেটর কমিয়ে দেয়। ওরে বাবা! প্রায়ই আমার ঘুমের দফারফা হয়ে যায়।
যামিনী মজা পায়। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি এনে বলল, কেন?
দেবনাথ ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে। কোলের ওপর বালিশ টেনে স্ত্রীর দিকে বড় চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে, কেন কী গো! ঘরে ভূত নিয়ে ঘুমোব? তুমি কি খেপেছ? বাকি রাত জেগে, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। কথাটা কাউকে বলতেও পারি না। ধেড়ে লোক ভূতের ভয় পায় শুনলে সকলে হাসবে। ভাবতাম, ইস রাতে কেউ যদি আমার সঙ্গে শুত! এই জন্যই বিয়ে। আবার শুয়ে পড়ল দেবনাথ। হাসিমুখে বলল, তুমি এসে গেছ আর চিন্তা রইল না। এবার নিশ্চিন্তে, নাক ডেকে ঘুমোব। আমার কী মনে হয় জানো যামিনী? মনে হয়, আমার মতো অনেকেই আছে যারা স্রেফ ভূতের হাত থেকে বাঁচতে বিয়ে করে। লজ্জায় মুখ ফুটে বলে না।
যামিনী মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে ফেলল। তার খুব ভালো লাগে। বিয়ের আগে অল্পস্বল্প কথা বলে বুঝেছিল, মানুষটা ভালো, কেয়ারিং। সম্ভবত এইরকম একজন পুরুষের জন্যই সে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু মানুষটার মধ্যে যে উইট আছে সেটা বুঝতে পারেনি। এটা বাড়তি পাওনা হল। ছ্যাবলা হওয়া খারাপ, তা বলে গোটা জীবন একটা গোমড়ামুখো মানুষের সঙ্গে কাটানো আরও ভয়ঙ্কর।
সেদিন রাতে আলো নেভানোর পর যামিনী যখন স্বামীর গা-ঘেঁষে আসে, দেবনাথ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেছিল, কে? ভূত নাকি?
যামিনী দেবনাথের কানের পাশে মুখ এনে বলল, না, পেত্নি!
দেবনাথ স্ত্রীর দিকে ঘন হয়। বলে, পেত্নি এত জামাকাপড় পরে নাকি? খসখসে বেনারসি?
যামিনী লজ্জা পায়। বলল, আমি জানি না।
দেবনাথ হাত বাড়িয়ে যামিনীর ব্লাউজের বোতাম খুঁজতে খুঁজতে বলে, আমি জানি।
পরদিন সকালে সবাই যখন যামিনীকে চেপে ধরেছিল, যামিনী মুচকি হেসে বলল, পরে বলব, সে একটা ভূতের গল্প।
এই লোক যে বাজারের আলু-পটল নিয়ে রসিকতা করবে সে আর আশ্চর্য কী?
যামিনী চায়ের জল বসিয়ে দিল। স্বামী হিসেবে যামিনীর কাছে দেবনাথের যে ছোটখাটো অল্প কয়েকটা চাহিদা আছে, তার মধ্যে একটা বাজার থেকে ফিরলেই চা দিতে হবে। গরম চা। তবে সেই চা সঙ্গে সঙ্গে খাবে না দেবনাথ। গরম চা সে খেতে পারে না। হাতে কাপটা ধরে খবরের কাগজ খুলে বসবে। সময় নিয়ে কাগজ পড়বে। চা ঠান্ডা হলে চুমুক দেবে। বিয়ের পর এই অদ্ভুত স্বভাব দেখে যামিনী অবাক হয়েছিল।
এ আবার কী! খাবে না তো এত হুটোপুটি করো কেন? আমি অন্য সব ফেলে চা নিয়ে পড়ি।
দেবনাথ বলছিল, খবরের কাগজ পড়ার সময় গরম কিছু হাতে না ধরলে মজা পাই না। তাই গরম কাপ নিয়ে বসি। তবে আজকাল কাগজগুলোতে গরম যেভাবে বাড়ছে তাতে আর চায়ের কাপে হবে বলে মনে হচ্ছে না। ডাইরেক্ট আগুন হাতে বসতে হবে। তুমি একটা কাঠকয়লা পুড়িয়ে রাখবে, আমি বাঁ-হাতের চেটোতে রেখে নেতা-মন্ত্রীর ভাষণ পড়ব আর উঃ আঃ করব। হা হা। প্রাণ খুলে হাসে দেবনাথ।
যামিনী ঠোঁট বেঁকায়। মজা পেলেও বুঝতে দেয় না। গলায় বিরক্তি এনে বলে, থামো তো, সবসময় তোমার এই হ্যাঁ-হ্যাঁ হি-হি ভালো লাগে না।
এখন দেবনাথ বাজার থেকে ফেরার আগেই মোটামুটি একটা হিসেব করে চায়ের জল বসিয়ে রাখে যামিনী। হিসেব কাছাকাছি ঠিকই হয়। এতদিনে আরও অভ্যেস হয়ে গেছে। আসলে গুছিয়ে বাজার করলেও, দেবনাথ কখনও রাস্তায় সময় নষ্ট করে না। কারও সঙ্গে দেখা হলে আড্ডায় দাঁড়িয়ে যাওয়ার স্বভাব তার নেই। দু-একটা কথা বলেই সরে পড়ে। শুধু বাজার নয়, কোথাও গেলেও বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে। নেমন্তন্ন বাড়িতে পৌঁছেই খেয়ে নিতে চায়। ট্রেন-বাসের বাহানা তোলে।
ভাই, শুনছি মেনু যেরকম লম্বা করেছ তাতে খেতে অনেকটা সময় লাগবে। লাস্ট ট্রেনটাও মিস হয়ে যাবে। তোমাদের মতো কলকাতাতে তো থাকি না। হয় মেনু কাটছাঁট করো, না হয় এখনই বসিয়ে দাও।
বিয়ের পর পর পুরুষমানুষ বাড়ির ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করলে বন্ধুরা ঠাট্টা করে। সেই ঠাট্টার মধ্যে আদিরস থাকে। দেবনাথের বেলায় সেরকম কিছু হয়নি। পরিচিতরা সকলেই জানে মানুষটা এরকমই। হোমসিক, ঘরকুনো। খানিকটা যেন অলস টাইপের। যামিনী বুঝেছে, অলস বা ঘরকুনো নয়, তার স্বামীর কাছে বাড়িটাই সবথেকে স্বস্তির জায়গা। রোজ কলকাতা পর্যন্ত চাকরি করতে গিয়ে অনেকটা সময় যাতায়াতেই চলে যায়। এরপর আর বাইরেটা ভালো লাগে না। আর যদি ঘরকুনো হয় তাতেই বা ক্ষতি কী? উড়নচণ্ডী স্বামীর থেকে ঘরকুনো স্বামী ভালো। স্ত্রীর সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা বেশি হয়। তা ছাড়া যখন খুশি সংসারের পাঁচটা পরামর্শও করা যায়। এটা খুব দরকার। যারা স্বামীকে পায় না, তারা বোঝে কত দরকার। তার ওপর দেবনাথের মস্ত গুণ হল, এমনি যতই হাসিঠাট্টা করুক, কাজের সময় সিরিয়াস। কোনও একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভেবেচিন্তে নেয়, কিন্তু নেওয়ার পর কখনও দোনামোনা করে না। কনফিডেন্সের সঙ্গে কাজটা করে। বলে, একবার যখন ঠিক করে ফেলেছি, দ্যাট ইজ ফাইনাল। যদি ভুল হয় হবে। বাড়ির পুরুষমানুষ এরকম হলে সুবিধে। যামিনী ভরসা পায়।