সরি মিসেস চ্যাটার্জি, আমাদের আর কিছু করার নেই। আপনাদের সমস্যা আমরা বুঝতে পারছি। হঠাৎ করে এতগুলো টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়া যে কতটা ভয়ঙ্কর আমরা জানি। আমি নিয়মের বাইরে গিয়েই বোর্ড মিটিংয়ে আরও এক মাসের এক্সট্রা লিভ স্যাংশন করেছিলাম। কিন্তু আর তো সম্ভব নয়। এবার টাকা পেতে গেলে দ্য পারসেন স্যুড জয়েন। তাকে এবার অফিসে আসতেই হবে।
যামিনী বলল, কিন্তু উনি তো মারা যাননি।
ছি ছি এ-কথা বলছেন কেন? আমরা সবসময় আশা করব, উনি সুস্থ শরীরে ফিরে আসবেন। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই মিসেস চ্যাটার্জি। আপনি যতই সেটা ব্রেক করুন এক সময় সেটাও আবার নিয়মের মধ্যে পড়বে।
আমি অ্যাপ্লিকেশনে ইনভেসটিগেশন রিপোর্ট জমা দিয়েছি স্যার। সেখানে সিআইডি লিখে দিয়েছে, তদন্ত চলছে। তারা আশা করছে, খুব দ্রুতই কিনারা হবে।
সুপ্রকাশ রায়চৌধুরি মার্জিত গলায় বললেন, আমরাও একই আশা করছি। কিন্তু একটা কথা আপনি বোঝার চেষ্টা করুন, সব অফিসেরই হিসেবপত্র নিয়ে অডিট হয়। কোনও কোম্পানিই মাসের পর মাস এমন কারও নামে ব্যাঙ্কে স্যালারি ভরে যেতে পারে না যার কোনও ট্রেস নেই। অডিট অ্যালাও করবে না। আমাদের হাত-পা বাঁধা।
যামিনী চুপ করে থাকে। মাথা নামিয়ে বসে থাকে।
আপনি কি এক কাপ চা খাবেন মিসেস চ্যাটার্জি?
ভদ্রতার সঙ্গে কথাটা বললেও, বলার ভঙ্গিটা ছিল, না খেলেই ভালো হয়, এবার আপনি উঠুন ধরনের। যামিনী ভঙ্গিটা বুঝতে পারে। উঠে পড়ে সে।
এরও দেড়বছর পর আবার স্বামীর অফিসে যায় যামিনী। সুপ্রকাশ রায়চৌধুরি নেই। রিটায়ার করেছেন। নতুন জেনারেল ম্যানেজার অবাঙালি এক ভদ্রলোক। কেরল থেকে এসেছেন। তিনি সপ্তাহের অর্ধেক দিন বাইরে থাকেন। সেদিন অবশ্য অফিসে ছিলেন, কিন্তু যামিনীর সঙ্গে দেখা করলেন না। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই। দেখা করতে চাওয়ার কারণও বলতে হবে। পি. এ. মেয়েটিও নতুন। যামিনী তার কাছেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইল। পরের সপ্তাহে যদি কোনওদিন দেখা করা যায়। মেয়েটি খাতা বের করে বিরক্ত মুখে বলে, মনে হয় না এত আর্লি হবে। তা-ও দেখব। বলুন কী কারণে দেখা করতে চাইছেন। যামিনী কারণ বলে। লেখা থামিয়ে মেয়েটি মুখ তুলে অবাক চোখে তাকায়। ফের বাকিটুকু লিখে একটু বসতে বলে। ইন্টারকমে বসের সঙ্গে কথা বলে চাপা গলায়।
স্যার বললেন, ওর সঙ্গে দেখা করার কিছু নেই। বিষয়টা নিয়ে আপনি অ্যাকাউন্টস। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন। আজই বলুন। উনি বলে দিচ্ছেন।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার পুরোনো। যামিনীকে যত্ন করে বসতে বললেন। যামিনী বলল, তা হলে আমি ওর গ্রাচুয়িটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করি।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার একটু ভেবে বললেন, আমাকে দুটো দিন সময় দিন।
আমি পরশু আসব? বুঝতেই তো পারছেন টাকাটার কত দরকার। সংসার টানা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বিষয়টা দেখছি আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমি খবর দেব। এটা আমাদের ডিউটি। খুব খারাপ লাগছে ওর মতো একজন হাসিখুশি মানুষ…।
যামিনী বিড়বিড় করে বলল, মাঝেমাঝে মনে হয়, এটাও ওর একটা ঠাট্টা। আমাদের সর্বনাশ দেখে আড়াল থেকে হাসছে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার ডিউটি পালন করলেন। দুটো দিন লাগল না, পরদিনই বিকেলে ফোন করলেন যামিনীকে।
সরি ম্যাডাম, দেবনাথবাবুর কোনও পাওনাই এখন ক্লিয়ার হবে না।
যামিনী তখনও স্কুলে। ক্লাস নিয়ে স্টাফরুমে ফিরছিল। সিঁড়িতে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কেন!
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার ঢোঁক গিলে বললেন, কাকে টাকাটা দেওয়া হবে?
কেন আমাকে। আমি তার স্ত্রী, নিশ্চয় নমিনি করা আছে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার টেলিফোনের ওপাশে মনে হল সামান্য হাসলেন। বললেন, সবই ঠিক আছে, কিন্তু যে মানুষটা মারাই যাননি তার নমিনির হাতে টাকাপয়সা কীভাবে দেওয়া হবে! কেউ দেবেও না।
যামিনী মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে অসহায় গলায় বলল, তা হলে কী হবে?
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার চিন্তিত গলায় বললেন, অপেক্ষা করা ছাড়া তো কোনও পথ দেখছি না।
কতদিন!
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার চুপ করে রইলেন। যামিনী রুক্ষ গলায় বলল, কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? ও না ফেরা পর্যন্ত?
যতদিন না অফিশিয়ালি একটা কিছু…।
কী একটা কিছু? আমি তো আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না!
ক্লাস টেনের কটা মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল। যামিনী মিসের চাপা অথচ উত্তেজিত গলা তাদের কানে যায়। তারা দ্রুত সরে দাঁড়ায়। স্বামী বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মিসের হাবভাব বদলে গেছে। ভয় করে। যামিনী হাতের ইশারায় তাদের উঠে যেতে বলে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার বললেন, বিষয়টা এখন থানা পুলিশের হাতে। মিসিং কেস চলছে। গোটাটাই লিগাল প্রসিডিওরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, একটা অফিশিয়াল ডিক্লারেশন ছাড়া কিছুই করা যাবে না। আমরা মুভ করতে পারব না।
কীসের ডিক্লারেশন?
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার সম্ভবত বুঝলেন, এবার স্পষ্ট করে বলা দরকার। তিনি তাই করলেন।
দেবনাথবাবু বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সে বিষয় পুলিশকে জানাতে হবে। যদি ওরা বলে, বেঁচে আছেন তা হলে তো আপনাকে টাকা দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। যতই নমিনি থাকুক তাঁর অনুমতি ছাড়া টাকা উঠবে কী করে?