সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরী ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো?
যামিনী অস্বস্তি নিয়ে বলল, মানে কোনওরকম হিন্ট? আসলে পুলিশ আমাকে বলছে, অনেকসময় কেউ কোনও মেজর সিদ্ধান্ত নিলে আগে থেকে কাউকে না কাউকে জানিয়ে দেয়। হয়তো বাড়িতে বলতে পারেনি, কলিগদের কাউকে বলেছিল…।
সোমপ্রকাশ অবাক হলেন। বললেন, পুলিশ কি ভাবছে দেবনাথবাবু নিজেই কোথাও চলে গেছেন? স্ট্রেঞ্জ! তা কেন হবে?
যামিনী পাশে বসা ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, না না সেরকম কিছু নয়। তবে পুলিশকে সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে হয়।
জেনারেল ম্যানেজারের চোখ মুখ থেকে অবাক হওয়ার ভাবটা গেল না। তিনি বেল। টিপলেন।
তপনবাবুকে ডাকছি। উনি মিস্টার চ্যাটার্জির ঠিক পাশের টেবিলে বসেন।
মা ছেলে সেদিন বেশ খানিকটা সময় দেবনাথের অফিসে কাটিয়েছিল। প্রায় এক ঘণ্টার ওপর। কাজের কাজ কিছু হয়নি। দেবনাথের কোনও কলিগই এমন কোনও কথা বলতে পারেনি যা থেকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়। বরং দু-একজন জানাল, মানুষটা সেদিনও একই রকম হাসিখুশি ছিল। রোজকার মতো মজার মজার কথাও বলেছে। তপনবাবু মনে করে একটা বলতেই পারলেন।
সেকেন্ড হাফে কম্পিউটারে কী একটা সমস্যা হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়র এসে বলল, মনে হচ্ছে ভাইরাস। ক্লিন করতে হবে। দেবনাথ বললেন, ভাই, তাহলে একইসঙ্গে আমাদেরও ক্লিন করে দিয়ে যাবেন। আমরা সকলেই ভাইরাস-আক্রান্ত। কী বোর্ডে একরকম কমান্ড পাঠাচ্ছি কাজ করছে অন্যরকম। এ টিপলে স্ক্রিনে জেড পড়ছে। শুরু করতে গিয়ে শেষ করে বসছি।
ক্যান্টিনের দিব্যেন্দুকেও ডেকে আনা হল। তপনবাবু বললেন, খোঁজ-খবর যখন হচ্ছে, ভালো করেই হোক। টিফিনের সময় চ্যাটার্জিদা তো ক্যান্টিনেই ছিলেন।
দিব্যেন্দু কাঁচুমাচু মুখে জানাল, কই অন্যরকম তো কিছু মনে পড়ছে না! রোজকার মতোই তো অমলেট-টোস্ট খেলেন। পরপর দুকাপ চা।
তপনবাবু ঘাড়টা একটু কাত করে বললেন, কোনও কথা বলেছিলেন?
কী কথা?
এই ধর, কটা দিন থাকব না বা ভালো থাকিস ধরনের কিছু?
দিব্যেন্দু মনে করার চেষ্টা করে। বলে, কই না তো! বরং একশো টাকার একটা নোট দিয়েছিলেন স্যার। তখন আমার কাছে ভাঙানি ছিল না। বললেন, ঠিক আছে রেখে দাও। আমি টাকাটা ম্যাডামের হাতে ফেরত দিই?
যামিনী চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না সামলেছিল। বলেছিল, না থাক, উনি এলেই ফেরত দিও।
চলে যাওয়ার সময় সবাই বলেছিল, আবার আসবেন। দরকার হলে ফোন করবেন।
সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরি নিজে লিফট পর্যন্ত এলেন। ট্রেনে উঠে নীলাদ্রি মাকে বলেছিল, আমি আর কখনও বাবার অফিসে আসব না।
যামিনী অবাক হয়ে বলল, কেন? মানুষগুলো তো ভালো। কত যত্ন করল।
নীলাদ্রি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, সেইজন্যই আসব না। এত যত্ন আমার ভালো লাগছে না। তুমি কিঙ্কিকে নিয়ে এসো।
সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা নীলাদ্রির গলায় অভিমান।
যামিনী ছেলের গায়ে হাত রেখে বলল, কী করব বল? আমি তো আর বলতে পারি না, আপনারা এত যত্ন করবেন না।
বলতে হয়নি। দেবনাথের অফিসের যত্ন কমে গেল নিজে থেকেই। নীলাদ্রি বা কিঙ্কিনি আসেনি, কিন্তু যামিনীকে তারপরও বহুবার আসতে হয়েছে। টাকা-পয়সার জন্য আসতে হয়েছে। তিনমাসের মধ্যে দেবনাথের মাইনে বন্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে নো পে। নির্ধারিত পাওনা ছুটির পরও বেশ কিছুদিন অনুমোদন করেছিল অফিস, তারপর আর পারেনি। একসময় স্বামী নিখোঁজ হওয়ার শোক ছাপিয়ে টাকাপয়সার অভাব মাথা চাড়া দিল। দেবনাথের মাইনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না যামিনী। তাকে কেউ সতর্কও করেনি। হয়তো তারাও ঠিক জানত না। জানবেই বা কী করে? একজন চাকরি করা মানুষ মারা গেলে কী হয় কম-বেশি সকলেরই জানা আছে। কিন্তু হারিয়ে গেলে? দেবনাথের অফিসের ডিপার্টমেন্টাল হেড, ক্যাশিয়ার, অ্যাকাউন্টস ম্যানেজারের কাছে ছোটাছুটি করেও কোনও সুরাহা করতে পারল না যামিনী। সকলে নানান পরামর্শ দিল। সবটাই অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে পুলিশের ডায়েরির কপি, তিনমাসের ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জমা দেওয়া হল। প্রথম প্রথম সঙ্গে দেবনাথের। কলিগরা অনেকেই থাকত। দোতলা, তিনতলা, চারতলা করত। এই ডিপার্টমেন্ট, সেই ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেত যামিনীকে। ক্যান্টিনে বসে চা খাওয়াত। এগিয়ে গিয়ে হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার বাসে তুলে দিত। ক্রমশ সেই সংখ্যা কমতে লাগল। তপনবাবুর মতো একেবারে দেবনাথের পাশে বসা দু-একজনে এসে ঠেকল। তা-ও বন্ধ হল একসময়। সকলের কাজ আছে। তা ছাড়া নিষ্ফলা ছোটাছুটিতে লাভ কী? বরং যামিনীর মুখোমুখি হলে লজ্জা করছে। কী বলবে? সবাই হাল। ছাড়লেও যামিনীর পক্ষে হাল ছাড়া সম্ভব ছিল না। তার টাকা লাগবে। তাকে সংসার চালাতে হবে। ভাই আমেরিকা থেকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিল, নিতে রাজি হয়নি যামিনী। কেন সাহায্য নেবে? স্বামী হারিয়ে গেছে বলে কারও কাছেই হাত পাতা অসম্ভব। নিজের ভাইয়ের কাছেও নয়।
যামিনী আবার একদিন দেখা করল সুপ্রকাশ রায়চৌধুরির সঙ্গে। এবার একঘণ্টার ওপর অপেক্ষা করতে হল। জরুরি কোনও মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা নয়, লাঞ্চের পর উনি একটু বিশ্রাম নেন। তবে মানুষটা ব্যবহার করলেন আগের মতোই সুন্দর। গলায় সেই সহানুভূতি, আন্তরিকতা। অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিলেন। কিন্তু যা বললেন, তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যামিনীর।