আর যদি উলটোটা বলে? মারা গেছে। কেটে কেটে বলে যামিনী।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার আবার একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, সেটা পারবে না। আমি খোঁজ নিয়েছি। সাত বছর পার না হলে নিখোঁজ মানুষকে মৃত ঘোষণা করা যায় না। পুলিশ পারবে না।
সেদিন ফোন ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে কিছুটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়েছিল যামিনী। সামনেই লম্বা কাচের জানলা। স্কুল মাঠটা দেখা যায়। স্কুল চলছে, ফলে মাঠটাও ফঁকা। একটু পরে ছুটি, তখন মেয়েতে কিলবিল করে উঠবে। বাংলা টিচার নিবেদিতা চক-ডাস্টার হাতে ক্লাসে যাচ্ছিল। যামিনীর থমথমে চোখমুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কী হয়েছে যামিনীদি? নতুন কোনও সমস্যা?
যামিনী মলিন হেসে বলল, তোদের দেবনাথদা আমাকে এত বড় বিপদে কেন ফেলল বলতে পারিস?
নিবেদিতা যামিনীর কনুই স্পর্শ করে বলল, এত ভেঙে পোড়ো না। নিশ্চয় খোঁজ পাওয়া যাবে।
আর খোঁজের দরকার নেই, এখন মনে হচ্ছে, মানুষটা মারা গেলেই ভালো। আমাদের তো বাঁচতে হবে!
ছিঃ যামিনীদি, মোটে কটা দিন হয়েছে। এর মধ্যে এত ভেঙে পড়লে চলবে কী করে?
আমি আর চলতে চাই না নিবেদিতা।
অনেকদিন পরে অন্যের সামনে এই ধরনের ভেঙেপড়া আচরণ করে ফেলল যামিনী। নিবেদিতা বলল, ছিঃ এরকম বোলো না। তোমার ছেলেমেয়ে আছে না? তাদের মানুষ করতে হবে।
তীব্র মাথার যন্ত্রণা নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল যামিনী। গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতে চমকে উঠল। বাড়ির ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রাণখোলা হাসি। ঠিক এভাবে দেবনাথ হাসত! কে হাসছে! হাসতে হাসতেই দরজা খুলল কিঙ্কিনি। যামিনী অবাক হল। মেয়েটা বাবার গলা পেয়েছে! গলা তো নয় হাসি। এমনও কি হয়? সন্তান বাবা-মায়ের হাসি কান্নার ধরন পায়? যামিনী অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
দারুণ, একটা দারুণ মজার ঘটনা হয়েছে মা। অপালা ফোন করেছিল, মিঠু একটা কাণ্ড করেছে। আমাদের ক্লাসের মিঠুকে চেনো তো? এই যে খুব ফরসা মেয়েটা, কাল বাজারে…হি হি..অপালা ভেবে…হি হি…আমাদের টিচার চৈতালি ম্যাডামের চোখ চেপে ধরে বলেছে, বল তো কে…হি হি।
যামিনী থমথমে মুখে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
সেদিন সন্ধেবেলায় দেরি করে পড়তে বসার অপরাধে যামিনীর হাতে বেধড়ক মার খেল কিঙ্কিনি, অনেক রাত পর্যন্ত নিজের ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল মেয়েটা। মেয়ের কান্নায় খুব রাগী মায়ের মনও নরম হয়। মেয়েকে কাছে নিয়ে আদর করে। কিঙ্কিনি অবাক হয়ে দেখল। সেরকম কিছুই তার হচ্ছে না! সে অন্ধকার ঘরে শুয়ে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে লাগল মন দিয়ে। হাসির মতো মেয়েটার কান্নাও কি তার বাবার? হলেই বা বুঝবে কী করে? দেবনাথের কান্নার আওয়াজ কখনও শুনেছে বলে মনে পড়ছে না তার।
যামিনী ভাবছিল, ঘটনা এখানেই থেমে গেল। দেবনাথের অফিসে আর যেতে হবে না। কিন্তু তা হল না। অ্যাকাউন্টস ম্যানেজারের টেলিফোনে কথা বলার ঠিক এক সপ্তাহ পর একটা ফোন এল। গম্ভীর গলায় পুরুষমানুষ। মানুষটা এক নিশ্বাসে গাদাখানেক কথা বলে যায়–
নমস্কার আমি অর্ধেন্দু দত্ত। আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে চাকরি করি। যদিও আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিল। দেবনাথবাবুর সঙ্গে আমার সেভাবে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। আমি অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি। সবসময়েই ইউনিয়ন নিয়ে ব্যস্ত। উনি তো আবার এসবের মধ্যে ছিলেন না। ফলে দেখাসাক্ষাৎ তেমন হয়নি। যা-ই হোক, ওঁর খবরটা আমি শুনেছি, কিন্তু আমাদের ইন্টারফেয়ার করার কোনও ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এখন শুনছি, দেবনাথবাবুর পাওনা টাকাপয়সার ব্যাপারে অফিস আপনার সঙ্গে কোঅপারেশন করছে না। আপনি যদি চান আমরা ইউনিয়নের তরফ থেকে বিষয়টা নিয়ে মুভ করতে পারি।
ভদ্রলোক থামলে যামিনী বলল, ধন্যবাদ। আমি সকলেরই সাহায্য চাই।
ধন্যবাদের কোনও ব্যাপার নেই। আমরা দেবনাথবাবুকে আজও আমাদের কলিগ মনে করি। তাঁর পরিবারের সুবিধে অসুবিধে দেখাটা ইউনিয়নের কাজের মধ্যে পড়ে। আপনি যদি কাল বা পরশু একবার আসেন তা হলে আমরা কথা বলে নেব। ইউনিয়নের অন্যদেরও থাকতে বলব।
তখন থেকেই অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে যামিনীর পরিচয়। প্রথম সাক্ষাতেই মানুষটাকে পছন্দ হয়েছিল। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। পেটানো চেহারা। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। চেয়ারে বসে পিঠ সোজা করে। বসার মতো মানুষটার কথার মধ্যেও একধরনের সোজাসাপটা ভাব রয়েছে। ইউনিয়নের অফিসে বসে আর পাঁচজনের সঙ্গে যামিনীর সমস্যা শুনলেন। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন
নিয়ম নেই, হয় না, অসম্ভব–এসব হল ম্যানেজমেন্টের কথা। আমাদের শুনে লাভ নেই। ইউনিয়নের কাজই হল এর বিরুদ্ধে ফাইট করা। আমাদের একজন কলিগ নিখোঁজ হয়েছেন। কেন নিখোঁজ হয়েছে, বেঁচে আছেন না মারা গেছেন পুলিশ দেখছে। অফিস নিয়ম দেখিয়ে তার স্যালারি বন্ধ করে দিয়েছে, আইনের কথা বলে তাঁর পাওনা টাকা আটকে রেখেছে। বলছে, সাত বছর বসে থাকুন। মানে কী! এই সাত বছর দেবনাথবাবুর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কী হবে? নিয়ম আর আইন ধুয়ে জল খাবে? আইন কীসের জন্য? মানুষের উপকারের জন্য। মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য নয়। ঘটনাটা আজ দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হয়েছে, কাল অন্য কারও হতে পারে।